স্রোতধারা
দ্বাদশ_পর্ব
~মিহি
“আপনি কী এমন করলেন বলুন তো যে মা আপনার সাথে আমাকে পাঠাতে রাজি হয়ে গেল?”
“তেমন কিছু না। আন্টিকে বলেছি তোমার কিছু বই দরকার। তাই আন্টি তোমার সাথে আমাকে বই কিনতে পাঠিয়েছেন।”
“ওহ আচ্ছা। আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“যাওয়ার তো জায়গার অভাব নেই তবে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটার মতো তৃপ্তির আর কিছু নেই। রিকশা থেকে নেমে সামনে পার্ক আছে। ঐটুকু হাঁটবো। তারপর দেখি গন্তব্য কোথায় হয়।”
“আপনি এমন ভবঘুরে আমি জানতাম না।”
“খাঁচায় বন্দি পাখি হঠাৎ মুক্ত হলে ভবঘুরেই হয়ে যায়।”
“আপনি খাঁচায় বন্দি পাখি?”
“হ্যাঁ তবে এখন সে খাঁচা ভেঙে গেছে। আবার কখনো জোড়া লাগলে আমার আবার সে খাঁচায় ফিরতে হবে।”
“আপনার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।”
“থাক বুঝতে হবে না।”
রিকশার ধার ঘেঁষে বসেছে ধ্রুব যেন ভুল করেও কোনো অনাকাঙিক্ষত দৃশ্য না ঘটে। সাবধানতা বোধহয় সবক্ষেত্রে খাঁটে না। স্পিড ব্রেকারে রিকশা এমনভাবে হোঁচট খেল, না চাইতেও হায়া ধ্রুবর সাথে ধাক্কা খেল। ধ্রুব খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সরে গেল। হায়াও বিব্রতবোধ করলো। কিছুক্ষণ পর ধ্রুব রিকশা থামালো। টাকা দিয়ে হায়াকে নামতে বললো।
“এই মাঝরাস্তায় এখন আমরা হাঁটবো?”
“হুম। চলো তোমার জন্য কয়েকটা বই কিনবো আগে।”
“এখন বই কিনে বই বয়ে বেড়াবো? আগে ঘোরাঘুরি শেষ করি। যাওয়ার সময় কিনবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। বাস স্ট্যান্ড ক্রস করলেই সামনে পার্ক। চলে এসো।”
হায়া ধ্রুবর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। রাস্তার ভীড়ে হায়াকে আগলে রাখতে ব্যস্ত ধ্রুব। আচমকা হায়া বিস্ফোরিত নজরে তাকায় সামনের দিকে। এক ঝটকায় ধ্রুবর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ধ্রুব অনেকটা লম্বা হওয়ায় হায়া অনায়াসে ধ্রুবর পেছনে লুকোতে পেরেছে কিন্তু বিষয়টা ধ্রুবর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা এভাবে লুকোচ্ছে কেন আর কাকে দেখেই বা লুকোচ্ছে?
“হায়া, কী হলো? তুমি লুকাচ্ছো কেন?”
“আমার দাদী…”
“তোমার দাদী এখানে কেন আসবে?”
“আরে সামনে বাস স্ট্যান্ড। ওনার আজ আসার কথা ছিল।এ অসময়ে তার সামনে পড়বো কে জানতো!”
“আচ্ছা চলো, আমরা বরং ওনাকেও সাথে নিয়ে ঘুরি।”
“চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওনাকে নিয়ে ঘুরতে গেলে আপনার আর বেঁচে থাকা লাগবে না।”
“কেন?”
“টিউশনি কন্টিনিউ করেন, এমনিই বুঝে যাবেন।”
ধ্রুব হায়ার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলো না। মিনিট তিনেক ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর হায়ার দাদী চোখের আড়াল হলো। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ধ্রুবর কাছ থেকে সরে এলো হায়া।অতঃপর আগের মতো সামনে এগোতে লাগল। ধ্রব হতবাক হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
“কী হলো আসুন। দাদী তো চলে গেছেন। এখন কেন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন?”
“কাহিনী কী বলো তো। দাদীকে দেখে এত ভয় পাওয়ার কী আছে?”
ধ্রুবর প্রশ্নে হাঁটা থামিয়ে দিল হায়া। এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানে না। কেন যে তার দাদী তাকে সহ্য করতে পারেন না! ছোট থেকেই তার দাদী তাকে দেখলে ভ্রু কুঁচকান। পরের বাড়ির সন্তানের মতো আচরণ করেন। ধারার বেলায় তেমন না হলেও হায়ার বেলাতে বরাবরই এরকম হয়ে আসছে। ব্যস্ত রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আচমকাই যেন জীবনের হিসেবগুলো মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো হায়া।
___________
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। ঋতুর এমন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে যে শরতের বিকেলেও বৃষ্টির আগমন আর অনাকাঙিক্ষত নেই। হাতের হ্যান্ডকাফটা এখনো দুজনকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি নামলো। স্রোত বামে সরে দাঁড়ালো আর ধারা দ্রুতগতিতে ডানে সরতে নিলে হ্যান্ডকাফে টান লেখে স্রোতের গায়ের সাথে ধাক্কা খেল। হঠাৎ ধাক্কায় স্রোতও বামদিকে কিছুটা সরে গেল। ধারা বাম হাতে অল্প ব্যথা পেয়েছে। হ্যান্ডকাফটা আস্ত একটা বজ্জাত একদম স্রোতের মতো! স্রোত হ্যান্ডকাফটা খুলে দিল। বৃষ্টির কারণে ধারা এমনিতেই আধভেজা। ছাড়া পেয়ে দ্রুত একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। স্রোত তখনো দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাদা শার্ট পড়ে বেরিয়েছিল, এখন তা ভিজে চুপসে গায়ের সাথে মিশে গেছে। ধারা একবার তাকিয়ে বিব্রত দৃষ্টিতে চোখ সরিয়ে নিল। অনেকক্ষণ বাদে স্রোত চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ধারার পাশে এসে দাঁড়াল।
“খবরদার এমন কাকভেজা হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। এতক্ষণ যে ভিজলে, এখন জ্বর হলে বুঝবে।”
“তো তখন আটকালে না যে?”
“আমি টিপিক্যাল ওয়াইফ না স্রোত। তোমার ভালো লাগছিল বৃষ্টিতে ভিজতে সেখানে আমি যেয়ে অসুখের ধমক দিয়ে নিয়ে আসবো, এ স্বভাব আমার নেই। আমরা অসুস্থ হবোই, এটা স্বাভাবিক কিন্তু অসুস্থতার ভয়ে জীবন উপভোগ করা তো থেমে থাকবে না, তাই না?”
“এই তুমি আসলেই ডাক্তার তো নাকি সাইকোলজির প্রফেসর?”
“ফাজলামি রাখো। এখান থেকে সামনে কাপড়ের দোকান আছে। যাও একটা শার্ট কিনে চেঞ্জ করো আর তারপর সোজা নিজের বাসায় যাও।”
“আচ্ছা আমরা যখন এসেছিই, বিয়ের শপিংটা করে ফেললে হয় না?”
“নাহ। চুপচাপ যেটা বলছি সেটা করো।”
“আচ্ছা তুমিও চলো। আমাকে একটু শার্ট পছন্দ করে দাও।”
ধারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এরকম একটা তারছিঁড়া তার কপালেই ছিল খোদা? স্রোতকে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে গেল সে। স্রোত মুখ টিপে হাসছে। ধারা তার উপর অধিকার খাটাচ্ছে, রাগ দেখাচ্ছে, শাসন করছে, এটাই তো সে চেয়েছিল বরাবরই।
কাপড়ের দোকানটা বেশ ছোট তবে দোকানের সামনের সাজসজ্জা বেশ আকর্ষণীয়। স্রোত এখন বেশ অপ্রস্তুত অনুভব করছে। দোকানে মেয়েরা বসে আর সেখানে সে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত বিব্রতকর অবস্থা! ধারা মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা নীলরঙা শার্ট পছন্দ করে কিনে ফেলল। অতঃপর স্রোতের হাতে দিয়ে বললো,”নাও! হবু স্ত্রী হিসেবে তোমার ইজ্জত রক্ষা করা আমার কর্তব্য।” বলেই হাসতে লাগল। স্রোত মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আর কতবার যে এ হাসির মায়ায় পড়ে বিলীন হতে হবে জানা নেই স্রোতের। শার্টটা হাতে নিয়ে আশেপাশে ওয়াশরুম খুঁজতে লাগল সে।
স্রোত শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পর ধারা দোকানটাতেই দাঁড়িয়ে রইল। একটা পাঞ্জাবি বেশ পছন্দ হয়েছে ধারার। ব্যাগে যথেষ্ট টাকা আছে কিনা সন্দেহ হচ্ছে কারণ সকালে তাড়াহুড়োয় বেরিয়েছে। তবুও পাঞ্জাবিটা দেখতে লাগল সে। এরই মাঝে পাশের দুইটা মেয়ের কথোপকথন কানে আসলো।
“অ্যাই দেখলি, ছেলেটা জোস ছিল না?”
“সাথে গার্লফ্রেন্ড আছে, দেখতেই তো পারছিস।”
“আরে বোন হবে হয়তো। বয়স একই মনে হচ্ছে দেখ। তুই থাক, আমি ফোন নম্বরটা নিয়ে আসি।”
“এসব ছ্যাঁচড়ামি বাদ দে নইলে তুইও ধোলাই খাবি সাথে আমিও।”
“এমন হ্যান্ডসাম বান্দার জন্য তো বিষ অবধি খাওয়া যায়। আয়হায়!”
এতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করলেও এবার আর ধৈর্যে কুলালো না ধারার। ঠাণ্ডা তবে তীক্ষ্ম স্বরে বলে উঠলো,”রাস্তায় অবধি বেহায়াপনা করতে হয় তোমাদের? টিনেজ তো, এখনো দুনিয়া চেনো না। সবাইকে এভেইলেবল ভেবে নাও নাকি? যার সম্পর্কে কথা বলছো সে আমার হবু স্বামী। এতটাও বাচ্চা নও তোমরা যে হাতে কলমে বোঝাতে হবে।সময় থাকতে শুধরে যাও, অন্যের বরের উপর নজর দেওয়া বাদ দাও।” মেয়েটার মুখ নিমেষেই কালো হয়ে গেল। কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলো মেয়েটি। ধারা হালকা হেসে পাঞ্জাবিটা দেখছিল। সাদা রঙা পাঞ্জাবিটার বুকের কাছে সোনালী সুতোর কাজ করা। হালকা ডিজাইন হলেও দেখতে বেশ সুন্দর লাগলো ধারার। ধারা প্রাইস ট্যাগ চেক করলো। আড়াই হাজারের উপর দাম অথচ তার ব্যাগে সর্বসাকুল্যে দেড় হাজারের মতো টাকা আছে। চাইলেই তো আর স্রোতকে বলা যায় না পাঞ্জাবিটা কিনে দিতে। পাঞ্জাবিটা রাখতেই দূরে চোখ পড়ল ধারার। অনাকাঙিক্ষত দৃশ্যে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে আসলো।
চলবে…