#এক_বরষায় [৩১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
_____________
ধারা আর হাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছিল না। বাবার চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। ধারা একটা জিনিস খুব ভালো করেই জানে, বাবা হয়তো মদ খেয়ে কোথাও মাতাল হয়ে পড়ে আছে। রাত দশটার পরেই উনাকে স্বাভাবিক পাওয়া যায় না। কিন্তু কোনোদিন মদ খেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকেনি। তাই ধারার মনে আজেবাজে সব ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। বাবার কাছে টাকাপয়সা তেমন থাকে না। তবুও যদি রাস্তায় ছিনতাইকারী বা চোরছ্যাঁচড়ের হাতে পড়ে। বা তার থেকেও ভয়ঙ্কর কোন কিছু ঘটে। নিজের হুঁশে নেই লোকটা যদি রাস্তায় কোন গাড়ির সামনে এসে যায়। আরও কত দুর্ঘটনাই তো ঘটতে পারে। ধারা আতিফের ঘরের সামনে গিয়ে প্রথমে দরজায় মৃদু শব্দ করে ডাকছে। হঠাৎ ঘুম থেকে জাগিয়ে ছেলেটাকে আতঙ্কে ফেলে দিতে চায় না।
-আতিফ। আতিফ, উঠবে একটু?”
না, ছেলেটার ঘুম ভাঙছে না। ধারার নিজেকে এতটাই অসহায় লাগছে সে কী করবে ভাবতে পারছে না। সে কি একাই বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে? কিন্তু রাত অনেক হয়েছে। ভূতপ্রেতে ভয় না থাকলেও মানুষ হয়ে মানুষরূপী কিছু জানোয়ারকেই যে ভয় করতে হয়। তার উপর গভীর রাতে একা একটা মেয়ে মানুষকে পেয়ে গেলে জানোয়ার গুলো তাদের নিকৃষ্টতম রূপে বেরিয়ে আসবে। ধারা আগের বারের থেকে একটু জোরেই ডাকছে। আতিফের ঘুম ভাঙেনি কিন্তু মুনতাসীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
-ধারা!”
দুই তিন দিন প্রচণ্ড জ্বরের পর হঠাৎ গা কাঁপিয়ে জ্বর ছেড়ে দিলে যেমন হালকা লাগে। ধারার এখন নিজেকে তেমনই লাগছে। তার সব ভয়, সব উদ্বেগ দূর হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, আমি তো একা না। তাহলে এত কেন ভয় পাচ্ছি? দূর থেকে একজন তো সবসময় আমার পাশে আছে। ধারার ভয় চলে গিয়ে অবসাদ নেমে এলো যেন।
ধারা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাসীর ওকে দেখতে না পেয়ে আবার ডাকল।
-ধারা! কী হয়েছে?”
সাথে সাথে কথা বলার মতো জোর পেল না গলায়। ধারা সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে না। তবুও অজানা ভয়ে আজ গলা ধরে আসছে। মুনতাসীর এবার ধারার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-চাচা কি এখনও ফিরেনি?”
না বলতেও মানুষটা কীভাবে বুঝে গেল? ধারার অস্থিরতা এত সহজে কীভাবে টের পেয়ে যায়? দাদী, জেসমিন ওরাও তো ধারার দুশ্চিন্তার কারণ জানে না৷ কিন্তু এই মানুষটা ধারার সাথে ঠিকই জেগে আছে। ধারা অবসন্ন ক্ষীণ গলায় বলল,
-না। বাবা তো কখনও এত দেরি করে না।”
মুনতাসীর ধারার গলা শুনেই বুঝল ধারা কতটা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। এত রাত পর্যন্ত মেয়েটা একা একা বাবার অপেক্ষায় বসে অস্থির হচ্ছে। মুনতাসীর ধারাকে আস্বস্ত করে বলল,
-চাচা হয়তো আশেপাশেই আছে। কোন দোকানে বসে আছে। সময় খেয়াল করেনি। আমি বেরুচ্ছি। চাচাকে নিয়ে ফিরব।”
ধারা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। এখন আর তার ভয় করছে না। মুনতাসীর ঘরে গিয়ে তার মোবাইল ফোন নিয়ে এলো। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ধারার বাবার খুঁজে বেরুতে লাগল। হঠাৎ ধারার কী হলো সে নিজেও হয়তো বলতে পারবে না। একজনকে খুঁজতে পাঠিয়ে আরেকজনকে অজানা কোন বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল। মুনতাসীর গেটের কাছে চলে গিয়েছিল। ধারা পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে বলল,
-দাঁড়ান। আমিও আপনার সাথে যাব।”
মুনতাসীর দাঁড়িয়ে পড়ে ধারার দিকে ফিরে তাকাল। মোবাইলের আলোয় ধারাকে দেখে নিঃশব্দে হাসল। ধারা মুনতাসীরের সাথে যেতে চেয়ে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তবে সে মানুষটাকে একা ছাড়তে পারবে না। মুনতাসীর গলা থেকে হাসির রেশ লুকিয়ে বলল,
-ঠিক আছে।”
ধারা মুনতাসীরের পেছনে হাঁটছে। মুনতাসীর লাইটের আলোয় আশপাশটা দেখে সামনে হাঁটছে। বার কয়েক ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে ধারাকেও দেখছে। কাছে কোথাও ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে শিয়াল ডেকে উঠেছে। অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধতা চেড়া সেই ডাক শুনে ধারার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। অজান্তেই মুখ থেকে করুণ একটা ধ্বনি বেরিয়ে এলো। তাদের বাড়িটা এই পাড়ার মাঝামাঝি। কিন্তু কাছাকাছিই বড় একটা জঙ্গল আছে। সন্ধ্যার পরেই ওখান থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়৷ মাঝে মধ্যে রাতের বেলা এক দুইটা শেয়াল এদিকে চলেও আসে। ধারা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাঁটতে গিয়ে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। তখনই ধারাকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে মুনতাসীর বলে উঠল,
-সামনে চলে আয়। পেছন থেকে শেয়ালে নিয়ে চলে গেলেও আমি কিছু করতে পারব না।”
মানুষটার কন্ঠে সেই তুই ডাক। ধারার সবকিছু উলটপালট করে দেওয়ার জন্য এই একটা ডাকই তো যথেষ্ট। তবুও ধারা দুর্বল হতে পারবে না। তার অনুভূতি মানুষটাকে জানান দেওয়া যাবে না। ধারা পেছন থেকে সামনে আসছে না দেখে মুনতাসীর দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ থেমে যাওয়ায় ধারা মুনতাসীরের পিঠে ধাক্কা খেতে খেতে সামলে নিল। মুনতাসীর গলায় কৃত্রিম বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বলল,
-আমার এক কথা কেন কানে যায় না তোর? আমার সাথে পাশাপাশি হাঁটলে জাত যাবে তোর?”
ধারা তর্কে যাবে তো দূর কোন জবাবই দিচ্ছে না। রাতের বেলা এরকম মাঝপথে দাঁড়িয়ে তর্ক করার কোন মানে নেই। মুনতাসীরের কপালে এবার সত্যিই বিরক্তির রেখা দেখা গেল। একদিন না একদিন এর সব ঘাড়ত্যাড়ামি ছুটিয়ে দিবে ও। তবেই তার নাম মুনতাসীর থাকলে। ধারার ঘাড়ত্যাড়ামি ছুটাতে না পারলে নাম পাল্টে ফেলবে। ধারা মুখে কুলুপ এঁটে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে দেখে মুনতাসীরের মাথায়ও একটা শয়তানি উঁকি দিল। সে ধারাকে ভয় দেখাতে গলায় আতঙ্ক এনে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
-তোর পেছনে শেয়াল!”
ধারা ভয় পেয়ে বাবাগো বলে শুধু মুনতাসীরের কাছেই চলে এলো না, বরং ওর একটা হাতও আঁকড়ে ধরল। ধারা এখনও চোখ বন্ধ করে আছে। মুনতাসীর ওর সাথে এরকম বাজে একটা মজা করবে এটা ভাবতেও পারেনি বেচারি। সত্যি সত্যিই শেয়াল এসেছে ভেবে মুনতাসীরের হাত খামচে ধরে থরথর করে কাঁপছে। সাহসী ধারার এই ভীতু রূপ দেখে মুনতাসীর শব্দ করে হেসে ফেলল। ওর হাসির শব্দে ধারা চোখ খুলে ওর দিকে তাকাল। মুনতাসীর হাসতে হাসতেই ওর হাত ধরে রাখা ধরার হাতের দিকে ইশারা করে বলল,
-প্রথমে তো পাশাপাশি হাঁটতেও আপত্তি। আর এখন?”
ধারা নিজেও দেখল সে মুনতাসীরের হাত ধরে রেখেছে। এটা যেন মুনতাসীরের হাত না কোন কারেন্টের তার ধরে ফেলেছে এরকম ভাবে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। ওর এমন কাণ্ড দেখে মুনতাসীর হো হো করে হেসে ফেলল। ধারা রেগেমেগে আগুন হয়ে চোখের দৃষ্টি দিয়ে মুনতাসীরকে ভস্ম করতে দিতে চাচ্ছে। একটা মানুষ কতটা বদ হলে এভাবে মানুষকে ভয় দেখায়? মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই পেটে পেটে যে এত শয়তানি! ধারা ভয় পেয়ে সত্যি সত্যিই যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলত তখন? নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল সে। তখন আর কি? হিরো সেজে তাকে কোলে তুলে নিয়ে পাড়ার মহিলাদের তাদের নিয়ে ফুসুরফাসুর গল্প বানানোর সুযোগ করে দিত। মুনতাসীরের মুখ থেকে তখনও হাসি মিটেনি।
-এমন ভাবে লাফালি যেন আমাকে ছোঁয়াতে কারেন্ট লেগেছে। আমি কি কারেন্টের খুঁটি? তোকে শক দিয়ে মেরে ফেলব!”
ধারা কোন জবাব দিল না। রেগেমেগে আগে আগে হাঁটতে লাগল। মুনতাসীর পেছন থেকে বলল,
-দেখেশুনে হাঁট। নয়তো সত্যি সত্যিই শিয়াল পা কামড়ে ধরে জঙ্গলে নিয়ে চলে যাবে।”
শিয়াল কাটু, কুকুর তাড়া করুক এমনকি বাঘ এসে খেয়ে ফেলুক। তবুও ধারা আর এই ইতর লোকের সাথে যাবে না। একাই বাবাকে খুঁজবে সে। কারো সাহায্য লাগবে না। এমন একটা সময়েও মজা করার মানসিকতা কোত্থেকে আসে মানুষটার!
বাবাকে খুঁজতে ওদের বেশি দূর যেতে হলো না। সামনে থেকে দুই জন লোক ধারার বাবাকে ধরে নিয়ে আসছে। উনি লোক দু’জনের কাঁধে দুই হাতে ধর দিয়ে টালমাটাল অবস্থায় হেঁটে আসছেন। আর কাউকে উদেশ্য করে বিশ্রী বিশ্রী সব গালাগাল দিচ্ছেন। বাবার গলা শুনেই ধারা বুঝে গেল বাবা আজ পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছে। তাই একা বাড়ি ফিরতে পারছিল না। এই মুহূর্তে বাবার উপর ধারার রাগ হলেও এগিয়ে গেল সে। উনি উচ্চ স্বরে প্রায় চিৎকার করে বলছেন,
-ওই বে*** মা** আমার মেয়েদের জীবন নষ্ট করেছে। ওই বাজারের মহিলা আমার জীবনটাও ছারখার করে দিয়েছে। শালি কোনোদিন সুখী হতে…
কথাগুলো সব জড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই কেউই স্পষ্ট করে কিছু বুঝলো না। মদের গন্ধে ধারা বাবার কাছে যেতে পারছে না। বাবার মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ আসছে। ধারা সহ্য করতে না পেরে নাক চেপে ধরল। তিনি হুঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে নিলে মুনতাসীর ধরে ফেলল। লোকজন এই পাড়ারই। বাবাকে চেনে। মেয়ের সামনে বাপের এহেন আচরণে একজন লোক ধমকে উঠে বলল,
-থামো মিয়া। একটা কথা কইও না তুমি। কয়দিন পর মাইয়া বিয়া দিবা এইডা কি তোমার এইসব করার বয়স!”
মেয়ের বিয়ের কথা শুনে তিনি হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে লাগলেন,
-আমার মেয়েরা আমার জীবন। আমার ধারা মা,, ওরে আমি একটা ভালো ছেলের হাতে…
বাবা নেশার ঘোরে কী কী বলে যাচ্ছে নিজেও জানে না। ধারা দু’জন লোককে বলল,
-চাচা আমরা বাবাকে নিয়ে যেতে পারব। রাত অনেক হয়েছে চাচা। আপনারা বাড়ি ফিরে যান। ধন্যবাদ চাচা। বাবার জন্য আপনারা কষ্ট পোহালেন।”
একজন লোক ধারার বাবার থেকে বয়সে কিছু বড়ই হবে। তিনি লজ্জিত ভাবে হেসে বললেন,
-মা গো, তোমার বাবা মানুষ খারাপ না এইটা আমরা জানি। ওর খালি এই একটাই দোষ। মা গো, বাপের উপর রাগ কইরো না মা।”
ধারা ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে মাথা কাত করল। উনারা চলে গেলে বাবার সমস্ত ভার মুনতাসীর নিয়ে নিল। ধারা শুধু বাবাকে ধরে রেখেছে। তিনি এখনও চুপ করেননি। জড়ানো গলায় বলে চলছেন,
-আমার মেয়ে দুইটার কোন দোষ নাই। ওরা তো ছোট মানুষ। ওদের মা, না না। ওই বাজারের মেয়েমানুষটা…
ধারা কঠিন গলায় বাবাকে ধমক দিয়ে থামাতে চাইল। মুনতাসীরের সামনে এসব কথা উঠে আসুক তা ধারা চায় না। মুনতাসীর মেহমান হিসেবে এসেছে মেহমান হয়েই থাকুক।
-বাবা তুমি চুপ করবে?”
তিনি ফের বাচ্চাদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নাক টানতে টানতে বললেন,
-কেন রে মা? তোরা তো কোন দোষ করস নাই। ওই মহিলার পাপের শাস্তি তোরা কেন ভোগ করবি। অনেক ভালো একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিব। তুই আমার জান মা। তুই জীবন অনেক সুখী…
এই মুহূর্তে ধারার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। বাবা কেন এসব কথা বলছে এখন? ধারা আড়চোখে মুনতাসীরকে দেখল। মুনতাসীরের চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। সে যেন কথাগুলো শুনছেই না। ধারা লজ্জায় অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গিয়ে বাবাকে কড়া গলায় বলল,
-বাবা প্লিজ চুপ করো। বাড়ি চলো তুমি।”
মেয়ের ধমকে বা অনুরোধে তিনি কী বুঝলেন কে জানে। আর কোন কথা বললেন না। তবে নিজে নিজে বিড়বিড় করে এখনও কিছু বলছে। ধারা মুনতাসীরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার শক্তিটুকু পেলো না। কেনই যেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। ওদের জীবনটা কেন এরকম হলো?
চলবে_
#এক_বরষায় [৩২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
______________
বাবার উপর ধারার এক আকাশ সমান অভিমান করতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় আজ থেকে আর বাবার সাথে কথা বলবে না৷ কিন্তু দিন শেষে বাবার একাকিত্ব ধারা ছাড়া আর কেউ হয়তো বুঝে না। বাবা কেন ওই মানুষটাকে এতটা ভালোবেসেছিল? কেন এতগুলো বছরেও ওই মহিলাকে ভুলতে পারেনি? এখনও কেন প্রতিরাতে মদ খেয়ে এসে ওই মহিলাকে গালাগালি করে? ভালোবেসেছিল বলেই এখনও ওই মহিলার দেওয়া ধোঁকা মনে রেখেছে। বাবা আসলে মানুষটাকে কখনও ঘৃণা করতে পারেনি। বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় ধারার। মানুষটা নিজের আপন দু’জন মানুষের থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বেইমানীর স্বীকার হয়েছে। এতগুলো বছরেও বাবার সেই ক্ষত ভরে উঠেনি। ধারা খুব করে চায় এই জীবনে যেন একটি বার সেই মানুষ দু’টির সাথে তার দেখা হয়ে যায়৷ ধারা ওই লোকটাকে কিছুই বলবে না। শুধু তার গর্ভধারিণীকে একটা প্রশ্নই করবে। আমার বাবা, আমাদের দুই বোনের সাথে কেন এমন করলেন আপনি? তার এই একটা প্রশ্নের জবাব চাইবে সে। তার বাবার ভালোবাসায় কিসের কমতি ছিল? কেন মানুষটার বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভরসা নিয়ে এভাবে খেলা করলো?
ধারা ভার্সিটি যাবার জন্য তৈরি হতে হতে অন্যমনস্ক হয়ে কথাগুলো ভাবছে। অনেকগুলো ক্লাস মিস হয়েছে। পরীক্ষার ডেটও নাকি জানিয়ে দিয়েছে। এমনিতেও বাড়ির কাজ, টিউশনি এসব করে তার পড়াশোনা তেমন হয়ে উঠে না। তবুও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে। জেসমিন ঘরে এসে কোন গোপন কথা জানতে চাওয়ার মতো ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল,
-আপু বাবা কি কাল রাতেও মদ খেয়ে মাতলামি করেছে?”
সেই রাতে চড় মারার পর রাগ করে জেসমিন ধারার সাথে দুই দিন কথা বলেনি। পুরো একটা দিন না খেয়ে থেকেছে। আজ নিজে থেকেই বোনের সাথে কথা বলতে এসেছে। ধারাও সব ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-এটা আর নতুন কী?”
জেসমিনের মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। বাবার উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট সে। একটা কারণেই মাঝে মাঝে বাবাকে অসহ্য লাগে ওর। একটা মানুষ কত মদ খেতে পারে! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে। বাবা কি একটা বারও ভাবে না ঘরে দুই মেয়ে আছে। এদেরকে বিয়ে দিবে কীভাবে? মদখোর বাপের মেয়েদের কি ভালো ঘরে বিয়ে হবে?
-বাবা কেন এমন করে! কী এত দুঃখ উনার যে মদ খেয়ে দুঃখ ভুলতে হবে। আমাদের কথা কি বাবা একবাও ভাবে না?”
ধারা বোনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চাপল। ভাবল, বাবার দুঃখের কারণ তোর অজানাই থাক। আমাদের ছোটবেলার সেই জঘন্য, নোংরা, বিষাদময় স্মৃতিটা তোর মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালোই হয়েছে। এত বছরেও তোকে কিছু জানতে দিইনি। ভবিষ্যতেও দিব না। তোর মনটা যে ভীষণ কোমল। সহ্য করতে পারবি না তুই। তোর জন্য ছোটবেলায় তোর মা মারা গেছে। আর আমার জন্য ওই মহিলা বেঁচে থাকলেও মৃতই।
জেসমিন বোনের থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আরও বলছে,
-মা’র দুঃখে কি বাবা মদ ধরেছিল? মা মারা যাবার পরই কি বাবার এই বদঅভ্যেস ধরেছে? পৃথিবীতে কত মানুষেরই তো বউ মরে। তাই বলে কি সবাই মদখোর মাতাল হয়ে যাবে!”
ধারা এই বিষয়ে কোন কথা বলতে চায় না। সে রেডি হয়ে গেছে। জেসমিনকে এখনও কলেজের জন্য রেডি হতে না দেখে বলল,
-তুই আজ কলেজে যাবি না?”
-না। পেট ব্যথা।”
-ওহ। ঠিক আছে। তাহলে শুয়ে থাক।”
-বাবা দেখেছি মাথায় হাত দিয়ে কলতলায় বসে আছে। মনে হয় কাল একটু বেশিই খেয়েছে। আমার কিন্তু রাগ উঠছে। বমি করে উঠোন ভাসিয়ে রেখেছে। ওসব কে পরিষ্কার করবে?”
কথা ক’টা বলতে বলতে জেসমিন নিজেও ঘেন্নায় বমি করে দিতে চাইল। তার আর এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। কবে যে আপুটার বিয়ে হবে! আপুর বিয়ের পরপরই দাদীকে বলবে তাকেও যেন বিয়ে দিয়ে দেয়। মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে তো কথা বলেছিল সে। ব্যাটা ভেজা বেড়াল তার বাপকে খবর দিতে এত দেরি করছে কেন? নাকি তার বোনকে পছন্দ না। পছন্দ তো অবশ্যই। হতে পারে তার বাবার এসব কীর্তি দেখে মন ঘুরে গেছে। না না। জেসমিন ঝট করে উঠে দাঁড়াল। বাবা যা-ই করুক এতে তো তার বোনের কোন দোষ নেই। মুনতাসীর ভাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
****
ধারাকে দেখে নয়ন দোকান থেকে উঠে এলো। আজ ধারা ভার্সিটি যাবে জানত না নয়ন। ধারা নয়নকে দেখে স্বভাবসুলভ মৃদু হাসল। নয়ন ধারার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল,
-পায়ের ব্যথা গেছে?”
-হু।”
-রিকশা লাগবে, না।”
ধারা হু না কিছু বলল না। কারণ নয়ন ভাই জানে সে রিকশায় করে যাবে। এখন যদি সে না-ও করে তবুও নয়ন ভাই রিকশা ডেকে দিবে। আজ এদিকে কোন রিকশার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। নয়ন রাসেলকে ফোন করল।
-এদিকে একটা রিকশা পাঠা তো জলদি। পাঁচ মিনিটের ভেতরে পাঠা।”
ধারা জিজ্ঞেস করল,
-রোজী আপা চলে গেছে নয়ন ভাই?”
-হুম। গতকাল গেল।”
-ওহ।” ইদানীং ধারার নিজের পারিবারিক সমস্যা গুলো এত বেড়ে গেছে ও রোজী আপাকে দেখতে যেতে পারেনি।
নয়ন ধারাকে কিছু বলবে বলবে করছে। কিন্তু কথাটা কীভাবে বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না। আবার ধারাকে না বলেও শান্তি পাচ্ছে না। পেটে কেমন পাক খাচ্ছে। ধারা নয়নকে লক্ষ করে বলল,
-কিছু বলবেন নয়ন ভাই?”
-হু? হু হু।”
ধারার ঠোঁটে আজকের দিনের প্রথম হাসি দেখা গেল। হেসে হেসেই বলল,
-কী হু হু করছেন? আচ্ছা আপনার আমাকে কোন কিছু বলার হলে এত ভয় পান কেন? আমি কি অনেক বেশি রাগী?”
-তুই রাগী না। তবুও আমি তোকে ভয় পাই।”
-ভয় পাবেন কেন! আজব তো। আমি তো আপনাকে ধমকাবো না বা বকা দিব না।”
-তারপরও…
-আচ্ছা কী কথা বলবেন বলবেন করেও পেটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন ঝটপট বলে ফেলুন। রিকশা এসে গেলে আমি আর দাঁড়াব না।”
নয়ন এই পনেরো ষোল দিনের ঘটে যাওয়া সব কথা ধারাকে বলে দিব। রোজ রাতে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসা। ওপাশের মানুষটার কিছু না বলা। নয়ন ধারাকে নিয়ে কী ভাবে সব জানানোর পরও কল আসা বন্ধ না হওয়া। সব বলে দিল। ধারা সব শুনে চোখ ঘুরিয়ে ভাবছে। তারপর বলল,
-আপনি আমাকে সব কথা বলে দিলেন কেন?”
-তুই জানলে আমার তো কোন সমস্যা নাই।”
-আপনার নাই। কিন্তু যে কল করছে তার থাকতে পারে।”
-তোরে নিয়ে যাদের সমস্যা থাকবে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।”
ধারা সন্তপর্ণে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সব পাগল তার কপালে জুটেছে।
-হু। কিন্তু মানুষটা কে? আমার মনে হচ্ছে এটা কোন মেয়ে। আমার আরও কী মনে হচ্ছে জানেন? মেয়েটা যেভাবেই হোক আপনাকে চিনে। আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানে। এবং মেয়েটা আপনাকে পছন্দ করে।”
-দূর।”
নয়ন এই সহজ হিসেবটাও এতদিন ধরে মিলাতে পারছে না। এখন ধারা মিলিয়ে দিয়েছে তবুও বিশ্বাস করতে পারছে না।
-বিশ্বাস করছেন না তো! না করুন। কিন্তু আমার এমনটাই মনে হচ্ছে।”
-তাহলে এখনই আমি মেয়েটার নাম্বার ব্লক করে দিচ্ছি।”
ধারা অবাক হওয়া গলায় বলল,
-ওমা! কেন?”
-এমনি। আমার এসব লাগবে না।”
ধারা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল,
-নয়ন ভাই, কাউকে ভালোলাগা বা ভালোবাসা অপরাধ না। আপনার যেমন যে কাউকে ভালোবাসার অধিকার আছে। তেমনি অন্য একজনেরও আপনাকে ভালোবাসার অধিকার আছে। আসলে ভালোবাসা জিনিসটা এমনই। আমরা তো এখন বন্ধু নয়ন ভাই। এমন বন্ধু হয়েই নাহয় সারাজীবন থাকব। আমাকে নিয়ে আপনার যা অনুভূতিই হোক না কেন, আমি আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি। কিন্তু আপনি যদি আমার জন্য জীবনে আগে চলতে না পারেন তাহলে কিন্তু আমি এই বন্ধুত্বটাও রাখতে পারব না। আমি না বললেও আপনি যেমন আমার সব প্রয়োজনে পাশে থাকেন, আমিও একজন বন্ধু হয়ে আপনার পাশে থাকার চেষ্টা করব। এর বেশি কোনোকিছু আমরা কেউই আশা করব না, কেমন?”
*****
ধারা বাড়ি ফিরে জেসমিনের থেকে জানতে পারলো মুনতাসীর নিজের বাড়ি গেছে। হঠাৎ করে ওর এই যাওয়ার কারণ ধারা না বুঝলেও জেসমিন মনে মনে খুশিতে বাক-বাকুম করছে। মুনতাসীর ভাই তার আর আপুর বিয়ের কথা আগানোর জন্য তার বাবাকে আনতে গেছে। মুনতাসীর ভাই ফিরে এলেই আপুর বিয়ে হয়ে যাবে। জেসমিন এখন থেকেই দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছে। কবে মুনতাসীর ভাই ফিরবে।
আপুর আড়ালে আতিফের সাথে এনিয়ে আলাপ আলোচনাও করে ফেলেছে।
-মুনতাসীর ভাই ওর বাবাকে আনতে গেছে। ওর বাবা এসে আপুর আর মুনতাসীর ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে আমার বাবার সাথে কথা বলবে।”
-তোমাকে কে বলেছে?”
-আমি জানি। খবরদার আতিইফার বাচ্চা। এই কথা যেন আপুর কানে না যায়।”
-যাবে না। কিন্তু ধারা আপু কি রাজি হবে?”
-কেন হবে না? ও হবে সাথে ওর বাপও হবে। বাবা এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করবে নাকি!”
****
মুনতাসীরের দুই দিনের মধ্যে ফিরে আসার কথা থাকলেও এক সপ্তাহেও সে ফিরছে না। জেসমিন অস্থির হয়ে পড়েছে। মুনতাসীর ভাই কোথায় গেল? বাবার মোবাইল দিয়ে মুনতাসীর ভাইকে ফোনে ধারার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনভাবেই মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। একা জেসমিনই মুনতাসীরের না ফেরায় এতটা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বাকিরা মুনতাসীরের জন্য চিন্তা করলেও কেউ জেসমিনের মতো অধৈর্য হয়নি। দাদীর কথা, ছেলেটা বাড়ি গেছে কয়টা দিন থেকে ফিরুক। এমন তো না যে আর ফিরবে না। জেসমিন বোনের সাথে মুনতাসীর ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারল না। ধারার আচরণে মুনতাসীরের জন্য কোন ভাবনা প্রকাশ পেল না। সে যে এই বাড়িতে কখনও ছিল এটাও যেন ধারার মনে নেই। উপরে উপরে ধারা এমনটা দেখালেও তার ভেতরে কী চলছে তা কেউ জানে না।
এর মাঝেই একদিন আরেকটা বড় ঘটনা ঘটল। সবার জন্য ঘটনাটা ছোট এবং স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু জেসমিনের জন্য এটা একটা বোম ফাটার মতো ঘটনা। এক সন্ধ্যায় আপুর এক ছাত্রের মা তার ভাইকে নিয়ে জেসমিনদের বাড়িতে হাজির। এই ছেলেটাকেই একদিন তাদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখেছিল। তার কাছে তার বোনের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। জেসমিন তো ছেলেটাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই ছেলে তাদের বাড়ি চিনলো কীভাবে? ছেলের বোনের ভাবসাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন মতলবে এসেছে ওরা। মহিলার ভাইয়ের অবস্থা এমন, আপুকে দেখে বলদটা এত বড় হাঁ করে তাকায় ওই সময় মুখের ভেতর মশা মাছি তেলাপোকা ঢুকে গেলেও খোঁজ পাবে না। বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিল। মহিলা বাবাকে কথার প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে প্রায়। জেসমিন মুনতাসীর ভাইয়ের কথা ভেবে দিশাহারা হয়ে দাদীর কাছে ছুটে গেল।
-ও দাদী তুমি ওই মহিলা আর তার ভাইকে ঝাঁটা মেরে বিদেয় করো। আপুর বিয়ে এখানে হতে পারবে না। আপুর বিয়ে হয়ে গেলে মুনতাসীর ভাইয়ের কী হবে? নয়ন ভাই, মুনতাসীর ভাই ওদেরকে মাঠের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে মাঝখান থেকে এই ছেলেটা আপুকে বিয়ে করে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাবে!”
চলবে_