এক বরষায় পর্ব-২১+২২

0
572

#এক_বরষায় [২১]
#লেখনীতে_জেরিন_আক্তার_নিপা

______________
জেসমিন দাদীকে নিয়ে বাড়ি এসে দেখল ধারা কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। বৃষ্টি এখনও থামেনি। এই বৃষ্টি থামার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। শেষে বৃষ্টি থামছে না দেখে নয়ন ভাইদের বাড়ি থেকে ছাতা নিয়ে চলে এসেছে। একটা ছাতা ওরা মানুষ তিনজন। দাদীকে মাঝে দিয়ে দুই পাশে জেসমিন আর আতিফ ভিজে ভিজেই এসেছে বলা যায়। বাড়ি আসতে আসতে ওরা চুপচুপে ভেজা। আতিফ নিজের ঘরে চলে গেছে। জেসমিন ছাতাটা বারান্দায় রেখে দাদীকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এসেছে। ধারাকে শুয়ে থাকতে দেখে ডাকল।

-অ্যাই আপু, ঘুমিয়ে গেলে নাকি?”

দাদী ধারার পায়ের কাছে বিছানায় বসেছে। জেসমিন ভেজা কাপড় ঝাড়ছে। ধারাকে আবার ডাকতে গেলে দাদী বলল,

-আগে তুই কাপড় পাল্টা। ঘর ভিজাইয়া ফেলতাছোস।”

-হুম কিন্তু তোমার নাতির আবার কী হয়েছে? এই সন্ধ্যারাতে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে কেন?”

-ঘুমাইয়া পড়ছে হয়তো। ডাকিস না।”

জেসমিন কাপড় পাল্টে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে ধারার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁথার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বোনকে দেখছে সে।

-তোমার নাতনি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে এমনটা কখনও হয়! ও নিশ্চয় জেগে আছে।”

ধারা সত্যি সত্যিই জেগে আছে। আজ রাত্রে তার ঘুম আসবে না। চোখের পাতা এক করলেই তো একটু আগের সবকিছু জলছবির মতো চোখের পর্দায় ভেঙে উঠছে। কে জানে কয় রাত তাকে না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে! ধারা এখনও সবটাকে তার কল্পনাই ভাবছে। এখন জেসমিনের ডাকে সাড়া দিয়ে তার ভেতর বয়ে চলা ঝড়ের আভাস দিতে রাজি না। এই মেয়ে এক মুহূর্তে তার মনের অবস্থা ধরে ফেলবে।
জেসমিন বিরক্ত গলায় এখনও বলে যাচ্ছে,

-মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। দূর একটু আলাপও করতে পারলাম না।”

-এহন আর আলাপ করা লাগত না। তুইও ঘুমা।”

জেসমিন বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল,

-রোজী আপা কত কেঁদেছে দেখেছ?”

-হ। বাপের ঘর ছাইড়া যাইতে সব মাইয়ারাই কাঁদে।”

জেসমিন কিছু একটা ভেবে মন খারাপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-আপুর বিয়ে হয়ে গেলে আপুও তো আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে দাদী।”

-তা তো যাইবোই। তুইও তো যাইবি।”

জেসমিন দাদীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে বলল,

-না দাদী। আমি শ্বশুরবাড়ি যাব না। ঘরজামাই আনব। সবাই চলে গেলে তোমাকে বাবাকে দেখবে কে?”

ধারা বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস চাপল। তার জীবনে এই দিনটা কোনদিনও না আসুক। বিয়ে, ভালোবাসা এসবে বিশ্বাস তার অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। ছোটবেলার সেই তিক্ত স্মৃতি তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় একটা মানুষ কখনও কাউকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে না। কোন ভালোবাসাই চিরস্থায়ী হয় না। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাও একটা সময় শেষ হয়ে যেতে পারে। যেমন তার বাবা মা’র হয়েছিল। মা সন্তানের ভালোবাসাও নিঃস্বার্থ না। যদি হতো তাহলে তার মা তাদের দুই বোনকে ফেলে রেখে যেতে পারতো না। আসলে ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু হয়-ই না। মানুষ ভালোবাসা নামে যা বিশ্বাস করে তা আসলে মোহ। এই মোহ কেটে গেলে ভালোবাসা শব্দটাও ঘৃণা, অমর্যাদা, অসম্মানে পরিণত হয়। ধারার জীবনে ভালোবাসার মতো তুচ্ছ শব্দের কোন জায়গা নেই। সে কাউকে ভালোবাসে না। আর কেউ তাকে ভালোবাসুক এটাও চায় না।
******

রাগে হোক, জেলাসিতে হোক এতদিনের চেপে রাখা আবেগ অনুভূতি গুলো আজ সব ধারার কাছে প্রকাশ পেয়ে গেছে। তখন তো খুব বীরত্ব দেখিয়ে ধারার সামনে কথাগুলো বলে দিল। এখন তার নিজের মাথা দেয়ালে বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কাল সকালেই তাকে এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। না চাইলেও তাকে চলে যেতে হবে। ধারাকে আর দিনের পুরোটা সময় চোখের সামনে পাবে না ও। মুনতাসীর ঘরময় পায়চারি করতে করতে দু-হাতে চুল টেনে ধরে নিজের উপরই বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

-কেন বলতে গেলাম? কেন ধারাকে নয়নের সাথে দেখে আমার এরকম হয়! আমি নিজেও তো জানি ধারা নয়নকে ভালোবাসে না। কখনও বাসবে এই চান্সও নেই। তার পরেও নয়ন ওর আশেপাশে থাকলে আমার কেন সহ্য হয় না। ভালো হয়েছে, এখন শুধু এই বাড়িতে কেন এই পাড়াতে থাকারও কোন অবকাশ থাকবে না।”

মুনতাসীর পায়চারি বন্ধ করে হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। পুরো ঘরটা দেখছে সে। এটা ধারার ঘর। এই ঘরের প্রতিটা জিনিসে ধারার ছোঁয়া অনুভব করতে পারে সে। মনে হয় ধারা তার আশেপাশে আছে। তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখন? ধারা যদি তার বাবাকে সবকিছু বলে দেয় তাহলেই তো তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। মুনতাসীর আর কিছু ভাবতে পারল না। চার হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল, ধারা এখন কী করছে? তাকে নিয়ে কী ভাবছে? এই কয়টা দিনে ধারাকে যতটা দেখেছে তাতে মনে হয় না ধারা আর কখনও তার সামনে আসবে।

-আমি আমার আগের ধারাকে ফেরত চাই। যার সব আবদার, সব শখ তার মুনতাসীর ভাইয়ের নিকট ছিল।”

ধারা বারবার এপাশ ওপাশ ফিরে শুয়েও ঘুমাতে পারছে না। তার চোখের সব ঘুম আজ কোথায় পালালো! ছটফট করতে করতে উঠে বসল ধারা। দাদী, জেসমিন ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদীর ক্ষীণ নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ধারা অন্ধকার ঘরে বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে চলে এলো। জানালার কপাট খুলে দিল। বৃষ্টি থামার পরে প্রকৃতি এখন নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে এক ঝাপটা বাতাস এসে হুড়হুড় করে ঘরে এসে ঢুকতে। ধারার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। আকাশের চাঁদটা আজ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ধারা অন্যমনস্ক হয়ে মেঘে ঢাকা চাঁদহীন আকাশটা দিকে দৃষ্টি মেলে নিঃশব্দে উচ্চারণ করল,

-তুমি আমার জীবনে কেন ফিরে এলে মুনতাসীর ভাই? আবার কেন সেই অতীতের সামনে আমাকে দাঁড় করালে? সবকিছু ভুলে আমি তো ভালোই ছিলাম। তুমি কেন আবার সব উলটপালট করে দিতে চাইছো?”
*********

ধারা প্রতিদিন ফজর ওয়াক্তে উঠলেও আজ বেলা হবার পরও তার ঘুম ভাঙছে না। দাদী সকালের রান্না করছে দেখে জেসমিন বোনকে ডাকতে এলো। রান্না না হলে তার কলেজে যেতে দেরি হয়ে যাবে।

-এইযে নবাবজাদী, প্রতিদিন তো আমাকে বলতা। এখন নিজেই বারোটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ। আপু, এই আপু। ওঠ বলছি।”

অনেক ডাকাডাকির পরেও ধারা সাড়াশব্দ না করলে জেসমিন ওর উপর থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে টের পেল, ধারার গা জ্বরে পুড়ে না। জ্বরে অচেতন হয়ে আছে। তাই তো এত ডাকার পরেও সাড়া দিচ্ছে না। জেসমিন তাড়াতাড়ি দাদীকে বলতে গেল। নিজেই একটা বাটিতে করে পানি এনে বোনের কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। ধারার হঠাৎ এমন জ্বরে জেসমিন ভয় পেয়ে গেছে। আপুকে সচারাচর অসুস্থ হতে দেখে না সে। আর অসুস্থ হলেও আপু কাউকে জানায় না।

-কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ এত জ্বর এলো কেন! নয়ন ভাইদের বাড়ি থেকে আসার সময় কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছে নাকি? কে জানে?”

জেসমিনের দিনটাই কাটে বোনের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি করে, ঝগড়া করে। এই ঝগড়ার মাঝেও ভালোবাসা আছে।
বোনের অসুস্থতায় সবচেয়ে বেশি অস্থির সে-ই হচ্ছে।
কলেজের সময় হয়ে গেলেও জেসমিন না বেরুলে মুনতাসীর ওকে ডাকল। মুনতাসীর কোনোভাবেই ধারার সামনে পড়তে চাচ্ছিল না। রাতের ঘটনার পর এখন ধারার সামনে পড়া সবচেয়ে অস্বস্তিকর সময় হবে। জেসমিন মুনতাসীরের ডাকে এসে বলে গেল,

-আজ আমি কলেজে যাব না মুনতাসীর ভাই।”

-কেন? এখনও কি বিয়ে খাওয়া শেষ হয়নি? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো।”

-আপু অসুস্থ। প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। আজ আমি যাব না।”

মুনতাসীরের বুকটা মুচড় দিয়ে উঠল। ধারার জ্বর আর এক বাড়িতে থেকেও সে এটা জানে না! কাল রাতে বৃষ্টিতে ভেজার কারণেই কি জ্বর এসেছে? মুনতাসীরও সকাল থেকে হাঁচি দিচ্ছে। ধারাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সম্ভব না। জেসমিনের জ্বর হলেও সে নির্দ্বিধায় ও ঘরে দেখতে চলে যেতে পারত। কিন্তু ধারার বেলায় এটা অশোভনীয় হয়ে যাবে। ধারার সাথে তার সম্পর্ক কেমন এটা তো সবারই জানা। মুনতাসীর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে মাথা নেড়ে ছোট্ট করে বলল,

-আচ্ছা।”
*******

পরের দিন রোজী আপা বাপের বাড়ি এলেও ধারা ওকে দেখতে যায়নি বলে ধারার উপর পাহাড় সমান অভিমান করে বসে রইল। এদিকে ধারা জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। জেসমিনের সেবাযত্ন পেয়ে ধারার হুঁশ ফিরেছে। বোনকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই জেসমিন উৎকন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করল,

-এখন কেমন লাগছে?”

ধারার মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে। সে মাথার পাশে জেসমিনকে দেখে দুর্বল কন্ঠে বলল,

-ভালো।”

-ভালো হবে না আবার! কে সেবা করছে দেখতে হবে না।”

-তুই কলেজে যাসনি?”

-যেতে পারতাম। কিন্তু আমি এতটাও নির্দয় না। তাই তোমার সেবা করতে রয়ে গেলাম।”

-দাদী কই?”

-আছে। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি। খেয়ে ঔষধ খাবে। জ্বর কমে গেলেই ভালো লাগবে।”

-কে রান্না করেছে?”

জেসমিন রাগী চোখে বোনকে দেখল। এই অসুস্থতার মাঝেও কে রান্না করেছে এই চিন্তা করছে। নিজেকে নিয়ে যদি একটু ভাবতো তাহলে এখন কষ্ট পেতে হতো না।
******

বিভিন্ন ঝামেলায় নয়ন সারাটা দিন বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। ধারাটা কেমন মানুষ! কাল যে গেল আজ একবারও আসতে পারলো না! কালও তাকে না বলেই চলে গেছে। আপা সাথে করে শ্বশুরবাড়ির কতগুলো আত্মীয় নিয়ে এসেছে। এরা ওর মাথা খাচ্ছে। আপার ভাসুরের বাচ্চা গুলো মহা বিচ্ছু। নয়নের পছন্দ না তার ঘরে কেউ যায়। কিন্তু এরা ঘরে তো যাচ্ছেই গিয়ে সব জিনিস নিয়ে খেলা করছে। নয়ন না পারছে ধমক দিয়ে ঘর থেকে তাড়াতে, না পারছে সহ্য করতে। এসব কিচিরমিচির তার আর সহ্য হচ্ছিল না। নয়ন ঘর থেকে বের হয়েই একজনের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে সামলে নিল। সামনে তাকিয়ে দেখল আপার ননদ এটা। মিথিলা মিষ্টি করে হেসে বলল,

-কোথাও যাচ্ছিলেন?”

-হুম। একটু কাজ আছে।”

-ওহ। আমার ফোনটা কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না বিয়াই। আপনার ফোন থেকে আমার নাম্বারে যদি একটু কল দিতেন।”

-নাম্বার বলেন।”

-দিন আমি তুলে দিচ্ছি।”

মিথিলা নিজেই নয়নের ফোন থেকে তার ফোনে কল করল। কোথাও রিংটোন হচ্ছে। খুঁজে দেখল, ফুপুর ফোনে তার বিচ্ছু ভাতিজা গেমস খেলছে। মিথিলা ছেলেটা একটা ধমক দিয়ে খেলতে পাঠিয়ে দিল। নয়নের দিকে ফিরে আগের থেকেও মিষ্টি হেসে বলল,

-ধন্যবাদ বিয়াই।”

নয়ন কিছু না বলে মাথা নাড়ল। নয়ন চলে গেলে মিথিলা হেসে ফেলে বলল,

-বিয়াই আমার এত গাধা কে জানতো! উঁহু, গাধা না। আসলে সহজসরল ভালো মানুষ।”

মিথিলা নয়নের নাম্বার বিয়াই নামে সেভ করে রহস্যময় হাসি দিল।
*****
ধারা ঘরে শুয়ে আছে। আধোঘুমে চোখ বুজে আছে। এখন জ্বর নেই। দাদী জেসমিন রোজী আপাদের বাড়িতে গেছে। তার এই শরীর নিয়ে রোজী আপাকে দেখতে যাওয়া সম্ভব না। এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে দু’বার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ধারা পলকে দরজার দিকে দেখল। এই ঘরে আসার আগে কে কড়া নাড়ব? জেসমিন, আতিফ এদের তো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে কি ধারা যার কথা ভাবছে সে এসেছে! ধারা দ্রুত চোখ বন্ধ করে নাকেমুখে কাঁথা টেনে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল।

চলবে_

#এক_বরষায় [২২]
জেরিন আক্তার নিপা

——————
মুনতাসীর দরজায় টোকা দিয়েও ভাবল ফিরে যাবে সে। এই ঘরে ঢোকা ঠিক হবে না। ধারা তার সম্পর্কে কী ভাবছে তা এখনও জানা হয়নি। এ’কয়দিনে মেয়েটাকে তো দেখেছে। বদমেজাজির জন্য অ্যাওয়ার্ড পাবে। মুনতাসীর ঠোঁট কামড়ে ভাবছে, ধারা অসুস্থ শুনেও ওকে একটা বার দেখতে না গেলে নিজের কাছেই যে মুখ দেখাতে পারবে না। সকালে শুনেছে ধারার জ্বর। কলেজ থেকে ফিরে পুরোটা সময় এই ঘরের দিলেই চোখ রেখেছে। ধারা যদি একটা বার ঘর থেকে বেরোয়। অন্তত দূর থেকে তো দেখতে পারবে। কিন্তু ধারা একবারও বাইরে যায়নি। তা দেখে মুনতাসীর আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। শেষে বাধ্য হয়ে নিজেই চলে এলো। জেসমিন দাদীকে নিয়ে কোথাও গেছে। এটাই সুযোগ। ওদের সামনে ধারাকে দেখতে আসতে পারতো না সে। মুনতাসীর মৃদু ভাবে আবারও দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসছে না। ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে অনুমতি না পেয়েও ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঘরে এসে দেখল বিছানায় কেউ একজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এটা যে ধারা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। মুনতাসীর সর্তক গলায় ডাকল,

-ধারা। ধারা!”

মনে মনে ভাবল ঘুমিয়ে আছে হয়তো। যাক এটাই ভালো হয়েছে। ধারার অগোচরে ওকে দেখে চলে যাবে। ওরা সামনাসামনি হলে দু’জনের কেউই সহজ হতে পারতো না। মুনতাসীর এক পা, এক পা করে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। এই মেয়ের জন্য তার মনে কত মায়া তা যদি মেয়েটা সামান্যও টের পেত! মুনতাসীর ঠিক করে উঠতে পারছে না সে কি ধারার মুখের উপর থেকে কাঁথাটা সরাবে? সরাতে গিয়ে যদি ধারা জেগে যায়! তখন? তখন ওকে সামনে দেখে নিশ্চয় চেঁচিয়ে উঠবে। একা ঘরে ওকে দেখে ভুলও বুঝতে পারে। ধারা তো আগের সেই সরল ধারা নেই। মুনতাসীর শব্দ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

-তুই যে কেন পাল্টে গেলি! শীতের সকালে ফোঁটা শিশির ভেজা শিউলি ফুলের মতো ছিলি তুই। যার ছোঁয়ায় শুভ্রতা ছড়াতো। যার সরলতায় মুগ্ধ হতে হতো। এখন তো কাঁটা যুক্ত গোলাপ হয়েছিল। ধরতে গেলেই কাঁটা ফুটিয়ে রক্ত বের করে দিস।”

ধারা চোখ মুখ খিঁচিয়ে পড়ে রইল। সে যে সবই শুনছে তা যদি মানুষটা জানতো! মুনতাসীর অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পরে ধারার মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দিল। এক দিনের জ্বরে মুখটা কেমন নেতিয়ে গেছে। দেখে বড্ড মায়া লাগছে। এই মুহূর্তে ওকে দেখে কেউ বলবে কত কঠিন ধাতুর মেয়ে এটা। মুনতাসীর পলকহীন চোখে ধারার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকটা সময় এভাবেই কাটল। মুনতাসীর সাবধানে একটা হাত ধারার কপালে রাখল। ওর গায়ের উষ্ণতা দেখছে ও। না জ্বর কমেছে। কপালে মানুষটার স্পর্শ পেয়ে ধারার হৃদপিণ্ডের গতি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। ধারার ভয় হচ্ছে তার বুকের ধুকপুকুনি মানুষটার কান পর্যন্ত না পৌঁছে যায়। কারণ তার মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে কেউ যেন ড্রাম পেটাচ্ছে। এই শব্দ যেকেউ শুনতে পাবে।

-এরকম বদমেজাজি হয়েছিস কেন? মাঝে মাঝে চড় দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে চড় দিয়ে সব রাগ বের করে দিই। শোন, আর কোনোদিনও যদি আমার সাথে ঘাড়ত্যাড়ামি করেছিস না, তাহলে সত্যি সত্যিই চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। তখন তোর বাবার কাছে বিচার দিস।”

মুনতাসীর কথাগুলো বলার সময় আনমনে হাসল। ধারার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। কত কথা জমে আছে তার। কিন্তু এই হৃদয়হীনা তার কোন কথা শুনতে চাইলে তো!

-বয়স তো মাত্র একুশ হয়েছে। এখনই দাদী দাদী ভাব করে থাকিস কেন? তোর কি হাসতে মানা? জেসমিন ঠিকই বলে তোর কপালে একটা টাকলা জামাই জুটলেই ভালো হবে। কিন্তু আফসোস আমার… ” বলতে বলতে থেমে গেল মুনতাসীর। নিজে নিজেই হেসে ফেলল। আজ কী হয়েছে তার? একটু আগেও ভয় ছিল ধারা জেগে গেলে সর্বনাশে কাণ্ড বেঁধে যাবে। কিন্তু এখন কোন ভয়ই কাজ করছে না। ধারাকে সে খুব সহজে কাবু করতে পারবে। ওর একটা ধমকই যথেষ্ট হবে।

-তোকে কিছু বলি না। কেন বলিনা জানিস? দেখছি তুই আমাকে কতদিন এড়িয়ে চলতে পারিস। সবকিছুরই তো একটা শেষ থাকে। তোর অবহেলাও একদিন শেষ হবে নিশ্চয়। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা ধারা। আবার আমার আগের ধারা হয়ে যা। গম্ভীরতা তোর চেহারায় ভালো লাগে না। আমার প্রতি কঠোর আচরণ করে এতদিন ধরে আমাকে যে কষ্ট দিয়েছিস, তার জন্য ক্ষমা চা। আমি বড় মনের পরিচয় দিয়ে তোকে ক্ষমা করে দেব। যতোই হোক, তুই এখনও আমার সেই আদুরে বিড়াল ছানাই আছিস। তোর উপর আমার রাগ, অভিমান, কষ্ট, অভিযোগ কিছু নেই।”

দরজায় মুনতাসীরের চলে যাবার শব্দ হলে ধারা চোখ মেলে তাকাল। এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাস গ্রহণ করল। তার বুকের ভেতর এই মুহূর্তে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যেতে লাগল। এই ঝড়ের প্রস্ফুটন উষ্ণ অশ্রু হয়ে চোখের কোন গড়িয়ে ঝরে পড়ছে। ধারা ওঠার চেষ্টা করল না। একই ভাবে স্থির দৃষ্টিতে সিলিঙের দিকে চেয়ে পড়ে রইল।
******

ধারার না আসার কারণ ওর গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। বেচারি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছে শুনে সবার আগে নয়নই অনুতপ্ত হলো। সে ভাবছিল ধারা হয়তো ইচ্ছে করেই আসেনি। কিন্তু ওর যে জ্বর তা নয়ন খোঁজ নেয়নি। রোজী আপা চিন্তিত গলায় জানতে চাইল,

-কীভাবে জ্বর এলো?”

জেসমিন উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিল,

-নিজের খেয়াল না রাখলে জ্বর কেন আরও কত রোগব্যাধি হবে।”

নয়ন পারলে এখনই ধারাকে দেখার জন্য ছুট দেয়। কিন্তু ভীষণ জরুরি কোন দরকার ছাড়া ধারাদের বাড়িতে যাবার অনুমতি তার নেই। এই নিষেধাজ্ঞা ধারাই দিয়েছে। মিথিলাও ওদের আলোচনার মাঝে ছিল। ধারাকে নিয়ে নয়নের ব্যগ্রতা সকলের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও মিথিলা অতিথি হিসেবে এই জিনিসটা তার চোখে নতুন। ধারা মেয়েটা কে সে চিনে না। কিন্তু ধারার অসুস্থতার খবর শুনেই নয়ন যেভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে এটা দেখে কেনই যেন মিথিলা মনে মনে কষ্ট পেল। অথচ তার কষ্ট পাওয়ার কোন কারণ নেই। চিন্তিত নয়ন জেসমিনকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-ধারা এখন কেমন?”

_ভালোই।”

-ভালোই কী কথা! এমন দায়সারা জবাব দিচ্ছিস কেন? বোনের চিন্তা নেই তোর!”

-চিন্তা আছে কিন্তু তোমার মতো,,’ জেসমিন ঠিকঠাক শব্দটা মেলাতে পারছে না। ভাবনায় পড়ে গিয়ে জেসমিন বলল,

-চিন্তা শব্দটাকে আরও সিরিয়াস বুঝাতে কোন শব্দ ব্যবহার করতে হবে? দুশ্চিন্তা! জানি না। ওই একটা হলেই হলো। বোনের চিন্তা আমার আছে। কিন্তু তোমার মতো মাত্রার বাইরে না।”

-তুই যে একটা হারামি।”

-আর তুমি একটা প্রেমিক পুরুষ। যাও প্রেমিকা, না দুঃখিত। আমার বোন তো তোমার প্রেমিকা না। যাও, অনেক চেষ্টার পরেও না পটাতে পারা প্রেমিকাকে ফলমূল নিয়ে দেখতে যাও। অসুস্থ অবস্থায় ফলফলাদি কাজে দিবে।”

-তোর সাথে কথা বলাই বেকার। কোন ঠেকায় যে তোর মতো বান্দরনীর সাথে কথা বলতে হয়।”

নয়ন রেগেমেগে চলে গেল। এতক্ষণ মিথিলার সমস্ত ধ্যান ওদের দু’জনের উপরে ছিল। জেসমিন ঘুরে দাঁড়ালে মিথিলার চোখাচোখি হয়ে গেল। দাঁত না বের করে হাসল জেসমিন। মিথিলা হাসল না। জেসমিন ভুরু কুঁচকে বলল,

-এই নারী আবার আমাকে ব্যথিত লুক দেয় কেন? এর সাথে তো আমি কিছু করি নাই।”

নয়ন ওদেরকে বাড়িতে রেখে তখনই বেরিয়ে গেল। জেসমিন রোজী আপার শাড়ি, গয়নাগাটি দেখছে। বিয়ের দিন এত মানুষের ভিড়ে কিছুই দেখা হয়নি।
শাড়ি গুলো দেখে জেসমিন মুগ্ধ হচ্ছে। সেই মুগ্ধতা তার চোখে, গলায় ধরা পড়ছে।

-শাড়ি গুলো কী সুন্দর! দুলাভাই বিদেশ থেকে এনেছে বুঝি?”

-না। আমাদের দেশেরই জিনিস।”

-কত সুন্দর!”

-তোর পছন্দ হয়েছে?”

-হুম।”

রোজী জেসমিনের হাতে ধরা শাড়ির দিকে ইশারা করে বলল,

-তাহলে এটা তুই নিয়ে যা। আমি তোকে দিলাম।”

জেসমিন হেসে ফেলে বলল,

-দূর!”

রোজী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-দূর কেন?”

জেসমিন এবার আরও বেশি হাসতে লাগল। খিলখিল করে হাসছে সে। রোজী ওর হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বোকা হয়ে চেয়ে রয়েছে। একা একাই অনেকটা সময় হেসে জেসমিন থামল। রোজী এবার কারণ জানতে চাইলে আবারও হাসতে লাগল। বিরক্ত হয়ে রোজী বলল,

-পাগলের মতো হাসছিস কেন? এত হাসার মতো আমি কোন কথাটা বলেছি!”

জেসমিন পাল্টা প্রশ্ন করল,

-বলোনি?”

-না।”

-বলেছ।”

-কী বলেছি তুই-ই বল তাহলে। আমিও শুনে একটু হাসি।”

জেসমিন হাসি না থামিয়েই বলল,

-তোমার শাড়ি গুলো আমার ভালো লেগেছে জেনে তুমি ওগুলো আমাকে দিয়ে দিচ্ছে চাচ্ছ৷ এখন যদি আমি বলি তোমার বরকেও আমার ভালো লেগেছে। তাহলে কি তুমি দুলাভাইকেও আমাকে দিয়ে দিবে? নিজের জিনিস এত সহজে অন্যকে দিয়ে দিতে চাও কেন? শাড়ি হোক বা বর। দু’টাই তোমার। আমাকে বা অন্য কাউকে কেন দিবে? কেউ চাইলেও দিবে না। কারো ভালো লাগলেও দিবে না বুঝেছ। তোমার জিনিস শুধুই তোমার।”

রোজী মেয়েটার পাগলামি দেখে মৃদু হাসল। জেসমিন বাচাল, ঠোঁটকাটা হলেও ওর মাথায় যথেষ্ট জ্ঞান আছে। মেয়েটা যতটা উড়নচণ্ডী দেখায় সে আসলে ততটাও না। জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই বুঝে।
******

নয়ন ধারার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই আজ ধারাদের বাড়ি চলে এলো। গেট খোলাই ছিল। ভেতরে গিয়ে নয়ন কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। যাতে ধারা বুঝতে পারে নয়ন এসেছে। কোন রকমের অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে না পড়ে যায়। মুনতাসীর ঘর থেকেই জানালা দিয়ে দেখল নয়ন এসেছে। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছিল ধারা জ্বর শরীরে নয়নের সাথে দেখা করার জন্য ঘর থেকে বেরুবে না। কিন্তু তার ভাবনা ধারা ভুল করে দিয়ে একটু পরেই বারান্দায় বেরিয়ে এলো। নয়নকে দেখে তেজ হীন গলায় বলল,

-আপনি কী দরকারে এসেছেন নয়ন ভাই?”

নয়ন লজ্জিত হাসল৷ মাথা চুলকিয়ে বলল,

-কোন দরকার না। শুনলাম তোর জ্বর। তাই দেখতে এলাম।”

ধারা নয়নের দু’হাতের দিকে দেখল। এই প্রথম সে নয়নের সাথে রসিকতা করে বলল,

-খালি হাতে রোগী দেখতে এসেছেন নয়ন ভাই!”

নয়ন এবার আরও লজ্জা পেল। জেসমিন ফল নিয়ে আসার কথা বলেছিল। সে তাড়াহুড়ো করে বাজারে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে।

-আমি আবার গিয়ে ফল নিয়ে আসি?”

ধারা ফ্যাকাসে ঠোঁটে হেসে ফেলল। নয়ন ভাইকে খোঁচাতে ভালোই লাগে। বেচারার সাদা মনে কোন কাদা নেই।

-মজা করছিলাম নয়ন ভাই।”

নয়নের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ কি সে কোন নতুন ধারাকে দেখছে! ধারা তার সাথে রসিকতা করছে! আগে তো কখনও করেনি।
ধারা আড়চোখে একবার মানুষটার ঘরের দিকে তাকাল। এদিকে মুনতাসীর ঘরে বসে চুলায় বসানো তাওয়ার মতো গরম হচ্ছে। এমন না যে ধারা নয়নকে পছন্দ করে। তবুও কেন এসব করে ছেলেটার মনে আশা জাগাচ্ছে? ভালো না বাসলে স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দেওয়াই কি ভালো না?

মিথিলা জেগেই ছিল। নয়নের বাড়ি ফেরার শব্দ পেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উঠুন জুড়ে পায়চারি করতে লাগল। নয়ন গেট লাগিয়ে এসে মিথিলাকে এত রাতে একা হাঁটতে দেখে কিছুটা অবাক হয়েই বলল,

-আপনি ঘুমাননি? একা একা বাইরে কী করছেন?”

-ঘুম আসছিল না। যেহেতু সঙ্গ দেবার কেউ নেই তাই একাই হাঁটছিলাম।”

-ওহ।”

-আপনি কি প্রতিদিনই এমন রাত করে ফিরেন?”

-হু।”

-এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী করেন?”

-কিছু না। এমনি আড্ডা দিই।”

-জানেন আমারও না শখ একদিন পুরো একটা রাত বাইরে কাটাব। নির্জন রাস্তায় হাঁটব। খোলা একটা মাঠে বসে জোছনা বিলাস করব। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে আমার এই স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই রয়ে গেল। আপনাদের কত মজা! যা খুশি তা-ই করতে পারেন। কোন বাধা, ভয় নেই।”

নয়ন লক্ষ করল মেয়েটার চেহারায় কেমন বিষন্নতা ছেয়ে আছে। কন্ঠেও কেমন কাতরতা। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া টগড়া হয়েছে নাকি? যা-ই হোক, নয়ন ছোট্ট করে বলল,

-দোয়া করি আপনার এই সুন্দর স্বপ্নটা, আপনার প্রিয় কোন মানুষের সাথে পূর্ণ হোক।”

চলবে