স্রোতধারা
ষোড়শ_পর্ব
~মিহি
গোধূলি বেলা। ছাদের একপাশে অনুভূতিশুন্যের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে হায়া। এ ছাদটাকে যেন দু চোখের বিষ মনে হচ্ছে তার। যত নষ্টের গোড়া এ ছাদটাই। সেদিন ছাদে না উঠলে সে কখনো ধ্রুবর মুখোমুখি হত না। অল্প কয়েক মুহূর্তেই ধ্রুবর প্রতি এত দুর্বল হয়ে পড়ত না। সবকিছু স্বাভাবিক থাকতো, তার জীবনটাও সুন্দরভাবে চলতো। একটা ভুল, সেই একটা ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে আজ হায়ার জীবনটা বিক্ষিপ্ত। “উহুম..” সৌহার্দ্যের কাশির শব্দে ঘোর কাটে হায়ার। চাহনিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসে না। সৌহার্দ্য আর হায়া উভয়েই জানে তারা কীজন্য এখানে দাঁড়িয়ে। হায়া অবশ্য নিজের বিয়ের কথায় অনেকটা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। এতদিন বিয়ে বিয়ে করে পাগল চিল অথচ এখন মন ভাঙার বিরহকালে তার বিয়ের আসর বসতে চলেছে। হায়া চাইলেও নিষেধ করতে পারতো বিয়ের জন্য। সে অধিকারটাও তাকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা সেও বুঝতে শিখেছে। নিজের সুখের জন্য নিজের পরিবারের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব না তবে এর চেয়েও ভয়ানক একটা তথ্য সে জেনেছে। আর তা হলো সে তার বাবা-মায়ের আসল সন্তান নয়। ধারা আর সে চাচাতো বোন। এ কথাটা তাকে জানিয়েছে তার দজ্জাল দাদী। এমনকি এ বিয়ে করতেও নিষেধ করেছে। হায়া কৃতজ্ঞতাবোধে অশ্রুসজল আঁখি নিয়ে বারংবার নিজের অতীত স্মৃতি মনে করেছে। নিজের বাবা-মা কিংবা বোনকে কখনো তো তার মনে হয়নি তবে কেন এ সত্য তাকে জানানো হলো? মিথ্যের রাজ্যে দিব্যিই তো ছিল সে তবে কেন তার সুন্দর রাজ্য অনাকাঙিক্ষত ধুলোর ঝড়ে ধূলিসাৎ হলো?
“কিছু কথা বলবো তোমার সাথে। মনোযোগ দিয়ে শোনো।” সৌহার্দ্যই প্রথম বলতে শুরু করলো।
“জ্বী বলুন।”
“এ বিয়েটা অনেকটা পরিস্থিতির চাপে হচ্ছে। তা তুমিও জানো আমিও জানি তবে তোমার কাছে কিছু সহজ স্বীকারোক্তি করতে চাই। অনুমতি হবে কী?”
“হুম।”
“ধারাকে দেখতে এসে প্রথম আমি তোমায় দেখেছিলাম। অনাকাঙিক্ষতভাবেই তোমায় ভালো লেগেছিল তবুও নিজেকে নিষেধ করেছিলাম কারণ তুমি আমার থেকে অনেকটাই ছোট। তোমার মায়ায় কতটা গভীরভাবে জড়িয়েছি তা বুঝলাম যখন প্রতি মুহূর্তে তোমার শূণ্যতা গ্রাস করতে লাগল আমাকে। আমি ভাবতাম আমার দ্বারা কখনো ভালোবাসা কিংবা বিয়ে এসব সম্পর্ক সামলানো সম্ভব না অথচ তোমার নেশায় এমন করে জড়ালাম যে সংসারের অন্য সবকিছু বৃথা মনে হতে লাগল।”
“সাজানো গল্প শোনাচ্ছেন?”
“সাজানো গল্পের মতো গোছালো নয় আমার কথাগুলো তবে যা বলছি সত্যি। তোমার যদি গল্প মনে ফয় তবে গল্পই হোক। আমি তোমার প্রতি অবিচার করবো না এই আশ্বাসটুকু দিতে পারি।”
“বিয়েটা আমি করবোই তবে বিয়ের পর কী হবে তা আমি জানিনা। আপনি যদি মানিয়ে নিতে না পারেন, আমি তখন এ সম্পর্কে আর থাকবো না। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হলে চলে যাবো।”
“সেরকম পরিস্থিতি কখনো আসবে না।”
“বেশ, যান তাহলে। গায়ে হলুদ তো আজ আপনার।”
“শুধু আমার?”
“আপনারই তো। আমার বেলায় তো কলঙ্ক ধোয়ার উৎসব চলছে।”
হায়া চুপচাপ নেমে গেল। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে মানিয়ে নিতে বড্ড বেগ পেতে হবে তার তবুও মানিয়ে তো সে নেবেই। আজ কেন যেন সৌহার্দ্যের মাথায় একটা হিন্দি সিনেমার ডায়লগ ঘুরপাক খাচ্ছে। ডায়লগটা ছিল, “আগার তুম কিসি চিজকো সিদ্দাত সে চাহো, তো পুরি কায়নাত তুমহে উসসে মিলানে কী সাজিস ম্যায় লাগ যাতি হ্যায়।” সত্যিই তো হায়াকে সে চেয়েছিল মনের গভীরতম স্থান থেকে, তবেই কি নিয়তি তার প্রতি এতটা সদয় হলো? অকারণ প্রশান্তি বারে বারে সৌহার্দ্যের মনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। অহেতুক কারণবশত ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হচ্ছে ক্ষণিক বাদেই। এত সুখ, এত শান্তি সৌহার্দ্যের মনে অস্বস্তি আর ভীতিও সৃষ্টি করছে। না জানি হঠাৎ কোন দমকা হাওয়া তার এ সুখের প্রাসাদ চুরমার করতে আসে?
______________
বিকেল থেকে গান বাজনা শুরু হয়েছে। ধারাকে মেয়ে কাজিনরা মিলে সাজিয়েছে কিন্তু হায়া কাউকেই নিজের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি।শেষমেশ ধারাই হায়াকে নিজ হাতে সাজিয়েছে। ধারার দিকে তাকাতেই হায়ার পৃথিবী থমকে যাচ্ছে। এই মানুষটা তার নিজের বোন না হয়েও তাকে ঠিক কতটা আগলে রেখেছে। হায়া মারাত্মক অনুশোচনায় ভুগছে। আজ সে না থাকলে তার বোনের বিয়েটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হত। হায়াকে আদৌ সৌহার্দ্যের পরিবার মেনে নিতে পারবে? এখন হয়তো দয়া দেখাচ্ছে তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষ তো পরিবর্তিত হয়। হয়তো দিনশেষে হায়াও অবহেলিত হবে। না চাইতেও নেতিবাচক বিষয়গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে হায়ার মাথায়।
স্টেজে একপাশে ধারা, অপরপাশে হায়া বসেছে। আত্মীয় স্বজন বলতে কাছের মানুষজন আর প্রতিবেশী তবে স্টেজের আশেপাশে ছোটরাই বেশি। সবাই যে যার মতো হলুদ লাগিয়ে মিষ্টিমুখ করছে। গান বাজনার তালে বাচ্চাদের উচ্ছ্বাসই বেশি।
“হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম বউরে
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ
বিয়ের দিনে আকাশ থেকে পরী নামিবে
পরীর সাথে আরো কিছু অপ্সরী থাকিবে
বিয়ের দিনে আকাশ থেকে পরী নামিবে
পরীর সাথে আরো কিছু অপ্সরী থাকিবে
অপ্সরীদের চোখের ভাষা বোঝা দায়” গানের শব্দে মুখরিত চারপাশ অথচ হায়ার মনে উথালপাথাল ঝড় চলছে। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দোটানায় পড়ে গেছে সে। ইচ্ছে করছে একছুটে সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে।
মেসেজের শব্দে ফোনের দিকে তাকালো ধারা। কোলের উপরেই ফোনটা রাখা ছিল বিধায় শুনতে অসুবিধে হয়নি। স্রোত মেসেজ দিয়েছে।
“বিয়ের ব্যস্ততায় দেখি বরকেই ভুলে গেলে। একটু দয়া করো আমার উপর। কল-টল দিও একটু। আমিও তো তোমায় মিস করি নাকি!”
স্রোতের মেসেজ পড়ে মুচকি ফাসি দিল ধারা। ব্যস! ধারার হাসতে দেরি আছে কিন্তু তা তার কূটবুদ্ধির কাজিনদের চোখে পড়তে দেরি নেই। তৎক্ষণাৎ সবাই এসে ঘিরে ধরলো ধারাকে। ধারার তখন নিজেকে জেল থেকে পালানো আসামির মতো মনে হচ্ছে। সকলের শয়তানি দৃষ্টির সম্মুখে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ধারা। সে নিশ্চিত জানে শয়তানগুলো মিলে নির্ঘাত কোনো ফন্দি আঁটছে তাকে বিরক্ত করার।
___________
“অবশেষে আমার কথা মনে পড়লো তাহলে…”
“হুম।”
“মিস করছিলে আমায়?”
“হুম।”
“ভালোবাসি”
“হুম।”
“কী হুম হুম করছো বলো তো?”
“হুম।”
“ধারা, ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। আরেকবার হুম বললে আমি তোমার বাড়িতে চলে আসবো।”
“হুম।”
“আজব তো।”
স্রোত বিরক্ত হয়ে গেল। মেয়েটা এভাবে হুম হুম করছে কেন? নির্ঘাত ঘাপলা আছে। স্রোত বেশ রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল, “রাখলাম আমি।” বলেই ফোন না কেটে চুপচাপ কানে ধরে রইলো। অপরপাশ থেকে একস্বরে সকলের হাসির শব্দ শোনা গেল। একটা মেয়েকণ্ঠ বলে উঠলো,” দুলাভাই তো আমাদের বোনের কণ্ঠ চেনেনা রে। সামান্য একটা হুম শুনে যদি বউয়ের গলা আন্দাজ করতে না পারে, সংসার করবে কেমনে? কী বলো, ধারা আপু?”
স্রোত অপেক্ষা করছে ধারা কী বলে শোনার জন্য। অপর পাশ থেকে মুচকি হেসে ধারা বলল,”যে মন বোঝে, তার কণ্ঠ না চিনলেও হয়। চোখ বন্ধ করে সহস্র মানবীর মাঝে তোমায় খুঁজে নেবো টাইপ ভালোবাসা তো নয় আমাদের। আমাদের ভালোবাসা হলো পাশে থাকবো সবসময়, ব্যস! ফিল্মের হিরোর মতো ও আমার সম্পর্কে সব জানবে এমন তো হওয়ার কথা নয়। তবে জেনে নিবে ধীরে ধীরে। সময়ের সাথে সাথে আমরা যতটা মুহূর্ত পাড়ি দিবো, আমরা একে অপরকে তত জানবো, তত বুঝবো। ও যেমন এখন আমার কণ্ঠ চিনতে পারলো না, তেমনি কিছুদিন আগে আমিও ওর কণ্ঠ চিনিনি। এর মানে তো এটা নয় যে আমাদের ভালোবাসায় খাঁদ আছে। আমাদের সম্পর্কটাকে সময় দেওয়ার প্রয়োজন আছে আর তোদের চক্করে সেটা হচ্ছে না। ফোনটা দিয়ে যা তো তোরা।”
চলবে…