এক বরষায় পর্ব-২৯+৩০

0
521

#এক_বরষায় [২৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
___________
মুনতাসীর ধারাকে হাসপাতালে যাওয়ার কথা বললেও ধারা গেল না। না বাবা থাক, হাসপাতালে গেলে যদি আবার ইনজেকশন দিয়ে দেয়। সে এমনিতেই সেরে যাবে। লোকের সামনে নিজেকে অনেক সাহসী প্রমাণ করলেও সামান্য ইনজেকশনের ভয়ে ধারা হাসপাতালে গেল না এই কথা যদি কেউ জানতে পারে তখন তাকে নিশ্চয় পৃথিবীর সেরা ভীতু আখ্যায়িত করবে।
পায়ের ব্যথা নিয়ে ধারাকে বেশি ভুগতে হয়নি। পরের দিনই ব্যথা কমে গেছে। শুধু পা ফোলা কমছিল না। তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারছিল।
ধারাকে দেখতে আসা নয়নের প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে গেছে। সেদিন রোজী আপার ননদও সাথে এসেছিল। জেসমিন তখন কলেজে ছিল। ধারা উঠে মেহমানের জন্য কিছু আনতে নিলে নয়ন এক ধমক দিয়ে বসিয়ে দিল।

-কোথায় যাচ্ছিস? চুপচাপ বোস এখানে।”

ধারা মেয়েটার সামনে তো আর বলতে পারলো না, বাড়িতে মেহমান এসেছে ওকে কি শুকনো মুখে বিদায় করবো? তবে তার পায়ে এখন আর ব্যথা নেই এটা নয়ন ভাইকে বোঝাতে গেলে আবার ধমক খেল।

-পা ঠিক হয়ে গেছে তার মানে এই না তুই সারাদিন ধেইধেই করে নাচবি। এখন কোথাও যেতে হবে না। বোস।”

মেয়েটার সামনে ধারা লজ্জায় পড়ে গেল। তাকে যতটা মুমূর্ষু রোগী বানিয়ে রাখা হচ্ছে সে আদতে ততটা অসুস্থ না। এখন তো পা ঠিকই আছে। তারপরও হাঁটতে নিলে সবাই তাকে এমন ভাবে ধমকা ধমকি করছে যেন সে হাঁটতে গিয়ে মস্ত কোন অপরাধ করে ফেলছে। বাড়িতে সর্বক্ষণ এক ঝামেলা তো আছেই। ঝামেলাটা কলেজে গেলে একটু শান্তি। কিন্তু এক ঝামেলা বিদেয় হলে আরেক জন এসে হাজির হয়। নয়ন ভাইও তাকে বাচ্চা পোলাপানের মতো ধমকায়।
শেষে ধারা ভাঙিয়েই বলল,

-নয়ন ভাই, মিথিলা এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওকে কি এভাবেই যেতে দেব?”

মিথিলা সৌজন্যমূলক হেসে ধারাকে ওর জন্য ব্যস্ত হতে বারণ করলো। ধারার নামটা সে এত বেশি শুনেছে যে ধারার সাথে একদিন সামনাসামনি দেখা করার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। ভাবী সারাক্ষণ ধারার গুণগানই গেয়ে যায়। ভাবীর ভাইয়ের কথা আর কী বলবে? ধারা ছাড়া তার কাছে তো আর কোন কথাই নেই। মিথিলা দীর্ঘশ্বাস চাপলো। দূরে থেকে মেয়েটাকে তার কাছে অহংকারী মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো ধারাকে তারও ভালো লাগছে। মেয়েটা সত্যি ভালো লাগার মতোই। তারই কপাল খারাপ। ধারার সামনে সে সত্যিই কিছু না। নয়ন মিথিলার দিকে দেখল। তারপর হেসে বলল,

-আমার বাড়িতে কি বিয়ানকে না খাইয়ে রেখেছি নাকি যে তোদের বাড়ি থেকে খেয়েই যেতে হবে। তাছাড়া এখানে আসার বিয়ানের প্রস্তুতি ছিল না। আসার পথে আমি বলাতে চলে এলো। তুই শুধু শুধু ব্যস্ত হোস না।”

মিথিলাও নয়নের কথা ধরে বলল,

-আমি এখন কিছু খাব না ধারা। তোমাকে দেখার কৌতূহল ছিল। আসলে ভাবীর মুখে তোমার কথা এত শুনেছি যে দেখা হবার একটা আগ্রহ থেকেই গেল।”

ধারা যেন লজ্জা পেলো। রোজী আপা তাকে নিয়ে বাড়িয়ে টারিয়ে কত কথা বলেছে কে জানে!
এই ভাইবোন দু’টো সত্যিই পাগল। নয়ন উঠে পড়ে বলল,

-আজ তাহলে যাই। তুই কিন্তু বেশি বেশি হাঁটাহাঁটি করিস না।”

-হুম।”

ওরা উঠলে ধারাও ওদের বিদায় জানাতে উঠলো। কিন্তু নয়নের চোখ পাকানো দেখে হতাশ হয়ে বসে পড়লো। মিথিলা যেতে যেতেও ধারাকে দেখছে। ধারা যে কী ভীষণ ভাগ্যবতী তা যদি সে বুঝতে পারতো। একটা ছেলে তাকে কোন আশা প্রত্যাশা ছাড়াই জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রধান্য দেয়৷ এরকম ভাগ্য কয়জনের হয়? এটাই হয়তো দুনিয়ার নিয়ম, কেউ চেয়েও পায় না। আবার কেউ পেয়েও দাম দেয় না।
_______
আতিফ স্কুল থেকে ফিরছিল। সামনে মনে হয় কোন ঝামেলা হয়েছে। কয়েকজন মহিলারা ঝগড়া করছে হয়তো। আতিফ মহিলাদের ঝগড়ায় কান না দিয়ে পাশ দিয়ে চলে আসছিল। কিন্তু জেসমিনের কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে গেল। মহিলা গুলোর মাঝে জেসমিন আপু কী করছে! আতিফ কোনোরকমে মহিলা গুলোকে সরিয়ে জেসমিনকে দেখতে পেলো। জেসমিন তুমুল উদ্যমে মহিলা গুলার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছে। পারলে হাতাহাতিও শুরু করে দেয়। একজন মহিলা বলছে,

-চোরের মা’র বড় গলা। নিজের বোন ফষ্টিনষ্টি করতে পারবে। আর আমরা বলতে পারব না।”

জেসমিন ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-মুখ সামলে কথা বলবেন। বয়স হয়েছে কিন্তু কথা বলার ভদ্রতা শিখেন নি, না?”

-তোদের দুই বোনের থেকে আমাকে ভদ্রতা শিখতে হবে? তোর বোন ওই মাস্টারের সাথে কী নোংরামি করে তা কি আমরা জানি না মনে করেছিস? এখন তো সবাই জানে।”

আতিফ যদি ঠিক সময়ে এসে জেসমিনকে না আটকাতো তাহলে মনে হয় জেসমিন মহিলাকে মেরেই বসতো৷ নিজের বোন আর মুনতাসীর ভাইয়ের নামে কোন বাজে কথা শুনবে না সে। আতিফ পেছন থেকে জেসমিনের দুই হাত আটকে ধরে রেখেছে। জেসমিন ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করছে।

-আতিফ ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি।”

-জেসমিন আপু তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! ঝগড়া করছো কেন তুমি?”

-ঝগড়া করবো না। এই ছোটলোক গুলো কী বলছে শুনছিস না।”

মহিলা তিনজন এবার আরও বাজে বাজে কথা বলছে। এতক্ষণ তো শুধু ধারাকে নিয়ে বলছিল। এবার ওর বাবাকে নিয়েও বলছে।

-দেখ দেখ কী অসভ্য মেয়ে। বাপটা তো একটা মাতাল। বোনেরও চরিত্রের ঠিক নেই। এই মেয়েও তেমন সুবিধার না। চালচলনের কোন ঠিক নেই। এদেরকে এই পাড়া থেকে বের করে দেওয়া উচিত।”

আতিফ এসেছিল জেসমিনকে ফেরাতে। কিন্তু মহিলা গুলোর কথা শুনে তার নিজেরও রাগ উঠে গেল।

-আপনারা তো অনেক ভালো। সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মানুষের বদনাম করে বেড়ান।”

-দেখেছ কোথাকার এই পুঁচকে ছেলেও কত বড় বড় কথা বলছে। আমাদের মুখ নাহয় বন্ধ করতে পারবি৷ কিন্তু পাড়ার বাকি মানুষের মুখ কীভাবে বন্ধ করবি? বিয়ের উপযুক্ত দুইটা মেয়ে ঘরে রেখে বাইরের ছেলেদের বাড়িতে জায়গা দেয়।”

ঘটনা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে গেল জেসমিনের আতিফকে সামলাতে হচ্ছে। এখানের একজন মহিলার ছেলেও আতিফের সাথে পড়ে, আতিফ সেই ছেলের সব কুকীর্তি ফাঁস করে দিচ্ছে। জেসমিনও থেমে থাকলো না বাকি দু’জনের ছেলেমেয়েদের গোপন কথাও বলে ফেলছে।
আতিফ বলছে,

-আগে নিজেদের ছেলেমেয়েকে ঠিক করুন। অন্যের কথা নিয়ে নাচতে হবে না। আমার ধারা আপু কেমন তা আমরা জানি।”

জেসমিন রাগের মাথায় মহিলা গুলোকে মুটি, মুটকি, আটার বস্তা ডাকতেও ছাড়ছে না।

-মুটির বাচ্চা তুই যদি আমার বোনকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বলিস তাহলে আমিও তোর মেয়ের কথা ফাঁস করে দিব। তোর মেয়ে যে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়ে ধরা খায় সেটা কি আমি জানি না।”

ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে তিনজন মহিলার সাথে ঝগড়া করছে। অল্প সময়ের মধ্যে ওদের ঘিরে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেল। আতিফ জেসমিন আশেপাশে দেখছে না। নিজেদের ছেলেমেয়ের কথা উঠে এলে মহিলা গুলো দমে গেল। ঘটনা কী হয়েছে জানার জন্য নয়ন ভিড় ঠেলে এসে আতিফ জেসমিনকে দেখে তব্দা খেয়ে গেল। এই দুইটা এখানে কী করছে? নয়ন যেভাবেই হোক পরিস্থিতি সামলে নিল।

-আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? নিজেদের কাজ নেই। যান সবাই। এখানে কি সার্কাস চলছে! যান সবাই।”

লোকজন কমে গেলে নয়ন মহিলা তিনজনকেও বুঝিয়ে ওদের হয়ে ক্ষমা টমা চেয়ে পাঠিয়ে দিল। সবাই চলে গেলে আগুন চোখে দুইজনকে দেখল। কিন্তু ওদের মাঝে কোন অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে না। নয়ন ধমকে উঠে বলল,

-কী করছিলি তোরা দুইটা? রাস্তায় দাঁড়িয়ে মহিলাদের সাথে ঝগড়া করছিলি! তোদের এই অধঃপতনের কারণ জানতে পারি?”

জেসমিন নিজেদের ভুল বোঝার ধারের কাছে না গিয়ে উল্টো তেতে উঠে বলল,

-বয়সে বড় হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? যা খুশি তা-ই বলবে আর আমরা শুনবো?”

নয়ন কটমট করে জেসমিনের দিকে তাকাল। কিন্তু এই মেয়ে কাউকে ভয় পেলে তো। আতিফও জেসমিনের পক্ষ নিয়েই বলছে,

-মুটি গুলো কী বলেছে জানলে তুমিও ঝগড়া করতে।”

-কী বলেছে? কী এমন বলেছে যার জন্য তোদের মা খালার বয়সী মহিলাদের সাথে ঝগড়া করতে হলো।”

বোনের নামে এমন জঘন্য অপবাদের কথা বলতে গিয়ে জেসমিনের গলা ধরে এলো।

-ওরা মুনতাসীর ভাই আর আপুকে নিয়ে কীসব বাজে বাজে কথা বলছিল।”

ধারার কথা উঠতেই নয়নের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

-কী বলছিল?”

– অ্যাক্সিডেন্টের দিন মুনতাসীর ভাই আপুকে কোলে নিয়ে বাড়ি গেল না, ওসব নিয়েই নানান বাজে কথা বলছিল। আপু নাকি মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে। আপুর চরিত্র ভালো না।”

বলতে বলতে কান্নায় জেসমিনের গলা আটকে এলো। আতিফ বলল,

-তুমিই বলো নয়ন ভাই, আমাদের ধারা আপু কি ওরকম? ওকে নিয়ে মানুষ বাজে কথা বললে আমরা ঝগড়া করবো না।”

নয়ন যদি একটু আগেও ঘটনা জানতো তাহলে সে নিজেই তো হয়তো মহিলা গুলোকে ছাড়তো না। ধারাকে নিয়ে যে একটা বাজে কথা বলবে তার জিভ ছিঁড়ে ফেলবে সে। নয়ন চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো পাকিয়ে রাগ সামলাচ্ছে। সামান্য একটা ঘটনাকে রঙ লাগিয়ে মানুষ এত বড় করে তুলেছে! ধারার চরিত্রে আঙুল তোলার আগে সেই হাতই রাখবে না নয়ন।
***
এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে গেল না। মহিলা তিনজন তাদের স্বামীকে নিয়ে আতিফ জেসমিনের বিচার করতে বাড়ি চলে এসেছে। ধারা এসবের কিছুই জানতো না। কিন্তু মানুষ গুলোর মুখে আতিফ, জেসমিনের এই কাজের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে রইল। তার বোন এখন পাড়ার মহিলাদের সাথে ঝগড়া করে বেড়াচ্ছে? ধারার বাবা বাড়িতে নেই। ধারা বোনকে ডেকে এনে কঠিন গলায় জানতে চাইল,

-উনারা যা বলছে তা কি সত্যি? সত্যিই তোরা উনাদের ওসব বাজে কথা বলেছিস?”

-উনারা কি বলেছে তা বলতে বলছো না কেন?”

-আমি ওদের কথা জানতে চাই না। তুই সত্যিই ঝগড়া করেছিস?”

একজন মহিলা বলল,

-আমরা কি মিথ্যে বলছি নাকি? তোর বোন আমাকে মুটি বলেছে। জিজ্ঞেস করে দেখ।”

সাথে সাথেই জেসমিন ফোঁসে বলে উঠল,

-আপনি আমার বাবাকে মাতাল বলেননি?”

ধারা কোনকিছু না শুনেই জেসমিনের গালে চড় মারলো। জেসমিন কখনও ভাবেনি তার বোন তাকে মারবে। গালে হাত দিয়ে ধারার দিকে চেয়ে রইল সে। চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। আতিফ চোখের সামনে অন্যায় দেখে চুপ করে থাকতে পারল না।

-তুমি জেসমিন আপুকে মারলে কেন? আমাদের তো একার দোষ ছিল না। উনারাও…

-তুমিও যদি মার খেতে না চাও তাহলে উনাদের কাছে ক্ষমা চাও। কিছু না বলতে বলতে দু’জন সাপের পাঁচপা দেখে ফেলেছ। এই বাড়িতে থাকতে হলে সভ্য মানুষের মতো থাকতে হবে। নইলে দু’টাকেই ঘাড় ধরে বের করে দিব।”

চলবে_

#এক_বরষায় [৩০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

_______
সে রাতে জেসমিন না খেয়েই শুয়ে পড়লো। ধারাও আর রাগ করে ওকে ডাকেনি। শাসন বারণ না করতে করতে দিনদিন অসভ্যের চূড়ান্তে পৌঁছুচ্ছে। আগে তো শুধু চেনা পরিচিত মানুষ গুলোর সাথে মুখের উপর সব কথার জবাব দিয়ে দিত। এখন পাড়ার মহিলাদের সাথেও ঝগড়া করে বেড়াচ্ছে। এই মহিলা গুলোই লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার বোনের নামে বদনাম করে বেড়াবে। জেসমিন মেয়ে মানুষ। তাদের কাছে যতই ওকে ছেলেমানুষ মনে হোক কিন্তু বাইরের মানুষ তো আর এটা মানবে না। এই মেয়েকে একদিন না একদিন বিয়ে দিতে হবে। তখন এই মানুষ গুলোই আড়ালে শত্রুতা করে শান্তি পাবে। জেসমিন দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ধারার দরজার সামনে থেকে ফিরে এলো। তার এই অবুঝ ছেলেমানুষ বোনটার গায়ে হাত তুলে সে নিজেও কি শান্তি পাচ্ছে? তার বুকের ভেতরটা পুড়ছে না? সদা হাসিখুশি থাকা এই মেয়েটাকে বকে যে সে নিজেও কষ্ট পায়। ধারা খুঁড়িয়ে হেঁটে আতিফের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আতিফ সামনে বই খাতা খুলে টেবিলে বসে আছে। কিন্তু পড়ছে না। তখন আতিফের সাথেও কঠিন গলায় কথা বলেছে ধারা। এই ছেলেটা তো আর তার নিজের ভাই না। তবুও এতদিনে একটা অধিকার এসে গেছে ওর উপর। ধারা গলাটাকে স্বাভাবিক করে নিল। যেন কিছুই হয়নি। রোজকার মতো ওকে খেতে ডাকতে এসেছে।

-আতিফ পড়াশোনা শেষ হলে খেতে এসো।”

আতিফ ঘাড় ফিরিয়ে দরজায় দাঁড়ানো ধারাকে দেখল। কিন্তু ওর কথার কোন জবাব দিল না।
ধারা কিছু সময় অপেক্ষা করে আবার বলল,

-খেয়ে এসে পড়তে বসো। আমি আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।”

-আমার ক্ষিধে নেই। আমি খাব না।”

ধারা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। আজ সবাই তার উপর অভিমান করেছে। এই পৃথিবীর কেউই হয়তো তাকে কোনোদিন বুঝবে না। নিজের গর্ভধারিণী মা-ই যেখানে ওকে বুঝেনি। সেখানেই অন্য কারো থেকে কিছু আশা করাই তো বোকামি। মা কি জানতো না, নয় বছর বয়সী সেই ছোট্ট ধারা মায়ের বুকে মাথা না রেখে, মায়ের গা থেকে আসা সেই মিষ্টি ঘ্রাণ না পেলে রাতে ঘুমাতে পারতো না। ঘুম থেকে জেগেও সেই ছোট্ট মেয়েটা চোখ খুলে প্রথমে ওর মা’কেই খুঁজেছে। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া, চুলে বিনুনি করে দেওয়া এমনকি ভাতটা পর্যন্ত মায়ের হাতে খাওয়া, সবকিছুর জন্যই তো সে মানুষটার উপর নির্ভরশীল ছিল। তবুও তো মানুষটা তাকে ফেলে রেখে চলে গেল। সেই মানুষটা যেহেতু যেতে পেরেছে তাহলে বাকি সবাই-ই পারবে। কেউ চিরকাল তার কাছে থাকবে না। কেউ তাকে বুঝবেও না। ধারা গলাটা ঝেড়ে নিয়ে ফের একবার বলল,

-ক্ষিধে না থাকলেও খেতে এসো। সকালে ভাত নষ্ট হবে।”

আতিফের ইচ্ছে করল সে এখন চেঁচিয়ে বলে, ধারা আপু তুমি এত কঠিন কেন? এত নিষ্ঠুর কেন তোমার মন? সবটা না জেনেই তুমি জেসমিন আপুকে মারলে। আমাকেও বকলে। আমরা তো তোমার জন্যই মহিলা গুলোর সাথে ঝগড়া করেছি। তোমাকে যে আমরা ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। তোমার নামে কেউ খারাপ কথা বললে আমরা সহ্য করতে পারি না। তোমাকে যারাই খারাপ বলবে তাদের সবার সাথেই আমরা ঝগড়া করব।
এসব কোন কথাই আতিফ বলতে পারল না। তার পেটের ভেতর থেকে একঝাঁক অভিমান দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেল। ধারা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

-আমি খাব না। তুমি জেসমিন আপুকে খেতে বলো।”

ধারা পড়েছে মহা জ্বালায়। এ তো ভাইবোনের গলায় গলায় ভাব দেখা যাচ্ছে। এই দুই ইঁদুর বেড়ালের কবে এত সখ্যতা হয়েছে? একজন না খেয়ে আছে বলে আরেকজনও খাবে না!
আতিফকে যা-ও খাবার টেবিলে আনা গেছে, জেসমিনকে ডেকে ডুকেও তোলা গেল না। মাথায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে শুয়ে আছে। ধারা যে এত ডাকল একটা বারও কোন সাড়াশব্দ করল না। এই মেয়ের অভিমান বরাবরই বেশি ছিল। না জানি এই ঘটনা মনে রেখে কয়দিন না খেয়ে থাকে।

মুনতাসীর বাড়ি ফিরেও এসবের কোন কিছুই জানতে পারলো না। ধারার সাথে যার নাম জুড়ে এতকিছু রটছে সেই মানুষটাই এসব বিষয় সম্পর্কে অজানা রয়ে গেল।
পরের দিন সকালেও জেসমিন না খেয়েই কলেজে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাবার সময় মুনতাসীরের সাথেও তেমন কথা বলল না। ওকে দেখে মুনতাসীর ভাবলো, এরে আবার কোন রোগে ধরল! নাকি অজান্তে সে কিছু করেছে? মুনতাসীর রিকশা থামিয়ে নিজে উঠে জেসমিনকে উঠতে বললে জেসমিন কাঠকাঠ গলায় বলল,

-আমি আপনার সাথে যাব না। আপনি চলে যান। আমি অন্য রিকশায় আসছি।”

মুনতাসীর কয়েক মুহূর্তে হতভম্বের ন্যায় কাটিয়ে কারণ জানতে চেয়ে বলল,

-আমার সারা কেন যাবে না?”

-কারণ আছে দেখেই তো যাব না। আপনি চলে যান।”

মুনতাসীরও সহজে ছাড়ার পাত্র না। জেসমিনের হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ জানতেই হবে। হাসিখুশি মেয়েটা হুট করে পুরোপুরি পাল্টে গেল কীভাবে?

-কারণটা কি জানতে চাচ্ছি।”

এদের তর্কাতর্কিতে রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল,

-যাইলে যাবেন, না যাইলে নাইমা যান। হুদাই আমার সময় খাইতাছেন কেন?”

কলেজে পৌছুতে দেরি হয়ে যাবে। আজকের ইংরেজি প্রথম ক্লাসটাই ওর। দেরি করা যাবে না। মুনতাসীর রিকশা থেকে নামলো না। জেসমিনকে টেনে তুলে নিল। জেসমিন নেমে যাবার আগে বা কোনরকম বাধা দেবার আগে চোখ গরম করে বলল,

-বোনের থেকে ঘাড়ত্যাড়ামি শিখতেছ নাকি? তুমি তো ওর মতো ছিলে না। কখনও হতেও চাও না। তাহলে?”

বোনের প্রসঙ্গ উঠতে জেসমিনের মুখ থমথমে হয়ে গেল। কাল রাতের চড়টা শুধু তার গালে লাগেনি। কলিজায় গিয়ে লেগেছে। মুনতাসীর সর্তক দৃষ্টি মেলে জেসমিনের চেহারার অভিব্যক্তি লক্ষ করছে। না, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে। মুনতাসীর কোমল গলায় জানতে চাইল,

-জেসমিন, কী হয়েছে? তুমি তো আমাকে বড় ভাই হিসেবে মানো তাই না? তাহলে আমাকে বলবে না?”

-মুনতাসীর ভাই, আপনি আমার আপুকে বিয়ে করবেন?”

জেসমিনের বলা কথাটা কি তার জন্য কোন প্রশ্ন ছিল? নাকি অনুরোধ? তবে মুনতাসীর এমন কিছু শোনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। সে বিষম খেতে গিয়েও খেল না। জেসমিন মুনতাসীর ভাইয়ের উত্তর জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মুনতাসীর পরিস্থিতি সহজ করতে বলল,

-এটা কি প্রশ্ন ছিল, নাকি অনুরোধ? উত্তর দিতে হবে?”

জেসমিন স্থির, অবিচল থেকে আগের মতো গলায়ই বলল,

-আপনি তো আমার আপুকে পছন্দ করেন। ভালোও বাসেন হয়তো। আপনি আমার আপুকে বিয়ে করে নিন না।”

মুনতাসীর একটানা অনেকক্ষণ জেসমিনকে দেখল। আসলে ওকে বোঝার চেষ্টা করল। সে কী বুঝল কে জানে। তারপর শীতল গলায় বলল,

-আমার একার পছন্দ করাতে তো কিছু হবে না জেসমিন। বিয়ে করার জন্য দু’পক্ষের মতামতই সমান গুরুত্ব রাখে। আমি চাইলেও কিছু হবে না যদি না তোমার বোনও সেটাই চায়।”

-আপুও আপনাকে পছন্দ করে।”

মুনতাসীর এবার হেসে ফেলল। জেসমিন এতটাই অধৈর্য হয়ে পড়েছে যে কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে ওর।

-এই কথা তোমার বোন তোমাকে বলেছে?”

-বলেনি। তবে ওর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।”

-কই আমি তো বুঝলাম না।”

-আপনি আমার আপুকে কতটা চিনেন? বুঝবেন কীভাবে?”

পাগল মেয়েটার কথা শুনে মুনতাসীরের হাসি বেড়েই যাচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, তোমার জন্মের আগে থেকে আমি তোমার বোনকে চিনি। আর তুমি কি-না আমাকে ওকে চেনাতে এসেছ? সেদিনের পুঁচকে মেয়ে তুমি নিজেই কতটা তোমার বোনকে চেনো? ধারা নিজেও যতটা নিজেকে না চেনে আমি ওকে তার থেকেও বেশি চিনি।
মুনতাসীর মজা করে বলল,

-সত্যিই চিনি না মনে হয়।”

-হু। শুনুন মুনতাসীর ভাই, আমি কিন্তু সেই কবে থেকেই আপনাকে দুলাভাই মেনে নিয়েছে। এখন আপনি শুধু আমার বোনটাকে বিয়ে করে ফেলুন। তাহলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।”

মুনতাসীরের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। সমস্যা? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? তা নাহলে জেসমিন হঠাৎ করে তার বোনকে বিয়ে করার কথা বলবে? জেসমিন অধৈর্য হয়ে বলল,

-কী হলো মুনতাসীর ভাই, কিছু বলছেন না কেন?”

-কী বলব?”

-আপনি আমার দুলাভাই হবেন কি-না? ”

-আমি তুমি চাইলেই কি দুলাভাই হওয়া যাবে নাকি? যাকে বিয়ে করব সে রাজি থাকতে হবে না?”

-আপুর তো কোন পছন্দ নেই। বাবা, দাদী যা বলবে আপু সেটাই করবে। আমি দাদীকে ম্যানেজ করে নেব। আপনি শুধু বাবার সাথে কথা বলে দেখুন। আপনার বাবা আছে না, উনাকে আমার বাবার সাথে কথা বলতে বলুন।”

মুনতাসীর মনে মনে ভাবল, ওসব কথা টথা অনেক আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার বোনটাই শুধু আমাকে পছন্দ করছে না। রোজ করে বিয়ে করার মাঝে কি কোন আনন্দ আছে? ওর মনেই যদি জায়গা করে নিতে না পারি।
*****
নয়ন হয়তো এখন সেই অচেনা ফোনকলের অপেক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন রাত ঠিক এগারোটার পর কল আসে৷ আসলে নয়ন এটা জানার জন্য কৌতূহলী ফোনের ওপাশে মানুষটা কে? আর তার থেকে কী চায়? রোজ কল করে অথচ কথা বলে না। মাঝে মাঝে নয়নও মুখে তালা দিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে কথা বলে। কথা বলা বলতে, মেয়েটার সম্পর্কে কিছু জানতে চায় না। তার নিজের কথাই বলে। নয়নের কথা বলার বিষয়ই তো ধারা। ধারাকে নিয়েই তার যত কথা।

-ভালোবাসা আসলে কি? ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া? নাকি ভালোবাসার মানুষটাকে সবসময় ভালো দেখা। ভালোবাসা কি পাওয়ার মাঝে? নাকি ত্যাগ করায়?”

আজও ফোনের ওপাশের মানুষটার থেকে কোন জবাব পেলো না। নয়নের মন আজ বিশেষ ভালো না। সেদিনের ঘটনা দিনদিন ডালপালা ছড়াচ্ছে। মুনতাসীরের সাথে ধারাকে জড়িয়ে পাড়ার লোকেরা নানান কথা বলছে। নয়নের সামনে অবশ্য কেউ বলে না। সেই সাহস কারো নেই। কিন্তু আড়ালে এই বিষয় নিয়েই কথা হয়। ধারা যতই কঠিন মেয়ে হোক। নিজের সম্পর্কে এরকম নোংরা মিথ্যে অপবাদ কোন মেয়েই সহ্য করতে পারবে না। ধারা কতদিন এসব চুপচাপ সয়ে যেতে পারবে? একদিন না একদিন ওর সহ্যের বাঁধ ভাঙবেই।
নয়ন অন্যমনস্ক হয়ে বলে যাচ্ছে।

-ধারাকে আমি কষ্ট পেতে দেখতে পারব না। পৃথিবীর যেকোনো সমস্যা ধারাকে ছোঁয়ার আগে আমার সামনা করতে হবে। পৃথিবীর সকল সুখ ধারার প্রাপ্য। মেয়েটা তো কারো খারাপ চায় না। তাহলে ওর খারাপ কেন হবে?
*****
ধারা বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় এখনও বারান্দায় বসে আছে। আজ বাবা এতো দেরি করছে কেন? কোনোদিনও তো বারোটার পরে বাড়ির বাইরে থাকে না। দাদী, জেসমিন ঘরে ঘুমিয়ে আছে। ধারা ঘরের, বারান্দার আলো নিভিয়ে একা বসে আছে। আতিফের ঘরও অন্ধকার। কিন্তু মুনতাসীরের ঘরে এখনও আলো জ্বলছে। লোকটা এত রাতেও জেগে কী করছে কে জানে? পড়ুয়া মানুষ, এখনও কি বই পড়ছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা বারবার গেটের দিকে দেখছে৷ দু-কান খাড়া করে রেখেছে। উঁহু, বাবার আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ অজানা কোনো কারণে ধারার মন কু’ডাকছে। কেমন অস্থির লাগছে। বাবা এখনও ফিরছে না কেন? সে কি আতিফকে ডেকে তুলবে? কিন্তু এই ছোট ছেলে এত রাতে একা বাবাকে কোথায় খুঁজবে? ধারা আর বসে থাকতে পারছিল না। সে উঠে উঠান জুড়ে পায়চারি করতে করতে চিন্তিত মুখে বারবার গেটের দিকে তাকিয়ে বাবার ফেরার প্রহর গুনছে।

চলবে_