#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯
ফোন ধরে বসে রয়েছে রাগিনী। মাঝে মাঝে দুটো হাত দিয়ে ফোন মুচড়ে ধরছে। ঠোঁট কামড়ে গভীর কোনো চিন্তায় মশগুল। তার অক্ষিকোটরে থাকা সেই প্রগাঢ় কৃষ্ণবর্ণের মণি দুটো ফ্লোরের দিকে স্থির। খুব কম টেম্পারেচারে চালিয়ে রাখা এসিও রাগিনীর কপালের ঘাম কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটা সময় পর দৃষ্টিটা ফোনের দিকে নিয়ে এসে ফোনের লকটা খুলে আবারও কল লিস্টে প্রবেশ করল সে। অনেক হন্নি হয়ে খুঁজে একটা নম্বরে এসে চোখ আটকালো তার। একবার দম নিয়ে কল করল সেই নম্বরে। কানে ধরল। কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পর ভেসে এলো এক চিকন মেয়েলি কন্ঠ।
“হ্যালো, রাগিনী। হোয়াটস্ আপ? কী খবর? পড়াশোনায় একদমই ডুব লাগিয়েছিস নাকি? কোন গর্তে গিয়ে লুকিয়েছিস?”
রাগিনী না চাইতেও হেঁসে শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
“তেমন কিছু না, উর্মিলা। একটু পড়াশোনায় বিজি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক্সাম শেষে এখন একদম ফ্রি! ঢাকায় এসেছি বেশ কয়েকদিন হলো।”
“তোর যা চাপ! আঙ্কেলের মতো সাইকোলজিস্ট হবি। কিপ ইট আপ। তো আয় একদিন দেখা করি। কতদিন তোকে দেখিনা ইয়ার!”
“অবশ্যই একদিন দেখা করব। কিন্তু একটা কথা ছিল।”
বেশ গাম্ভীর্যের সাথে কথাগুলো বলল রাগিনী। অপরপাশ থেকে আগ্রহের সাথেই জবাব আসে।
“কি কথা বল না!”
রাগিনী কিছুটা সংকোচ নিয়েই বলে,
“তুই বলেছিলি না? তোর মামা মেন্টাল পেশেন্ট নিয়ে রিসার্চ করে? স্পেশালি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট নিয়ে?”
“হ্যাঁ। মামা তো এসব নিয়েই বিজি থাকেন এখন পার্টনারস্ নিয়ে।”
“তো উনার থেকে একটা হেল্প লাগতো। তুই কি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট নিয়ে যত ইনফরমেশন আছে বা যত আর্টিকেল আছে সব কালেক্ট করে দিতে পারবি?”
উর্মিলা ওপাশ থেকে উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
“হুয়াই নট। দিতে তো পারব। কিন্তু হঠাৎ তোর এগুলো কোন কাজে লাগবে?”
কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় রাগিনী। নিজের মনে জমে থাকা সব কথাগুলো আয়ত্তে করে নেয়। নিজেকে সামলে বলে,
“ফোনে এতো কথা বলা পসিবল নয়। একদিন দেখা করিস। সেদিন বলবো।”
উর্মিলা হচ্ছে কথার ঝুরি। যার কথা শুরু হলে থামানো বড্ড মুশকিল। এক কথায় বাঁচাল যাকে বলা হয়। এই মেয়েটা রাগিনীর বান্ধবী সেই স্কুল জীবন থেকেই। দুজনে একসঙ্গে স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করলেও রাগিনীর ভাগ্যে পড়ে চট্টগ্রাম। সে সেখানে তার খালার বাড়ি থেকে পড়াশোনা শুরু করে। ফলে দুজনের যোগাযোগ কমে। আজ উর্মিলা তার পুরোনো বান্ধবীকে কাজ ছাড়া করবেই না। কথার উপর কথার বর্ষন হতে থাকে। প্রায় গুনে গুনে ত্রিশ মিনিট পর রাগিনী ঘুমের বাহানা দিয়েই ফোনটা কাটে। ফোনটা বিছানায় রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাগিনী আপনমনে আউড়ায়,
“মুখে যেন পপকর্ণ। আগের মতোই রয়ে গেল মেয়েটা।”
কথাটুকু শেষ হবার পর চুপচাপ বসে থাকে রাগিনী। কথার মাঝে দরজা খুলে রিওকে নিজের ঘরে এনেছিল সে। এখন রিও পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। তার গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় রাগিনী। রাত বেশি না হলও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে আজ তার ঘুম হবে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা হচ্ছে যেন। সে খুব করে চায় তার বিশ্বাস জিতে যাক। সেই বিশ্বাস যাকে ভর করে সে কোহিনূরকে আস্তে আস্তে নিজের মনের সংলগ্নে এনেছে। সে চায় তার দেখা জিনিসগুলো ভুল প্রমাণিত হক। সঠিক হক তার দেখা সেই সুন্দর দৃষ্টি। ঠিক প্রমাণিত হক মানুষটির বলা প্রতিটা কথা!
পরদিন রাগিনী ঠিক করল সে আজ কোহিনূরের কাছে যাবে না। বাড়িতেই থাকবে। তার বাবার কথা রাখার চেষ্টা করল সে। যেই ভাবা সেই কাজ। সারাদিন বাড়িতেই কাটল তার। তবে কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে। কিছুটা অশান্তি নিয়ে। মূলত অশান্তি কোথায় সেটা তার জানা নেই। চারিদিকে সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতো ফাঁকা ফাঁকা লাগার কারণও তার জানা নেই। একদিনেই কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। বাড়িতে আর ভালো লাগছে না। ক্ষণে ক্ষণে গিয়ে নিজের আঁকা স্কেচ খুলে খুলে দেখছে। যেখানে সে কোহিনূর সাহেবকে সে নিজের মতো করে এঁকেছিল। তবুও যেন এই স্কেচটা জীবন্ত নয়। এতে সেই দৃষ্টি নেই যেই দৃষ্টি রাগিনীর মনে উথাল-পাতাল সৃষ্টি করে। এই স্কেচ তার সাথে কোনোরকম কথা বলে না। উদ্ভট সব কথা বলে তাকে রাগিয়ে দেয় না। এই স্কেচে থাকা মানবটিকে রাগিনী চোখ রাঙানি দিতে পারে না। এতো মহা মুশকিল!
বিকেল বেলা কোহিনূরের স্কেচই ঘাটাঘাটি করছিল রাগিনী। অবশেষে না পেরে স্কেচটা একটা বড় ফ্রেমে সেট করে খালি দেয়ালে আঁটকে দিয়েছে। কাজটা করেই ফিরে এসে বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে বসে সে। ব্যাকুল চোখ দুটো সরে না স্কেচ থেকে। আনমনে সে বলে ওঠে,
“কোহিনূর রত্ন, আপনি আমার কাছে একজন অদ্ভুত জাদুকর। আপনি কি সেই জাদু দিয়েই আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারবেন?”
কোনোকিছুর স্পর্শ পেতেই নিচু হয়ে তাকায় রাগিনী। রিও তার সামনের পা দিয়ে রাগিনীকে ডাকছে বারবার। রাগিনী তাকাতেই সে ভং ধরে শুয়ে পড়ে খেলা করতে লাগে। রাগিনী হেঁসে ফেলে তৎক্ষনাৎ। রিওর মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“এতো ভং ধরা কই থেকে শিখেছো লিটল কিউটি?”
কথাটা বলতেই তার স্মরণে এলো কোহিনূরের বলা কথাগুলো। লোকটা বলেছিল, ‘দেখো একদিন হতে না হতেই তোমার সঙ্গে থেকে থেকে সে তোমার স্বভার পেয়ে যাচ্ছে। যখন তখন আমাকে ধমকাচ্ছে।’
রাগিনী আবার নিঃশব্দে হাসলো। পরমুহূর্তেই মুখটা ভার হলো তার। সে আবারও কোহিনূরের কথা মনে করছে? নিজের মাথা জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে রিও এর দিকে একটু ঝুঁকে রাগিনী আদুরে সুরে বলে,
“তুমি বাড়ি থেকে বোর হচ্ছো রিও? তাহলে চলো বাহিরে থেকে ঘুরে আসি?”
রিও যেন মনে মনে খুশি হয়। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে থাকে। সেও বোধহয় বাহিরে যেতে চায়। রাগিনী মুচকি হেঁসে তাকে কোলে তুলে নেয়।
বিকেলে আকাশ জুড়ে নামে রঙিন মেঘের খেলা। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নিজেরে নীড়ে ফিরতে দেখা যায়। সূর্যের দিনের শেষ রোদটা তখন একটু নমনীয় হয়ে ওঠে। হালকা রোদের তাপে তখন পরিবেশ স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল রায়ান। গাড়িতে তেল নেই। পাম্প স্টেশনে দাঁড় করানো ছিল তার গাড়ি। রাস্তার একপাশে রায়ান একনাগাড়ে ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলে চলেছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। শার্টের মাঝখানে ঝোলানো সানগ্লাসটা নড়ছে। স্কাই ব্লু রঙের শার্টের বোতামের ফাঁকে আটকানো সেটি। মুখে পড়েছে বিকেলের সেই নম্র রোদ।
“হ্যাঁ। আমি আসছি এখনি। আর পনেরো মিনিটের মতো লাগবে।”
বলেই ফোনটা কাটে রায়ান। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে আসে গাড়ির দিকে। বিল মিটিয়ে দিতেই গাড়ির দরজা খুলে যখন বসতে যাবে তখনই তার নজরে পড়ে গাড়ির পেছনে থাকা একটা মেয়ের। তৎক্ষনাৎ রায়ান বলে ওঠে,
“কে ওখানে?”
গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি হকচকিয়ে ওঠে। রায়ান দ্রুত পেছনের দিকে যেতেই মেয়েটি বেরিয়ে আসে। মুখটা মাস্ক দিয়ে ঢাকা সেই নারীর। চোখটা বেরিয়ে থাকলেও সামনের চুলগুলোতে লেয়ার কাট দেওয়ায় কপাল ও চোখের অর্ধেকটাও ঢেকে গিয়েছে। পরনে ছিমছাম সুন্দর একটা টপস আর গলায় একটা স্কার্ফ ঝোলানো। মেয়েটা ভয়াতুর গলায় বলে ওঠে,
“বিলিভ মি! আমি কিচ্ছু করিনি।”
“বিলিভ করার মতো কোন কাজটা করলেন ম্যাডাম? গাড়ির পেছনে চোরের মতো লুকিয়ে থাকলে কাকে বিলিভ করা যায়?”
মেয়েটির চোখে স্পষ্ট ভয়। আমতা আমতা করছে। রায়ানের ভ্রু কুঁচকে যায়। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে মেয়েটাকে। কিন্তু ঠিক মনে আসছে না। রায়ান হাত নাড়িয়ে আবারও বলে,
“ও হ্যালো! কিছু বলুন নাহলে…”
“আ…আসলে আমার ভাই এ…এক্সিডেন্ট করেছে। আমি তো টাকা নিয়ে বের হতে ভুলে গেছি। তাই কেউ লিফট দিচ্ছে না।”
রায়ানের কাছে বিষয়টা অযৌক্তিক লাগলেও সে বিষয়টা এড়িয়ে বলে উঠল,
“তাহলে চলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিই?”
“আ…আপনি…”
মেয়েটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রায়ান বলে ওঠে,
“হ্যাঁ। কাম।”
মেয়েটা একটু একটু করে পিছিয়ে যায়। রায়ান ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায়। তীব্র সন্দেহ জাগছে তার মনে। তাকে জানতে হবে মেয়েটা কে। রায়ান এগিয়ে যেতেই মেয়েটি তড়িঘড়ি করে ফোন ধরে বলে,
“হ্যালো, মা। তোমরা পৌঁছে গেছো? আমি দেরিতে গেলেও হবে?”
বলেই চুপ রইল মেয়েটি। আঁড়চোখে তাকালো। রায়ান এখনো সন্দিহান হয়ে তার দিকেই চেয়ে রয়েছে দেখে মেয়েটি আবারও বলল,
“ঠিক আছে তাহলে রাখছি।”
বলেই ফোনটা রাখল মেয়েটি। আর রায়ানের উদ্দেশ্যে ধড়ফড়িয়ে বলে উঠল,
“থ্যাংক ইউ আপনাকে। কিন্তু আমার আর লিফট লাগবে না। মা হসপিটালে পৌঁছে গেছে।”
বলেই রায়ানকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটি দ্রুত পেছন দিকে হাঁটা ধরল। রায়ান ডাকতে চাইলো। কিন্তু এই রাস্তায় কোনো মেয়েকে আটকানো ঠিক হবে না বলে মনে করল। তাই মেয়েটির অযৌক্তিক কথাগুলো চিন্তা করতে করতে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল সে। গাড়ি স্টার্ট দিল। সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল দ্রুত। বেশ কিছুদূর যেতে যেতে কিছুক্ষণ আগে দেখা হওয়া সেই মেয়েটির মুখ স্মরণে এলে হঠাৎ করেই রাস্তার মাঝে দ্রুত গাড়ি সাইড করে গাড়ি থামায় সে। কেমন যেন গোলমেলে লাগছে সে। মাথায় অতিরিক্ত চাপ দিতেই তার মনে পড়ে সে এই মেয়েটাকে চিনে। হুবহু সেই রাগিনী তাজরীনের মতোই ছিল চোখ। যদিও অনেকাংশেই ঢাকা ছিল মুখশ্রী কিন্তু রায়ানের চোখ চিনতে ভুল করবে না। সে বিরবির করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,
“তবে সে আমার গাড়িতে কী করছিল?”
কিছু একটা মনে আসতেই আশংকা করে ঝড়ের গতিতে নিজের গাড়ির সিট বেল্ট খুলতে শুরু করে সে। গাড়ির দরজায় হাত লাগায়। টেনশনে গাড়ির দরজাও সহজে খুলতে পারছে না। অবশেষে সক্ষম হয়েই বাহিরের দিকে নেমে অনেকটা দৌড়ে কংক্রিটের দিকে যেতেই তীব্র বিকট শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে। রায়ান সবে তিন থেকে চার ধাপ রাখতে পেরেছিল বাহিরে। তৎক্ষনাৎ এমন ঘটনায় বেশ দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে সে উপুড় হয়ে। শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। কোনোরকমে মাথা উঠিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে দেখে তার গাড়িতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। আর একটু হলে বোধহয় সে নিজেও সেই গাড়ির সাথে পুড়ে জ্বলে যেতো। ঝাপ্সা দেখতে চারিপাশ। চোখজোড়া হয়ে আসছে নিস্তেজ।
পা টিপে টিপে করিডোর দিয়ে হাঁটছে রাগিনী। একহাতে একটা ব্যাগ। অন্যহাতে রিও। আশেপাশে তাকাচ্ছে সে বারংবার। চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আশেপাশেই নেই তো? মন যে মানছে না আর। শুধু একটুখানি খবর পাওয়ার জন্য ছটফটিয়ে উঠেছিল। দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। অন্যদিকে মস্তিষ্ক বলেছিল, হসপিটালে আজকের দিনটা অন্তত পা না রাখতে। তবে দিনশেষে মন ও মস্তিষ্কের কঠিন লড়াইয়ে মনের জিত হয়। মনের আদেশ পালন করতে রাগিনী আবারও হসপিটালে পা রাখে। তবে তার উদ্দেশ্য একটাই। কোহিনূরকে সে দেখা দেবে না। কোনোমতে খাবার তার ঘরে রেখে পালাবে।
সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কোহিনূরের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল সে। উপরে রুম নম্বর লিখা ১০৭। দরজা হালকা করে ভিড়িয়ে দেওয়া। রাগিনী আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেও বৃথা গেল চেষ্টা। বিরক্তিতে ‘চ’ এর ন্যায় শব্দ করে আরেকটু দৃষ্টি প্রবল করে দেখতে চাইলো। সেই মূহুর্তেই চোখের সামনে আস্ত প্রশস্ত হাত চলে এসে তার চোখ দুটো চেপে ধরল। হতবিহ্বল হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাগিনী। ঢক গিলে ফেলল বেশ কয়েকটা। মনে হচ্ছে পুরো প্ল্যানটাই পানিতে গেল। কারণ এই হাওয়ায় এমন সুভাস তখনি আসে যখন তার আশেপাশে সেই কাঙ্ক্ষিত মানবটির আনাগোনা হয়। এই শীতল স্পর্শ রাগিনীর পরখে পরখে চেনা। এবার সেই পুরুষালি কন্ঠে শিরশির করে কেঁপে উঠল রাগিনী।
“এতো কাছে এসেও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তো হবে না মিস!”
“কেন?”
“আপনি যতই অতলে গিয়ে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন কিংবা অজস্র নারীর মাঝে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করুন আমার এই দৃষ্টি ঠিক আপনার উপরেই পড়বে। আপনাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে নেবে। কাছে এভাবেই টেনে নেবে।”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০
“আমি কেন আপনার থেকে পালানোর চেষ্টা করব বলুন তো? আপনি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
রাগিনীর এমন কথা শুনে ঠোঁট বাঁকায় কোহিনূর। ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে অতঃপর এক ঝলক হেঁসে দরজায় হাত রেখে একটু ঝুঁকে উত্তর দেয়,
“বাঘ বা ভাল্লুককে তো শি’কার করা যায়, বন্দি বানানো যায়। কিন্তু কোহিনূরকে আপনি শি’কার করতে পারেন না। বন্দিও করতে পারেন না। তাই নিজেকে বন্দি রাখার চেষ্টা করছে। এম আই রাইট?”
রাগিনী দমে না। তবে দৃষ্টিটা নামিয়ে নেয় এবার। দৃষ্টি মেলানো সম্ভব হচ্ছে না মানুষটির সাথে। কন্ঠে খানিকটা ঝাঁঝ এনে বলে,
“কীসব আজেবাজে কথা। পাগল লোক!”
“তা সেই পাগলের সেবা করতে সবে হাজির হলে? আরো আগে হাজির হওয়া উচিত ছিল তোমার। পেশেন্টের প্রতি এতো ইরেসপন্সিবল হলে হয়?”
এবার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে রাগিনী। তেতে উঠে বলে,
“হেই লিসেন, আমি এই হসপিটালের কোনো ডক্টর নয় যে আপনার প্রতি আমাকে রেসপন্সিবল হতে হবে। বাকি যারা আছে তারা দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছিল না। তাই আমাকে এসব করতে হচ্ছে।”
আরেক দফা হাসে কোহিনূর। তার হাসিটা যখন বেড়েই চলে তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলে রাগিনীর হৃৎস্পন্দন। শরীরটা কেমন যেন শিউরে ওঠে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তার দৃষ্টি এক জায়গায় আঁটকে যায়। বেহায়া হয়ে মানবটির হাসির সৌন্দর্য উদ্ঘাটন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাগিনীর কানে এবার কোহিনূরের বলা কথাগুলো ঝনঝন করে বেজে ওঠে।
“তাই যদি হয় তাহলে বাকিদের নিয়ে ব্যস্ততা নেই কেন তোমার? তারাও তো এখানকার। কেন তোমার হাজারও ব্যস্ততার মাঝে শুধুই কোহিনূর বিরাজ করে?”
কান গরম হতে থাকে রাগিনীর। কথাগুলো হজম হয় না। সত্যিই তো তাই। কেন এই মানুষটিকে ঘিরেই তার এতো ভাবনা? রাগিনী আর ভাবতে চায় না। কথা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি করে রাগিনী তার হাতে থাকা ব্যাগটা ধরিয়ে দেয় কোহিনূরের হাতে। আর বলে,
“ধরুন আপনার জন্য খাবার। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আমাকে যেতে হবে। আজকে গাড়িও নিয়ে আসিনি আমি।”
রাগিনী এই বলে পেছন ফিরে হাঁটা ধরে। কোহিনূর তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পেছন থেকেই শান্ত সুরে বলে ওঠে,
“যেও না রাগিনী! কিছুক্ষণ থাকো।”
লোকটার কথাতেও যেন জাদু রয়েছে। তার কথা হয়ে দাঁড়াল রাগিনীর কাছে মস্ত বড় বাঁধা যা টপকে রাগিনী আর এক পাও হাঁটতে পারছে না। সেই ছোট্ট কথায় মিশে ছিল করুণ সুর। হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে না তাকিয়ে রাগিনী রিওকে ভালো করে কোলে নেয়। আর বলে,
“কেন? আমি তো শুনলাম আপনার কাউন্সেলিং ভালোভাবেই হয়েছে আজ। তাই আমার দায়িত্ব তো শুধু ছিল খাবার পৌঁছে দেওয়া। কারণ এখানকার খাবার খেতে আপনি পারেন না। খাবারের জন্যই তো আমাকে প্রয়োজন ছিল তাই না?”
কোহিনূরের বলা কিছু মূহুর্তের জন্য থেমে গেল। বিস্ময়ে ছেয়ে গেল তার চোখ। আজ রাগিনীর কথাবার্তা তার বেশ অন্যরকম লাগছে। মেয়েটার এমন কথা বলার কারণ সে বুঝে উঠতে পারছে না। সরাসরি তীব্র আঘা’তও হানছে সেইসব কথা। কথা গুলোর ধার এতোই তীব্র হয় বুঝি? তবে কোহিনূর মুখে কিছু বলল না। রাগিনী আবারও যেতে ধরল। তখন আবারও কোহিনূর নিরবতা ভেঙ্গে বলে ওঠে,
“আর একটু থাকলে হতো না?”
“কেন?”
কোহিনূর না চাইতেও জোর পূর্বক হেঁসে বলে ওঠে,
“মিস. রাগিনী থাকলে আমি যা খাবারই খাই না কেন তা আরো দশগুন বেশি স্বাদে পরিণত হয়। আই থিংক ইউ আর অ্যা ম্যাজিশিয়ান। একটু থাকবে?”
আবদারের সুরে বলা কথাগুলো এড়াতে পারলো না রাগিনী। তবে তার হাসি পেলো এমন কথায়। হাসিটা চাপিয়ে রেখে সামনে ঘুরলো সে। তার সামনে ঘোরা দেখে হাসি ফিরল কোহিনূরের। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়েই রিও তার সামনের দুটো পা উঁচিয়ে ছটফটিয়ে জোরে মুখ দিয়ে শব্দ করে কোহিনূরকে ধমকালো যেন। রাগিনী তা দেখে রিও এর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে করতে বলল,
“দেখেছেন? সেও বাড়ি যেতে চাইছে।”
“ছোটবেলায় আমার বাবাও আমার দিকে এতোবার চোখ গরম আর ধমকানি দিয়েছে নাকি আমার জানা নেই যতবার এই পিঁপড়ের মতো দেখতে এই ছানা আমাকে ধমকায়।”
রাগিনী এবার হাসি থামাতে পারল না। ফিক করে হেঁসে দিল। সেই হাসির ঝংকারে কোহিনূরের মনের দ্বারে যেন শান্তির বাতাস বয়ে গেল। এইতো! রাগিনী আগের মতো হাসছে। এভাবেই তো তাকে ভালো লাগে।
খাওয়ার সময় কোনো প্রকার কথা বলেনি রাগিনী ও কোহিনূর। কোহিনূর নিরব ভাবে খেয়েছে আর রাগিনী কখনো রিওকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে নয়ত কোহিনূরকে আঁড়চোখে দেখার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। এমনভাবেই সময় শেষ হয়। পৃথিবী জুড়ে অন্ধকার নামে। রাগিনীর যাওয়ার তাড়া শুরু হয়। তার বাবা আসার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। সে আবারও সেসব অনাকাঙ্ক্ষিত কথাবার্তা শুনতে চায় না। তাই সে তড়িঘড়ি করে বলে,
“আপনার খাওয়া তো শেষ। আমি এখন যাচ্ছি।”
“জাস্ট ফাইভ মিনিটস্।”
হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে উৎসুক সুরে বলে কোহিনূর। বসে থম ধরে বসে থাকে। কোহিনূর তাকে প্রশ্ন করে,
“আজ এভাবে পালাতে চাইছিলে যে?”
এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাগিনী। আমতা আমতা করে বলে,
“এমনি। বাড়িতে কাজ আছে আমার।”
“কী কাজ?”
রাগিনী বিরক্ত হবার ভান করে বলে,
“সব কিছু আপনাকে বলতে হবে নাকি?”
কোহিনূর আরো কিছু বলতে উদ্যত হয়। তবে বলতে গিয়েও থেমে যায়। কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে বসে থেকে ফট করে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
বলেই আর দেরি করে না কোহিনূর। প্রস্থান করে। সে যাওয়ার সাথে সাথে রিও এর দিকে তাকায় রাগিনী। তার ঘুম পেয়েছে বেশ। ঘুমে টলে টলে পড়ছে। দ্রুত বাড়িতে গিয়ে আগে তাকে খাওয়াতে হবে। কিন্তু এই জেদি লোকটার কারণেই তো যত সমস্যা!
মিনিট পাঁচেক পর ফিরল কোহিনূর। কেমন যেন এলোমেলো লাগল তার ভঙ্গি। রাগিনীর সাথে কোনোরূপ কথা না বলে এবার ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তাড়ার সাথে বলল,
“রাগের রানী! আমার খুব ঘুম পেয়েছে। তুমি যাও তো। আমি ঘুমাবো।”
অবাক না হয়ে পারল না রাগিনী। এবার মানুষটার কণ্ঠে বাচ্চামি। সে তড়তড় করে বলল,
“আমি তো সেই কখন থেকে যেতে চাইছি। আপনিই তো যেতে দিচ্ছেন না।”
কোহিনূর নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিল,
“তখন মন চাইছিল না যেতে দিতে। এখন আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করছে তাই যেতে বলছি। তুমি কি আমার সাথে থাকতে চাও? ঘুমাবে? তাহলে সমস্যা নেই।”
“মহা অসভ্য লোক তো আপনি। আমি যাচ্ছি।”
বলেই তাড়াহুড়ো করে হাতে ব্যাগ আর রিও কে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাগিনী। রাগে বিরবির করতে করতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সে যাবার সাথে সাথে চোখ খুলে তার প্রস্থান দেখল কোহিনূর। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসল। বড় একটা শ্বাস নিল।
আধো আধো চোখে চারিপাশটা দেখার চেষ্টা করল রায়ান। চোখটা খুলতে পারছে না তবুও জোর করে খুলছে। আশপাশটা হালকা আলোয় অস্পষ্ট। কেমন যেন উদ্ভট গন্ধ এসে ঠেকছে নাকে। হাতটা একটু খানি নাড়ানোর চেষ্টা করতেই ব্যথা অনুভব করে সে। চোখমুখ সরিয়ে আসে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে ব্যথিত হয়ে ‘উহ’ করে ওঠে। চোখটা বড় বড় করে মেলতেই সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সোজা হয়ে বসে থাকা পুরুষটি। প্রথমে বুঝতে না পারলেই পোশাক পড়ার ধরন দেখে বুঝতে সময় লাগে না মানুষটা নির্জন। মাথা একটু ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি প্রখর করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে এটা হসপিটাল। আর নির্জন তাকে দেখতে এসেছে। রায়ানের জ্ঞান ফিরতে দেখে নির্জন বলে ওঠে,
“আর ইউ ওকে?”
রায়ানের কথা বলতে আরেকটু সময় লাগবে। গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না। তাই সে একটু মাথা দুলিয়ে জানান দেয় সে ঠিক আছে। বুকে হাত বটে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে নির্জন। আর জিজ্ঞেস করে,
“কী করে হলো এসব?”
রায়ানের চোখে এবার ভেসে ওঠে তার সাথে ঘটা সেসব ভয়াবহ ঘটনা। সেই মানবীর চোখ, কথা বলার ধরণ স্মরণে আসতেই অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“রাগিনী! রাগিনী তাজরীন। সে রাগিনী তাজরীন ছিল।”
চকিতে তাকায় নির্জন। পায়ের উপর পা নামিয়ে দিয়ে আবারও সোজা স্থির হয়ে বসে। হাত নামিয়ে বেডে রেখে বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,
“হোয়াট?”
“হ্যাঁ। সে রাগিনী তাজরীন ছিল। যে আমার গাড়িতে বো’ম ফিট করছিল। আমি তাকে দেখেছি। শুধু মুখে মাস্ক ছিল। আর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে পালায়। আমি ধরতে পারিনি।”
নির্জন নিরব হয়ে কিছু একটা ভাবে। আর পরক্ষণেই উত্তরে বলে,
“ইটস ইম্পসিবল ইন্সপেক্টর রায়ান। আপনাকে দেখতে আসার আগে আমি রাগিনীর ফোনের লোকেশন চেক করেছি। যেটা ছিল রাগিনী তাজরীনের বাড়ির পার্কের কাছে, এর আশেপাশে আর মেন্টাল হসপিটাল অবধি। আর আপনার গাড়ি ব্লা’স্ট করেছে সেটা মিনিমার ফাইভ কিলোমিটার দূরে। তাই এটা একপ্রকার অসম্ভব!”
মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে রায়ানের। কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। বিস্ময়ের সাথে বলে,
“তাহলে ওই মেয়েটা কে ছিল? সে তো অনেকটাই রাগিনীর মতো দেখতে ছিল।”
“রাগিনীর মতো দেখতে আর রাগিনীই ছিল দুই কথার মধ্যে অনেক পার্থক্য ইন্সপেক্টর রায়ান।”
“এমন হওয়া তো অসম্ভব নয় যে সে আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। হতে পারে ফোনটা অন্য কারো কাছে ছিল? আর আপনাকে বোকা বানানোই ওর আসল কাজ!”
এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল নির্জন। তার কাছে এসব বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না। সে শক্ত গলায় বলে উঠল,
“নো, ইন্সপেক্টর রায়ান। আমি আর রাগিনী তাজরীনকে জোর করে ফাঁসাতে চাই না। হতেও তো পারে ওকেই ফাঁসানো হচ্ছে!”
রায়ান চোখ সরু করে তাকালো। আস্তে করে ওঠার চেষ্টা করল। নির্জন তাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। সাহায্য না করার কারণ ভেতরে থাকা কোনো দ্বিধা! দুজনের মন ভর্তি ইগো! রায়ান নিজে নিজে উঠে বসে বলে,
“আপনি কি রাগিনীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন অফিসার নির্জন?”
অস্বস্তিতে পড়ে যায় নির্জন। কেমন যেন গরম লাগতে শুরু করে। জোর গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আমি কেন তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করব?”
বেশ শান্ত ভাবেই রায়ান জবাব দেয়,
“কারণ হতেই পারে আপনি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছেন।”
চোখমুখ পুরো শরীরে গরম লাগতে শুরু করে নির্জনের। বার বার চোখের পলক ফেলে আশেপাশে তাকায়। কান থেকে যেন ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে। সে রাগান্বিত সুরে বলল,
“দেখুন, আপনি কিন্তু যা ইচ্ছা তাই বলছেন। আপনি এসব বলতে পারেন না। কাজের কথায় আসুন। আপনি যেই মেয়েকে দেখিছিলেন তার ড্রেসআপ কেমন ছিল?”
রায়ান একটু ভেবে বলে,
“টপস্, স্কার্ফ, মাস্ক ছিল মুখে। ঘাড়ে একটা ব্যাগও ঝোলানো ছিল।”
“আর রাগিনীর ড্রেসআপ ছিল লং একটা জামা। আই ডোন্ট নো কী বলে সেটাকে। আর গলায় লম্বা ওড়না ঝুলিয়ে রেখেছিল। মুখে মাস্ক ছিল না। আপনিই বলুন, আপনার সঙ্গে যেই ঘটনা ঘটল সেটা সাড়ে ৫ টায়। রাগিনী মেন্টাল হসপিটালে গেল ঠিক ৬ টায়। আধঘন্টার মধ্যে এতো কাজ সেড়ে ফেলল সে?”
রায়ান এবার ভাবে সত্যিই তাই। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে সে যাকে দেখল সে কে? মাথায় তো আর কাজ করছে না। নির্জন স্পষ্টভাবে বলল,
“রাগিনীকে কেউ ফাঁসাচ্ছে। তার প্রমাণ আমি প্রতি পদে পদে পেয়েছি। যেটুকু সন্দেহ বাকি আছে সেটাও দূর করব। আই নিড দ্যা মেইন কার্লপ্রিট।”
বলে থামে নির্জন। উঠে দাঁড়ায় এবার। নিজের পরনে কোট ঠিকঠাক করে বলে,
“আপনার শরীর ভালো নেই অনেক স্ক্র্যাচ পড়েছে। কাল তো অভিরূপ চৌধুরী আসছে। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার উপর পড়েছিল। কিন্তু যা কন্ডিশন! আপনি রেস্ট করুন। ওইদিক দেখে নেব।”
বলেই বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়ায় নির্জন। পেছন থেকে রায়ান সোজা কথায় বলে,
“সেটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। হাত-পায়ে লেগেছে একটু। ভেঙ্গে যায়নি। থ্যাংকস ফর ইউর সাজেশন অ্যান্ড হেল্প। আপনি আপনার কাজ করুন। আমি কালকে এয়ারপোর্টের দিক সামলে নিতে পারব।”
নির্জন কিছু বলতে গিয়েও বলল না আর। কিছু মানুষকে সাহায্য করতে গেলেও তারা এমন ভাব ধরে যেন তাদের সাহায্য জীবনে প্রয়োজনই নেই। কথা আছে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। রায়ান যেন তেমনই একটা মানুষ। চুপ থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো নির্জন।
সকাল ঠিক সাতটা। এয়ারপোর্টে বেশ ভীর জমেছে। অনেকে কাজের সূত্রে এখানে এসেছে। আবার অনেকে দেশে পদার্পণ করা সেই গায়ককে দেখতে ছুটে এসেছে। ইন্ডিয়া থেকে প্লেন ল্যান্ড করেছে। ডার্ক ব্লু শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরিহিত সুদর্শন পুরুষ তাড়াহুড়ো করে চেক আউট করছে। মুখে জড়িয়ে স্নিগ্ধ হাসি। যেন তার তড় সইছে না একদমই। তড়িঘড়ি করে আউট করতেই লাগেজ ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে সে বলে উঠল,
“দারুন ওয়েদার!”
পেছন থেকে নোমানের চেক আউট করতে দেরি হওয়ায় সে লাগেজ ঠেলে কিছুটা দৌড়েই অভিরূপের পিছু আসতে আসতে বলল,
“আরে দাঁড়া।”
অভিরূপ দাঁড়াল। অন্যরকম লাগছে তার। আশপাশটা ভালো করে দেখল। হঠাৎ করে তার সামনে ভীর জমা শুরু হতেই কিছু সিভিল ড্রেসে থাকা পুরুষ তার সামনে দাঁড়াল। অভিরূপ সরু চোখে বোঝার চেষ্টা করল এরা কারা। তৎক্ষনাৎ উচ্ছ্বাসের সাথে বলে উঠল,
“ইন্সপেক্টর রায়ান রাইট?”
রায়ান একটু সৌজন্যমূলক হেঁসে মাথা দুলাতেই অভিরূপ নিজের হাসি প্রসারিত করে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। রায়ানও নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশিপ করল। এরপর নোমানও তার হাত বাড়িয়ে বলল,
“হ্যালো, ইন্সপেক্টর রায়ান!”
“হ্যালো। আই হোপ, আমাদের দেশটা আপনাদের ভালো লাগবে। এই উচ্ছ্বাস আপনাদের শেষ অবধি থাকবে।”
নোমানের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল রায়ান। বুঝতে পারল তারা অন্য দেশের হলে কী হবে? যতই হক না কেন ফেমাস পারসন! বেশ মিশুক। রায়ানের বেশ ভালো লাগল। তার চোয়ালে ব্যথা করছে। বাম হাতের কনুইয়ে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। হাঁটতেও একটু কষ্ট হচ্ছে। গালের একপাশে একটু ফুলে গেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিল সে। আশপাশটা ভীর জমলো অভিরূপকে দেখার জন্য। সেখানে উপস্থিত থাকা সব গার্ড সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রায়ান বলল,
“বাহিরে গাড়ি আছে।”
বলার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা ধরল অভিরূপ। কিন্তু তাকে দেখার জন্য যারা এসেছে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালো। কোনো কোনো মেয়ে প্রসন্ন হলো। কেউ কেউ উদ্বিগ্ন হলো তার সাথে যদি একটা ছবি তোলা যায়!
সমস্ত ভীড় ঠেলে বাহিরে আসতেই মেঘলা আকাশ দেখে শান্ত হয়ে দাঁড়াল অভিরূপ। অন্যরকম আবহাওয়া তার মনে শান্তি এনে দিল। তার দাঁড়ানোতে নোমান সহ সকলেই দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই দুহাত ছড়িয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“ওয়েলকাম টু মি, বাংলাদেশ!”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]