#শৈবলিনী—-২০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★রাত তখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে হয়তো।ফার্মহাউসের সুইমিং পুলের পাশে ছাতা বিশিষ্ট লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আদিত্য। পাশেই আছে আবির আর জিদানও। তিনজনের হাতেই বিয়ারের ক্যান। এর আগেও কয়েকটা খালি করে দিয়েছে। খালি ক্যানের সংখ্যা আদিত্যের খাতাতেই বেশি আছে। তখন নূরের সাথে যা হয়েছিল তারপর থেকে আদিত্য প্রচুর অশান্তিতে ছিলো। কিছুই ভালো লাগছিলো না ওর। তাই একটু রিল্যাক্স হতে ফার্মহাউসে এসেছে আদিত্য। জিদান আদিত্যের মুড অফ দেখে আবিরকে ফোন করে ডেকে আনে। আবিরও চলে আসে সাথে সাথে। বর্তমানে তিনজনই নেশায় মাতাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আদিত্য মাতাল কন্ঠে দুঃখপ্রকাশ করে বলে উঠলো,
–ইয়ার আবির, মেয়েরা এমন কেন হয়? সো আনপ্রেডিক্টেবল। এদের বোঝাই মুশকিল।
আবির বাবা তার জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান বিতরণ আরম্ভ করলো। মাতাল কন্ঠে বলল,
–শোন মেয়েদের বুঝতে গেলে তুই নিজেকেও বুঝতে ভুলে যাবি। মেয়েদের বুঝতে পারা দুনিয়ার কোনো বুঝদার ব্যক্তির বোঝার আয়ত্তের বাইরে। তাদের বুঝতে যাওয়া মানে বোঝাকে বোঝার ওপরই বোঝা(ভারী) করে দেওয়া। তাই এসব বোঝাবুঝির চক্করে পরিসনা। এসব বোঝাবুঝির খাতা খুললে তোর বোঝা বুঝতে পারার ক্ষমতায় থাকবেনা। বুঝতে পেরেছিস আমি কী বোঝাতে চাইছি?
জিদানের মাথার উপর মনে হলো তিন চারটা কাক একসাথে ঠোকাতে শুরু করলো। বেচারা বেকুবের মতো মাথা চুলকিয়ে বলল,
–স্যার আপনি কী বোঝাইলেন, নাকি বোঝার চাউমিন বানাইলেন? মাথার ভিতরেতো তারাগুলো ছিড়ে শর্ট সার্কিট হয়ে গেল।
–আরে মিঞা সার্কিট করবা বড় পরিসরে করো।সেটাও আবার শর্ট করে করো কেন? তুমি মিঞা কিপ্টার কিপ্টাই থাইকা গেলা।
আদিত্য ধমকে উঠে বলল,
–এই চুপ করবি তোরা! এখানে আমার বুকে জ্বলছে আর তোরা আছিস তোদের স্টুপিট কথা নিয়ে।
জিদান বলে উঠলো।
–স্যার আপনার বুক জ্বলছে আগে বলবেন না। এই দেখেন আমার কাছে সেকলো আছে। একটা খান এখুনি বুক জ্বালাপোড়া সেরে যাবে।
–জিদান, তুমি যদি আর একটা কথাও বলেছ তাহলে বাকি সেকলো আর তোমার খাওয়ার সাধ্য হবেনা।
চুপ হয়ে গেল জিদান বেচারা। আজকাল ভলো মানুষের দামই নেই দুনিয়ায়। আদিত্য আবারও মাতাল সুরে আপসোসের সহিত বলল,
–ইয়ার আবির, ও আমার সাথে এমন করে কেন বলনা? লুক অ্যাট মি, কী কমতি আছে আমার মধ্যে?
–দেখ, অনেস্টলী তো দেখতে গেলে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট তুই।কিন্তু এখন তোর অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাক্তিগত সমস্যা আছে কিনা আমি কী করে বলবো।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে? কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
–এখন কী হাতে কলমে বোঝাব তোকে? মানে,হতে পারে তোর পার্সোনাল প্রোপার্টিতে দূর্বলতা আছে। যেটাই বুঝতে পেরেছে নূর।
আদিত্য ক্ষেপে গিয়ে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট। মাথায় খালি অশ্লীলতা ছাড়া কিছু নেই তোর। নূর কী আমার পার্সোনাল প্রোপার্টি এসে পরিদর্শন করে গেছে নাকি যে ও দূর্বল কী সবল জানবে?
–তারমানে কী তুই সত্যিই দূর্বল? মানে বংশের বাতির লাইট ফিউজ? দেখ চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি কালই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। দেখবি লাইট আবার জ্বলে উঠবে।
–ডাক্তার দেখানো দরকার তোর। আমার সব ঠিক ঠাকই জ্বলছে।
–কেমনে বুঝলি? কখনো এক্সাম হলে গিয়েছিস? তাহলে বুঝলি কী করে তুই পাশ না ফেল? আচ্ছা চল একটা টেস্ট নেই তোর। সঠিক উত্তর দিতে পারলে তুই সবল পুরুষে ভেরিফাইড হবি। রেডি?
আদিত্য নড়েচড়ে আঁটিসাঁটি হয়ে বসে বলল,
–রেডি মিলর্ড ।
–ওকে তো তোর প্রথম প্রশ্ন ; নূরকে দেখলে তোর কেমন লাগে? আই মিন তোর কী করতে মন চায়?
আদিত্য বাচ্চাদের মতো হেঁসে বলল,
–আমার না ওকে দেখলে….ওকে দেখলে….ওকে দেখলে……….
আবির অতি আগ্রহের সহিত বলল,
–হ্যাঁ বল, ওকে দেখলে কী?
–ওকে দেখলে…আরও দেখতে মন চায়। মন চায় ওকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে শুধু দেখতেই থাকি।
আবিরের উৎসুক মুখটার ফুসস করে হাওয়া বেড়িয়ে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে। তদন্ত জারি রেখে বলল,
–শুধু দেখতেই মন চায়? আর কিছু মন চায়না?
আদিত্য হঠাৎ কিছু মনে আসার মতো করে বলল,
–হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস করতে মন চায়।
আবিরের উৎসুক নজর আবার দিগুণ আগ্রহ নিয়ে বলল,
–কী মন চায় বল?
–মন চায়…মন চায় তার ওপর ফুল চন্দনের বর্ষণ করি। দ্বীপ জ্বালিয়ে তার আরতি করি।
আবির আরও একবার নিরাশ হয়ে মেজাজ খারাপ করে বলল,
–ধ্যাৎ, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এক্সামে একেবারে জিরো পেয়ে ফেইল করলি তুই।
আদিত্য বাচ্চাদের মতো মুখ কালো করে বলল,
–আরে ফেইল কী করে হয়ে গেলাম? তুই এক্সামই নিতে জানিস না। টিচার নামের কলঙ্ক তুই।
–হ,এক্সামে পাশ না করতে পারলে এখন টিচারের দোষ। মানবিকতা আজ কোথায়!
একটু পরে আদিত্য একটু লাজুক হেঁসে বলল,
–আচ্ছা শোন, আমার না আরও একটা জিনিস করতে মন চায়।
আবির ভাবলো আদিত্য আবারও আগের মতোই কিছু বলবে। তাই দায়সারা ভাবে বলল,
–কী?
–মাঝে মধ্যে না ওকে আমার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে মন চায়।এক্সুয়ালি মাঝে মধ্যে না। সবসময়ই ওকে আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে মন চায়। আমার হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি শোনাতে মন চায়। যাতে ও বুঝতে পারে আমার প্রত্যেকটা স্পন্দন শুধু ওর নামেই ধ্বনিত হয়। আবার মাঝে মধ্যে না, চুমুও খেতে মন চায়। সেদিন বৃষ্টির মাঝেও অনেক জোরে চুমু আসছিল আমার। কতো কষ্ট করে যে চুমুকে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম তা শুধু আমি জানি।চুমুতো ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছিল। যেন বলছিল,এই ব্যাটা সর যেতে দে আমাকে। আমাকে আমার কাঙ্ক্ষিত স্থানে যেতে দে। একেবারে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছিলো। সর্বশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে হয়েছে। ইটস ভেরি টাফ ব্রো।
আবির এবার প্রফুল্লিত হলো। আদিত্যের হাতে হ্যান্ডশেক করে বলল,
–আরিব্বাস, এ হুই না বাত। এখন হলি তুই গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাশ।
–থ্যাংকস ইয়ার।
পরমুহূর্তেই আদিত্য মুখ গোমড়া করে বলল,
–কিন্তু এতো ভালো মার্ক পাওয়ার পরও, তাও নূর কেন আমাকে ভালোবাসে না? কেন আমাকে উপেক্ষা করে বলনা?
–দেখ এমনিতেতো এসব ভালোবাসা টালোবাসায় আমার চুল পরিমাণও বিশ্বাস নেই। কিন্তু ওইযে কথায় আছে না বন্ধু যাই করুক তাতে সহযোগিতা করা আরেক বন্ধুর পরম কর্তব্য। আর আমি সেই কর্তব্য অবশ্যই পালন করবো। ক্রাইম ইন পার্টনার বলে কথা। আমিও দেখছি নূর তোকে ভালো না বেসে কোথায় যাবে।আরে দ্য সুপারস্টার সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যকে ইগনোর করার মতো কেউ পয়দা হয়েছে নাকি। এমনি এমনি কীভাবে ইগনোর করবে তোকে? তারজন্য যথাযথ কারণ দর্শিত করতে হবে। বিশ্লেষণ করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট প্রমাণ করতে হবে। নাহলে ইগনোরেন্স অগ্রহণযোগ্য যোগ্য হবে। উপেক্ষা বাতিল ঘোষিত করা হবে। আমাদের রায় না মানলে দরকার হলে আদালতে যাবো আমরা। হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, শার্ট-কোট,পেটিকোট সব জায়গায় যাবো আমরা। তোর জন্য নূরের ভালোবাসা আদাই করেই ছাড়বো। এবারের সংগ্রাম তোর মিঙ্গেল হওয়ার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম তোর পরাধীনতার সংগ্রাম।
জিদানও আবিরের তেজে তেজ দেখিয়ে বলল,
–জয় লাভ গুরু, জয় আবির বাবা। কিন্তু স্যার আদালতে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওরাতো বেঈমানী করে। যা বলে তা করেনা।
–কেন? তুমি কীভাবে বুঝলে?
–আরে স্যার আমিও এক কেসের কারণে আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরাতো বেঈমানী করে। জজ লোকটা একটু পরপরই অর্ডার অর্ডার বলে চিল্লায়। অথচ আমি এতবার করে তারে খাবারের অর্ডার দিলাম। সে খাবার আনলই না। তাইলে কন, নিজেই অর্ডার নেওয়ার জন্য চিল্লায়, অথচ অর্ডার দিলে তখন আর আনে না। এইডা কোনো কথা? নিজরাই বেইমানী করে ওরা, তাইলে আর মানুষের বিচার কীভাবে করবে?
আবির হো হো করে হেঁসে উঠে বলল,
–ইউ আর এ অ্যান্টিক পিচ জিদান মিঞা।
__
মাঝখানে একদিন গত হয়ে গেছে। ছুটির দিন ছিলো গতকাল। তাই আর নূরের সাথে দেখা হয়নি আদিত্যর। ওদিকে আদিত্যর গ্যাং-এর যে লোককে খোঁজ নিতে বলেছিলো সেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর দিতে পারেনি। তবে চেষ্টায় আছে। তেমন কোনো খবর জানতে পারলে জানাবে আদিত্যকে। শুটিং-এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে বসে আছে আদিত্য। পাশেই জিদান বসে রোজকার মতো ডাইরি দেখে আদিত্যর সারাদিনের সিডিউল শোনাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তার মাঝে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কী শফিক, গাড়ি থামালে কেন?
–স্যার, মনে হচ্ছে গাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে। গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না। আমি চেক করে দেখছি।
ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ী চেক করে এসে বলল,
–স্যার, ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে। গাড়ি এখন আর চলবে না।
–হোয়াট? এখন এই মাঝরাস্তাই কী করবো আমি?
জিদান বলল,
–স্যার, অন্য গাড়িকে আসতে বলি?
–না না, রাস্তায় অনেক জ্যাম। বাসা থেকে অন্য গাড়ি এসে পৌঁছাতে সময় লেগে যাবে। শুটিংয়ে দ্রুত পৌঁছাতে হবে আমাকে। এক কাজ করো তোমরা গাড়িটাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি বরং টেক্সিতে করে এটুকু চলে যাবো।
–ওকে স্যার।
আদিত্য মাস্ক আর ক্যাপ পড়ে নিজেকে আড়াল করে গাড়ি থেকে বের হলো। ভাগ্যবশত নামতেই রাস্তার পাশে একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব দেখতে পেল। আদিত্য দ্রুত গতিতে গিয়ে ট্যাক্সির দরজা খুলে ভেতরে বসে পড়লো। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আদিত্য ।এখানে কেউ চিনে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
–চলুন।
–কোথায় যাবেন স্যার?
কন্ঠটা কর্ণগুহে পৌঁছাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল আদিত্য। চকিত নজরে তাকালো ড্রাইভিং সিটে বসা ব্যক্তির পানে। সামনে ঘুরে থাকায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথায় ক্যাপ পড়ে আছে সে। আদিত্য এখুনি যে কন্ঠ শুনতে পেল সেটা কী সত্যি নাকি আবারও ভ্রম হয়েছে ওর? ভ্রমই হবে,নাহলে নূর এখানে কী করে আসবে।
–কী হলো স্যার বলুন কোথায় যাবে…..
বলতে বলতে পেছনে ঘুরে প্যাসেঞ্জারের সিটে আদিত্যকে দেখে চমকে গেল নূর। এই মুহুর্তে এই লোকটাকে মোটেও আশা করেনি সে। গ্যারেজ বন্ধ হওয়ায় পরিবারের খরচ চালানোর জন্য নূরের উপার্জনের জন্য অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতেই হতো। তাই সময় নষ্ট না করে নূর যেহেতু ড্রাইভিং জানে আর লাইসেন্সও আছে।তাই পরিচিত এক চাচার কাছ থেকে টেক্সি ভাড়ায় চালানোর জন্য নেয় সে। আজই প্রথম টেক্সি নিয়ে বের হয়েছে। আর প্রথম প্যাসেঞ্জার হিসেবে এই লোকটাতেই আসতে হলো! নূর ভেবেছিল রোজকার সময় অনুযায়ী গিয়ে এই লোকের কাজ করে দিয়ে আসবে। ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত দায় আছে যে সে। কিন্তু উনি নিজের গাড়ি রেখে টেক্সিতে কী করছে? এখন এই লোক নিশ্চয় জেরা শুরু করে দিবে। এবং হলোও তাই। নূরকে এই বেশে দেখে অবাক হয়ে গেল আদিত্য। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুমি ? এখানে? এসব কী নূর? তুমি টেক্সি কেন চালাচ্ছ?
নূর সোজা হয়ে বসে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
–আমার ইচ্ছা। আমার মন চাইছে তাই চালাচ্ছি। আপনার কোনো সমস্যা আছে? থাকলেও আমার কিছু করার নেই।
আদিত্যর রাগ এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমনিতেও সেদিন নূরের উপর চাপা রাগ জমে ছিলো। আর আজ নূরের এই বেখাপ্পা আচরণ আদিত্যর রাগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আদিত্য চোখ মুখ কঠিন করে থমথমে কন্ঠে বলল,
–নূর এনাফ নাউ। ডোন্ট ট্রাই মাই পেশেন্স। সত্যি সত্যিই বলো কী হয়েছে। নাহলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না।
নূর এবার একটু ঘাবড়ে গেল। রাগের বশে আবার লোকটা কোনো সিন ক্রিয়েট না করে বসে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে নূর বলল,
–দেখুন অযথা এতো ফুলকো লুচি হওয়ার দরকার নেই। আমার বেশি বেশি টাকা উপার্জনের ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই পার্ট টাইম কাজ হিসেবে টেক্সি চালাচ্ছি।
–কিন্তু তোমার গ্যারেজ তো আছে। ওটার কী হয়েছে?
–ও ওটাও আছে। পল্টু আর আরেকটা ছেলে আছে ওরা সামলাবে গ্যারেজ। আর আমি টেক্সি চালাবো আর ভার্সিটির কাজ করবো। আসলে আপনাকেতো বলেছিলাম আমি গাড়ি বানাতে চাচ্ছি। তো ওটার সরঞ্জামাদি কেনার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন এখন আমার। তাই বেশি বেশি টাকা উপার্জনের জন্য এসব করছি। এখন বুঝেছেন? বুঝে থাকলে বলুন কোথায় যাবেন? আর না যেতে চাইলে নেমে যান।
নূরের কথা কেন যেন কনভিনিয়েন্স মনে হচ্ছে না আদিত্যর। এখনো মনে হচ্ছে কিছু লুকাচ্ছে মেয়েটা। যাইহোক সত্য তো আমি বের করেই ছাড়বো। আপাতত নূরকে হাতছাড়া করবেনা কিছুতেই। তাই আদিত্য বলল,
–এইসময় কোথায় যাই তা তুমি ভালো করেই জানো। ক্যাম্পাসে চলো। আর তুমি ক্যাম্পাসে যাবেনা?
–না আজ যাবোনা। তবে চিন্তা করেন না। আপনার কাজে সময়মত চলে আসবো আমি।
মেয়েটা ক্লাস বাদ দিয়ে টেক্সি চালাবে? আদিত্য সেটা হতে দিবেনা কিছুতেই। তাছাড়া নূরের প্যাসেঞ্জার হিসেবে অন্য লোক এসে বসবে তা কীভাবে মেনে নিবে আদিত্য। বিষয়টা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে হানা দিতেই আদিত্য দ্রুত বেগে জিজ্ঞেস করে উঠল,
–এক মিনিট! তুমি কবে থেকে টেক্সি চালানো শুরু করেছ? আমার আগে অন্য কেউ বসেছিল?
–না, আজই বের করেছি। আর আপনিই আমার প্রথম প্যাসেঞ্জার।
আদিত্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নূরের প্যাসেঞ্জার হওয়ার অধিকার শুধু আদিত্যর আছে। আর কারোর না। নূর প্রশ্ন করলো,
–বাইদা ওয়ে আপনার গাড়ি করা হয়েছে? এতো দামী গাড়ি থাকতে টেক্সিতে কেন উঠলেন?
–রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে গাড়ি। তাই টেক্সিতে উঠতে হয়েছে। থ্যাংক গড গাড়ি নষ্ট হয়েছিল। নাহলে তো এই বিষয় জানতেই পারতাম না।
শেষের কথাটা মনে মনে আওরালো আদিত্য। কিছু একটা ভেবে বলল,
–শোন, আজকের সারাদিনের জন্য আমি তোমার ট্যাক্সি বুক করলাম। সারাদিনের যা ভাড়া আসে তা দিবে আমি।
–কেন? আপনার গাড়ির কী অভাব পড়েছে? একটা নষ্ট হয়েছে তো কী হয়েছে আরেকটা ডেকে পাঠান।
আদিত্য আমতাআমতা করে বলল,
–আমার সব গাড়িই নষ্ট হয়ে গেছে। কবে ঠিক হবে জানি না। তাই টেক্সিতেই চলতে হবে। আর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর ট্যাক্সি ডাকতে পারবোনা তাইনা? তাই এটাই বেস্ট হবে। এখন থেকে তোমার টেক্সি বুক করে নিলাম আমি। রোজ সারাদিনের যা ভাড়া হবে সেটা বলে দিও। তোমার ভাড়া তুমি পেয়ে গেলে হলো তাইনা? তাহলে তো আর সমস্যা থাকার কথা না।
আদিত্য যে সব ইচ্ছে করে করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে নূর। একসাথে উনার সব গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল? যতসব বাহানাবাজি। যাকগে আমার কী, আমার ভাড়া পেয়ে গেলে মিটে গেল। সারাদিন কয়টা ভাড়া পাবো না পাবো। সেখান থেকে আবার টেক্সি মালিককে জমাও দিতে হবে। তারপর নিজের কিছু পাবো। তার থেকে এটাই ভালো আছে। প্যাসেঞ্জার কে হলো সেটা এখন দেখার বিষয় না। পরিবারের খরচ চালাতে এখন আমার টাকার প্রয়োজন। আর গাড়ি তৈরি করার জন্যেও টাকার প্রয়োজন। তাই পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে ধরে বসে থাকলে চলবেনা আমার।তাছাড়া প্র্যাকটিক্যালি তার কাছ থেকে তো আমি এমনি এমনি টাকা নিচ্ছি না। কাজের পরিবর্তেইতো টাকা আসছে, সেটা যেখান থেকেই আসুক তাতে কী যায় আসে। ভাবনার হিসাব নিকাষ শেষে গাড়ি স্টার্ট দিতে নিলেই হঠাৎ আদিত্য বলে উঠল,
–নূর,দাঁড়াও এক মিনিট।
বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল আদিত্য। তারপর সামনে এসে সামনের দরজা খুলে নূরের পাশের সিটে বসে বলল,
–হ্যাঁ, এখন চলো।
–সামনে কেন বসলেন? প্যাসেঞ্জাররা তো পেছনেই বসে।
–প্যাসেঞ্জার আমি। ইচ্ছেও আমার। আমার এখানেই বসার ইচ্ছে হয়েছে। এখন কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাও।
নূরও আর কথা বাড়াল না। জানে এই লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। আদিত্য মনে মনে বলল,তোমার সহযাত্রী হতে চাই নূর। তাইতো পিছে নয় সঙ্গে চলতে চাই তোমার।
বিশ মিনিট পর ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছাল নূরের ট্যাক্সি। আদিত্য দরজা খুলে নামতে নিয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–শোনো, শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে গিয়ে ক্লাস করো। তারপর সময়মত আমাকে হেল্প করতে চলে এসো। ভেবোনা তোমাকে হেল্প করার জন্য আমি বলছি। আসলে তোমাকে চালাকি করতে দিবোনা আমি। এদিকে আমার কাছ থেকে সারাদিনের ভাড়া নিবে। আবার এই সময়ের ভেতর গিয়ে অন্য ভাড়াও চালাবে সেটা হতে দেবোনা আমি। তাই গিয়ে ক্লাস করো।
বলেই বেড়িয়ে গেল আদিত্য। হঠাৎ এক সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো নূরের ঠোঁটের কোণে। আদিত্য যে ওকে ঠিকমতো ক্লাস করানোর জন্যই এতসব ফন্দি এঁটেছে তা বুঝতে একবিন্দুও সময় লাগাল না নূরের। হঠাৎ লোকটার প্রতি এক সুপ্ত অনুভূতির সৃষ্টি হলো যেন। সেটা শ্রদ্ধাবোধ নাকি অন্যকিছু তা অস্পষ্ট নূরের কাছে।
চলবে….
#শৈবলিনী—২১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বেলা তখন দ্বিপ্রহর প্রায়।রোদের তাপ নেই আজ। বরং আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা চলছে। ছায়া আছন্ন হয়ে আছে চারপাশ টা। একটা ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের মাঠের কোণে গাছতলায় বসে আছে নূর, শিখা আর গিয়াস। ক্যাম্পাসে আসা হবেনা ভেবে দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে আসেনি নূর। তাই একটা ক্লাস অ্যাটেন্ড করে আর করলোনা নূর। ওর সাথে শিখা আর গিয়াসও যোগ দিয়েছে। নূর ঘাসের উপর এক পা ভাজ করে আরেক পা মেলে দিয়ে, দুই হাত পেছনে ঘাসের উপর ভর দিয়ে ঘাড়টা হালকা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে আকাশপানে আনমনে তাকিয়ে আছে। সাদা মেঘ গুলোকে কালো মেঘগুলো কেমন ঢেকে ফেলেছে। কালো মেঘ কী সাদার মেঘের তুলনায় বেশি শক্তিশালী? তাই কী তারা এভাবে সাদা মেঘগুলোকে এভাবে আয়ত্তে করে নিয়েছে? তবে কী সাদা মেঘ পরাজিত কালোর কাছে? নাকি সাদা কালোকে সম্মতি দিচ্ছে তার কাছে যাওয়ার? সে নিজেই চাইছে কালো মেঘ তাকে জড়িয়ে নিক? ক্ষণিকের মেহমান জেনেও তাকে সবটুকু অধিকার অর্পণ করতে চাইছে? জেনে বুঝে নিজেকে শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে দিতে চাইছে? এতে কী সে সুখী হবে? সেতো জানে এই সন্ধি স্থায়ী নয়। ক্ষাণিক পরেই ঘটবে বিচ্ছেদ। সেই অনাগত চিরন্তন সত্য জেনেও কী সে এই মোহে আবদ্ধ হবে? তার কী ভয় হয়না? নূরের কল্পনায় সাদা মেঘ যেন প্রতিত্তোরে বলল,কেন ভয় হবে? মানুষতো জানে তার একদিন মৃ,ত্যু হবেই। তাই বলে কী মানুষ বেঁচে থাকতে ভয় পায়? তাহলে পরে হারানোর ভয়ে আমি বর্তমান কেন হারাবো?
–কীরে আসমানে কী দেহস? আলাদীনের জিনি উড়তাছে নাকি আকাশে? খালি চোখে পরপুরুষ গো এমনে দেখতে নাই। নজর লাইগা যাইবো তো।
গিয়াসের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলো নূর। মাথা ঝাঁকাল সে। কী ভাবছিলো এসব আবোলতাবোল? ওদের মহল্লার গফুর পাগলের মতো পাগল হয়ে গেল নাকি ও? মাথায় ডায়রিয়া হয়ে গেছে নির্ঘাত। সব দোষ ওই মিঃ নায়ক বেটার। আজকাল আমার ব্রেইনটাকে কচুখেত বানিয়ে দিয়েছে। নাজানি কীসব চলতে থাকে। মা ঠিকই বলে সঙ্গদোষ বড় দোষ। এই সঙ্গদোষ আজকাল বেশিই প্রভাব ফেলছে আমার ওপর। নূরকে এমন আনমনা দেখে শিখা জিজ্ঞেস করলো,
–কী হয়েছে বলতো? তোকে এমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন? আর তুই না বললি আজ আসবিনা? তো এলি কী করে?
নূর ফোঁৎ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ওদের সবটা খুলে বললো।সব শুনে শিখা তৃপ্তীময় একটা হাসি দিয়ে বলল,
–দেখেছিস আমি বলেছিলাম না। আদিত্য ভাইয়া বাকিদের মতো না। আর না ওনার ভালোবাসা বাকিদের মতো বানোয়াট। জানি তুই মানবি না। তবুও বলবো, ভাইয়াকে একটা চাঞ্চ দিয়ে দেখ।
–প্লিজ শিখা তুই ভালো করেই জানিস এসব আমার জন্য না। আমার লক্ষ্য আলাদা। যে লক্ষ্যে এসবের জায়গা নেই।
–হুম জানি। তবুও তোর কাছে একটা অনুরোধ রইলো। কখনো যদি তোর মন তোকে ডাক দিয়ে কিছু বলতে চায় তাহলে মনের কথাটা একটু শুনিস প্লিজ।
নূর আর জবাব দিলো না। কী জবাব দিবে? এই জবাব যে সে নিজেই জানে না। আর জানতেও চায়না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো হয়। যা ভেতরে কোনো এক গোপন জায়গায় দাফন করে রাখতে হয়। যাতে নিজ পর্যন্তও পৌঁছাতে না পারে সে উত্তর। নাহলে যে সব এলোমেলো হয়ে যায়। নিয়মের মধ্যে বাঁধা জীবনটা তখন নিয়মের বাইরে চলে যায়। আর নূরের নিয়মের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। নাটাই ছিঁড়া ঘুড়ি হওয়ার অনুমতি নেই তার। অনুমতি নেই দিশাহীন পাখি হওয়ার। কিছুতেই না।
___
রোজকার সময় অনুযায়ী আজও নূর এসে আদিত্যর কাজে হেল্প করলো। সব কাজ শেষে আদিত্য শুটিংয়ে প্যাকআপ করে নূরের সাথে বের হলো বাসার উদ্দেশ্যে। তবে আদিত্যর মাথায় চলছে অন্য ফন্দি। আজ সে নূরের সাথে এই একাকী মুহুর্তটা আরও দীর্ঘ করতে চায়। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়না সে। এরজন্য আজকে নাহয় একটু ছলচাতুরীই করলো। নূর যেহেতু ওর বাড়ির ঠিকানা জানে না। সেটারই সুযোগ নিলো। নূরকে ভুল পথে নিয়ে গেল সে। ঘন্টাখানিক চালিয়েও যখন আদিত্যের বাড়ি পৌঁছাল না। তখন নূর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
–আপনি সঠিক ঠিকানাই বলেছেন তো?
আদিত্য আমতাআমতা করে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই বলেছি।
–কিন্তু এটাতো কোনো আবাসিক এলাকা মনে হচ্ছে না। এটাতো কোনো নদীর কিনারা মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ ওই আসলে, আমার না মাঝে মধ্যে মন অস্থির হলে এখানে আসতে ইচ্ছে হয়। এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মনটা অনেক ফ্রেশ হয়ে যায়। আজ যেহেতু গাড়ির বদলে তোমার টেক্সি ব্যবহার করছি। তাই তেমাকেও নিয়ে আসতে হলো। তাছাড়া তোমাকে এখানে আনার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। সত্যিই বলছি।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আপনিতো সত্যির দেবতা। মিথ্যে কখনো আপনার মুখ দিয়ে বেরই হয়না। আপনার কী মনে হয়, আমাকে কী এতটা বোকা মনে হয়?
আদিত্য মেকি হেসে বলল,
–না না, কি যে বলোনা। তোমাকে বোকা বলার সাধ্য কার আছে। আমার এতো জলদি মরার শখ নেই। দেখ মাত্র পাঁচ মিনিট। এরবেশি নিবো না আই প্রমিজ।
–ঠিক আছে যান।
–তুমিও আসোনা আমার সাথে।
–আমি গিয়ে কী করবো? আমার মন একদম শান্তশিষ্ট আছে। যান আপনি গিয়ে মনের আইসক্রিম করে আসেন।
–ও বুঝতে পেরেছি। তুমি আসলে ভয় পাচ্ছ। ভুত,পেত্নী এসে তোমাকে খেয়ে না ফেলে সেই ভয় পাচ্ছ তাইনা? কিন্তু তুমি কেন ভয় পাচ্ছ। তোমার চেয়ে ভয়ংকর কিছু আছে নাকি। ভুতেরা বরং উল্টো তোমাকে দেখেই মাটির সাত স্তর গভীরে নিজেদের কোয়ারান্টাইন করে নিবে।জানো ভুতের বাচ্চারা যখন কাঁদে তখন মা ভুত বলে,”চুপ হয়ে যা, নাহলে নূর চলে আসবে”।
নূর মুখ ভেঙিয়ে বলল,
–হা,হা,হা ভেরি ফানি। নূর কাউকে ভয় পায় না।
–তাহলে বাইরে এসে দেখাও। কিন্তু জানি তুমি পারবেনা। তাই গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে সীটের নিচে ঢুকে লুকিয়ে থাকো।
বলেই দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল আদিত্য। বাইরে এসে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। নূরও সাহসিকতার প্রমাণ দিতে খট করে বেড়িয়ে এলো। আদিত্যর পাশে এসে বলল,
–নূর কোনো কিছু ভয় পায়না। এই কথাটা কাগজে লিখে ফেবিকল আঠা দিয়ে ভালো করে চিপকিয়ে নিন।
আদিত্য কিছু না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মনে মনে আওড়ালো, ভয় পাবে নূর, একদিন তুমি শ্বাসরুদ্ধকর ভয় পাবে।আর তোমার সেই হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া ভয়ের কারণ হবে এই আদিত্য।
নূর এবারে আশেপাশের পরিবেশ টা লক্ষ্য করলো। সামনে একটা বিশাল বিলের মতো জলাশয়ের ভরা জায়গা। আর তার পাশ দিয়েই বিশাল বিশাল কাশফুলের বন। শীতল বাতাসে ঢেউ খেলছে কাশফুলের বনগুলো। এতো সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মুহুর্তেই নূরের সব বিরক্তি যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। মন মস্তিষ্ক বিশুদ্ধতায় ভরে উঠল। লোকটা ঠিকই বলেছে। জায়গাটা সত্যিই মনকাড়া। আদিত্য পাশ থেকে বলে উঠল,
–তুমি আমাকে তোমার একটা স্পেশাল জায়গা দেখিয়েছিলে।তাই আজ আমিও তোমাকে আমার একটা স্পেশাল জায়গায় নিয়ে এলাম।
আদিত্য মায়াবী চোখে নূরের পানে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে ওর হাতের মাঝে নিজের হাতটা দিয়ে নূরের হাত ধরে নূরকে সামনের দিকে নিয়ে গেল। নূরও কেন যেন বিনাবাক্যে চলল আদিত্যর সাথে। আদিত্য নূরকে নিয়ে এসে বিলের একেবারে কিনারায় এসে নূরকে সহ নিজেও ঘাসের উপর বসলো। দিনের বেলা মেঘের আনাগোনা থাকলেও এখন আকাশ পরিস্কার। চন্দ্রের শশিপ্রভায় আলোকিত হচ্ছে প্রকৃতি। চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে পানির মাঝে।প্রকৃতির এই অপরুপ চিত্র উপভোগ করছে নূর। আর আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার নূরকে। চাঁদের রুপালি আলোয় নূরকে লাগছে মায়াহরিণী। যে মায়াহরিণীর মায়ায় আদিত্য আবেশিত হয় বারংবার। ওই চোখের গহ্বরে তলিয়ে যায় বারংবার। বারংবার ঘায়েল এই রমনীতে। তবুও বারংবার এই নারীকেই চায় আদিত্য। অন্তহীন চায় তাকে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চায় তাকে।চায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে। নিজেকে বিলীন করতে চায় শুধু এই নারীতে।
আদিত্যর মুগ্ধতার মাঝেই নূর বলে উঠল,
–ওয়াও,কত সুন্দর পদ্ম ফুটেছে পানিতে।
নূরের কথা অনুযায়ী আদিত্য ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই বিলের মাঝে কয়েকটি পদ্ম ফুটে আছে। আদিত্য একবার নূরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে পদ্মটার দিকে। চোখের কোন চকচক করছে তার। আদিত্য নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে নিচে রাখলো। তারপর জুতা জোড়া খুলল।এবং কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে সামনের পানির মাঝে নেমে গেল। আদিত্যর কান্ড দেখে নূর বিস্মিত হয়ে বলল,
–আরে আরে কী করছেন আপনি? পানিতে নামছেন কেন?
আদিত্য জবাব না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো। ধীরে ধীরে গলা পানির মাঝে নেমে গেল। তারপর একসময় পানির মাঝে সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল সামনে। অতঃপর সেই পদ্ম ফুলের কাছে গিয়ে একটা পদ্ম ছিঁড়ে নিয়ে এলো। ফুল নিয়ে আবার সাঁতরে ফিরলো সে। কিনারে উঠে আসতে আসতে ভেজা চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিলো। সারা শরীর থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে। নূরের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পদ্ম ফুলটা সযত্নে এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। হাসিমুখে বলল,
–এটা তোমার জন্য নূর। আমার ভালোবাসার প্রথম পদ্ম। সরি,একটু ফিল্মি লাইন হয়ে গেল। তাই চাইলে স্কিপ করতে পারো।
নূর অবাক, বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–আপনি কী পাগল?
–সেটাতো তোমাকে দেখার পর থেকেই হয়ে গেছি। তুমি আজ জানলে? এখন এই ফুলটা আগে নাও। আচ্ছা নিতে হবে না দাঁড়াও।
আদিত্য এবার পদ্ম ফুলটা নূরের কানের পিঠে চুলের মাঝে গুঁজে দিলো। ফুল গুঁজে দিয়ে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আদিত্যর ওই মায়া ভরা চাহুনিতে নূরও মায়ায় পড়ে গেল। আদিত্য মায়াময় কন্ঠে বলে উঠলো,
–আমি বলবোনা এই ফুলে তোমাকে সুন্দর লাগছে। উহুম,দুনিয়ার কোনো জিনিস তোমার সৌন্দর্যকে তাদের দ্বারা আরও উত্তম করতে পারবেনা। এতো স্পর্ধা কারোর নেই। বরং এই ফুলটাই তোমার সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়ে গেল। ওর জনম সার্থ আজ। কারণ সে নূরের অঙ্গে শোভা পেয়েছে। যে নারী নিজেই নিজের তুলনা। তুমি জানো সবাই আমাকে বলে আমি অনেক ভাগ্যবান। কারণ আমি আমার জীবনে এতো সফলতা পেয়েছি । তাদের কথায় আমি তেমন বিশ্বাস করতাম না। তবে আজ আমি বিশ্বাস করি নূর। বিধাতা আমাকে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের অধিকারী করেছে। কারণ আমার জীবনে তোমার আগমন ঘটেছে। তুমি জানো, এখন এই মুহুর্তে আমার মরে গেলেও আপসোস নেই। কারণ আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছি। এটাই আমার কাছে সর্বসুখের কারণ।
নূরের ভেতর কোথাও একটা ভেঙে পড়ছে। অন্তর্দেশে অসহ্য পীড়ন অনুভব হচ্ছে তার। হঠাৎ যেন কেমন শক্তিহীন দূর্বল হয়ে পড়ছে সে। আদিত্যর ওই মায়ার সমুদ্রে যেন না চাইতেও ডুবে যাচ্ছে সে। আদিত্য নূরের আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–আমি জানি, তুমি আমাকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছ নূর। তবে আজ একটা অবাধ্য আবদার করতে চাই নূর। প্লিজ মানা করোনা। তোমার এই মায়াবী ললাটে একটু স্পর্শ করতে চাই আমি।
চকিত চোখে তাকালো নূর। সে চাইছে মানা করতে। কিন্তু কন্ঠনালী কেন যেন তার এই সিদ্ধান্তে সহমত প্রকাশ করছে না।শব্দকোষ গুলো হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল। মুখ যেন তার হরতালে বসে গেছে। খুলছেনা কিছুতেই। নূরের নীরবতাকে সম্মতি ভেবে নিলো আদিত্য।দুই হাতে নূরের মাথাটা ধরে, নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে নূরের ললাটের মাঝ বরাবর অধর ছুঁইয়ে গভীর ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো আদিত্য। হৃদপিণ্ড ঝংকার দিয়ে উঠল নূরের। কেঁপে উঠল সারা অঙ্গ। দুই হাতে মাটির ঘাস খামচে ধরলো নূর।নিঃশ্বাস থেমে গেল যেন। এ কেমন অনুভুতি হচ্ছে তার? তারতো এমুহূর্তে অত্যন্ত রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু এই অনুভূতিটা তো রাগ জাতীয় কিছু না। এটা তবে কোন নাম না জানা অনুভূতি? যে অনুভূতি পীড়াদায়ক। তবে এই পীড়ায় কষ্ট নেই, বরং কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। কপালে চুমু দেওয়া শেষে নূরের কপালে কপাল ঠেকালো আদিত্য। চোখ বুজে ঘনঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তীব্র নেশালো আর আবেগ ভরা কন্ঠে আদিত্য বলে উঠল,
–ভালোবাসি নূর। সত্যিই ভালোবাসি। যতটা সত্য এই পৃথিবী,যতটা সত্য এই নির্জন রাত,যতটা সত্য আকাশের ওই চন্দ্রটা, ঠিক ততটাই সত্য তোমাকে ঘিরে আমার অন্তহীন ভালোবাসা। যতটা ভালোবাসলে নিজেকেই ভুলে যাওয়া যায়।যতটা ভালোবাসলে নিজের নিঃশ্বাসও তার নামে করে দেওয়া যায়। ঠিক ততটা বা তার চেয়েও ভালোবাসি তোমাকে নূর।
হৃদপিণ্ডে অসহনীয় ব্যাথা শুরু হলো নূরের।ভেতরটা কেমন চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। হঠাৎ তার কেমন কান্না পাচ্ছে। আর এখানে বসে থাকতে পারছেনা সে। অনেক প্রচেষ্টা করে কোনরকমে সে বলল,
–পাঁচ মিনিট শেষ হয়ে গেছে। আমাদের এখন যাওয়া উচিত।
চোখ খুলে তাকিয়ে নূরকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো আদিত্য। মুচকি হেঁসে বলল,
–আর কিছু সময় প্লিজ। আচ্ছা চলো তোমাকে একটা গান শোনাই। আজকের এই স্পটে মুহুর্তে একটু গান গাইতে ইচ্ছে করছে আমার। গাই?
–মানা করলে কী আপনি শুনবেন? তো করুন যা ইচ্ছে।
–ওয়াও, কতো ভালো করে বুঝে গেছ আমাকে। দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ সো মাচ। তো এতো করে ইনসিস্ট করছ তাহলে কি করে মানা করি বলো।
আদিত্য হঠাৎ ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নূরের পানে তাকিয়ে থেকেই গেয়ে উঠল,
♬ আজকের এই নিশি, ভালোবাসি, ভালোবাসি
নিকষ মেঘে তোমার ওই চোখ
দেখেছি আজ এই আমি
মৃদু বাতাস বলে, ছিলে সেই তুমি
তোমারই মোহে হারাই আমি
নিজেকে যে খুঁজি ফিরি
তোমার প্রেমের সুখ সারি
যখন দাঁড়াও এসে,ভুলে যাই সবই
হৃদয়ের সব কথা,বলে দেই আমি
তোমারই যে চিরদিনই
রবো আমি তোমারই
হোওও আজকের এই নিশি ভালোবাসি ভালোবাসি
নিকষ মেঘে তোমার ওই চোখ
দেখেছি আজ এই আমি ♬ ♬
আর বসে থাকার শক্তি পাচ্ছে না নূর। মনে হচ্ছে তুফানে সব তছনছ করে দিবে। নূর উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
–আপনার প্রতিভার প্রদর্শন শেষ হলে এবার চলুন। এখানে কেউ অস্কার দিতে আসবেনা।
স্মিথ হাসলো আদিত্য। অস্কারের থেকেও বেশি কিছু পেয়েছে আজ সে।
এদের এই সুন্দর মুহুর্তের মাঝে কেউ জানতেই পারলোনা দূর থেকে কেউ একজন দেখছে তাদের। শুধু দেখছেনা, ক্যামেরায় বন্দি করছে দুজনের এই বিশেষ মুহুর্ত।
__
–স্যার, স্যার উঠেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠেন।
সকাল সকাল ঘুমের মাঝে এমন বেসুরো আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ অবস্থায়ই কপাল কুঁচকে এলো আদিত্যর। বিরক্তিকর চেহারা করে চোখ মেলে তাকালো সে। তাকাতেই সামনেই আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গেল জিদানকে। যেন এই মুহুর্তে সে ভুত পেত্নীর সাথে বোর্ড মিটিং করে এসেছে। আদিত্য উঠে বসে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কী হয়েছে? সকাল সকাল তুমি এখানে কী করছ? আর এভাবে আমার ঘুম নষ্ট করছ কেন?
জিদান শঙ্কিত কন্ঠে বলল,
–স্যার, আজকের ব্রেকিং নিউজ দেখলে আপনার ঘুমতো দূরে থাক। ঘুমের শশুর শাশুড়ীও লেজ গুটিয়ে পালাবে।
–হোয়াট? কী বলছ এসব? কীসের ব্রেকিং নিউজ?
জিদান তার ফোন ঘেটে আজকের ব্রেকিং নিউজটা বের করে দেখালো আদিত্যকে। ফোন হাতে নিয়ে নিউজ টা দেখতেই হকচকিয়ে উঠল আদিত্য। মুহুর্তেই ঘুমের লেশ মেশ সব উড়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আদিত্যর নূরকে দেওয়া সেই চুমুর মুহুর্ত। সাথে মসলা মেশানো কাহিনি তো আছেই। চমকে গেল আদিত্য। অন্যসময় হলে সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু এটা নূরকে নিয়ে হয়েছে। আর নূর নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নিবেনা। খুবই বাজে ভাবে ঘটনা মোড় নিয়েছে। নাজানি মেয়েটা কী ভাববে ওর ব্যাপারে। কী করে সামলাবে ওকে এবার।
চলবে……..