এক বরষায় পর্ব-২৫+২৬

0
539

#এক_বরষায় [২৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

____________
জেসমিন আজ একা পড়তে এসেছে। আতিফ বাড়ি গেছে। ওর মা অসুস্থ। এখানে থাকতে তো জেসমিন আতিইফ্যাটাকে কত বকেছে, মেরেছেও পর্যন্ত। এখন গাধাটা নেই কেমন যেন খালি খালি লাগছে। যে কারণে আজ জেসমিনের পড়তেও ভালো লাগছে না। বইপত্র বের করলেও ওর মন অন্য কোথাও। বিকেলে আবার মুনতাসীর ভাই আর আপুকে একসাথে দেখেছে। ওই কথাটাই মনের মধ্যে কাঁটার মতো খোঁচাচ্ছে। যতক্ষণ জানতে না পারবে ওদের মধ্যে কী চলছে ততক্ষণ আর অন্য কিছুতে মন লাগাতে পারবে না। মুনতাসীরও আজ অন্যমনস্ক। তাই জেসমিনের উপর তেমন কড়া নজর দিতে পারছে না। জেসমিন ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল,

-মুনতাসীর ভাই, আমার আপুকে আপনার কেমন লাগে?”

ওর হঠাৎ এই প্রশ্নে মুনতাসীরের উপর বাজ পড়ার মতো প্রতিক্রিয়া হলো। এই মেয়ে বলে কী এসব! জেসমিন কি কোনোকিছু আন্দাজ করেছে? এই মেয়ে বোনের মতো গবেট না। জেসমিন দরকারের চেয়ে একটু বেশিই চালাক। সেটাই তো ভয়ের। নিজের বিস্ময়কে লোকাবার যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে মুনতাসীর বলল,

-তোমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না।”

জেসমিন মুখ বাঁকাল। মনে মনে বলল, আহ ন্যাকা! কিছু বুঝে না, শিশু। এই প্রশ্ন না বোঝার মতো অবুঝ তো আপনি না। তাহলে কেন না বোঝার ভান করছেন বলুন তো। কিন্তু সে মুখে বলল,

-মানে আপুকে আপনার কীরকম মনে হয়?”

-কোন অর্থে উত্তর দিলে উত্তরটা তোমার পছন্দ হবে?”

-যেকোনো অর্থে। মানে একটা মানুষকে ভালো, খারাপ মনে হতে পারে না! ব্যাপারটা তেমনই।”

ধারাকে নিয়ে যেকোনো প্রশ্নের উত্তরে তাকে এক সেকেন্ডও ভাবতে হবে না। সব প্রশ্নের উত্তরই তার কাছে আছে। কিন্তু জেসমিনের সামনে চট করে উত্তর দেওয়ার মতো ভুল করলো না। খানিকটা সময় নিল। যেন ভাবনা চিন্তা করে উত্তর দিচ্ছে এমন ভাব করে বলল,

-সেই অর্থে বলতে গেলে তোমার আপু ভীষণ রাগী।”

-সেটা তো সবাই জানে। আপনি নতুন কিছু বলুন।”

-ভীষণ জেদি। একরোখা ঘাড়ত্যাড়া টাইপ মানুষ আছে না কিছুটা ওরকম।”

-যা! বলতে বলেছি বলে সব খারাপ গুণ গুলোই বলবেন? আমার আপুর কিছু ভালো দিকও আছে।”

-তা আছে।”

-তাহলে সেগুলো না বলে শুধু খারাপ গুলোই বলছেন কেন?”

মুনতাসীর হাসল। জেসমিন সত্যিই ছেলেমানুষ। পুরোটা সময় বোনের সাথে ঝগড়া করে। দুই বোনের কখনো বনিবনা হয় না। কিন্তু কারো মুখে বোনের বদনামও শুনতে পারে না।

-তোমার আপু মানুষটা শুধু বাইরে থেকেই রাগী। ভেতর থেকে আসলে ততটা রাগী না যতটা বোঝায়। ওর মনটা ভীষণ নরম। এমন মানুষ গুলো সবার মাঝে থেকেও নিজেকে একা করে রাখে।”

জেসমিন মুখ ফসকে বলেই ফেলতে যাচ্ছিল, আমার বোনের নরম মনের খবর তাহলে আপনিও জেনে গেছেন! এখন কী মনে ঢোকার পথ খুঁজছেন। কথাটা ঠোঁটের আগায় চলে এলেও শেষ পর্যন্ত আর বেরুতে দিল না। মনের কথা টুপ করে গিলে ফেলল। মুনতাসীর আরও কিছু বলছিল। জেসমিন সেসব কথা কানে নিল না৷ সে তার মনের চিন্তার ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে আপনার মনে এসব চলছে মুনতাসীর ভাই! মুনতাসীর যখন বুঝতে পারল সে বেশি কথাই বলে ফেলছে। তখন চুপ করে গেল। গল্প ছেড়ে পড়াশোনায় ফিরে এলো।

-গল্প শেষ। এবার পড়তে বসো। কোন বিষয় বুঝো না দেখে আমাকে বলো।”

পড়তে জেসমিনের একটুও ইচ্ছে করছে না। সে কতক্ষণ বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করল। তারপর মনের মধ্যে একটা শয়তানি বুদ্ধি উদয় হলে বলল,

-মুনতাসীর ভাই, আপুর বিয়ে নয়ন ভাইয়ের সাথে হলে কেমন হয়?”

-একটুও ভালো হয় না।”

মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেও ওই কথার জেরে আরও বলল,

-ভালো হয় যদি তুমি এখন উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়তে বসো।”

জেসমিন মনে মনে বিশ্ব জয় করা হাসি দিল। মুনতাসীর ভাই তাকে গাধা ভাবলেও সে তো আর গাধা না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যা জানার ছিল জেনে নিয়েছে। এখন আর কোন সন্দেহ নেই। তার দুলাভাই কেউ হলে মুনতাসীর ভাই-ই হবে। ভাই তো এখন থেকেই ডাকে। ভবিষ্যতে শুধু ভাইয়ের আগে দুলা লাগিয়ে নিবে। জেসমিন বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে মুখ টিপে হাসছে। মুনতাসীর ওকে দেখে মনে মনে বলল,

-এ তো ভালো জ্বালায় পড়ে গেলাম। এই মেয়েকে এত চালাক হতে কে বলেছিল!”

জেসমিন কিছুক্ষণ বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তারপর আবার একটা একটা করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। ওর যে আজ পড়ায় মন নেই এটা বুঝতে পেরে মুনতাসীর বলল,

-জেসমিন তোমার কি আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না?”

জেসমিন বই বন্ধ করে ওর দিকে ফিরে উদাস গলায় বলল,

-শুধু আজ কেন মুনতাসীর ভাই, আমার তো কোনো সময়ই পড়তে ইচ্ছে করে না। তবুও জোর করে পড়তে হয়।”

-ইচ্ছে না করলে আজ বরং উঠে যাও। কাল এসো।”

-না এখনই ফিরে গেলে আপু বকবে। তার থেকে ভালো একটু পড়ি, একটু আপনার সাথে গল্প করি।”

-একটু পড়া, একটু গল্প করা দু’টোই একসাথে কখনও হয় না।”

-খুব হয়। আমি যখন অনেকক্ষণ পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে যাই তখন একটু বিরতি নিয়ে গল্প করলে পড়ায় মনোযোগ আসে।”

এই মেয়েকে আর কোন কথা বলে দমাতে পারবে সে? পৃথিবীতে এমন কোন কথা আছে যার উত্তর এর কাছে নেই? সব কথার জবাবে তার একটা না একটা কিছু রেডি থাকবেই।
*****
রাত এগারোটা পনেরোতে একবার নয়নের ফোনে কার কল এলো। বেশি সময় না, মাত্র দু’সেকেণ্ড রিং হয়ে কেটে গেল। তারপর এভাবে পরপর কয়েকবার রিং হলো। ফোন ধরতে যাওয়ার আগেই কেটে যায়। নয়ন বিরক্তি দৃষ্টি নিয়ে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার এখন ভীষণ খারাপ খারাপ গালি দিতে ইচ্ছে করছে। এত রাতে কার শখ জেগেছে তাকে জ্বালানোর? নয়ন কল ব্যাক করল না। অপেক্ষা করে থাকল আর একবার রিং হবার সাথে সাথে ধরে ফেলবে। তখন দেখবে ব্যাটা বা বেটি যে-ই হোক, কথা না বলে যায় কোথায়। কিন্তু সে রাতে ওই নাম্বার থেকে আর কোন কল এলো না৷ নয়ন আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘুমোতে গেল। কেউ হয়তো রং নাম্বারে মজা করতে চাচ্ছে। এ নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে না।
*****

ধারা, জেসমিন, মুনতাসীর রিকশার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ধারা বরাবরের মতো ওদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন মুনতাসীরের সাথে কথা বলার ফাঁকে নিজের বোনকেও দেখছে৷ মুখ মুচড়ে ভাবছে, ঢঙ! দু’দুটো সুদর্শন ছেলে তার পেছনে লাইন দিচ্ছে আর সে মহারাণী কি-না কাউকে পাত্তাই দিচ্ছে না! কপাল, একেই বলে কপাল। তবে মুনতাসীর ভাই যে আপুকে পছন্দ করে সেটা এখনও স্বীকার করেনি৷ কিন্তু জেসমিন জানে মুনতাসীর ভাইও নয়ন ভাইয়ের কম্পিটিশন। একটা রিকশা আসতে দেখা গেলে জেসমিনের মাথায় একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি দেখা দিল। সে রিকশা দাঁড় করিয়ে আগে নিজের বোনকে উঠতে বলল।

-আপু তুই ওঠ।”

জেসমিনের এই কথায় ধারা যথেষ্টই অবাক হয়েছে। বাবা! আজ মুনতাসীর ভাইকে রেখে বোনের প্রতি দরদ দেখাচ্ছে! যাক আপন বোনের প্রতি একটু তো মায়া মহব্বত আছে। ধারা রিকশায় উঠে বসেছে। হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভাব দেখিয়ে জেসমিন ব্যাগ খুলে কিছু খোজাখুজি করে বলল,

-এইরে! রুমকির কাছে আমার নোটস রয়ে গেছে। ও যদি ভুল করে বাড়ি রেখে যায় তাহলে মুন্সি স্যার আজ আমাকে আস্ত রাখবে না। এমনিতেই তো আমাকে পড়া চোর ভাবে। আপু তুই মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে চলে যা। আমি রুমকির সাথে আসছি।”

বলেই জেসমিন ধারাকে কিছু বলার সুযোগই না দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। ধারা বোনের এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেছে। মনে মনে রেগে ফেটে পড়লেও বুঝতে দিচ্ছে না। মুনতাসীর মনে মনে হাসল। জেসমিন কেন এমন করেছে এটা ধারা না বুঝতে পারলেও সে খুব ভালো ভাবেই বুঝেছে। মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে। ঠিকই টের পেয়েছে মুনতাসীর ধারাকে পছন্দ করে। তাই তো ওদের আজ একসাথে যাওয়ার সুযোগ করে দিল। ধারা মুনতাসীরের দিকে তাকাল। সে রিকশা ওয়ালাকে যেতে বলার আগেই মুনতাসীর লাফিয়ে রিকশায় উঠে ধারার পাশে বসে পড়লো। এই সুযোগ হাত ছাড়া করার মতো গাধা সে না। জেসমিন যদি জানতে পারে তার সব কষ্ট বৃথা গেছে তাহলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। পরপর দু’টো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ধারা বাকরুদ্ধ। এক রিকশায় মুনতাসীরের পাশে বসে যাবার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। ধারার মতিগতি দেখে মুনতাসীর রিকশা ওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,

-মামা কলেজে নামব। তাড়াতাড়ি যান।”

ধারা ততক্ষণে বিস্ময়ের ধাক্কা সামনে নিয়ে নিজের রূপে ফিরে এসেছে। সে বলল,

-মামা রিকশা থামান।”

মুনতাসীর কঠিন চোখে ধারার দিকে তাকালো। ধারা ওর তাকানোর পাত্তাও দিল না। সে আবার বলল,

-মামা আপনাকে দাঁড়াতে বলেছি।”

মুনতাসীর সাথে সাথেই বলল,

-মামা আপনি যান।”

ধারা আগুন চোখে ওকে দেখল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-মামা দাঁড়ান।”

-মামা আপনি যেতে থাকেন।”

এবার লোকটাও কনফিউজড হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকালেন তিনি। একজন বলছে যান। একজন বলছে দাঁড়ান। কার কথা শুনবেন তিনি? বিরক্তি মুখে লোকটা বলল,

-নিজেদের ঝগড়া মিটাইয়া নেন না আপা। কেন খামোখা আমার পেটে লাথি দিবেন? বিশটা টাকা বেশি পাইলে আমারই তো লাভ।”

ধারা কি এত সহজে হার মানার পাত্রী? তবুও সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই মুনতাসীর ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে, ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেব। না আসলে ফেলবও না। তোকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বাকিটা পথ নিয়ে যাব। চিৎকার করতে চাইলে যে আরও কী করব সেটা শুনে জ্ঞান হারাবি। টুক করে চুমু খেয়ে ফেলব।”

ধারার চোয়াল ঝুলে গেছে। হাঁ করে মুনতাসীরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এরকম কিছু একটা সে শুনবে এটা কল্পনারও বাইরে ছিল। লোকটা কী চরম অসভ্য! ধারা রাগ, ক্ষোভ, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে। মুনতাসীর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল৷ যাক এবার তাহলে বাঘিনীকে জব্দ করা গেছে। জেসমিন ঠিকই বলে, দুনিয়ায় ভালো মানুষের ভাত নেই। এতদিন তো ভালো হয়ে দেখেছে। কই ধারার মন গলাতে পেরেছে কি? এবার নাহয় একটু অসভ্য, অভদ্র, খারাপই হলো। তাতেও যদি এই হৃদয়হীনার পাথুরে মনে নিজের ভালোবাসার বীজ বপন করতে পারে।

চলবে_

#এক_বরষায় [২৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

_________________
বাড়ি ফিরে ধারা যদি জেসমিনকে সামনে পেতে তাহলে সে কী করতো তা নিজেও জানে না। আজ ওরকম একটা পরিস্থিতিতে তো ওর জন্যই পড়তে হয়েছে। সকালে যদি ওভাবে চলে না আসতো তাহলে তো তাকে ওই লোকের সাথে এক রিকশায় বসে যেতে হতো না৷ শুধু যাওয়া পর্যন্তই তো শেষ না। মুনতাসীর রিকশায় বসে আরও অনেক কথাই বলেছে। জেসমিন জানতো আজ সে বোনের সামনে পড়লে তার কপালে খারাবি আছে। তাই নয়ন ভাইদের বাড়ি গিয়ে বসে রইল।

এদিকে ধারা সত্যি সত্যিই রোহানকে পড়াতে যাচ্ছে না। রোহানের ম্যাম না আসার জন্য রোহান মামাকেই দায়ী করছে। রোহানের মামার নাম সাদাফ। সাদাফেরও যে ধারাকে দেখছে ইচ্ছে করছে না এমন না। মেয়েটার মাঝে কিছু তো আছে। নইলে প্রথম দেখাতেই একটা মেয়ের প্রতি সে কখনও এরকম টান অনুভব করেনি। কিন্তু এই মেয়ের প্রতি করছে। আপা মেয়েটার সম্পর্কে একটা শব্দও বানিয়ে বলেনি৷ যা যা বলেছে সবই সত্যি। মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। আর এইজন্যই হয়তো সে বাকিদের থেকে আলাদা।

সেদিন ধারার পেছন পেছন ওদের পাড়ায় এসেছিল সাদাফ৷ আজ ধারার খুঁজে আবার এসেছে। যদি দেখা হয়ে যায়! সেদিন একটা ভুল করেছে, মেয়েটার বাড়ি চিনে রাখা উচিত ছিল।
সে তো ধারার নাম জানে। কাউকে কি জিজ্ঞেস করবে ধারার বাড়ি কোনটা?

-জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে? মানুষ যদি ভুল ধারণা করে ধারাকে খারাপ ভাবে। না থাক। এমনিতেই খুঁজতে থাকি। ভাগ্যে থাকলে দেখা হয়ে যেতেও পারে।”

পুরো পাড়াটা সাদাফ এক চক্কর দিয়ে এলো। কিন্তু না, তার ভাগ্য এতটাও ভালো না। মনে হচ্ছে ধারার দেখা পাবে না সে। জেসমিন হেলেদুলে বাড়ি ফিরছিল। ওদের বাড়ির রাস্তার সামনে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেল। ছেলেটা কি কাউকে খুঁজছে? জেসমিন দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ছেলেটা কী করে। কিন্তু এ তো ঘুরেফিরে তাদের বাড়ির সামনেই এসে দাঁড়াচ্ছে। মতলব কী?

-এর উদ্দেশ্যটা কী? জানতে হবে তো।”

জেসমিন মনে সন্দেহ নিয়ে ছেলেটার দিকে এগিয়ে এলো। সাদাফ জেসমিনকে দেখে ভাবল এবার তার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, ওর কাছে ধারার কথা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। জেসমিন আগন্তুক লোকটার কাছাকাছি এসে বলল,

-আপনি কি কাউকে খুঁজছেন? পাড়ায় নতুন মনে হচ্ছে।”

সাদাফ এখনও দোটানায় আছে। মেয়েটা ধারাকে চিনলেও তার মতো অচেনা একজনকে ধারার বাড়ি চিনিয়ে দিবে? জেসমিনের সন্দেহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। ছেলেটার চেহারা সুরত তো ভালোই। দেখে তো চোর বাটপার মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই ছেলের মাঝে কিছু একটা ঘাবলা আছে। জেসমিন আবার জিজ্ঞেস করল,

-আপনার কি কোন সাহায্য লাগবে? লাগলে বলতে পারেন।”

সাদাফ কিছুটা সময় ইতস্তত করে সাহস করে ধারার কথা জিজ্ঞেস করেই ফেলল।

-এই পাড়ায় ধারা নামের কাউকে চিনেন আপনি?”

জেসমিন ফিক করে হেসে ফেলতে গিয়েও সামলে নিল। তাকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনি আপনার বোনকে চিনেন?” কে এই গাধা? হায় আপুর কপাল! এরকম কপালকেই কি চাঁদ কপাল বলে? সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো কপাল পেয়েছে তার খিটখিটে মেজাজের বোনটা। জেসমিন মুখে আলগা গম্ভীরতা এনে বলল,

-কেন ওকে দিয়ে আপনার দরকার কি? আর আমি চিনলেও আপনাকে তার কথা কেন বলবো?”

-দেখুন আমি কিন্তু কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে উনার কথা জানতে চাচ্ছি না। আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। বিশ্বাস করুন।”

হায় এই ছেলেটাও তো মুনতাসীর ভাইয়ের মতোই সুন্দর। এই ছেলেও কি আপুর জন্য দিবানা? এই আপুটার পেছনে কত ছেলে ঘুরে? জেসমিন নিজের কপালের উপর আফসোস করে মনে মনে বলল,

-আমি কি মেয়ে না? আমি কি দেখতে সুন্দর না? আপুর মতো না হই ওর থেকে একটু কম সুন্দর, তবুও তো আমি সুন্দরী। তাহলে এখন অব্দি আমার পেছনে কেন কোন ছেলে ঘুরলো না? আমার জন্য দুই তিনটা ছেলে কেন এমন পাগল হলো না? কেন কেন কেন? কেন আল্লাহ? কেউ কেন জেসমিনের খোঁজ নেয় না।”

-আপনি মনে হয় আমাকে ভুল ভাবছেন।”

জেসমিন নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটার উপর নজর দিল। কপালে না থাকিলে ঘি ঠকঠকাইলে হইব কী? তার কপালেও ছেলে নেই। ছেলেহীন মরুভূমি কপাল পেয়েছে একটা।
সাদাফ ঠিক বুঝতে পারছে না মেয়েটা তার সম্পর্কে কী ভাবছে।

-আপনি কি আমাকে ধারাদের বাড়ির ঠিকানাটা দিতে পারবেন।”

-পারব। কিন্তু আপনাকে ঠিকানা দিলে আমার লাভ কী?”

ছেলেটা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকে দেখছে। তারপর মুচকি হেসে বলল,

-লাভ! আপনাকে আমার বিয়েতে দাওয়াত দিব।”

না, অতটাও গাধা না। বুদ্ধি আছে ব্যাটার মাথায়। হাসিটাও সুন্দর।

-তা নাহয় দিলেন। কিন্তু ধারা যদি জানে অচেনা একটা মানুষকে আমি তাদের বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছি তাহলে আমাদের বাড়িতে আগুন দিবে।”

-উনি জানবে না। এই কথা আমার আর আপনার মাঝেই থাকবে।”

তারপরও জেসমিন কয়েক মুহূর্ত ভাবল। ছেলেটা আগ্রহী চোখে তাকে দেখছে। জেসমিন ভীষণ মিষ্টি করে হেসে বলল,

-ঠিক আছে। আপনি ঠিক এই সময় কাল আসবেন। আমি আপনাকে ধারাদের বাড়ি চিনিয়ে দেব। এখন তো আমার হাতে সময় নেই।”

সাদাফ ভাবেনি এই ছোট্ট মেয়েটা তাকে এভাবে ঘোল খাওয়াবে। পুলিশের মতো এতক্ষণ নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে এখন বলছে কাল আসবেন। সোজাসুজি বলে দিয়েই তো হয়, আমি বলব না।
জেসমিন সাদাফকে নিরাশ করে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ব্যাটা তাকে বোকা ভেবেছিল।
******

জেসমিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। কোথায় তার খুঁত আছে খুঁজে বের করছে। সে কি দেখতে সুন্দর না! অবশ্যই সুন্দর। তারপরও কোন ছেলে কেন তাকে পছন্দ করে না। উঁহু নয়ন ভাইয়ের বোন হয়ে তো একটা সমস্যা হয়েছে। ভয়ে আজ পর্যন্ত কোন ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিল না। ধারা ঘরে এসে বোনকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রঙঢঙ করতে দেখে পেছন থেকে এসে ওর কান টেনে ধরল। জেসমিন ব্যথায় ককিয়ে উঠে কাতর গলায় বলল,

-আপু লাগছে ছাড়। ছাড় না প্লিজ।”

-লাগুক। তোর লাগাই দরকার। সকালে কী কাজটা করেছিস ভুলে গেছিস!”

-কী করেছি আমি?”

-কিছু করিসনি?”

জেসমিন সত্যি সত্যিই ব্যথা পাচ্ছে। বোনের হাত থেকে আজ সহজে ছাড়া পাবে না ভেবে দাদীকে ডাকতে লাগল,

-দাদী, ও দাদী। দেখো তোমার বড় নাতনি কী করছে।”

-দাদীকে ডাকলেও লাভ হবে না।”

-তুই কান না ছাড়লে কিন্তু আমি সবাইকে বলে দেব একটা ছেলে তোকে খুঁজছে। আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছে তুই কারো সাথে প্রেম করিস নাকি। আরও অনেক কথা আছে। সব বলে দেব।”

ধারা জেসমিনের ভয় দেখানোতে না ও এমনিতেই জেসমিনের কান ছেড়ে দিল। জেসমিন কি সত্যি বলছে? কোন ছেলে বাড়ির সামনে এসে তার খোঁজ নিবে? জেসমিন বোনকে দেখল। যাক বাঁচা গেল বাবা।

-আমি তো এমনিতেই সুন্দর না। কেউ আমাকে পছন্দ করে না৷ কোন ছেলে আমার খোঁজ নিতে চায় না। তার উপর যদি একটা কান না থাকে তাহলে তো যৌতুক দিয়েও বিয়ে দেওয়া যাবে না।”

ধারা চিন্তান্বিত গলায় বলল,

-সত্যিই কেউ আমার কথা জানতে চাচ্ছিল?”

-আমি কি মিথ্যা বলছি নাকি?”

-একটা ছেলে! কিন্তু কোন ছেলে কেন আমার কথা জানতে চাইবে?”

-ছেলে রাশি নিয়ে জন্ম নিলে তো ছেলেরা খোঁজ করবেই। আমার মনে হয় তোর ছেলে রাশি। তাইতো এত ছেলে তোর জন্য পাগল।”

ধারা বিরক্ত হয়ে বলল,

-বাজে বকিস না।”

-বাজে বকা কী? তুই নিজেও জানিস কত ছেলে তোকে পছন্দ করে। কই আমিও তো সুন্দর। আমার পেছনে তো কোন ছেলে ঘুরে না। তোর ছেলে কপাল।”

-তোর মনে হয় অনেক শখ পেছনে ছেলে ঘোরার।”

-শখই তো। আমি তোর মতো এত ভাব নিতাম না। ছেলেগুলোকে ছিলে খেতাম।”

-যেসব মেয়েরা ছেলেদের থেকে খায় ওদের চরিত্রে সমস্যা আছে বুঝলি।”
*****

রাতে ধারাদের ঘরে মুনতাসীরের ডাক পড়ল। ধারার দাদী নাকি ওকে ডাকছে। জেসমিন এসে বলল,

-মুনতাসীর ভাই, দাদী আপনাকে ডেকেছে চলুন।”

হঠাৎ দাদী কেন ডেকেছে এটা ভাবতে ভাবতেই মুনতাসীর এই ঘরে এলো। ধারাও ঘরেই আছে।
মুনতাসীরকে দেখে দাদী আগের দিনের অনেক গল্প জুড়ে দিলেন।

-তোমার বাপ এহন কী করে ভাই?”

-আব্বা তেমন কিছু করেন না।”

-শইল স্বাস্থ্য ভালা আছে?”

-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।”

দাদী ইনিয়েবিনিয়ে আরও অনেক কথার পরে আসল কথায় এলো। মুনতাসীর মনে মনে হাসল। দাদী তাকে এই কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও পারতো।

-বিয়াশাদী নিয়া কিছু ভাবছো?”

দাদীর কী খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই? অন্যের বিয়ে নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন? ধারা কটমট চোখে দাদীকে দেখছে। মুনতাসীর আড়চোখে একবার ধারাকে দেখে মৃদু হেসে বলল,

-ভাবছি দাদী। কিন্তু মনের মতো কাউকে পাচ্ছি না।”

ধারা ঝট করে অসভ্য ফাজিল লোকটাকে দেখল। মনের মতো পাত্রী পাচ্ছে না বিয়ে করার জন্য। কিন্তু হুটহাট তার হাত ধরে টানাটানি, রিকশায় চেপে বসা এমনকি চুমো খাওয়ার কথাও বলতে পারছে। দাদীও তো আর কম যায় না। তিনিও বললেন,

-কও কি? তোমার তো মনে হয় কাছের দৃষ্টি দুর্বল। আশেপাশে না খুইজাঁ কই খোঁজাখুঁজি করতাছো কে জানে?”

জেসমিন ফিক করে হেসে ফেলল। দাদী কি কোনোভাবে তার বড় নাতনির কথা বলছে? তাহলে দাদীর জন্য সুখবর। মুনতাসীর ভাই অলরেডি দাদীর খিটমিটে বড় নাতনির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।বরং তার নাতনিই পাত্তা দিচ্ছে না।

-দাদী মুনতাসীর ভাইয়ের বউ খোঁজার দায়িত্ব নাহয় তুমিই নাও।”

-আমি নিতাম? তুমি কি কও ভাই?”

মুনতাসীর হেসে বলল,

-তাহলে তো আরও ভালো হয় দাদী।”

-ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দের মাইয়া যদি তোমার পছন্দ না হয়।”

মুনতাসীর উত্তর দেওয়ার আগেই জেসমিন বলল,

-কেন হবে না? খুব হবে।”

এসব আলোচনার মাঝে ধারার আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না। দাদীর মাথা খারাপ হয়েছে। কেন সেধে সেধে অন্যের বোঝা নিজের কাঁধে নিচ্ছে?
*****

প্রতি রাতে ওই নাম্বারটা থেকে কল আসা এখন যেন নিয়ম হয়ে গেছে। কে কল করে নয়ন জানে না। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছে ওপাশের মানুষটা একটা মেয়ে। নয়ন প্রথম কয়েকদিন বিরক্ত হলেও। এখন তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেমন ইন্টারেস্টিং লাগে। মেয়েটা যে-ই হোক তার কাছে কী চায়। প্রথম দুই দিন কেউ-ই কোন কথা বলেনি। কিন্তু এখন নয়ন বলে।

-আপনি যে-ই হোন না কেন, ছেলে যে হবেন না এটা জানি। আপনি কে আমি জানি না। আমার কাছে আপনি কি চান এটাও জানি না। কিন্তু আপনাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা দরকার মনে করছি, আমি একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি। মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে না। তবুও আমি মেয়েটাকে ভালোবাসি। হয়তো সারাজীবন বেসে যাব। এখনও কি আপনি আমার সাথে কথা বলতে চান?”

চলবে_