#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব
বাসের সামনের সিটে একাকি বসে আছে প্রিয়া। হঠাৎ সে পাশের সিটে এক ছেলেকে এসে বসতে দেখে বিরক্তির চরম শিখরে পৌঁছে গেলো। এই বাসে আলাদা করে মহিলা সিট নেই বলে এমনিতেই বিরক্ত বোধ করছিল সে। তারওপর পাশে একটা ছেলের উপস্থিতি বিরক্তি কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো। এমনিতে সকাল বেলা। সকাল সকাল বিরক্তি নামক ঝঞ্ঝাটের উপস্থিতি মানে সারাটা দিন বর্বাদ! সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে আসার মতো প্যারা মনে হয় জীবনে আরেকটা নেই। কে বলেছে? সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস রাখতে! সে দুর্ভাগ্য ক্রমে দশটা দশের ক্লাস সাড়ে আটটায় নিয়েছে। কী করবে? সিট ফাঁকা ছিল না। প্রথমদিন ক্লাস আজ। তারওপর জানুয়ারি মাস! বছরের সবচেয়ে শীতলতম মাস। ঘুম তো ভাঙতেই চায় না। প্রিয়া তার লাল রঙের পশমি শালটাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বসে একটু উষ্ণতার খোঁজে।
শুনেছে, যেই ম্যামের ক্লাস, তিনি নাকি ঠিক ক্লাস টাইম হলেই দরজা লক করে দেয়। এরপর আর কারও দেরি করে ঢোকার সাধ্য নেই। পুরো বাংলাদেশে তার সুনাম আছে। হবেই নাই বা কেনো? হাভার্ড থেকে পিএইচডি করা এরপর কয়েকটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে তাকে গেস্টটিচার হিসেবেও নিয়েছিল। তাই আর কী করা! মনের দুঃখে সেই ভোরে উঠে নামাজ পড়ে নাস্তা খাওয়ার প্যারা নিতে হয়েছে। এতো সকালে মা না খাইয়েও বের হতে দিবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসের জানালার দিকে দৃষ্টি স্থির রাখলো। এই রুটটা খুব সুন্দর ও ট্রাফিক খুব একটা থাকে না বলেই প্রিয়া এখান দিয়ে যাতায়াত করে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলো, পাশে বসা ছেলেটা একটু বেশিই নড়াচড়া করছে। প্রিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটাকে এক পলক দেখে মনে হলো ছেলেটা খুব অস্বস্থিতে আছে। সুদর্শন ছেলেটির ফর্সা মুখশ্রী এই সকাল সকালই চিন্তায় অবসন্ন। কোলের উপর ব্যাগ আর হাতে কিসব শিটের মতো কাগজ পত্রে ঘাটাঘাটি করছে আর লিখছে। আবার বারবার কপালে হাত রাখছে আর টিসু দিয়ে ঘাম মুছছে। পকেট থেকে ফোন বের করে বারবার সময়ও দেখছে।
প্রিয়া ছেলেটার কার্যকর্মে খুব বিরক্ত হলো। এখনও ক্লাস শুরু হতে আধঘণ্টার মতো বাকি তার মানে সকাল আটটার বেশি বাজে না। এসময় তো শীতে কাঁপাকাঁপি করার কথা। তাছাড়া শীতকালে এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠার কারনে বাসে সিট পেলে বসে ঘুমানোর কথা। প্রিয়া অবশ্য ঘুমাচ্ছে না। কুয়াশা ঢাকা সকাল তার বড্ড পছন্দের কিন্তু আলসেমির কারণে আর উপভোগ করা হয়ে উঠে না। সাথে যদি হয় ধোঁয়া উঠা চা তো! আর কী লাগে? যাই হোক, বাসে তো আর এতো আমোদ প্রবণ পরিবেশ পাবে না। বাসে ভিড় প্রচুর লেগে আছে। যাত্রী ধারণ ক্ষমতার উর্ধে যাত্রী উঠিয়েছে। লোকাল বাস তো! কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে কানে হেডফোন লাগিয়ে হালকা সফট মিউজিক চালিয়ে ছুটে চলা প্রকৃতি দেখছিল আর তারমধ্যেই পাশের ব্যক্তিটি!
কিছুক্ষণ পর, কান থেকে হেডফোন খুলে সামনে তাকিয়ে দেখল সামনে ট্রাফিক জ্যাম পরেছে। মানে দশ মিনিটের রাস্তা বিশ মিনিট বা তার বেশি লাগবে। গাড়ি খুব মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। আরেকটু সামনে গিয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। সেখানে নেমে রিকশা করে দশ মিনিটের রাস্তা। প্রথমদিন তাই জলদি পৌঁছানোটা জরুরী।
“এই মামা একটু সামনে বাস থামান আমি নামবো।”
“কই নামবেন আপা? আরেকটু গেলেই ভার্সিটি।”
প্রিয়া কপাল কুঁচকে তাকালো অতঃপর বলল,
“হোক। আপনি কি আমাকে ঠিক ভার্সিটি বরাবর নামাবেন? না তো। সেই তো অনেকখানি আগে নামাবেন নয়তো পরে। তার থেকে আমি আজকে এখানেই নামি। রিকশাও পাবো। অন্তত বিরক্ত হবো না!”
কথাটা বলে আঁড়চোখে পাশের ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটিও ভ্রুঁ কুঁচকে প্রিয়ার দিকে তাকিয়েছে। অপ্রত্যাশিত দৃষ্টি বিনিময়ে অপ্রতিভ হয় প্রিয়া। হাঁক ছেড়ে আবার থামাতে বললে প্রিয়া শেষবারের মতো লুকিং মিরর দিয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। না! ছেলেটাকে এতক্ষণ যতোটা নার্ভাস লাগছিল এখন তা লাগছে না। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বিরক্ত ও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে! প্রিয়া নিজের মনেই লজ্জিত হয় এই ভেবে যে, ছেলেটির নার্ভাসনেসের কারণ হয়তো সে নিজেই! মুখ ভার করে বাসের ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে যায় প্রিয়া। তারপর রাস্তা পার হয়ে অপর পাশ থেকে রিকশা নিয়ে সোজা ভার্সিটিতে যাবে। রিকশা খুঁজতে গিয়েও প্রচন্ড বিরক্ত প্রিয়া! কারণ রিক্সাওয়ালা মামারা ভাড়া বেশি চাচ্ছে। নায্য ভাড়ার থেকে বেশি চাচ্ছে যার কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে, সকাল বেলা! এতো শীতের মধ্যে রিকশা চালানো কস্টকর তাই ভাড়া বেশি নিবে আর যদি রেগুলার ভাড়াতে যেতে চায় তবে আরও অন্তত আধঘন্টা পর যেনো আসে!
প্রিয়া তর্কে গেলো না। আজকে দিনটা যে তার বাজে যাবে তা সে আন্দাজ করেই ফেলেছে। বাস থেকে নামলো একটু শান্তির জন্য আর এখানে এসে শান্তির মূল্য যে চওড়া তা হারেহারে টের পাচ্ছে। শীতল বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশায় চড়ে বসল। দশ মিনিটের মধ্যে ভার্সিটিতে গিয়ে আরেক মুসিবত! আইডিকার্ড তো আনে নি! এখন গার্ড তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আইডি কার্ডের বিপরীতে টিউশন ফি এর স্লিপ দেখানো যাবে কিন্তু প্রিয়ার কাছে সেটাও নেই। এখন প্রিয়ার নিজের উপর প্রচুর প্রচুর পরিমানে রাগ হচ্ছে। সকালবেলা মা এতোবার বলল, ‘প্রিয়া আইডিকার্ড নিয়েছিস? প্রিয়া পানির ফ্লাস্ক নিয়েছিস?’ তখন ব্যাগে সব আছে বলে হ্যাঁ বলে এসেছে। আর এখন! হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। এতোটা ভুলোমনা কেনো সে!
গার্ড প্রিয়াকে বলল স্টুডেন্ট এন্ট্রি লিস্টে নিজের নাম, আইডি ও ফোন নাম্বার লিখে তারপর ভিতরে ঢুকতে। প্রিয়া হতাশ হয়ে সেটাই করল। ভাগ্যিস এখনও পাঁচ মিনিট বাকি ক্লাস শুরু হতে। প্রিয়া দৌঁড়ে লিফটের কাছে গেলো। লিফটও দেখি আজ তার সাথে ছিনিমিনি খেলছে! দুই মিনিট অপেক্ষা করে লিফটে উঠে কাঙ্খিত ফ্লোরে গেলো তারপর ঠিক এক মিনিট আগে ক্লাসে ঢুকলো তাও শব্দ করে দরজা খুলে। ম্যাম প্রিয়াকে হাঁপাতে দেখে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এই দৃষ্টির মানে সে মোটেও সন্তুষ্ট না প্রিয়ার এহেনো আচরণে। প্রিয়া ‘সরি’ বলে সিটে বসে পরলো। দেড় ঘণ্টার ক্লাসটা যেনো বড্ড বোরিং। প্রথমদিন অনুসারে আজকে পড়ানোর কথা না কিন্তু তিনি পড়াচ্ছেন। দেড় ঘণ্টাকে এখন প্রিয়ার কাছে তিন ঘণ্টা মনে হচ্ছে। অতঃপর বহু প্রতিক্ষার পর ক্লাস শেষ হলো। এখন দেড় ঘণ্টার মতো কোনো ক্লাস নেই। ঘুমে চোখ নিবে আসছে বিধায় বন্ধু-বান্ধুবীদের নিয়ে ক্যান্টিনে গেলো তারপর চা-কফি, লেমোনেট যার যা প্রয়োজন অর্ডার দিলো।
প্রিয়া ভার্সিটিতে প্রায় নতুনই বলা যায়। লাস্ট ইয়ার আগস্টে ভর্তি হয়েছিল। মাত্র একটা সেমিস্টার শেষ করলো। নিজের ব্যাচমেটদেরই মনে হয় সবাইকে ঠিকমতো চিনে না। যাদের সাথে ক্লাস মিলে তাদেরকেই চিনে। আগের সেমিস্টারে তো ওর মা ওর সাথে আসতো। এবার প্রিয়া জেদ করে আর ওর মায়ের শুধু শুধু পেরেশানির দোহাই দিয়ে মাকে আনেনি।
হাঠাৎ কিছুটা দূরত্বের টেবিলে বাসের ওই ছেলেটাকে বসে থাকতে দেখে নয়নযুগল আপনা-আপনি বৃহৎ আকার ধারণ করলো। ছেলেটা ক্যান্টিনের বিস্বাদপূর্ণ খাবার ডিমের স্যান্ডুইচ খাচ্ছে। প্রিয়া তৎক্ষণাৎ মুখশ্রী কুঁচকে বিকৃত আকার করে ফেলল। ডিমের অমলেটটা জাস্ট পাউরুটির ভিতর ঢুকিয়ে সেটা ত্রিশ টাকা রাখে! তাও যদি একটু মেয়োনিস ও গ্রিল করতো! প্রিয়া ব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করে পানি খেয়ে নিলো। একি! পানির স্বাদটা কেমন জানি! মনে হচ্ছে, বহুদিন আগের পানি। তখন প্রিয়ার মনে পরলো এই পানিটা সে ডিসেম্বর মাসে সেমিস্টার ফাইনালের শেষ পরীক্ষার দিন এনেছিল। সেদিন পানিটা এক ঢোক খেয়ে আর খাওয়া হয়নি তাই আজকে পানিটার স্বাদ বিচ্ছিরি লাগছে।
এবার প্রিয়া ছলছল নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। আজকের মতো সে আর কোনো অঘটন চায় না। কিন্তু অঘটন যে আরও বাকি আছে!
চলবে ইনশাআল্লাহ্,