#এক_বরষায় [৩৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
_______________
উঠোন থেকে বৃষ্টির পানি নেমে গেলেও এখনও কাদা হয়ে আছে। মুনতাসীর লাগেজ হাতে সাবধানে জায়গাটা পেরিয়ে এলো। শেষ বারের মতো পেছনে তাকালে দেখতে পেল একজোড়া চোখ কতটা আকুল হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসীর গেটের কাছে থাকতেই জেসমিন পেছন থেকে দৌড়ে এলো।
-মুনতাসীর ভাই! মুনতাসীর ভাই দাঁড়ান।”
মুনতাসীর ফিরে তাকাল। জেসমিনের পায়ে এমনকি সালোয়ারেও কাদা লেগে গেছে। মুনতাসীর ওকে সাবধান করে দিয়ে বলল,
-আস্তে আসো। পড়ে যাবে।”
জেসমিন মুনতাসীরের সামনে এসে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
-আপনি কি সত্যিই চলে যাচ্ছেন মুনতাসীর ভাই?”
মুনতাসীর হেসে জবাব দিল,
-হুম।”
-কেন? আমাদের বাড়িতে কি আপনার ভালো লাগছে না? কেন যাচ্ছেন মুনতাসীর ভাই?”
-আমি তো তোমাদের বাড়িতে মেহমান হয়ে এসেছিলাম জেসমিন। আমাকে তো একদিন না একদিন যেতেই হতো। চার/পাঁচ মাস তো থেকেছি। আর কত থাকব বলো? তাছাড়া এখন তো তোমাদের একটা ঘরের প্রয়োজন পড়বে।”
জেসমিন অবুঝের মতো বলল,
-কেন?”
-তোমার আপুর বিয়ে হলে ওর ঘরটা কি ওর লাগবে না! আমি ওর ঘর দখল করে রাখলে বর নিয়ে বেচারি কোথায় থাকবে?”
জেসমিন আশাহত হয়ে মুনতাসীরকে দেখছে। কোথায় ভেবেছিল মুনতাসীর ভাই তার দুলাভাই হবে। এখন কোথাকার এক চোর তার দুলাভাই হচ্ছে। এই চোর নয়ন ভাই, মুনতাসীর ভাইয়ের থেকে তাদের ভালোবাসা চুরি করে নিচ্ছে।
-আপুকে তো আপনিও পছন্দ করেন মুনতাসীর!”
-পছন্দ করাটাই সব না জেসমিন। ভাগ্যে থাকাটাই আসল।”
জেসমিনের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তবুও কান্না চেপে বলল,
-চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই।”
-ঠিক আছে চলো।”
মাগরিবের আজান এখনও হয়নি। তবুও আবহাওয়ার কারণে এখন সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। দুপুর থেকে টানা বৃষ্টি হয়েছে। রাতেও একদফা হবে মনে হচ্ছে। মেঘেরা এখনও গুড়ুম গুড়ুম করে ডাকছে। আজকের দিনে মুনতাসীর ভাই না গেলেই পারতো। কিছু দূর এসে মুনতাসীর বলল,
-আর যেতে হবে না। তুমি এখন ফিরে যাও জেসমিন।”
জেসমিনের চোখ ছলছল করে উঠল। কাল সকালে কার সাথে কলেজে যাবে সে? ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।
-মুনতাসীর ভাই, আপনি কি আর কোনোদিন আমাদের বাড়িতে আসবেন না?”
মুনতাসীর হেসে জবাব দিল,
-আসব না কেন!”
-আজ গিয়ে কোথায় থাকবেন আপনি? বাড়ি ওয়ালা নিশ্চয় বিছানা বালিশ দেয়নি।”
-হু, আজ সারাদিনে নিজে সব কিনেছি। কাল তুমি গিয়ে দেখে এসো আর কী কী লাগবে। তারপর তোমাকে সাথে নিয়ে বাকি জিনিস কিনব।”
-রান্না কে করে দিবে? আপনি খাবেন কী?”
-ভাত ডিম ভাজি এটুকু নিজে করে নিতে পারব।”
-প্রতিদিন কি ভাত আর ডিম ভাজি খেয়েই থাকবেন?”
-কাজের লোক রাখতে হবে একটা। প্রথম কয়েকদিন একটু অসুবিধা হবে।”
-অথচ দেখুন আমার আপুকে বিয়ে করে নতুন বাসায় উঠলে আপনার কোন সমস্যাই হতো না। আপু একা হাতেই সব গুছিয়ে নিতে পারত।”
-কিন্তু তোমার আপু তো আমাকে বিয়ে করবে না।”
-কাল সকালে আমি কার সাথে কলেজে যাব মুনতাসীর ভাই?”
জেসমিনের গলা ধরে এসেছে। মুনতাসীর এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখল। এই কয়দিনে জেসমিনের উপরই হয়তো তার সবথেকে বেশি মায়া পড়েছে। মেয়েটা একদম সহজসরল। মনের মধ্যে কোন রাখঢাক নেই।
-জেসমিন আমি তো দূরে কোথাও যাচ্ছি না। এইতো এখান থেকে সাত/আট মিনিটের পথ। আমি রাস্তায় নাহয় তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।”
-আপনি আমাদের বাড়িতে থেকে গেলেই পারতেন।”
*****
দূর দূরান্তের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। জেসমিন বাড়ি ফিরে পায়ে লেগে থাকা কাদা ধুতে কলপাড়ে গেলো। এক হাতে কল চাপছে অন্য হাতে সাদা সালোয়ারে লেগে থাকা কাদা পরিষ্কার করছে। বারান্দায় উঠে বোনের মুখোমুখি হলো। জেসমিন ধারাকে দেখেও কিছু বলল না। মুনতাসীর ভাই এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সব দায় জেসিমন বোনের উপরই চাপাচ্ছে। বারান্দায় টানানো দড়ি থেকে গামছা নিয়ে হাত মুখ মুছছে। ধারা মুনতাসীরের কথা কীভাবে জিজ্ঞেস করবে ভেবে পাচ্ছে না। ধারা এখান থেকে যাচ্ছে না দেখে জেসমিন চেতে উঠে বলল,
-তোমার ঘর খালি হয়েছে। এবার তো খুশি হয়েছ? আপদ বিদেয় হয়েছে! তোমারই তো খুশি হওয়ার দিন আজ।”
পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মেয়ে আছে ওরা ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। ধারাও সেই শ্রেণীতে পড়ে। মুখে কাঠিন্য এনে বলল,
-তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি উনাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছি! উনি এসেছিলেন নিজের ইচ্ছায়৷ গিয়েছেনও নিজের ইচ্ছাতেই। উনি চলে যাওয়াতে তুই আমাকে অপরাধী বানাচ্ছিস কেন?”
বোনের কথা শুনে জেসমিন কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার বোনটা কি সত্যিই এত গাধা! মুনতাসীর ভাই ওকে পছন্দ করে এটা সে বুঝতে পারছে কিন্তু তার বোন পারছে না! এতদিন মুনতাসীর ভাই তাদের সাথে ছিল। এখন চলে যাওয়ায় কি আপুর নূন্যতম কষ্টও হচ্ছে না! কী পাষাণ দুনিয়া! দুনিয়ার মানুষ গুলো তার থেকেও বেশি পাষাণ। জেসমিন রেগে গিয়ে বোনকে আরও অনেক কিছু বলতে পারতো। কিন্তু এই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীকে কিছু বলাই বেকার।
-বোন তুমি মহান। তোমাকে কিছু বলে আমি পাপ করেছি। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করতে হবে আমাকে বলে দাও। নাকে খত দেব? নাকি কান দু’টো কেটে ফেলব?”
ধারা নিজের ঘরে ফিরে এলেও সে এই ঘরে থাকতে পারছে না। ঘরের প্রতিটা জিনিসে মুনতাসীরের স্পর্শ অনুভব করছে। মুনতাসীর এখানে নেই তবুও প্রতিটা সেকেন্ডে তার উপস্থিতি অনুভব করছে। ধারা পড়ার টেবিলে বসলে তার মনে হচ্ছে মুনতাসীর বিছানায় বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি দরজা ঠেলে মুনতাসীর ঘরে ঢুকে পড়বে। বিছানায় শুতে গিয়েও ধারার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল। মুনতাসীরের গায়ের নিজস্ব পুরুষালী ঘ্রাণ বালিশে চাদরে মিশে আছে। বালিশে মাথা রেখে ধারার মনে হলো সে মুনতাসীরের বুকে মাথা রেখেছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল ধারা। কীভাবে কি থাকা যায়? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে ধারা বলছে,
-কী হচ্ছে এসব আমার সাথে! কেন হচ্ছে? বারবার কেন ওই মানুষটার কথা মনে করছি আমি! এরকম হতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। আপনি বাড়ি থেকে চলে গিয়েও কেন আমার মন থেকে যাচ্ছেন না? কেন আপনার কথা ভাবছি আমি?”
*****
পরের দিন ধারা ভার্সিটি যাবার জন্য রেডি হচ্ছিল। বাবা তার ঘরের সামনে এসে ডাকল। সচারাচর বাবা তার দুই মেয়েদের ডাকেন না। দরকারি কথা ছাড়া বাবা মেয়ের মাঝে আর কোন কথা হয় না তেমন। ধারা বাবার ডাকে সাড়া দিল।
-হ্যাঁ বাবা।”
-ভার্সিটিতে যাচ্ছ?”
-হুম।”
শরিফুল ইসলাম আমতা আমতা করছেন। মেয়ের সাথে কথা বলার সময় তিনি ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যান। এমনটা হওয়ার কিন্তু কোন কারণ নেই। তিনি মেয়ের বাবা। মেয়েকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। ধারা বাবাকে ইতস্তত করতে দেখে নিজেই বলল,
-কিছু বলবে?”
-সাদাফ আসবে। আজ যদি ভার্সিটিতে না যেতে।”
কথাটা বলার সময়ও তার মনে হচ্ছে সে মেয়ের কাছে ভীষণ অন্যায় কোন আবদার করে ফেলছে। ধারা বাড়িতে না থাকলে সাদাফ এসে কি খালি বাড়ি থেকে ঘুরে যাবে? ছেলেটা হয়তো ধারার সাথেই দেখা করতে আসছে। ধারা বড় করে দম ফেলল।
-ঠিক আছে।”
বাবা চলে গেলে ধারা হিজাব খুলে ফেলল। বিয়েটা সে করতে চায় কি-না তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সবকিছু যেন আপনাআপনিই হয়ে যাচ্ছে। তার হাতে কিছুই নেই। ওই ছেলেটাকে সহ্য করতে হবে ভাবতেই ধারার মন তেতো হয়ে গেল। পড়ার টেবিলের উপর চোখ গেলে দেখতে পেল মুনতাসীর তার বই ফেলে রেখে গেছে। ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
*****
সাদাফ রাস্তায় পা রাখতেই তার আরও অনেক পেছনে দু’জন লোক তাকে অনুসরণ করতে লাগল। ওরা সাদাফের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাঁটতে। যাতে ধরা পড়ে না যায়। সাদাফ জানতেও পারল না দুই দিন ধরে দুইটা ছেলে তাকে ফলো করছে। তার প্রতিটা গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। পারভেজ হাঁটার গতি বাড়িয়ে ওদের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনলে রাসেল ওর মাথার পেছনে চটাস করে এক চড় বসালো।
-গাধার বাচ্চা! এত কাছে গেলে ধরা পড়ে যামু না। ভাই কী কইছিল মনে নাই? ধরা পড়লে পিঠের চামড়া তুলে নিবে। দূর থেকে নজর রাখতে বলছে শুধু।”
চড় খেয়ে পারভেজ খেঁকিয়ে উঠতে গিয়ে আশেপাশে লোকজন তাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে কিছু বলল না। রাসেল সামনে দেখে বলল,
-ব্যাটার ভাবসাব দেখ, যেন কোন দেশের রাজার ছেলে। ফকিন্নির পোলা দুইটা দিন ধইরা ঘুরাইতাছে। সন্দেহজনক কিছু কর ব্যাটা। নইলে বিয়াটা ভাঙমু ক্যামনে?”
পারভেজ বলল,
-এই হালার কুকীর্তি ফাঁস কইরা বিয়া ভাঙতে হইব? বিয়ার দিন তুইলা নিয়া গেলেই তো ঘটনা ঘইটা যাইব।”
-ভাই তার শ্বশুররে খুশি করতে চায়। তাই তো এই প্যারা লইতে হইতাছে। নইলে আমিও তোর মতোই ভাবছিলাম। এই হালারে তোলা আমার বাম হাতের কাজ।”
-হালা সিএনজিতে উঠছে। হারাইয়া ফেলার আগে চল চল। পিছা করতে হইব।”
******
মুনতাসীর ক্লাস শেষ করে বাইরে আসতে পেছন থেকে জেসমিনের ডাক শোনা গেল।
-স্যার! স্যার…
মুনতাসীর দাঁড়াল। জেসমিন দৌড়ে এসে হেসে বলল,
-মুনতাসীর ভাই, আজ কিন্তু আপনার নতুন সংসার দেখতে যাব। ছুটির পরে আমার জন্য দাঁড়াবেন।”
-ঠিক আছে।”
-সকালে কী খেয়েছেন?”
সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মুনতাসীর কিছু খায়নি। নতুন বাসায় কোনোকিছুই ঠিক করে উঠতে পারছে না। রেঁধে খাওয়ার জন্য কিছুই নেই। বাজারও তো করা হয়নি। তারপরও হেসে বলল,
-দুইটা আইটেমই তো পারি।”
-ভাত ডিম ভাজি! ইশ, দাদী এইজন্যই এত চিন্তা করছিল। আর কিছু রাঁধতে পারেন না? ইউটিউবে তো সব আছে। দেখে দেখেও পারবেন না!”
-এখনও সবকিছু কেনা হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ছুটির পরে মুনতাসীর জেসমিনের জন্য দাঁড়ালেও জেসমিন বলল,
-মুনতাসীর ভাই, এখন যাব না। আপনার বাসাটা ঠিক কোথায় পড়েছে আমাকে বলে যান। আমি বিকালে আসব।”
জেসমিন কলেজ থেকে ফিরে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে কলেজ ড্রেস না ছেড়েই রান্নাঘরে চলে গেল। বেচারা মুনতাসীর ভাই, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল না খেয়ে আছে। তবুও কেমন মিথ্যা বলল! একটা মানুষ হোটেলের খাবার কয়দিন খেতে পারবে! না, সে নিজেই একটা রান্নার মানুষ ঠিক করে দিবে। ধারা দরজার সামনে থেকে উঁকি দিয়ে আকাশ থেকে পড়ল। আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে! জেসমিন কলেজ থেকে ফিরে রান্নাঘরে এসে রান্না করছে! ধারা গলা খাঁকারি দিল। জেসমিন ওদিকে না ফিরেই মুরগী কাটতে বসে গেল। ধারা ভেতরে এসে বলল,
-দুপুরের রান্না করে রেখেছি। আবার এসব করছিস কেন তুই?”
-আমার জন্য না। মুনতাসীর ভাইয়ের জন্য। বেচারা আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর থেকে না খেয়ে আছে। আজ কলেজে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল।”
ধারা এবার উদ্বিগ্ন হলো। বিচলিত কন্ঠে বলল,
-সত্যি বলছিস তুই!”
-মিথ্যা বলে আমার কী লাভ? আর যদি মিথ্যাই বলতাম তাহলে কি কষ্ট করে রান্না করে মুনতাসীর ভাইয়ের জন্য নিয়ে যেতে চাইতাম?”
কথা বলতে বলতে অসাবধানতায় বটিতে জেসমিনের আঙুল লেগে গেছে। সামান্যই কেটেছে। তবুও রক্ত দেখে জেসমিন ফিট খেতে চাইল। চিৎকার চেঁচামেচি করে সামান্য ব্যথাকেও বিশাল রূপ দিল। ধারা ওকে তুলে বলল,
-তুই রান্না করলে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হবে না। তোর রান্না কুকুর খেলেও পেট খারাপ করবে।”
ধারা একা হাতে সব রাঁধছে জেসমিন পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। আপুটার বিয়ে মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে হলে কত ভালো হতো! আপুও কাছাকাছি থাকতো। দুলাভাইও মন মতো হতো। এখন কোথাকার কোন ছাগল তার দুলাভাই হবে আল্লাহই জানে। জেসমিন আফসোসের সুরে বলে উঠল,
-কত শখ ছিল মুনতাসীর ভাইকে দুলাভাই ডাকব। তা আর হলো না। না জানি মুনতাসীর ভাই কোন বেটির দুলাভাই হবে! আমার তো এখন থেকেই হিংসা লাগছে।”
চলবে_
#এক_বরষায় [৩৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
____________
ধারা রান্না করা খাবার টিফিনবাক্সে ভরে দিয়েছে। জেসমিন সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে ধারা চোখ বাঁকাল। এত সেজে যাচ্ছে কেন মেয়েটা? জেসমিন ফুরফুরা মনে আতিফকে সঙ্গে করে মুনতাসীর ভাইয়ের নতুন বাসা দেখতে বেরিয়ে পড়ল।
মুনতাসীর যে বাসায় উঠেছে তা তাদের কলেজের পেছনেই বলা যায়। দু’চার মিনিটের পথ। আসতে আসতে আফিত বলল,
-মুনতাসীর ভাই কেন নতুন বাসায় উঠতে গেল!”
-তোর আদরের বোনের জন্য।”
-ধারা আপুর সাথে মুনতাসীর ভাইয়ের বিয়ে কি কোনভাবেই সম্ভব না?”
জেসমিন উদাস গলায় বলল,
-আল্লাহ জানে। আমি তো কোন আশাই দেখছি না।”
-ধারা আপু কি মুনতাসীর ভাইকে পছন্দ করে?”
-তোর বোনের মন আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।”
-আমরা যদি ওই লোকটাকে আপুকে বিয়ে না করতে অনুরোধ করি তাহলে কি উনি আমাদের কথা শুনবেন না?”
-শুনবে কি না শুনবে তা পরের কথা। লোকটা যদি বাবাকে বলে দেয় তাহলে আমরা বাড়ি ছাড়া হবো শিওর জেনে রাখ।”
-তা ঠিক।” আতিফ ভাবনায় পড়ে গেল। ছোট হয়ে এখন দেখা যাচ্ছে অনেক সমস্যা। ছোটদের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। সে যদি ধারা আপুর বড় হতো তাহলে নিশ্চয় বড় ভাইয়ের অধিকার নিয়ে ধারা আপুর বিয়ে মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে দিতে পারতো। জেসমিনও ভেবে যাচ্ছে কীভাবে আপুর বিয়ে আটকানো যায়।
-নয়ন ভাই কি ধারা আপুর বিয়ে হতে দিবে? ও কিছু করবে না?”
জেসমিন মুখ বাকিয়ে বলল,
-যার বিয়ে তারই যদি খবর না থাকে তাহলে অন্যরা কী করতে পারবে বল। আপুই তো রাজি হয়ে বসে আছে।”
দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে মুনতাসীর ভাই উঠেছে। ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম, একটা কিচেন, সামনে ছোট্ট একটা বারান্দাও আছে। সব মিলিয়ে ছিমছাম পরিবেশ। মুনতাসীর ওদের দেখেই হাসল। ছেলেমেয়ে দু’টোকে ভীষণ মিষ করছিল। একা একা তার কোন কথা বলার মানুষও নেই। ওই বাড়িতে থাকতে জেসমিন তো সারাক্ষণই মুনতাসীরের ঘরে থাকত। মুনতাসীর আতিফের হাতে টিফিনবক্স দেখে বলল,
-এসব কী?”
জেসমিন উত্তর দিল।
-আপনি না খেয়ে থাকবেন এটা জেনেও আমরা কীভাবে খাব বলুন তো।”
-এসবের তো কোন দরকার ছিল না জেসমিন।”
-দরকার ছিল। আমি নিজের হাতে সব রেঁধেছি। এখন থেকে যতদিন আপনি একটা কাজের লোক না পাবেন ততদিন রান্না করে নিয়ে আসব। বেশি কথা না বলে খেয়ে বলুন তো আমার রান্না কেমন হয়েছে।”
আতিফ অবাক চোখে জেসমিনকে দেখছে। কী মিথ্যুক রে বাবা! সব রাঁধল ধারা আপু। এখানে এসে ও নিজের নাম করে চালিয়ে দিল!
দুপুরের খাবার সময় অনেক আগেই চলে গেছে। রাতের খাবার সময়ও দেরি আছে। তবুও জেসমিনের জোড়াজুড়িতে মুনতাসীরকে খেতে বসতে হলো। প্রথম বার খাবার মুখে নিয়েই মুনতাসীর বুঝে ফেলল আসলে কে রান্না করেছে। ধারার হাতের রান্না তার অচেনা না। মুনতাসীর মনে মনে হাসল। জেসমিন আগ্রহ নিয়ে মুনতাসীরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-কেমন হয়েছে? ভালো হয়েছে? ঝাল বেশি হয়েছে? লবণ ঠিক আছে?”
মুনতাসীর ঠোঁটে হাসি নিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
-অসাধারণ হয়েছে। তুমি এত ভালো রাঁধতে পারো আগে তো জানতাম না।”
জেসমিন লজ্জিত মুখে বলল,
-আমি সবই পারি। সব গুণ আমার মধ্যে আছে। তবুও আপু আমাকে অকর্মা ভাবে।”
মুনতাসীর হাসছে। এই মেয়ের ছেলেমানুষী কোনোদিনও শেষ হবে না। আতিফ জেসমিনকে থামানোর জন্য কথ ইশারা ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানুষ এতটা বোকা হয় কীভাবে! মুনতাসীর ভাই এতগুলো দিন তাদের বাড়িতে ছিল। ধারা আপুর রান্না কি ও চিনবে না? তারপরও জেসমিন আপু কেমন চাপা মেরে যাচ্ছে।
জেসমিন সাদা কাপড়ে বাঁধা কেটে যাওয়া হাতটা এগিয়ে ধরে বলল,
-হাত কেটে আপনার জন্য রান্না করেছি।”
মুনতাসীর আদিখ্যেতা করে বলল,
-ইশ! অনেকটা কেটেছে?”
-না সামান্য।”
*****
ওই মানুষটার কথা ভাবলে সময় কখন কেটে যায় ধারা নিজেও বুঝতে পারে না। কিন্তু সাদাফের কথা ভাবলেই তার সময় যেন থেমে যায়। আজ সাদাফ এসেছিল। দাদী ওদের আলাদা করে কথা বলতে দিয়েছে। সাদাফ অনেক কথাই বলেছে। ধারা কিছুই বলতে পারেনি। সাদাফের সাথে যতটা সময় ছিল ধারার অস্বস্তির শেষ ছিল না।
-আপনি ফোন ইউজ করেন না?”
-দরকার পড়ে না।”
ধারার নিজস্ব ফোন নেই এটা যেন কোন আশ্চর্যের কথা। মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার না-ই করতে পারে। এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? সাদাফ বিস্ময় লোকাতে না পেরে বলল,
-বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেন কী করে?”
-আমার তেমন বন্ধু নেই।”
সাদাফ ধারাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ধারা রাগী এটা সে জানে। রোহান বলেছে ম্যাম রেগে গেলে মার পড়ে। সাদাফ আমতা আমতা করে বলল,
-আমি যদি আপনার সাথে কথা বলতে চাই, মানে কোন প্রয়োজন পড়ে তখন কীভাবে…
সাদাফ কথা শেষ করার আগেই ধারা জবাব দিয়েছে,
-বাবার ফোনে কল করবেন।”
সাদাফ শত চেষ্টা করেও ধারার সাথে কথা আগাতে পারল না। ধারা নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। আবার সে কিছু জিজ্ঞেস করলেও শর্টকাট উত্তর দিচ্ছে।
******
বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই ধারার কাছে সবকিছু দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বিয়ের কোন কাজেই সে মন লাগাতে পারছে না। বাবা মানুষ লাগিয়ে বাড়িঘর গোছাতে ব্যস্ত। রোজী আপার বিয়েতে জেসমিনের যতটা আগ্রহ ছিল, নিজের বোনের বিয়েতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে দিব্যি কলেজে যাচ্ছে। বাড়ি এসে মুনতাসীরের জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছে। বোনের বিয়ে নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথাই নেই। মুনতাসীর এবাড়ি থেকে গেছে আজ চার দিন হয়ে গেছে। চার দিনে একবারও সে এবাড়িতে আসেনি। বাবা প্রায়ই ধারাকে জিজ্ঞেস করে,
-আমি বাড়িতে না থাকলে কী মুনতাসীর আসে? ওর সাথে দেখা হয় না। আরেকদিন এলে বসতে বলিস।”
কাকে বসতে বলবে ধারা! মানুষটা তো তাদেরকে যেন ভুলেই গেছে। ধারা নিজের মনের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত তার উপর আবার সাদাফ নামের মাথা ব্যথা ঘাড়ে এসে জুটেছে। বাবা ফোনেই দিনে চার পাঁচ বারের উপর কল দেয়। তার সাথে কথা বলতে চায়। বাবার সামনে ধারা লজ্জায় বাঁচে না।
জেসমিন গুনগুন করতে করতে ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দিল। এদিক ওদিক মুখ বাঁকিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। ধারা ভেবে পায় না এই মেয়ে মুনতাসীরের কাছে যাবার সময় এত সাজে কেন? ধারার মনে ক্ষীণ সন্দেহ বাসা বেঁধেছে জেসমিন কি মুনতাসীরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে! বলা যায় না। অল্প বয়সী মেয়ে গুলোর মনে কখন কী চলে কেউ জানে না। ধারা বিরক্ত গলায় বলল,
-এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?”
-কোথায় আবার? রোজ যেখানে যাই।”
-তোর কী আর কোন কাজ নেই? সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকিস। পড়াশোনা তো আগে থেকেই গোল্লায়। এখন পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছিস নাকি?”
জেসমিন ভ্রু কুঁচকে বোনকে দেখল। আজ তাড সাথে যেচে পড়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছে নাকি?
-আমি না পড়েও পাস করব।”
জেসমিন বেরুতে নিলে ধারা বলল,
-এতদিনেও কি কাজ লোক খুঁজে পায়নি। রোজ তোর খাবার নিয়ে যেতে হয়।”
জেসমিন দুনিয়ার সমস্ত বিরক্তি তার মুখে ফুটিয়ে বলল,
-কেমন ছোট লোকের মতো কথা বলছিস রে তুই! একজন মানুষ খেলে আমাদের কি চাল কমে যাবে? নাকি বাবাকে রাস্তায় বসতে হবে! তুই এরকম আমি আগে জানতাম না। কাজের লোক পাওয়া কি মুখের কথা? মুনতাসীর ভাইকে বিয়ে করিয়ে দিই তারপর ওর বউকে বলে তোর রেঁধে সব খাবার ফেরত দিয়ে দেব। একটু ভালো রাঁধতে পারে বলে কত অহংকার। হিংসাও।”
চটাং চটাং করে বোনের মুখের উপর কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে জেসমিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ধারা ওদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে আছে। সে অহংকারী! মুনতাসীরকে হিংসে করে সে?
****
আজ স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে। আতিফকে আজ পাওয়া যাবে না। খেলা রেখে আতিইফার বাচ্চা মরে গেলেও আসবে না। তাই জেসমিনকে একাই আসতে হচ্ছে। আজকে আর রাত করে ফেরা যাবে না। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে।
জেসমিন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো। মুনতাসীর ভাই এ সময় বাড়িতেই থাকে। জানে এসময় জেসমিন আসবে। প্রতিদিনকার মতো আজ দরজা খোলা পেয়ে জেসমিন ঘরে ঢুকে গেল। হাতে থাকা ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মুনতাসীরকে ডাকতে লাগল।
-মুনতাসীর ভাই! মুনতাসীর ভাই, আপনি কোথায়?”
এত ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মুনতাসীর ভাই কি ঘরে নেই? কোথাও গেলে দরজা খুলে যাবে নাকি? সে তো এসে দরজা খোলাই পেল। জেসমিন নিঃশব্দ পায়ে পাশের ঘরে উঁকি দিল। ওই ঘরে একটা লোক! কিন্তু লোকটা যে মুনতাসীর ভাই না এটা জেসমিন একশো এক পার্সেন্ট শিওর। পেছন থেকে দেখলেও মুনতাসীর ভাইকে চিনবে সে। জেসমিন বিস্ময়ে দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। মনে মনে বলল,
-চোরের বাচ্চার কত বড় কলিজা! দিনে দুপুরে মানুষের ঘরে ঢুকে চুরি করতে এসেছে! একে তো শিক্ষা দিতেই হবে। কোনোভাবেই পালাতে দেওয়া যাবে না। ব্যাটা চোর আজ তোর কপালে শনি আছে। কার খপ্পরে পড়েছিলি সারাজীবন মনে রাখবি।”
দরজার সামনে থেকে ফিরে এলো জেসমিন। আশেপাশে কিছু খুঁজছে সে। একটা মোটা লাঠি বা বাঁশ টাশ পেলেও চোরের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু এখন লাঠি পাবে কোথায়? মুনতাসীর ভাই ঘরে একটা লাঠি এনে রাখতে পারল না!
খোঁজাখুঁজি করেও লাঠি টাইপ কিছু না পেয়ে ঘরের এক কোণ থেকে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে নিল। পা টিপেটিপে আবার এঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তার সাহসের অভাব নেই। বুক ভরা সাহস। তবুও বড় করে দম নিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে মনটাকে আরেকটু সাহস দিল। তুই পারবি জেসমিন। তুই পারবি। চোরকে শায়েস্তা করা তোর বাঁ হাতের কাজ। জেসমিন শিকারি বিড়ালের মতো মাটিতে পা না ছুঁইয়ে ইঁদুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একপা একপা করে শিকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরা ঝাড়ুটা শক্ত করে ধরে আল্লাহর নাম দিয়ে লোকটার পিঠে এক বাড়ি দিল। দ্বিতীয় বার আঘাত করার আগে ছেলেটা পেছনে ফিরে জেসমিনের হাত উঁচুতে ধরে ফেলল। ব্যথায় বেচারার মুখ কুঁচকে উঠেছে। জেসমিন এবার বুঝল ব্যাটার কানে ইয়ারফোন লাগানো ছিল বলেই এতক্ষণ তার উপস্থিতি টের পায়নি। চোর নিশ্চয় কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে চুরি করতে আসবে না! এটা কি চোর না? তাহলে কে এই লোক? ছেলেটা চোখ লাল হয়ে রাগান্বিত গলায় ধমক দিয়ে বলে উঠল,
-এই মেয়ে, কে তুমি? পাগল হয়ে গেছ নাকি?”
জেসমিনও গলায় সমান তেজ এনে বলল,
-আপনি কে? এখানে কী করছেন? মুনতাসীর ভাই কই? ঘরের দরজা খুলেছেন কীভাবে? কী চুরি করতে এসেছে?”
চুরি! মেয়েটার কি সত্যিই মাথায় সমস্যা আছে? অবশ্যই আছে। নইলে না জেনেশুনে তাকে চোর ভেবে মারতে যাবে কেন? মাতিমের রাগে গা ফেটে যাচ্ছে। মেয়ে হয়ে বেঁচে গেল। নইলে আজ এর খবর করে ছাড়ত। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল,
-আমার ভাইয়ের ঘরে আমি চুরি করতে ঢুকব?”
ভাই! মুহূর্তে জেসমিনের মুখ চুপসে গেল। এই ছেলে তাহলে মুনতাসীর ভাইয়ের ভাই! হে আল্লাহ, না জেনে এটা কী করে ফেলেছে! মুনতাসীর ভাই জানলে এখন তার কী হবে?
চলবে_