ভয়ংকর সে পর্ব-৩৪+৩৫

0
308

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩৪
#M_Sonali

“কিরে চাঁদনী মা, এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস তুই? এভাবে রেডি হয়ে?”

সবেমাত্র রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হতে নিয়েছে চাঁদনী। তখনই পিছন থেকে ডেকে তার বাবা এ কথাটি বলে উঠল। সে স্বাভাবিক ভাবেই মৃদু হেসে উত্তর দিলো,

“তেমন কোথাও নয় বাবা। আসলে অনেকদিন হলো শিউলীর সাথে দেখা হয় না। তাই ওর কাছে যাচ্ছিলাম। একটু দেখা করে আসি।”

ওর কথার উত্তরে বেশ অবাক হলেন রতন মিয়া। ভ্রু কুঁচকে বললেন,

“চাঁদনী তোর মাথাটা কি আসলেই গেছে নাকি? এসব কি আবোল তাবোল বলছিস। ভুলে গেছিস শিউলি অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে। কার সাথে যেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে এক রাতে।”

ওর বাবার কথা শুনে মুখে হাসি ফুটে উঠল চাঁদনীর। কারণ সে ভালোভাবেই জানতো শিউলি সেখানে নেই। কারণ শিউলিকে তো অনেক আগেই শ্রাবণ রক্ত চুষে মেরে ফেলেছে। নিজের শক্তি হাসিলের জন্য। তাই ওর এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব এটা শিওর হওয়ার জন্যই ওদের বাসায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যেতে হলো না তার আগেই তার বাবা সবকিছু বুঝিয়ে দিল তাকে।

চাঁদনীকে হাসতে দেখে বেশ অবাক হলেন রতন মিয়া। সে ওর কাছে এগিয়ে এসে গম্ভির গলায় বললেন,

“কিরে তুই আবার হাসছিস কেন? তোর সবচাইতে ভালো বান্ধবী হারিয়ে গেছে এটা শুনে হাসছিস? মা সত্যি করে বলতো তোর শরীর কি খারাপ লাগছে? আজ তুই এমন আজব ব্যবহার কেনো করছিস বলতো?”

“আমার কিছু হয়নি বাবা। আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না। আসলে শিউলি দের বাড়িতে এমনি একটু ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম। থাক আর যাব না। তুমি থাকো আমি একটু বাইরে দিয়ে হেটে আসছি। ঘরের মধ্যে থেকে আর ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসব।”

কথাটি বলে রতন মিয়া কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল চাঁদনী। বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বড় করে নিঃশ্বাস টেনে সামনের দিকে হাটা শুরু করল। তার গন্তব্য তার আর এক বান্ধবীর বাড়ি।

গুটি গুটি পায়ে বেশ কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পরেই এক পাড়া-প্রতিবেশী চাচির সাথে দেখা হলো চাঁদনীর। ওকে দেখেই মহিলাটি বলে উঠলো,

“কে গো রতন ভাই এর মেয়ে চাঁদনী নাকি! অনেকদিন পর দেখলাম তোমায়। কবে আসছো?”

ওনার কথা শুনে চাঁদনীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে মুচকি হেসে বলল,

“এই তো চাচি ভালোই আছি। আপনি ভালো আছেন?”

ওর কথার উত্তরে মহিলাটি একগাল হেসে উত্তর দিলেন,

“ভালোই আছি। তা জামাইকে সাথে নিয়ে এসেছো নাকি একাই এসেছো? তোমার জামাইটাকে কিন্তু তোমার সাথে অনেক সুন্দর মানায়। এমন জামাই গোটা এলাকা খুঁজেও একটা পাওয়া যাবে না। সত্যি কপাল করে এত সুন্দর একটি জামাই পাইছো।”

চাঁদনী মৃদু হাসে, কোন উত্তর দেয় না। তারপর বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে গল্প করে সামনে এগিয়ে যায়। মহিলাটি চোখের আড়াল হতেই চাঁদনীর মুখে ফুটে ওঠে বিশ্বজয় করা হাসি। তার মানে সে কোন কিছুই স্বপ্ন দেখেনি। তার বাবা এবং দাদি সব কিছু ভুলে গেলেও এলাকার সকলের মনে আছে তার বিয়ের কথা। তার মানে শ্রাবণ সত্যিই তার জীবনে ছিল। কোন কিছুই মিথ্যে নয়। যদিও এটা তার অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু চাঁদনী বুঝতে পারছে না সে এমন কেন করল? কেন তার বাবা এবং দাদির মন থেকে তার সকল স্মৃতি মুছে দিল। কেনই বা তাকে এখানে রেখে গেল?

এসব কথা ভাবতে ভাবতে যেন মাথা ধরে যাচ্ছে চাঁদনীর। যেভাবেই হোক এই সকল প্রশ্নের উত্তর তাকে জানতেই হবে। আর সে শ্রাবনকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। তার কাছে ফিরে যেতে চায় সে। রাগের মাথায় যত কিছুই বলুক না কেন। সে তো শ্রাবণকে ভালোবাসে। বড্ড বেশি ভালোবাসে। তাই যেভাবেই হোক সে আগের মত তার কাছে ফিরে যাবে। সব ভুলে তার সাথেই সংসার করবে।
,
,
,
৭ দিন পর,
বিকাল ৪:৫৫ মিনিট,
জঙ্গলের রাস্তা ধরে সোজা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদনী। কোথায় যাচ্ছে বা কেন যাচ্ছে তার কোন হদিস নেই। সে একনাগাড়ে সামনে এগিয়ে চলেছে। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে। কোথায় কি আছে সেটা হিসাব করছে না। আশেপাশে দেখার সময় নেই তার। তার মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরছে। গত সাত দিনে সে হাজারবার শ্রাবনকে স্মরণ করেছে। ডেকেছে। কিন্তু সে একবারের জন্য আসেনি। বা তার কোনো অস্তিত্ব আশেপাশে টের পায়নি চাঁদনী। কিন্তু এমন কেন করছে শ্রাবণ? কেন তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না? কেনইবা আসছে না। এসব কিছুর উত্তর জানতে হবে তাকে।

এদিকে তার বাবা তাকে বিয়ে দিবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে। চারিদিকে ঘটক লাগিয়েছে পাত্র খোঁজার জন্য। যেটা চাঁদনীকে ভীষণ রকম কষ্ট দিচ্ছে। তাই সে আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভাবেই হোক আজকে সে শ্রাবনের সাথে দেখা করেই ছাড়বে।

এ সব কথা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের একদম ভিতরে চলে এসেছে চাঁদনী। হঠাৎ বেখেয়ালে কিছু একটার সাথে হোচট খেয়ে মুখ থুবরে আছড়ে পরে সে।

ওর পায়ের কাছেই একটি কাটাযুক্ত গাছের ডাল থাকায় সেই কাঁটাগুলো ওর হাটুতে ঢুকে যায়। যার কারণে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে সে। ব্যাথায় কোকিয়ে উঠে। ওর চিৎকারে কিছুটা দূরে জঙ্গলের মাঝে বসে থাকা বেশ কয়েকজন নেশাখোর ফিরে তাকায় ওদিকে। সবাই উঠে দাঁড়ায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এই জঙ্গলের মাঝে কে এসেছে রে? চলতো গিয়ে দেখি। মনে তো হলো কোনো মেয়ে মানুষ।”

কথাটি বলেই তারা চিৎকার লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। কিছু দূর আসতেই দেখতে পায় একটি সুন্দরী মেয়ে জঙ্গলের মাঝখানে শুয়ে থেকে পা ধরে ব্যথায় কোঁকাচ্ছে। ওকে দেখে লোকগুলোর মুখে বিশ্রি হাসি ফুটে ওঠে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আজকের দিনটা তো মজাই মজার। পাখি নিজেই এসে আমাদের মনোরঞ্জন করার জন্য ধরা দিয়েছে। তাহলে আর দেরি কেন চল ওকে নিয়ে যাই আমাদের ডেরায়। অনেকদিন হলো এমন সুন্দরী মেয়ের সাথে মজা করা হয় না।”

কথাগুলো বলেই আবারও বিশ্রি হাসি দিতে শুরু করে তারা। তারপর সবাই মিলে এগিয়ে আসতে থাকে চাঁদনীর দিকে। আশেপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত আশেপাশে ফিরে তাকায় চাঁদনী। সে মনে করে হয়তো শ্রাবণ এসেছে। কিন্তু পাশে তাকাতেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। সে দেখে নেশাগ্রস্ত বেশ কয়েকজন লোক তার দিকে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। লোকগুলোর চোখে কি বিশ্রি চাহনি। তাদের ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে আসতে দেখে যেন গা ঘিন ঘিন করে উঠে চাঁদনীর। ভীষণরকম রাগ হয় তার। সেইসাথে বুক কেপে ওঠে ভয়ে।

সে পায়ে ব্যথা পাওয়া সত্বেও জোর করে কষ্ট করে উঠে দাড়ায়। দৌড়ে পালানোর জন্য একদিকে প্রাণপণে ছুটতে থাকে। কিন্তু বেশিদূর চলতে পারে না সে। তার আগে লোক গুলো তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এবার চাঁদনী বেশ ঘাবড়ে যায়। সে বুঝতে পারে সে কত বড় বিপদে পরতে যাচ্ছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। চোখ বন্ধ করতেই শ্রাবণের মুখটা দেখতে পায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর হিংশ্র চেহারাটা। মুহুর্তেই তার সকল ভয় দূর হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে সে এ জন্যই এসেছে এখানে। তাহলে ভয় কেন পাচ্ছে। সে বেশ ভালো করেই জানে তার কোন কিচ্ছু হবে না। শ্রাবণ তার বিপদে পড়া কখনোই সহ্য করতে পারবেনা। সে অবশ্যই ছুটে আসবে তাকে রক্ষা করতে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩৫
#M_Sonali

চোখ বন্ধ করতেই শ্রাবণের মুখটা দেখতে পায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর হিংশ্র চেহারা। মুহুর্তেই তার সকল ভয় দূর হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে সে তো এজন্যই এসেছিল এখানে। তাহলে ভয় কেন পাচ্ছে। সে বেশ ভালো করেই জানে তার কোন কিচ্ছু হবে না। শ্রাবণ তার বিপদে পড়া কখনোই সহ্য করতে পারবেনা। সে অবশ্যই ছুটে আসবে তাকে রক্ষা করতে।

কথাগুলো ভেবে নিশ্চিন্তে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে চাঁদনী। আর অপেক্ষা করতে থাকে শ্রাবণের জন্য। কিন্তু এটাই যেন তার সবচাইতে বড় ভুল ছিল। আশে পাশের নেশা-খোর লোকগুলো ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শয়-তানি হাসে। তাদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠে,

“আরে আমরা খামোখাই ওকে ধরার জন্য এত চিন্তা করছিলাম। পাখি তো নিজেই আমাদের ফাঁদে থাকতে চায়। সেও হয়তো মজা নিতে চাচ্ছে। আরে এত ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। ধীরে ধীরেই মজা নেওয়া যাবে।”

কথাগুলো বলেই লোকগুলো হাসতে হাসতে ওর এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু তবুও চাঁদনী এক পাও নরে না। চুপচাপ সেখানেই দাড়িয়ে থাকে। তার যে ভয় করছে না তেমনটা নয়। মনে মনে অসম্ভব রকম ভয় পাচ্ছে সে। কিন্তু তার সাথে আশা নিয়ে বসে আছে শ্রাবণ তাকে বাঁচাতে আসবে। তাকে আসতেই হবে। সে চারি দিকে তাকিয়ে দেখে লোক গুলো একদম তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এই বুঝি ধরে ফেলবে তাকে। সাথে সাথে সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর একমনে শ্রাবনকে ডাকতে থাকলো। মনে মনে বলতে শুরু করলো,

“শ্রাবণ আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না? শুনতে পাচ্ছেন না আমার মনের চিৎকার? কেন এভাবে দূরে সরে আছেন। আজ যদি আপনি আমাকে বাঁচাতে না আসেন তাহলে চিরদিনের মতো আমাকে হারিয়ে ফেলবেন। আর কখনোই হয়তো আমার জীবিত মুখ খানি দেখা হবে না। এরা যে আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নষ্ট করে ফেলবে আপনার চাঁদ পাখিকে। মেরে ফেলবে এখানেই। আমি আজকে দেখতে চাই আপনার ভালোবাসা কেমন। কিভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দূরে রেখে তার ক্ষতি দেখতে পারেন। আপনার আসার অপেক্ষা করছি। আপনি না আসা অব্দি আমি এখান থেকে এক পাও নরবো না।”

কথাগুলো মনে মনে ভাবার সময় দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চাঁদনীর। সে চোখের জল টুকু হাত দিয়ে মুছে নিয়ে ধীরে ধীরে তাকায়। কিন্তু তাকাতেই যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যায়। কারণ তার আশেপাশে যে নেশা-খোর লোক গুলো ছিল তাদের মাঝে এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। চাঁদনী ঘুরে ঘুরে চারদিকে তাকায় সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু তার পাশের লোক গুলো যেন ত্রিসীমানার কোথাও নেই। সে আবার এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে খুঁজতে থাকে লোকগুলোকে। কিন্তু তারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

চারিদিকে একদম অন্ধকার হয়ে আসছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সেইসাথে জঙ্গলের করমর শব্দ যেন আরও ভয়ংকর করে তুলছে চারিদিকের পরিস্থিতি। চাঁদনী কি করবে ভেবে পায়না। কিছুতেই বুঝে আসেনা লোক গুলো হঠাৎ করে কোথায় মিলিয়ে গেল। সে তো কোনকিছু টেরও পেল না। তবে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে? এসব কথা ভেবেই যেন মাথা ধরে যাচ্ছে চাঁদনীর। সে এবার সিদ্ধান্ত নিল বাসায় ফিরে যাবে। তাই একমনে হাঁটা শুরু করল সামনের দিকে। কিন্তু সে ফিরে যাওয়ার বদলে পথ হারিয়ে আরও গভীর জঙ্গলে পৌঁছে গেল। যতক্ষণে তার খেয়াল হল ততক্ষণে অনেক রাত হয়ে গেছে। কোন দিকে বিন্দু পরিমান আলোর চিহ্নটুকুও নেই। নিজের হাতটাও নিজে দেখতে পাচ্ছে না।

চারিদিকে এমন অন্ধকার দেখে এবার যেন ভীষণ রকম কান্না পেতে লাগল চাঁদনীর। সে এমনিতেই অন্ধকার বেশ ভয় পায়। তার ওপর এমন ভয়ানক অন্ধকার সে জীবনে আর কখনো দেখেনি। নিজেকে ভীষণ রকম অসহায় লাগছে তার। তার মন বলছে শ্রাবণ আসবে না। সে হয়তো সত্যি হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। সে নিজেই শ্রাবনকে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। তার নিজের কারণেই শ্রাবণ তাকে একটি বারের জন্যও বাঁচাতে আসছেনা। তাকে বিপদে পড়তে দেখেও কোন সহানুভুতি দেখাচ্ছেনা। কথাগুলো ভেবে দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে চাঁদনীর। সে ভীষণ রকম ভেঙে পড়ে। হাঁটু গেড়ে সেখানেই বসে পড়ে কান্না করতে শুরু করে। পুরো জঙ্গলে তার কান্নার শব্দ টা যেন ভৌতিক রকমের শব্দ হয়ে প্রতিধ্বনি হতে থাকে।

বেশ অনেকটা সময় এভাবে বসে থেকে কান্না করতে থাকে চাঁদনী। তারপর নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। সে এবার যেভাবেই হোক জঙ্গল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু কিভাবে বের হবে সেটা ভেবেই যেন কুপোকাত অবস্থা। তবুও সে হাত দিয়ে হাতরিয়ে হাতরিয়ে নিচে পড়ে থাকা একটি গাছের মরা ডাল হাতে নেয়। সেটা দিয়ে কোনমতে গাছের অন্ধ মানুষের মত সামনের দিকে এগোতে থাকে।

বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই কিছু একটার সাথে হোচট খেয়ে মুখ থুবরে পড়ে চাঁদনী। সাথে সাথে সামনে পরে থাকা কিছু একটার সাথে ভীষণ রকম আঘাত পায় কপালে। কপাল ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। সে কপালে হাত দিতেই হাতটা ভিজে একাকার হয়ে যায় রক্তে। এবার যেন ভীষণ রকম কান্না পেতে থাকে চাঁদনীর। সে মনে মনে শ্রাবনের কথা ভাবতে থাকে। মনে মনে বলতে থাকে,

“আপনি সত্যিই অনেক বদলে গেছেন। আমাকে এত বিপদে দেখেও আপনি আমাকে বাঁচাতে আসছেন না। কোনরকম সাহায্য করছেন না। এই বুঝি ছিল আপনার ভালবাসা। ঠিক আছে আমি এখানেই পরে থাকবো। আপনার আসতে হবে না। আর কখনো দেখতে হবে না এই চাঁদনীর মুখ।”

কথাগুলো বলেই হু হু করে কান্না করে উঠল। ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে তার। সাথে রাগও হচ্ছে প্রচুর। সেখানে বসেই আবারও কান্না করতে লাগল। এদিকে কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে থুতনিতে এসে চুইয়ে চুইয়ে পরতে লাগলো নিচে। এভাবে বেশ কিছুটা সময় চলার পর, চাঁদনীর চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। একসময় সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল সে।
,
,
,
সকালে চারিপাশে পাখির কিচির-মিচির ডাকে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরে চাঁদনীর। সেই সাথে সুর্যের আলো এসে মুখে পড়ায় কোনমতে চোখ মেলে তাকায় সে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে। চারিদিকে একদম নিরব নিস্তব্ধ। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। চাঁদনী উঠে বসে। তার মাথা অনেক ব্যথা করছে। মাথাটা যেন ফেটে যাচ্ছে। মাথায় হাত দিতেই দেখে তার কপালের রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেছে। একদম পরিষ্কার হয়ে আছে কপাল ও মুখ। কিন্তু মাথা ফাটা আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে মনে হচ্ছে যেন ফাটা জায়গাটায় পরিস্কার করে কিছু লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চাঁদনী ভাবে এটা হয়তো তার মনের ভুল। হয়তো তেমন কিছুই হয়নি। তাই সে এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তাকে বাড়িতে ফিরতে হবে। উঠে দাঁড়াতেই যেন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নেয় সে। তবুও একটি গাছের সাহায্যে নিজেকে সামলে নেয়। তারপর গাছ ধরে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে বুঝতে পেরে গেছে শ্রাবণ আর কোনোদিনও ফিরবে না। সে শত বিপদে পড়লেও তাকে বাঁচাতে আসবে না। সে সত্যিই স্বার্থপরের মত চাঁদনীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বললে ভুল হবে। চাঁদনী নিজেই তাকে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। শেষবার অনেক বাজে আচরণ করেছে তার সাথে। তাই হয়তো রাগ করেছে। চিরদিনের মত ওর জীবন থেকে চলে গেছে। চাঁদনী এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। সে তো সত্যি সত্যি শ্রাবনকে ভালোবাসে বড্ড বেশি ভালোবাসে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে অনেকটা দূরে চলে এসেছে চাঁদনী। কিন্তু এখন পর্যন্ত সঠিক রাস্তা খুঁজে পায়নি সে। সে শুধু একই জায়গায় বারবার ঘুরেফিরে বেরোচ্ছে। যেন গোলকধাঁধায় আটকে গেছে সে। এবার তার প্রচণ্ড রকম খারাপ লাগতে থাকে। সে বুঝতে পারে তার বাবা এবং দাদি হয়ত তার চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে। তাকে হয়তো খুঁজা খুঁজি শুরু হয়ে গেছে। সে এমন ভুল পদক্ষেপ কেন নিল এসব ভেবে নিজের উপর রাগ হতে থাকে প্রচুর। সে আবারও মনে সাহস যুগিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে। তখনই তার সামনে বিশাল বড় একটি পুকুর পরে। জঙ্গলের মাঝখানে এমন পুকুর দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায় চাঁদনী। পুকুরে কোনো পানি নেই। শুধু একদম কুচকুচে কালো কাদা। যেন অনেক দিনের ময়লা জমা হয়ে কালো হয়ে গেছে কাদাগুলো। সেইসাথে কাদা থেকে উঠে আসছে বিশ্রী পঁচা গন্ধ।

এই গন্ধে চাঁদনীর যেন ভিতর থেকে সবকিছু উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চাঁদনী দ্রুত সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য পিছন দিকে ঘুরতে নেয়। তখনই সে কিছু একটা দেখে থমকে দাঁড়ায়। ভয়ে ভয়ে আবারও ফিরে তাকায় পুকুরের দিকে। সে দেখতে পায় পুকুরের মাঝখানে কাদার মধ্যে পাঁচ জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। যেন পাঁচজন মানুষ উল্টো হয়ে ঢুকে আছে কাদার মধ্যে। আর তাদের পা গুলো শুধু বের হয়ে আছে উপরে। বিষয়টা দেখতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে চাঁদনীর। সে আরো ভালো করে দেখার জন্য আরেকটু এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে দেখে। হ্যাঁ সে যেটা দেখছে সেটা সত্যি। সত্যি’ই পুকুরের মাঝখানে পাঁচটি মানুষের পা দেখা যাচ্ছে।

চাঁদনী ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে এক দিকে ছুটতে থাকে। ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেছে সে। যেন বুকের মাঝে একনাগাড়ে হাতুড়িপেটাচ্ছে তার। দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় যাচ্ছে তার কোনো দিক নেই। একসময় এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আবারো মুখ থুবরে আছড়ে পরে চাঁদনী। আশে পাশে তাকাতেই দেখে সে লোকালয়ের খুব কাছে চলে এসেছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তার মুখে ফুটে ওঠে জয়ের হাসি। কিন্তু ভিতরের ভয়টি এখনো যায়নি। সে আবারও উঠে দাঁড়ায়। পায়ে ব্যথা পাওয়ায় নেংড়িয়ে নেংরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে লোকালয়ের দিকে। কিন্তু লোকালয়ে পৌছেই সে খেয়াল করে অন্য কোন গ্রামে চলে এসেছে। এটা তার নিজের গ্রাম নয়।

এখানে কোনদিন এসেছে বলে তার মনে হয় না। সবকিছুই কেমন অচেনা অপরিচিত। গ্রামের মানুষগুলো তাকে দেখে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। চাঁদনী সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। অন্ততপক্ষে জঙ্গল থেকে বের হতে পেরেছে এটাই অনেক। ঐ জঙ্গলে থাকলে হয়তো ওখানেই মরে পড়ে থাকতে হতো তার। সামনে এগিয়ে যেতেই একটি মধ্য বয়ষ্ক লোকের সামনাসামনি পরে সে। লোকটা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। গম্ভির গলায় জিজ্ঞেস করে,

“এই মেয়ে কে তুমি? আর কোথা থেকে আসলে এখানে? তোমাকে এই গ্রামে এর আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না? তোমার শরীরে এত আঘাতের চিন্হ কিসের।”

উনার কথার উত্তরে চাঁদনী বেশ ঘাবড়ে যায়। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“আমি চাঁদনী। অমুক গ্রামে আমার বাড়ি। জঙ্গলে ঘুরতে এসে রাস্তা হাড়িয়ে এখানে চলে এসেছি। আপনি কি আমায় একটু বাড়ি ফিরতে সাহায্য করতে পারেন প্লিজ?”

ওর কথার উত্তরে লোকটি বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে দেখে নিয়ে বিশ্মিত গলায় বলে,

“কি বলছো তুমি এসব? ওই জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছো। আর এক রাত থেকে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছো! এটা কিভাবে সম্ভব? ওই জঙ্গলে কেউ গেলে ফিরে আসে বলে তো জানা যায় না। আজ অব্দি জঙ্গলের মাঝে রাতের বেলায় যে গিয়েছে সে আর কখনো ফিরে আসেনি। তুমি ফিরে এলে কিভাবে?”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,