মন গহীনে পর্ব-১৭+১৮

0
421

#মন_গহীনে

#পর্বঃ১৭

#দোলন_আফরোজ

ফুলেল বিছানায় বসে আছে তমা। পুরো ঘরটা গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো। বিছানার মধ্যে খানে বসে আছে তমা। মনের মাঝে হাজার রকম জল্পনা কল্পনা আর ভয় নিয়ে বসে আছে সে। মনে হয় আবিরের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা। আনমনেই হেসে উঠে। তখন হঠাৎ ই মনে পড়ে তিথীর করা আবিরকে অপমানের কথা। আবিরের সু*সা*ই*ড করার কথা। আবির আগের কথা কিছু মনে নিয়ে বসে থাকেনিতো? প্রতিশোধ নিবে নাতো এখন এসবের?
যাহ কি ভাবছি আমি এসব? এই কদিনে তো ওরকম কিছু মনে হয়নি ওকে দেখে।
মনকে অন্য দিকে ঘুড়ানোর জন্য এ বাড়ির সবার কথা ভাবতে থাকে। সবাই সত্যিই অনেক ভালো। ওর শ্বশুর শাশুড়ী, চাচা শ্বশুর চাচী শাশুড়ী সবাই অনেক অনেক ভালো।
হঠাৎ ই মনে পড়ে মাহীর কথা। সেই বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই মেয়েটা কতো মিশেছে ওর সাথে। বিয়ের আগেও কতো ভালো কথা হলো, আর কতো শতো ছবি ও তুলেছে। কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর হঠাৎ কি হলো? একবারো আর দেখেনি মাহীকে, আর এ বাড়ি আসার পর থেকেও একবারো দেখেনি ওকে।কিজানি কি হলো মেয়েটার।
আবার মনে হয় নানীর বলা কথা গুলো। আজ রাত তোদের বাসররাত। এ রাতে স্বামী যা চাইবে কোনো মানা করবি না। স্বামী সোহাগ করতে চাইলে তুই ও সায় দিবি তাতে। স্বামী যেনো কোনো কারণে অসন্তুষ্ট না হয়।এসব ভাবতেই তমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে।আবির এলে কি করবে সে! কিভাবে চোখ তুলে তাকাবে আবিরের দিকে। লজ্জায় এখনি নুইয়ে পরছে সে।

এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার শব্দ পায়। বুঝতে আর বাকি নেই আবির ই এসেছে। অজানা ভয়ে তমার সারা শরীর যেনো বরফ এর মতো জমে যাচ্ছে।

ঘরে ঢুকেই বধূ বেশে আবির তার প্রেয়সীকে দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়ে। আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হচ্ছে।

লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে তমা বসে আছে খাটের মধ্যে খানে। আবির মুখে হাসি নিয়ে তমার পাশে বিছানায় গিয়ে বসতেই তমা নড়েচড়ে বসে। আবির তা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। তমার ঘনঘন শ্বাস নেয়া সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। এই নিশ্বাসের শব্দ ও যেনো আবিরকে পাগল করে দিচ্ছে।
আবির আসতে আসতে হাতটা বাড়িয়ে ঘোমটা খুলে দেয় তমার। ভয়ে লজ্জায় তমা ওর চোখ দুটো বুজে নেয়।
আবির আবেশি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমার দিকে। কি স্নিগ্ধ সুন্দর এই রূপ। কি অমায়িক লাগছে তার বউটাকে। মনে পড়ে যায় তমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো সেই দিন টার কথা।মেয়েটা কি সরল। তমার এই সরলতায় আবিরকে তমার দিকে আকৃষ্ট করে। বার বার মুগ্ধ হয়েছে সে তমার সরলতা দেখে। একটা সময় মনে হয়েছে এই মেয়েটাকেই আমার চাই। তাই নানান ভাবে তমার মন পাওয়ার চেষ্টা করেছে।

তমার এই বন্ধ চোখ দুটোতে ঠোঁট ছুইয়ে দেয় আবির।কেঁপে উঠে তমা। ফট করেই চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় আবিরের দিকে। তমার এমন চাহনি দেখে হেসে দেয় আবির।
এটুকুতেই এতো ভয়? বলেই আবারো হাসে।

তমা ছোট করে একটা ঢোক গিলে। জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয়।

আবির তমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে এভাবে পাগল করে দিও না প্রেয়সী।

আবিরের কথায় লজ্জায় চোখ দুটো নামিয়ে ফেলে তমা।আবির তমার হাত দুটো তার হাতের মাঝে পুড়ে বলে, যানো প্রেম ভালোবাসা সব সময় আমার কাছে ফালতু মনে হতো। মনে হয়েছে পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ আর কষ্টদায়ক জিনিস টার নাম ই হলো ভালোবাসা।
আমি আমার কলিজার বন্ধু, আমার ভাই কাব্য কে দেখেছি এই ভালোবাসার জন্যই তিলে তিলে কষ্ট পেতে।আমার চোখের সামনে ছেলেটা চেইন স্মোকার হয়ে গেলো। হয়তো নিকোটিন এর ধোঁয়ায় নিজের কষ্ট গুলো কে উড়িয়ে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করতো সে।
ওর কষ্ট পাওয়া দেখে সারাজীবন এই ভালোবাসা নামক চিজ থেকে দূরে থেকেছি।কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখার পর কি যে হয়ে গেলো নিজেই বুঝিনি। আমার শুধু মনে হতো এই মেয়েটাকে যে করেই হোক আমার জীবনে চাই। আমার সবটা দিয়ে হলেও চাই। তাই তোমার ভালোবাসা পাবার চেষ্টা করেছি অনেক ভাবেই। কিন্তু তিথী যেদিন অনেক কথা শুনালো খুব কষ্ট লেগেছিলো সেদিন। বিশ্বাস করো তিথীর কথা অপমানের জন্য না। এটা ভেবে কষ্ট লেগেছিলো তুমি কোনো দিন আমায় ভালোবাসবে না, বরং ঘৃণা করো আমায়।আমার হৃদয় টা কাব্যর মতো এতো শক্ত নয় যে ভালোবাসা না পেয়ে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকবো। তখন মনে হয়েছে ভালোবাসা টা সত্যিই খারাপ জিনিস, শুধু কষ্ট দেয়। আর তাই এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ই সেদিন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।কিন্তু ভাগ্য তোমাকে আমার করবে বলেই আজো আমি বেঁচে আছি।

তমা মুখ তুলে আবিরের হাত দুটো যত্ন সহকারে তার হাতে পুড়ে বলে, আমি আপনাকে অপছন্দ করতাম না। ভয় পেতাম, ভয় পেতাম এটার জন্য যে আমিও যদি আপনাকে ভালোবেসে ফেলি। আসলে আমি মধ্যবিত্ত ফেমিলিতে বড় হয়েছি তো। আমার আব্বু আম্মু আমাদের দুই বোন কে সব সময় এই শিক্ষা দিয়েছেন যাতে এমন কিছু না করি যে লোকের বাঁকা চোখে পড়ি। আর প্রেম ভালোবাসা টা বর্তমান সময়ে মানুষ ভালো চোখে দেখে না। এতে সম্মান হানি হয়। আর আমাদের মধ্যবিত্তদের কাছে সম্মানটাই সবচেয়ে বড়। তাই সব সময় এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি।
আপনার চোখে চোখ রাখতে পারতাম না আমি। কি যেনো হয়ে যেতো আমার। তাই ভার্সিটি যাওয়া অফ করে দিয়েছিলাম।
আর তিথী খুব জোড়াজুড়ি করেছিলো কেনো যাই না। এটা বলার পর সে যে এমন কিছু করবে আমি ভাবিনি। আমার বোন টা রাগী কিন্তু মন টা ভিষণ নরম। ওর জন্য মনে কোনো ক্ষোভ রাখবেন না দয়া করে।

পাগল হয়েছো তুমি? অতটুকু পিচ্চি মেয়ে তিথী।আর ওর জন্য তো আমি ওমন সিদ্ধান্ত নেই নি। তবে ক্ষোভ থাকবে কেনো?
আর ও আমার একমাত্র শালিকা, আর সবচেয়ে বড় কথা আমার কাব্যর বউ, কাব্যর পুতুল বউ।
তিথীর মুখ টা দেখলে যে কারোরি ভালোবাসা ই পাবে শুধু। রাগ তো অসম্ভব। আর আমার রাগ হওয়া তো আরো অসম্ভব।

কথাটা শুনে তমার বুকের উপর থেকে অনেক বড় একটা পাথর যেনো সরে যায়। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে।

আবির সন্তর্পণে সেই অশ্রু মুছে দিয়ে তমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।তমা ও আবিরের বুকে লুটিয়ে পড়ে।

আবির তমাকে আরো শক্ত করে ধরে, অবশেষে তুমি আমার হলে।

***************

ডাইনিং টেবিলে থমথমে মুখে বসে আছেন সেলিম আহমেদ। কাল রাতেও শাহানারা বেগম এর সাথে রাগারাগি করেছেন। কাব্য কি করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত হুট করে নিতে পারে?
উনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। উনার ছেলের বিয়ে হবে ধুমধাম করে। তা না উনার ছেলে হুট করেই কাল রাতে বউ নিয়ে হাজির। এটা উনি কিছুতেই মানতে পারছেন না।
শাহানারা বেগম পাচ্ছেন অন্য ভয়। উনি জানেন সেলিম সাহেব কাব্য কে কিছুই বলবে না। কিন্তু উনি যদি ওই পিচ্চি মেয়েটার উপর রাগ করেন তবে? এমনিতেই মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো না, তার উপর যদি সেলিম সাহেব উল্টো পাল্টা কিছু বলেন কি হবে তখন।

কায়েস ও মোটামুটি ভয় পাচ্ছে বাবার থমথমে মুখ দেখে।হিয়া ও চুপটি করে বসে আছে নাস্তার টেবিলে। স্বাভাবিক আছে শুধু অর্না। সে অপেক্ষা করছে একটা জবরদস্ত ড্রামা দেখার।

হিয়ার মা হেনা বেগম তিথীকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামছেন। ওদিকে তাকিয়ে শাহানারা বেগম পরপর দুবার ঢোক গিল্লেন। উনি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছেন।

তিথী টেবিলের সামনে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দেয়। সবটাই শিখিয়ে এনেছে হেনা বেগম।

তিথীর সালাম শুনে সেলিম সাহেব চোখ তুলে তাকান তিথীর দিকে। কমলা পাড়ের কালো শাড়ীতে তিথীকে যেনো আরো ফর্সা লাগছে। মাথায় ঘোমটা দেয়া।
সেলিম সাহেব এর মনে হচ্ছে উনার সামনে ধবধবে সাদা একটা পুতুল কেউ দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সালামের উত্তর হাসি মুখে নিয়ে উনি বলেন তুমিই তাহলে আমাদের তিথী মা?সেই ছোট্ট তিথী?

তিথী হালকা হেসে মাথা নাড়ালো।
মায়ের কাছে গল্প শুনেছে ওদের গ্রামের বাড়ি আর সেলিম চাচাদের গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি ছিলো। তাই হয়তো তাকে ছোট্ট বেলায় দেখেছে।

সেলিম সাহেব উনার পাশের চেয়ার টাই ইশারা করে বলেন তিথীকে বসতে। তিথী ও হাসি মুখে বসে। তখন সেলিম সাহেব বলেন মাশাল্লাহ তুমি সত্যিই একটা পুতুল, আমার কাব্যর পুতুল বউ।

কথাটা শুনে তিথী বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায় উনার দিকে। তখন উনি শাহানারা বেগম কে ইশারায় কিছু বলেন। তারপর শাহানারা বেগম এনে দিতেই উনি তিথীর হাতে একটা খাম দিয়ে এটা খুলতে তিথীকে ইশারা করেন।

তিথী খুলে দেখে এর ভিতর টাকা আছে। গুনে দেখেনি সে। তার আগেই বলে, এসব লাগবে না চাচা।

উহুম, চাচা না। আমি তোমার বাবা, আজ থেকে বাবা বলবে আমায়। আর ছেলের বউ এর মুখ খালি হাতে দেখতে হয় না। সেই ছোট বেলার পর আমি আজই তোমায় প্রথম দেখলাম। খালি হাতে কি করে দেখি বলো? এটা বলেই উনি হালকা হাসলেন।

বিপরিতে তিথীও হাসলো। মনে মনে বল্লো, চাচা চাচী দুজনেই কতো ভালো। বড় ভাইয়া ও কতো ভালো। কাবির সিং টা এতো বদ হলো কি করে? আচ্ছা ওকে কুড়িয়ে পায়নি তো উনারা? 🤔
হুম খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
তিথীর এসব ভাবনার মাঝেই সেলিম সাহেব বলেন তোমার ছেলে কই শাহানা? আজো কি আমার সাথে বসে খাবে না? আর তো ওর কাংখিত মানুষ ও পেয়ে গেছে। এখনো কি অভিমান ভাংবে না ওর?

আমি ডাকছি মামা, বলে হিয়া কাব্য কে ডাকতে গেলো।

এদিকে তিথী কিছুই বুঝতে পারছে না, কিসের কাংখিত মানুষ, আর কিসের মান অভিমান। যাক গে সে তার ছোট্ট মাথাতে এতো চিন্তা ঢুকাতে পারবে না। আপাতত তার এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে সত্যিই কি কাবির সিং কে কুড়িয়ে পেয়েছে নাকি।

তিথীর এসব ভাবনার মাঝেই কাব্য সিড়ি বেয়ে নামছে। ডাইনিং এ সেলিম সাহেব কে বসে থাকতে দেখে কাব্য আবার ঘুরে চলে যেতে নিলে সেলিম সাহেব পিছন থেকে ডাকেন, খোকা আজ ও কি আমার সাথে খেতে বসবি না?
কথাটা কাব্যর কলিজায় গিয়ে লাগে। অনেক বছর হয় কাব্য সেলিম সাহেব এর সাথে কথা বলে না, এক টেবিলে খায় না পর্যন্ত। একটা সময় পর সেলিম সাহেব ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। উনিও আর ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেননা। কিন্তু আজ এতো বছর পর যখন ওর বাবা এভাবে ডাকে ওই ডাক ফিরাতে পারেনি সে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসে পরে সে। একি টেবিলে বাবার সাথে বসায় শাহানারা বেগম এর আনন্দ যেনো ধরে না।

সেলিম সাহেব সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, খোকা এভাবে বিয়ে করেছে এটা তো কেউ জানে না। লোক সমাজে আমার একটা সম্মান আছে।আমার ছেলে এভাবে চুপিসারে বিয়ে করে ফেলবে এটা দেখতে কটূ দেখায়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি খোকা আর তিথী মার বিয়ের জন্য একটা পোস্ট মেরিটুয়াল পার্টি দিবো।
কথাটা শুনে সবাই খুশি হলো। কিন্তু কাব্য যেভাবে ছিলো ঠিক ওভাবেই আছে। এক মনে খেয়ে যাচ্ছে।

তিথী ব্যাপার টা লক্ষ্য করে অবাক হলো। ও বেশ ভালোই বুঝতে পারছে কাব্য সেলিম সাহেব কে যেনো ইগনোর ই করছেন।কিন্তু কেনো?

সেলিম সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন আজ তো আবিরের বিয়ের রিসিপশন পার্টি। তবে আমাদের প্রোগ্রাম টা ২ দিন পর ফিক্সড করি। এই দুদিনের গেস্ট দের ও ইনভাইট করা হয়ে যাবে।

সবাই এতে একমত পোষণ করলেই কাব্য সেই আগের মতোই আছে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায় সে। সেলিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শাহানারা বেগম উনার কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করেন সব ঠিক হবে আসতে আসতে।

তিথী অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই আছে।লোকটা কথা কম বলে জানি, তাই বলে নিজের পরিবার এর সাথেও?🙄

ঘরে ঢুকে তিথী ফ্রেশ হয়ে এসে আরেক দফা অবাক হয়। পূর্ব পাশের পুরো দেয়াল জুড়েই প্রায় তার বাচ্চাকালের ছবি দিয়ে ভরা।
কি বেপার আমার ছবি এখানে কেনো? তাও আবার কাবির সিং এর ঘরে? কাল রাত থেকে সে এই রুমে আছে, কিন্তু ডিপ্রেশন এর কারণে খেয়াল করেনি কিছুই। এর আগেও একবার এ ঘরে এসেছিলো, কিন্তু তখন দেয়ালে কি আছে না আছে তা দেখার পরিস্থিতি ছিলো না। কিন্তু এখন তার নিজের ছবি দেখে সে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে।

সে ছোট্ট একটা বউ সেজে আছে, একটা আট ন বছরের ছেলের কোলে৷ ছেলেটাও জামাই সেজে আছে।
সে এভার জোরে ই বলে উঠে ও মা গো, এই জামাই টা আবার কে?😲😲
আরেকটা ছবিতে মনে হচ্ছে ঐ ছেলেটাই তার পেটে মুখ দিয়ে আছে, আর ও একটা অমায়িক হাসি দিয়ে।

মাথাটা চুলকে, কি হচ্ছে এসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

তখনই কাব্য ঘরে ঢুকে। তিথীকে দেখে সে আরেক দফা ধাক্কা খায়। মনে মনে বলে, এই মেয়েটা কি আমায় না মেরে শান্তি পাবে না? এতো সুন্দর করে শাড়ী পড়ে বউ বউ হয়ে থাকতে কে বলেছে ওকে।
আমি তো মানুষ নাকি? রোবট তো নয়, যে আবেগ, অনুভূতি, কামনা বাসনা কিছুই থাকবে না আমার!

নিজেকে কন্ট্রোল করার জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নেয় সে।

তখনই তিথীর কথায় চোখ খুলে সে।
আমার ছবি এখানে কেনো? বলে আংগুল দেয়ালে তাক করাতে কালো শাড়ীর ফাঁকে ফর্সা পেট টা স্পষ্ট দেখতে পারে সে।
একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজের ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয়। তিথী কাব্যর চোখ অনুসরণ করে তাকায় তার উন্মুক্ত ফর্সা পেট টাতে। তৎক্ষনাৎ চোখ দুটো বড় বড় করে পেটের কাছের কাপড় টেনে দেয়।

তিথী অপ্রস্তুত হয়েছে বুঝতে পেরে কাব্য বেলকনিতে চলে যায়। খুব করে একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে তার। সিগারেট খেয়ে যদি বুকের ভিতরের তৃষ্ণাটা কিছুটা হলেও কমে।
কিন্তু সিগারেটের গন্ধে তো আবার তিথীর শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায়, তাই তো কাল রাতের পর আর একটাও সিগারেট খায়নি সে।
কিন্তু এখন নিজেকে কন্ট্রোল করার একটাই উপায় আছে তার কাছে।
তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে আবার ঘরে আসে সে। তিথী এখনো ওভাবেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্য কে আসতে দেখে কেনো জানি তিথীর ভয় ভয় লাগছে।
কাব্য সোজা গিয়ে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেট এর প্যাকেট টা নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনির দরজা টা চাপিয়ে দিয়ে সুখ টান বসায় সিগারেট এ।সিগারেট এর ধোঁয়া গুলো আকাশে উড়াচ্ছে আর ভাবছে কাব্য তোকে আরো ধৈর্য ধরতে হবে। এখন তো তিথীর তোর কাছে আসার কথা ছিলো না, তবে একদিনেই এমন উথলা হয়ে যাচ্ছিস কেনো! আরো সময় দে তোর পুতুল বউ কে। আসতে আসতে অকে ভালোবাসা শিখা।

এদিকে তিথী ভাবছে যা ভেবেছিলাম তাই। লোক টার নজর ভালো না।
তিথী, এই কাব্য বেটার কাছ থেকে যতো দূরে থাকবি ততোই তোর মংগল। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে, নিজের ভালোটা বুঝতে শেখ।

কাব্য সিগারেট শেষ করে রুমে আসতেই তিথী দৌঁড়ে পালায় রুম থেকে। কাব্য ভাবে হয়তো সিগারেট এর গন্ধ্যেই। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে এখন। সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় ও। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়।
তিথী এখনো রুমে আসেনি। কই গেলো? খুঁজতে খুঁজতে মায়ের রুমে গিয়ে পায় ওকে। সবাই আছে এখানে। মা, ভাবি, ফুফি, হিয়া।
সবাই পার্টির প্ল্যান করছে। তখনই হিয়া বলে, ভাইয়া শোনো পার্টি হওয়ার আগে পর্যন্ত ভাবি আমার রুমে আমার কাছে থাকবে বলে দিচ্ছি।
হিয়ার কথায় যেনো তিথী আকাশের চাঁদ হাতে পায়। খুশিতে এখন একটু সাম্বা ডান্স করতে ইচ্ছে করছে।

কাব্য বলে তোদের যা খুশি কর, তবে আমার বউ আমার সাথেই থাকবে।

উম্মম দেখেছো মামীমা, তোমার ছেলে কেমন বেহায়া হয়েছে। মা ফুফির সামনে কি সব বলছে।

তিথী মনে মনে ভাবছে, যা বলেছিলাম তাই। ব্যাটা আস্ত একটা লুচু। তিথী সাবধান থাক বলে দিচ্ছি। কিছুতেই ঐ ব্যাটার কাছে ঘেঁষবি না।

না ভাই এতো কিছু শুনতে চাই না, আমি আমার বউ কে নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না।

ছেলের কথা শুনে মা ফুফি মুচকি মুচকি হাসছেন।বিরক্ত হচ্ছে অর্না, এসব আদিক্ষ্যেতা ওর মোটেও ভালো লাগছে না।

হিয়া এসে কাব্যর কানে কানে কিছু একটা বলতেই কাব্য আর এই ব্যাপার টা নিয়ে ঘাটায় না।

সন্ধ্যা হতে চল্লো, কিছুক্ষণ পরেই আবিরের রিসিপশন পার্টি। সবাই মোটামুটি রেডি হচ্ছে। কাব্য দুপুরের পর ই তিথীকে একটা শাড়ী দিয়েছিলো, পড়ে রেডি থাকতে বলেছে।
সে রেডি হয়ে তিথীর জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে হিয়ার রুমের দরজায় নক করে। হিয়া দরজা খুলে দেয়।
ঘরে ঢুকে দেখে তিথী বিছানায় ওভাবেই বসে আছে। চোখ দুটো কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে।

কাব্য রুমে আসতেই হিয়া বেরিয়ে যায়।

রেডি হওনি কেনো? কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে কাব্য।
কোনো উত্তর নাই তিথীর। সে গিয়ে তিথীর কাছে বসতে নিলে ছিটকে দূরে সরে যায় তিথী। বুঝতে পেরে কাব্য দাঁড়িয়ে পরে দুহাত উপরে তুলে বলে, ওকে ওকে বসছি না আমি।
প্লিজ রেডি হয়ে নাও।( খুব ইচ্ছে করছে তিথীর হাত দুটো ধরতে)

যাবো না আমি কোথাও।

প্লিজ এমন বলোনা। কষ্ট পাবে আবির খুব। তাছাড়া তমা ও তো কষ্ট পাবে। আর ওখানে তো চাচা চাচী ও আসবেন, তোমার ভালো লাগবে।

এই জন্য ই যাবো না আমি। দেখতে চাই না আমি ওদের মুখ, কেউ নেই আমার। আমি এখানে পরেই মরবো।

এবার কাব্য আর নিজেকে সামলাতে পারে না। তিথীর পাশে বসে ওর হাত টা ধরতে নিলেই তিথী আবারো তেঁতে উঠে। একদম না, না বলছি তো আমি।

আচ্ছা ঠিকাছে, ধরবো না তোমায়। তোমার অপরাধী তো আমি, তবে চাচা চাচী কে কেনো কষ্ট দিবে এভাবে।

তারা এই কষ্ট টা ডিজার্ভ করে।

তবে মরার কথা বলে আমাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছো?

আপনি যদি এতে কষ্ট পেতেন তবে এই দিনটাই আসতো না আজ।

মুখ টা মলিন করে ফেলে কাব্য। সবটা যে সে নিজ হতেই নষ্ট করেছে শুরু থেকে। আবার সব ঠিক করতে অনেকটা সময় হয়তো লাগবে।তার আর বুঝতে বাকি রইলো না তিথী কিছুতেই যাবে না ওখানে। তাই তার ও আর যাওয়া হলো না।

সেলিম সাহেব শাহানারা বেগম কায়েস আর অর্না যায় আবিরের পার্টিতে। আবিরের প্রান প্রিয় বন্ধু তারই বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেনি এতে সে খুবই ব্যাধিত হয়। শাহানারা বেগম সবটা বুঝিয়ে বলার পর কিছুটা শান্ত হয় আবির।

এদিকে সেলিম আহমেদ তারেক রহমান এর সাথে কোলাকুলি করেন। এলাকার ভাই থেকে আজ বিয়াই হয়ে গেছে যে।

তিথী আসেনি শুনে তারেক রহমান তানিয়া বেগম দুজনেই হতাশ হন। মেয়েটা যে খুব বেশি অভিমান করে ফেলেছে উনাদের সাথে।


চলবে…

#মন_গহীনে

#পর্বঃ১৮

#দোলন_আফরোজ

দেখতে দেখতেই দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিনে তিথী যতোটা সম্ভব কম গিয়েছে। এক কথায় কাব্য তিথীর দেখা পায়নি বললেই চলে।তমার রিসিপশনের পর দিনি তারেক রহমান আর তানিয়া বেগম এসেছিলেন তিথীর সাথে দেখা করতে, কিন্তু দেখা করেনি তিথী। দরজা বন্ধ করে বসেছিলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে ফিরে যান উনারা।
আজ সন্ধ্যায় সেলিম সাহেব একটা পার্টি রেখেছেন তিথী আর কাব্যর জন্য। এতে সেলিম সাহেব এর বড় বড় লোক সহ নিজের আত্নীয় স্বজন সবাই এসেছে। এসেছে তিথীর আত্নীয় স্বজন রাও।

তিথীর এইসব বিরক্তিকর ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। অন্য সময় হলে এমন প্রোগ্রাম এর জন্য সেই বেশি এক্সাইটেড থাকতো। কিন্তু আজ তার মনে নেই কোনো আনন্দ। কিন্তু আর যাই হোক তিথী বেয়াদব না। তাই সেলিম সাহেব এর সিদ্ধান্ত কে সে সম্মান জানায়।

পার্লার থেকে লোকজন এসেছে তিথীকে সাজাতে। পড়ার জন্য সেলিম সাহেব নিজেই ডিজাইনার লেহেঙ্গা আনায়। প্রোগ্রাম এর জন্য সাভারের সবচেয়ে বড় কনভেনশন হল বুক করেন সেলিম সাহেব। সেলিম সাহেব কায়েস আগেই চলে যায় কনভেনশন হলে। কাব্য ও যায় উনাদের সাথে। কারণ এরেঞ্জমেন্ট ঠিক ঠাক আছে নাকি তা উনাদের ই দেখতে হবে। আর গেস্ট রাও কিছু কিছু আসা শুরু করেছে।

কাব্য আজ ফর্মাল ড্রেস পরেছে। ব্লু প্যান্ট এর সাথে হোয়াইট শার্ট এর উপর ব্লেজার। অমায়িক লাগছে দেখতে।

সন্ধ্যা ৭ টার দিকে তিথী আসে হিয়া আর অর্নার সাথে গাড়ি করে।

তিথী যখন স্টেজ এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তখন সবার নজর তিথীর দিকে। কাব্য ওর ফ্রেন্ডস এর সাথে কথা বলছিলো। তিথীকে দেখে সে হা হয়ে থাকে।
রয়্যাল ব্লু লেহেঙ্গা আর ভারী সাজে তিথী অন্যরকম লাগছে। কাব্য মনে হচ্ছে তার পুতুল বউ টা যেনো হুট করেই বড় হয়ে গেছে। তার চোখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দরী নারী বুঝি আর দেখেনি। হার্ট যেনো বিট করাই ভুলে গেছে কিছু সময় এর জন্য।
ওর হা হয়ে থাকা দেখে পিয়াস বলে, মুখ টা বন্ধ করো বন্ধু, মশা মাছি সব ঢুকে যাবে নয়তো।বলতেই বাকি সব বন্ধু এক সাথে হেসে উঠে।
হিমেল বলে বউ টা তো তোর ই নাকি, এখনি এভাবে দেখলে সারারাত কি করবি হুম? বাই দ্যা ওয়ে, বাসর কি করে ফেলেছিস?
কথাটা বলতেই কাব্য ওর পেটে আলতো ঘুষি মেরে বলে, শা*লা বদলালি না তুই। মাথায় সব সময় আজেবাজে কথা ই ঘুরে।

বা রে আজেবাজে কেমনে হলো?এটা আজেবাজে কথা নাকি আবির এলে আবিরকেই জিজ্ঞেস করিস। বলেই আবার সবাই হাসতে থাকে।

স্টেজে বসানো হয় তিথীকে, সেও সবার সাথে হাসি মুখেই কথা বলছে। এটা দেখে কাব্যর মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। তারমানে কি তার পুতুল বউ টা সব আসতে আসতে মেনে নেয়ার চেষ্টা করছে?

তিথীর বাবা মা, তার সব আত্নীয় স্বজন রাও সবাই এসে গেছে।সবার সাথে ভালো করে কথা বল্লেও ওর বাবা মার সাথে কথা বলেনি একবারো। তারেক রহমান হতাশ হয়ে মেয়ের দিকে তাকান। মেয়ের চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। আজ চার দিন হয় নিজের বাড়ি ছাড়া, বাবা মা ছাড়া। ইচ্ছে করছে বাবার বুকের উপর পরে মন খুলে কাঁদতে। কিন্তু না, তা করবে না সে। অনেক অভিমান জমে আছে তার বাবা মায়ের উপর। কেনো করলো তারা তার সাথে এমন টা।কেনো জোর করে ঐ ভিলেন টার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো তার।
কোনো দিন কথা বলবে না সে বাবা মায়ের সাথে। যাবেও না কোনো দিন ও বাড়ি আর। মরতে হয় এখানে পরেই মরবে সে।

কাব্য ও স্টেজে এসে দাঁড়ায়। কি যে সুন্দর লাগছে দুজন কে এক সাথে। একেবারে যেনো রাজ জুটক। কাব্য পাশে এসে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে তিথী। মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? চারপাশে মানুষ দেখে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করে সে। ফটোগ্রাফার বিভিন্ন এংগ্যালে ছবি তুলে ওদের।এর মাঝেই আবির তমা আসে। আবির এসে কাব্য কে জড়িয়ে ধরে।

অবশেষে পেয়ে গেলি তোর পুতুল বউ কে। কিন্তু আমি গুরুতর রাগ করেছি তোর সাথে। দুইটা বড় অন্যায় করেছিস তুই আমার সাথে।
প্রথম টা, তিথী ই যে তোর পুতুল বউ তা আমাকে কেনো আগে জানাসনি?😡

আসলে আমি চাইনি এভাবে কিছু হোক। আমি চেয়েছিলাম আগে তিথী সবটা জানবে, তারপর তোদের জানাবো। তাকেই তো জানাতে পারিনি, তাই আর তোদের ও বলিনি। রাগ করিস না প্লিজ, বলে আবার জড়িয়ে ধরে আবিরকে।

এখন বলেছিস তো নাকি?

উহুম, আমি চাই না আমি এতো বছর যাবৎ ওকে ভালোবাসি, ওর জন্য অপেক্ষা করে আছি, এটা জেনে আমাকে ভালোবাসুক। আমি চাই ও আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসবে, তারপর না হয় অতীত টা জানলো।

তুই কিন্তু ব্যাপার টাকে আরো কমপ্লিকেটেড করছিস।
জানিয়ে দিলেই কিন্তু তিথী সবটা মেনে নিতো। তোর জন্য এতোদিনের জমে থাকা সব ভুল ধারণা গুলো কেটে যেতো।

আমি চাই না সে দয়া করে আমাকে ভালোবাসুক। আমি জানি আমার ভালোবাসা দিয়ে ঠিক ই আমি ওর সব ভুল ধারণা দূর করতে পারবো। পারবো ওর মন জয় করতে।

তাই যেনো হয় ভাই। তোর কিন্তু আরো ধৈর্যশীল হতে হবে।

প্রতিনিয়ত সেই চেষ্টা ই করছি। কিন্তু পারি নারে এখন আর। ইচ্ছে করে বুকের মধ্যে খানে লুকিয়ে রাখতে।

আবির কাব্যর কাঁধে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

তমা এসে তিথীকে জড়িয়ে ধরে। এবার তিথী আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। কেঁদে দেয় জোরেসুরেই। তমা তিথীকে বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে। যা হয়েছে তোর ভালোর জন্য ই হয়েছে।

কিচ্ছু ভালো হয়নি। কেউ ভালোবাসে না আমায়। আমাকে ঐ কাবির সিং তোলে নিয়েছিলো জেনেও কি করে পারলো আমায় ওর সাথেই বিয়ে দিতে।

তখন তিথীর নানী এসে বুঝায় অনেক্ষণ। এতো মানুষের মাঝে এভাবে কাঁদে না দিদিভাই। লোকে খারাপ বলবে।

তিথী নাক টেনে ফুঁপিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। সবটাই দেখে কাব্য, বুকের ভিতর টা কেমন যেনো হু হু করে উঠে তার। তার পুতুল বউ তাকে এতোটা অপছন্দ করে!

নানী গিয়ে কাব্য পাশে দাঁড়িয়ে গলা খাকানি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি নাত জামাই, ফুলের মধু খাওয়া হয়নি বুঝি?

নানীর কথায় কাব্য উনার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে, তোমার নাতনি কি এতোটাও বুঝদার!

চিন্তা করো না, আমি বুঝিয়ে দিবো সব।

মানুষ জনের ভীড় কমছে। এখন শুধু বাড়ির মানুষ গুলোই আছে। নানী এসে তিথীকে অনেক কিছু বুঝাচ্ছে। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের স্বামী ই সব। আর কাব্যর মতো ছেলেতো আর দ্বিতীয় টি হয় না। কোনো দিন কষ্ট দিস না দিদিভাই, নাত জামাইকে।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা কেমন হয় তা বলতেই তিথীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে।
হালকা ধাক্কা দিয়ে নানীকে সরিয়ে দিয়ে বলে এসব কি নোংরা কথা বলছো বুড়ি। আমি কিন্তু আপুটিকে দিয়ে তোমার মেয়ের কাছে নালিশ জানাবো।

নারে দিদিভাই না, এসব নোংরা কথা না। এসবই হয় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে। নাত জামাই যদি সোহাগ করতে আসে ফিরিয়ে দিস না তাকে।

নোংরা বুড়ি। তুমি থেকে যাও ঐ ভিলেন টার সোহাগ খেতে। আমি থাকবোই না ওর সাথে।

ওদের কথা শুনে তমা মিটমিট করে হাসছে।

****************

রাত প্রায় পৌনে ১২ টা। তিথীকে কাব্যর রুমে নিয়ে যাচ্ছে হিয়া।অনেক বলেছে তিথী, যাবে না ঐ কাবির সিং এর রুমে। থাকবে না ওখানে। সে হিয়ার সাথেই থাকবে।তিথীর কথা শুনে হাসে হিয়া। আমার রুমে আর থাকা যাবে না তোমার।

তিথী গিয়ে শাহানারা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলে, মামনী আমি তোমার সাথে থাকবো। যাবো না আমি ভিলেন টার রুমে।

শাহানারা বেগম পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী স্ত্রীর আলাদা থাকতে হয়না। আমার ছেলেটা অতোটাও খারাপ না যতোটা তুই ভাবছিস। একটু সুযোগ দে আমার ছেলেটাকে, দেখবি তুই নিজেই সব বুঝতে পারবি ও কেমন। যা মা ঘরে যা।

উনাদের সাথে পেরে উঠে না তিথী, তাই কাঁদো কাঁদো হয়েই কাব্যর রুমের ভিতর যায় সে। তিথীকে ঘরে নিয়ে যায় হিয়া। ।ঘরে ঢুকে তো তিথী পুরাই অবাক।
পুরো ঘরটা অপরাজিতা আর কাঠ গোলাপ দিয়ে সাজানো। বিছানায় লাল গোলাপ দিয়ে হার্ট শেপ আঁকা, তার চারপাশে ঘার নীল অপরাজিতা। মুহূর্তেই তিথীর মন কেনো জানি ভালো হয়ে যায়। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে নিজেও তো আজ অপরাজিতার রঙে সেজেছে। অপরাজিতা বরাবর ই তিথীর পছন্দের ফুল। আর কাঠ গোলাপ কার না পছন্দ।

তিথী হিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

আইডিয়াটা আমার, সাজিয়েছিও আমি। কিন্তু অপরাজিতা আর কাঠ গোলাপ এর কথা ভাইয়া ই বলে। তোমার নাকি অপরাজিতা পছন্দের ফুল।

অবাক হয় তিথী। এই কাবির সিং টা এতো রোমান্টিক হওয়া শুরু করেছে কেনো? আর জানলোই বা কোথায় অপরাজিতা আমার পছন্দ!

পরক্ষণেই নানীর বলা কথা মনে পড়ে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। ও আল্লাহ, এই কাব্য ব্যাটার এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? ব্যাটার তো এমনিতেই নজর খারাপ। আমি এখন কই যাই।

হিয়াপু, আমি থাকবো না এ ঘরে। প্লিজ আজ রাত টা তোমার সাথে থাকতে দাও, কাল ই আমি বাড়ি চলে যাবো। বলেই কান্না শুরু করে।

পাগল হয়ে গেছো ভাবি? কতো প্ল্যান করে এসব করেছি। তোমাদের বাসর করাবো বলেই ২ দিন ভাইয়াকে তোমার থেকে আলাদা রেখেছি।

আপু আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি বলো? কেনো করছো আমার সাথে এমন টা?

পাগলি মেয়ে, কিছু হবে না, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো তুমি। আচ্ছা থাকো, ভাইয়া এখনি চলে আসবে, বলেই হিয়া দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়।

ভয়ে তিথীর কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। থাকতে পারবে না সে ঐ ভিলেন এর সাথে এক ঘরে। এসব ভাবনার মাঝেই কাব্য ঘরে আসে। কাব্যর আসাতে তিথীর বুকের ভিতর টা যেনো শুকিয়ে যায়। এক দৌঁড় দিয়ে গিয়ে খাটে বসে পরে কম্বল জড়িয়ে। এক দম না। একদম কাছে আসবেন না আমার বলে দিচ্ছি।

ভ্রু কুঁচকায় কাব্য। কি হলো হঠাৎ? এতো ভয় পাচ্ছো কেনো, কাছে গিয়ে বসতে বসতে। কাব্যর বসা দেখে তিথী খাটের উপর ই দাঁড়িয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, আ আপ আপনি কি সোহাগ করতে আসছেন?? আমার চাই না সোহাগ, নানীকে গিয়ে করুন, বলেই কেঁদে দেয় সে।

এবার শব্দ করে হেসে দেয় কাব্য। এসব কে বলেছে তোমাকে, নানী?

কান্না অবস্থাতেই উপর নিচ মাথা নাড়ায় তিথী।

আয়েশ করে বিছানায় বসে, কি বলেছে শুনি? ( মুখে মুচকি হাসি লেগে আছে)

বলেছে, স্বামী তার স্ত্রী কে সোহাগ করে। আরো বলেছে,,,, বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে সে।

আবার হাসে কাব্য, হুম আরো বলেছে? বলে ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় তিথীর দিকে।

তিথী দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে, উহুম, আর কিছু বলেনি।
আমার সোহাগ চাই না, প্লিজ। আমি বাড়ি যাবো।

আগে ঠান্ডা মাথায় বসো আমার সামনে।

আবার মাথা নাড়ায় তিথী, উহুম।

কপট রাগ দেখিয়ে, বসো বলছি।

তিথী ও বাধ্য মেয়ের মতো বসে পরে।

কাব্য তিথীর মুখোমুখি বসে বলে, খুব ইচ্ছে করছে হাত টা ধরতে, ধরি প্লিজ?

বড় বড় চোখ করে তাকায় তিথী।

আচ্ছা আচ্ছা ধরবো না। আমাকে কি তোমার অনেক খারাপ মানুষ মনে হয়?

উপর নিচ মাথা নাড়ে তিথী।

খুব বেশি খারাপ?

আবারো আরো জোরে উপর নিচ মাথা নাড়ে সে।

হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে কাব্য। তোমার সাথে যা করেছিলাম তা আমার জীবনে করা সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। উহুম ভুল বললে ভুল হবে, অন্যায় করেছিলাম আমি। বিশ্বাস করো, কাব্য কোনো দিনো কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করেনি।
আবির সু*সা*ই*ড করার পর আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তাই হিতাহিত জ্ঞান ভুলে এতো বড় একটা অন্যায় করে ফেলি আমি।

তুমি ভেবোনা অপরাধবোধ থেকে বিয়ে করেছি তোমায়।তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে তাকে কখনোই বিয়ে করতাম না আমি, হয়তো তার সাথে করা অন্যায় এর মাসুল টা অন্যভাবে দিতাম।
এখন বলতে পারো তোমাকে কেনো বিয়ে করলাম তবে, জানবে, সময় হলে ঠিক জানবে।

দুই হাটুতে মুখ গুজে তিথী চুপ করে আছে। কাব্য কথা গুলো বলার সময় তার চোখ দুটো ছলছল করছিলো। তা দেখে তিথীর বুকের ভিতর টা হু হু করে উঠে। মনে মনে ভাবে তবে কেনো বিয়ে করলো আমায়!

এবার হালকা হাসে কাব্য। সোহাগ করার কথা বলছিলে না? এখন নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তোমার অনুমতি ছাড়া ছোঁবো না তোমায়। এসব আদর সোহাগ সব তুলা রাখলাম। যখন আমায় ভালোবাসবে তখন সব হবে। এর আগে না। আর তখন শোধ সমেত সব ফেরত নিবো আমি। বলে মুচকি হাসে।।

আর এখন যা করবো তার জন্য অনুমতি নিবো না।

কাব্যর কথা শুনে ভরকে যায় তিথী। চোখ দুটো বড়
বড় করে ফেলে। কি করবে এখন আবার? ভয়ে অন্তর আত্না শুকিয়ে যায় তিথীর।

পকেটে হাত দেয় কাব্য, একটা বক্স বের করে। তা থেকে একটা গোল্ড এর পায়েল বের করে নিজ হাতে পরিয়ে দেয় তিথীর সুন্দর পা টা তে। পড়িয়ে দিয়ে পায়ে গভীর চুমু খায়।

তিথীর শরীর যেনো হিম হয়ে আসে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তিথীর। ভালো লাগছে নাকি খারাপ বুঝতে পারছে না সে। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।

পা থেকে ঠোঁট তুলে তিথীর বন্ধ চোখ জোড়ায় ফুঁ দেয় কাব্য। এতে কেঁপে উঠে তিথী।

ভালোবাসি! বড্ড বেশি ভালোবাসি!!

চোখ দুটো বড় বড় করে খুলে ফেলে তিথী। এর জন্য যেনো প্রস্তুত ছিলো না সে। এই কাবির সিং এতোটা রোমান্টিক হতে পারে তা তার জানা ছিলো না। সারাক্ষণ তো মুখ গোমড়া করে রাখে।

তিথীর এই চাহনি দেখে কাব্যর নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মনের অবাধ্য ইচ্ছে গুলো বার বার হানা দিচ্ছে। এক্ষুনি কিছু অঘটন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
ফট করে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এসে বলে, যাও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো।




চলবে…..