#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩০
#M_Sonali
গলা-কা-টা মুরগির মত ছটপট করতে করতে একসময় শান্ত হয়ে গেল চাঁদনী। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। দু চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পরলো দুফোঁটা অশ্রু জল। একদম নেতিয়ে গেলো সে। যেন এই মুহূর্তে প্রাণ বেরিয়ে গেছে তার ভেতর থেকে। কিন্তু শ্রাবণ এখনো তাকে ছাড়েনি। আগের মতোই তার গলায় কামড় দিয়ে ধরে আছে। এভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। এক সময় শ্রাবণ ওকে ছেড়ে দিলো। নিজেও ওর পাশে ধপ করে শুয়ে পড়ল। শ্রাবনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে সে। ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে পানিতে। হঠাৎ টপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা পানি। সে ক্লান্ত শরীরে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ওর পাশে শুয়ে রইলো।
একটু পর চোখ মেলে তাকিয়ে চাঁদনীর দিকে ফিরে তাকাল। দেখল ওর গলায় কামড় দেওয়া জায়গাটা জ্বলজ্বল করছে। যেন ভিতরে আগুন জ্বলছে সেখানে। তাই ওখানে আলো হয়ে জ্বলছে। চাঁদনীর মুখটা একদম ফ্যাকাশে হয়ে আছে। সারাটা শরীর একদম ধবধবে সাদা। যেন শরীরে কোনো রক্ত নেই তার।
ওর এই অবস্থা দেখে ক্লান্ত শরীরেও মুখে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাশি। সে এবার চাঁদনীর দিকে ঘুরে শুলো। তারপর ওর গালে হাত রেখে করুন গলায় বলল,
“সরি জান, তোমাকে সারা জীবনের মতো নিজের করে রাখতেই এত বড় একটি পদক্ষেপ নিতে হলো আমায়। জানি এই সময়ের কথা তোমার মনে থাকবে না। কিন্তু আমি তোমাকে এতটা কষ্ট দিলাম সেটা আমার মনটাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। এই কষ্টটা আরো তিনবার সহ্য করতে হবে তোমায়। তারপরই তুমি পুরোপুরি ভাবে আমার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমাদের দুজনের মাঝে আর কোনো বাধা থাকবে না। আমরা সারা জীবনের মতো এক হয়ে যাব। আমার মায়ের মত তোমাকে মরতে হবে না আমাদের সন্তানের জন্য। বরং তুমি তখন আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের রানী হবে। একজন ভয়ংকর ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হবে। ঠিক আমার মত শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ারে।”
কথাগুলো বলেই মুখে মৃদু হাসি দিল শ্রাবন। তারপর বিছানা থেকে নেমে আকাশে থাকা চাঁদের দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইল। চাঁদটা যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিছু বলতে চাইছে ওদের। বেশ কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকে এবার চোখ সরিয়ে চাঁদনীর দিকে তাকাল। দেখল ওর পুরোটা শরীর জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলোয়। যেন ওর শরীর থেকে এক প্রকার আলোকরশ্মি ঠুকরে পড়ছে। বিশেষ করে ওর গলায় কামরের জায়গাটা একদম জ্বলজ্বল করছে।
শ্রাবনের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। সে আবারও চাঁদনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। চোখ বন্ধ করে ওর গলার কাঁটা অংশটায় হাত রাখল। মুহূর্তের মাঝে কাটা অংশ মিলিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
সকাল 11 টা 15 মিনিট,
শরীরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় চাঁদনী। তার সারা শরীর যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। তার সাথে কি হয়েছে কিছুই মনে নেই তার। শুধুমাত্র অনুভব করতে পারছে শরীরের এই তীব্র যন্ত্রণা। সে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু তার চোখের সামনে যেন সব কিছুই ঝাপসা। কোন কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে যতটুকু অনুমান করতে পারছে, তাতে সে বুঝতে পারছে সে নিজের রুমেই আছে। হয়তো নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা এখনো বোধগম্য হয়নি তার।
সে শরীরের উপর প্রেসার দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করতে নেয়। কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠে না। তার শরীর যেন একদমই সায় দিচ্ছে না তাকে। সে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলে। দু চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা অশ্রু-জল। তীব্র যন্ত্রনার হাত থেকে বাঁচার জন্য মনে মনে মৃত্যু কামনা করতে থাকে সে। তখনই অনুভব করে তার মাথায় কেউ হাত বুলাচ্ছে। সে আবারো চোখ মেলে তাকায়। ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পায় শ্রাবণ তার সামনে বসে আছে। হাতে একগ্লাস দুধ নিয়ে। ওকে দেখে কিছু বলার মত সাধ্য নেই তার। শ্রাবনও কোন কথা না বলে তাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। তারপর দুধের গ্লাসটা তার সামনে ধরে বলে,
“একটু কষ্ট হবে কিন্তু এটা খেয়ে নাও চাঁদপাখি। সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখনি সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।”
কথাটি বলেই তার উত্তরের অপেক্ষা করে না। জোর করে দুধের গ্লাসটা তার মুখে ধরে। এবং তাকে খাওয়াতে থাকে। চাঁদনী ও কোন উপায় না দেখে এক চুমুকে সেটা খেতে থাকে। সবটুকু তরল খেতেই চাঁদনীর ভেতর থেকে যেন উল্টে বমি আসতে চায়। কিন্তু বমি হয় না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন নিজের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে,
“আমার কি হয়েছিল শ্রাবণ? আমি এখানে এভাবে পড়েছিলাম কেন? কি হয়েছিলো আমার?”
ওর কথার উত্তরে শ্রাবন হাতে থাকা গ্লাসটি পাশে টেবিলের উপর রেখে মৃদু হেসে বলল,
“কিছুই হয়নি তোমার। এমনি একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলে তাই তোমাকে জরিবুটি বানিয়ে খাওয়ালাম। এখন তুমি পুরোপুরি সুস্থ। এখন চলো তো আমার সাথে। তোমাকে নিয়ে আজ অনেক দূরে ঘুরতে যাব। ”
ওর কথার উত্তরে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো চাঁদনী। গম্ভির গলায় বলল,
“আমি আবার কখন অসুস্থ হলাম শ্রাবণ? আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি তো গতকাল রাতে আপনার জন্য অনেক সেজে ছিলাম। আপনার সাথে ছাঁদে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর কি হয়েছে কিছুই মনে পড়ছে না। তাহলে আমি এখানে বিছানায় এলাম কিভাবে। আর আমার গায়ের কাপড় চোপড় সব কিছু চেঞ্জ হলো কি করে? কি হয়েছিল আমার সাথে প্লিজ বলুন?”
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ একটুও ভিতু হলো না। বরং সে স্বাভাবিকভাবেই মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“তুমি তো দেখছি বড্ড ভুলোমন চাঁদপাখি। সারারাত এত আদর ভালোবাসা পেয়েও সব ভুলে গেলে? আর তোমার গায়ের পোশাক তো আমি চেঞ্জ করে দিয়েছি গতকাল রাতে। যদি মনে না থাকে তাহলে বলো, আবার নতুন করে দেখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে কী করেছি।”
ওর এমন কথায় বেশ লজ্জা পেল চাঁদনী। মাথা নিচু করে ফেললো সে। মনে মনে ভাবল সত্যিই তো সে কালকে রাতে সেজেগুজে শ্রাবনের সাথে ছাদে গিয়েছিল। হয়তো ওদের মাঝে কিছু হয়েছে। তাই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারপরেও মনের মাঝে একটা খটকা থেকেই গেল চাঁদনীর। কিন্তু মুখে আর কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইলো।
ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শ্রাবণ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ওর ডান হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“চাঁদপাখি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর দুজনে একসাথে খাবার খাব। আমি অপেক্ষা করছি তুমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসা।”
চাঁদনী ওর কথার কোন উত্তর দিল না। একবার ওর দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। একটু পর ফ্রেস হয়ে আসলে দুজন একসাথে নাস্তা করতে নিচে নেমে এলো। কিন্তু অদ্ভুতভাবে চাঁদনী খেয়াল করল বাসায় শুধু ওরা দুজন ছাড়া অন্য কেউই নেই। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“শ্রাবণ আমাদের বাসার বাকি লোকগুলো কই? মানে যারা এতদিন কাজ করতো তাদের কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
” তাদের সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি সাতদিনের জন্য। সবাই ছুটিতে গেছে। এখন বাসায় শুধু তুমি আর আমি। আর সাথে আমাদের রোমান্স।”
” কিন্তু সবাইকে একসাথেই কেন ছুটিতে পাঠালেন শ্রাবণ? আমাকে তো কিছু বললেনও না?”
” বললাম তো উনাদের সবাইকে ছুটিতে পাঠিয়েছি। তোমার সাথে সারাক্ষণ রোমান্স করব বলে। আমাদের তো অনেকদিন হলো বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দুজনের মাঝে সেরকম প্রেম মোহাব্বত ভালোবাসা আদর সোহাগ কিছুই হয়নি। সেগুলো কানায় কানায় পূর্ণ করতেই সবাইকে ছুটি তে পাঠিয়েছি। এখন তাড়াতাড়ি চলো দুজনে একসাথে খাবার খাব।”
কথাটি বলেই চাঁদনীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর বসিয়ে দিল। তারপর ওর সামনে বড় এক বাটি তরল রাখলো। যেটা দেখতে অনেকটা সুপ এর মত।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩১
#M_Sonali
“এটা কি শ্রাবণ? এমন দেখতে কেন এটা?”
ওর কথার উত্তর দিলো না শ্রাবণ। মৃদু হেসে ওর পাশে বসে বাটি থেকে এক চামচ তরল হাতে তুলে নিয়ে বললো,
“খেয়ে দেখো কি এটা। আমি নিজের হাতে বানিয়েছি শুধুমাত্র তোমার জন্য চাঁদ পাখি।”
চাঁদনীর কেন জানি না ওটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তারপরেও শ্রাবণ এত ভালোবেসে দিচ্ছে দেখে সে এক প্রকার জোর করেই হা করলো। সাথে সাথে শ্রাবণ তরলটা ওর মুখে ঠেলে দিলো। ওটার স্বাদ পেতেই চাঁদনীর রুপ যেন কিছুটা বদলে গেল। চোখটা হালকা লাল বর্ণ ধারণ করলো। সে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো তরলটার দিকে। শ্রাবনের হাত থেকে চামচটা কেড়ে নিয়ে দু’চামচ দ্রুত মুখে দিলো। তারপর বাটিটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু তরল শেষ করে ফেলল। তরলটা এতক্ষণ সুপের মত দেখা গেলেও, এবার সেটা আর সুপের মতো দেখতে লাগলো না। চাঁদনী যখন পুরোটা খেয়ে ফেলল তখন সেটার রং হল অনেকটা রক্তের মতো লাল। যেটা চাঁদনীর মুখের চারিপাশে লেগে আছে। ওকে এভাবে খেতে দেখে শ্রাবণের মুখে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি। সে মনে মনে বলল,
“আমি আমার কাজে অনেকটাই সফল হয়েছি। খুব শিগ্রই তুমি ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের রাণী হওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে চাঁদপাখি।”
তরলটা খাওয়া শেষ হতেই চাঁদনী আবারো নিজের স্বাভাবিক রূপে ফিরে এল। সে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে কাপাকাপা গলায় ঢুলতে ঢুলতে বলল,
“এটা কি ছিল শ্রাবণ? এটা এতটা মজার ছিল কেন? আমি আরো খেতে চাই।”
কথাটি বলেই সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরলো শ্রাবণের কোলে। সে ওর কথার কোন উত্তর দিল না। শুধু মুচকি হাসল। তারপর তাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
দিন পেরিয়ে রাত নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। কিন্তু চাঁদনীর এখনও জ্ঞান ফেরেনি। সে আগের মতোই চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে। যেন গভির ঘুমে তলিয়ে আছে সে। শ্রাবণ তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে আবারো সেই অন্ধকার রুমের ভেতর প্রবেশ করল। লাইট জ্বেলে সেই বইয়ের তাকের কাছে গিয়ে পুরোনো সে বইটি বের করলো। সেটা খুলতেই মাঝখানে একটি পৃষ্ঠায় দেখতে পেল বেশ কিছু লেখা। এবং উপরে একটি ছবি আঁকা। যে ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন ভয়ংকর ভ্যাম্পায়ার একটি নারীর গলায় কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খাচ্ছে। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। শ্রাবণ সেটা দেখে মৃদু হাসলো। নিচের লেখাগুলো পড়ে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা করলো। তারপর বইটা যথাস্থানে রেখে আবার রুম থেকে বেরিয়ে সোজা চাঁদনী কাছে চলে এলো।
ওর সামনে এসে নিজের ভয়ানক ভ্যাম্পায়ার রুপ ধারণ করলো সে। মুহূর্তে ওর কাছে ছুটে গিয়ে গলায় নিজের দাঁত বসিয়ে দিল। সাথে সাথে ঘুমন্ত চাঁদনী ছটফট করতে লাগল গলা-কা-টা মুরগির মত। এভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। তারপর শ্রাবণ তাকে ছেড়ে দিয়ে পাশে স্বাভাবিক রূপ নিয়ে শুয়ে পড়লো। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। আর মাত্র দুইবার এমন করলে চাঁদনী হয়ে উঠবে একজন ভয়ানক ভ্যাম্পায়ার। কথাটা ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো শ্রাবনের।
১ দিন পর,
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে আগের মতোই অসম্ভব অসুস্থ লেগেছে চাঁদনীর। শ্রাবণের দেওয়া জোরিবুটি দেওয়া দুধ খেয়ে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তারপরেই শ্রাবণ তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। অবশ্য যাওয়ার আগে তার প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর বাড়িতেও আগের কাজের লোক গুলোকে এনে কাজে লাগানো হয়েছে। চাঁদনীর ভীষণ মন খারাপ লাগছে। কেন জানে না ইদানিং মনটা ভীষণ হতাশ হতাশ লাগে। বারবার মনে হয় তার সাথে এমন কিছু হচ্ছে যার ব্যাপারে কিছুই জানেনা সে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ছাদের উপর চলে এসেছে। ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। একটু পরেই হয়তো রাত নেমে আসবে। চারিদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো শ্রাবণের আসার নাম নেই।
আনমনে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে আছে সে। আজ বড্ড বেশি বাবা এবং দাদির কথা মনে পড়ছে তার। কেন যেন মনে হচ্ছে আজকে তার সাথে ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে। বা অনেক কিছু ঘটে যাবে তার জীবনে। যেটার ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই। সে একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কখন যে চারিদিকে অন্ধকার নেমে রাত হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। যতক্ষণে খেয়াল হয়েছে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
হঠাৎ পাশে কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই ধ্যান ভেঙ্গে সেদিক ঘুরে তাকাল সে। দেখল বিশ্রী দেখতে একটি বিশাল বড় বাদুর দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। যার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। চাঁদনী চারিপাশে ফিরে তাকাল। দেখল রাত হয়ে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিপদ বুঝতে পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে। কিন্তু কেনো জানি তার ভয় হচ্ছে না। বরং ভিতর থেকে এক হিংস্র রুপ বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সামনে থাকা বাদুর রুপি ভ্যাম্পায়ার টা মুহূর্তে তার ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলো। তখনই চাঁদনীর মাঝে কি হলো সে জানেনা। সে হঠাৎ’ই হিংস্র হয়ে উঠলো। এবং তার সাথে যেন যুদ্ধে নেমে পরল। দুজনের মাঝে ভীষণ রকম ধস্তাধস্তি শুরু হল। যেন কারো সাথে কেউ পেরে উঠছেনা। ঘটনার এক পর্যায়ে চাঁদনী ওই ভ্যাম্পায়ার টার গলায় কামড় দিয়ে বসল। এবং মুহূর্তেই ভ্যাম্পায়ারটার গলার রগ ছিঁড়ে নিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। সাথে সাথে বাদুড় রুপি ভ্যাম্পায়ার ছাদের উপরে পড়ে ছটফট করতে করতে মৃত্যুবরণ করল। কিন্তু চাঁদনীর এখনো হুঁশ আসে নি। সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থেকে হিংস্র বাঘিনীর মত মুখ দিয়ে গর্জন করছে।
এভাবে বেশ কিছুটা সময় কেটে যেতেই সে ধীরে ধীরে নিজের স্বাভাবিক রূপে ফিরে এলো। তার খেয়াল হল সে কি করেছে। সে নিজের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল তার হাতে বিশাল বড় বড় নখ। যেগুলো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। তার মুখে লেগে আছে ওই ভ্যাম্পায়ারটার রক্ত। এবং তার মুখ ভেদ করে বেরিয়ে থাকা বড় দুটি সরু লম্বা দাঁত ধিরে ধিরে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। এটা খেয়াল হতেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল তার। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তার সাথে এটা কি হলো। তবে তার সাথে যে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেছে সেটা তার বুঝতে বাকি নেই। নিজেকে এমন ভয়ানক রূপে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলো সে। সাথে কষ্টে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় এলো না তার। ভয় ও আতঙ্কে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। চোখ দিয়ে অঝোর-ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। সে তো এমন জীবন চায়না।
সে ছাদের উপরে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। চিৎকার করে কান্না করতে লাগল। আর বলতে লাগল,
“এটা আমার সাথে কি হচ্ছে? শ্রাবন আপনি কোথায়? আমি জানি এসবের পিছনে আপনি আছেন। আপনি কেন এমনটা করলেন? কেন আমার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে এমন অভিশপ্ত ভ্যাম্পায়ার এর জীবন এনে দিচ্ছেন। আমি এমন জীবন চাইনা। যে জীবনে অন্য প্রানী বা মানুষের জীবন শেষ করে তাদের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এর চাইতে ভালো আমাকে মেরে ফেলতেন। তবুও এমন কাজ করতেন না। এটা আপনি কী করলেন শ্রাবণ। আমিতো আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। মন থেকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়ে ভালবেসে ছিলাম। কিন্তু আপনি আমার সাথে এমন করলেন? আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা কোরবোনা। কোথায় আপনি সামনে আসুন।”
কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলেই রাগে গর্জন করতে লাগল চাঁদনী। তখনই তার সামনে এসে উপস্থিত হল শ্রাবণ। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে চাঁদনী সব জেনে গেছে। যেটা তার ধারনার বাইরে ছিল। কারণ আজ রাতেই আর একবার চাঁদনীর ওইভাবে রক্ত পান করলে সে পুরোপুরি ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হবে। শুধু আজকের রাতটাই বাকি ছিল। আজকের রাতে বিশেষ কিছু জিনিসের জন্য একটি জায়গায় গিয়েছিল সে। কিন্তু এখানে এত কিছু ঘটে যাবে সে ভাবতে পারেনি।
শ্রাবণ কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে গর্জন করতে করতে উঠে দাঁড়ালো চাঁদনী। তেরে এসে শ্রাবনের কলার চেপে ধরল। গালে মুখে জোরে জোরে থাপ্পর মারতে মারতে বলল,
” আর কতবার বেইমানি করবেন আমার সাথে? আর কত ঠকাবেন আমায়? আমারই ভুল হয়েছে আপনার মত একটি মানুষ রুপি পিচাশকে ভালোবেসে। স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। আমার প্রথমেই বোঝা উচিত ছিল আপনার মনে ভালোবাসা বলতে কিছু থাকতে পারে না। আপনিতো একটা ভ্যাম্পায়ার, একটা নর-পিশাচ। যে কিনা পশু এবং মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। আপনাকে আমি ঘৃণা করি। আপনি আমার সাথে যেটা করেছেন তারপরে আপনার সাথে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমি এই ভয়ানক জীবন রাখতে চাই না। আমি জানি আমি যদি এই অবস্থাতে বেঁচে থাকি তাহলে আমিও হয়তো কারো না কারো মৃত্যুর কারণ হব। আপনি তো সেই ব্যবস্থা পুরোপুরি করে ফেলেছেন। চাইনা আমার এ জীবন। আমি এখনই নিজেকে শেষ করে ফেলব। মরে গেলেও আপনাকে আর কখনো ক্ষমা করব না। আই জাস্ট হেট ইউ শ্রাবণ। আই জাস্ট হেট ইউ।”
কথাটি বলেই শ্রাবনের মুখে আরও একটা থাপ্পড় মেরে ছাদের কিনারায় দৌড়ে গিয়ে সেখান থেকে নিচে লাফ দিলো চাঁদনী।
কিন্তু নিচে পড়ার আগেই তাকে ধরে ফেললো শ্রাবণ। তাকে বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে নিয়ে উড়ে যেতে লাগল অচিন দেশের উদ্দেশ্যে। চাঁদনী অনেকবার তার বুক থেকে ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠলো না। শেষে শান্ত হয়ে দেখতে লাগলো তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সে দেখল ঝাড় জঙ্গল আকাশ বাতাস বেরিয়ে যেন উড়ে চলেছে শ্রাবণ তাকে নিয়ে। এভাবে অনেকটা পথ উড়ে চলার পর একটি গভীর জঙ্গলের মতো জায়গায় গিয়ে পৌঁছালো তারা। চাঁদনী খেয়াল করে দেখল এই জঙ্গলের মাঝে একটি পশুপাখির চিহ্নটুকুও নেই। জঙ্গল টা এতটাই ঘন যে বলার বাইরে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে জঙ্গলের প্রতিটি গাছপালার কোনো পাতা নেই। বা গাছগুলো সবুজ নয়। যেন সবগুলো গাছই মরা ও শুকনো। আর এতটা বিশাল বিশাল যে কল্পনার বাইরে।
চাঁদনী বেশ অবাক হয়ে এসব কিছু দেখতে লাগল। হঠাৎ সে খেয়াল করল যেন গাছগুলো নড়াচড়া করছে। দেখে মনে হচ্ছে গাছগুলো জীবন্ত। যেন একে অপরের সাথে কথা বলছে। এবার বেশ ভয় হল তার মনে। কিন্তু সে কিছু বলার মত অবস্থায় নেই। হঠাৎ দেখল শ্রাবণ তাকে নিয়ে বিশাল বড় একটি প্রাসাদের সামনে নেমেছে। চাঁদনী প্রাসাদটার দিকে দেখেই বুঝে গেল এটা ভ্যাম্পায়ার রাজ্য। শ্রাবণ তাকে নিয়ে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে চলে এসেছে। কথাটা ভাবতেই আরেক দফা ভয় বাসা বাধলো তার মনে। কিন্তু রাগও হচ্ছে প্রচুর।
শ্রাবণ এখনো তাকে ছাড়েনি। আগের মতোই বুকে জড়িয়ে রেখেছে। তাকে নিয়ে উড়ে যেতে লাগল প্রাসাদের ভেতরে। প্রাসাদটা বাইরে থেকে দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু তার চাইতে বেশি ভয়ানক। কারণ প্রাসাদের দেওয়ালের সাথে ভয়ংকর সব ভ্যাম্পায়ার এর প্রতিচ্ছবি আকা।
শ্রাবণ ওকে নিয়ে সোজা নিজের দাদুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সে শ্রাবণ ও চাঁদনী কে একসাথে দেখে নিজের সিংহাসন থেকে নেমে এলো। গম্ভীর চোখে তাকাল দুজনের দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
“ওকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন? ও এইখানে আসার উপযুক্ত এখনো হয়নি। আজ তো তার উপযুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তাহলে তুমি নিজের কাজ শেষ না করেই ওকে এখানে কেন এনেছ শ্রাবণ?”
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,