আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
491

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

২৪.

আনরুবা এখন ধরাবাঁধা নিয়ম করে দিয়েছেন কুহেলী হয় সমারোহ নয়তো সান্দ্রর সাথে আসা যাওয়া করবে রোজ। কুহেলীর ক্লাস শেষে কিছুক্ষণ পর সমারোহর আড়াই ঘণ্টার ব্রেক। সে টাইমেই কুহেলীকে বাড়ি রেখে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার আসতে হয় হসপিটালে। কুহেলী মেডিক্যালে এসে চন্দ্রিমার সাথে দেখা করেই চিঠি দুটো দেখায়। চন্দ্রিমা তো হাসতে হাসতে কাহিল!কুহেলী ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে,

‘ আচ্ছা চন্দ্রি তুই সত্যি করে বলতো, তুই জানিস না চিরকুট গুলো কে দিচ্ছে? নাকি যে দিচ্ছে তুই নিজেই তাকে সাহায্য সহযোগিতা করছিস? এমনটা হলে কিন্তু খারাপ হবে বললাম। ‘

‘ আমি কিভাবে জানবো কে দিচ্ছে? বড্ড আজব কথা বলিস, অবশ্য আমি জানলে সাহায্যই করতাম বেচারার কি কাহিল অবস্থাই করে ছাড়লি কুহু! আহারে। ‘

কুহেলী মেজাজ খারাপ করে অন্য দিকে চেয়ে থাকে। চন্দ্রিমা বুঝতে পারে, না বিষয়টা সিরিয়াস। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,

‘ তুই সুন্দরী, মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্ট আর কদিন পর ডাক্তার হয়ে যাবি, ক্যারিয়ার সেটেল। তো ছেলেরা পছন্দ করতেই পারে। আর এরকম দুএকটা প্রেমপত্র তোর মতো রূপবতী পেতেই পারে এতে এতো চিন্তিত কেন হচ্ছিস? ‘

কুহেলী ভারী ভোলোভালা কন্ঠে বলে,

‘ পেলে কলেজে পাচ্ছি তা মানা যায় কিন্তু বাসায় কিভাবে তাও আবার আমার রুমে? সেখান পর্যন্ত যেতে পারলে তো অবশ্যই কেউ না কেউ সাহায্য করছে সেই ছেলেটাকে! ‘

চন্দ্রিমা চিন্তায় পড়ে যায়। কুহেলীর দিকে আড়চোখে বারকয়েক চেয়ে থেকে বলে,
‘ আর যদি সে তোর বাড়িতেই থাকে? ‘

কুহেলী সন্দিহান কন্ঠে বলে, ‘ কি বলতে চাস তুই? ‘

‘ খুব সিম্পল।সমারোহ ভাইয়ার হ্যান্ড রাইটিং খেয়াল করেছিস কখনো তুই? ‘

‘ আমি জানতাম, আমি জানতাম তো তোর মাথায় এসব ফালতু কথা ছাড়া আর কিছুই আসবে না। গোবর ভরা মাথা। উনি খুব ব্যস্ত আর গুমোট টাইপ মানুষ। এসব লিখার তার সময় কই! আর উনি কেন আমাকে চিরকুট দিতে যাবে হে! ‘

‘ আমার মনে হয় ভাইয়া তোর প্রতি দুর্বল। ‘

‘ মানে? ‘

‘ তুই দেখিস না উনি তোর কতো খেয়াল রাখে? তুই যখন অসুস্থ ছিলি তখন তোর পাশে থেকে এক ফোঁটাও সরেননি। বাসেও উনি কীভাবে পৌঁছে গেলেন। সকালেও তো তোকে কড়া কড়া করে বলে গেলেন উনার পারমিশন ছাড়া মেডিক্যালের বাহিরে একপা রাখলেও ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে! তোর কি চোখে পড়ে না কিছু? আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় গাধী তুই, মেয়েরা ছেলেমানুষের এক ইশারায় মনের কথা বুঝে যায়! আর তোকে কেউ গিলিয়ে দিলেও কিছু বুঝবি না। ‘

কুহেলী চুপসে যায়। মনে পরে যায় সমারোহ কেবিনে সেদিন বলেছিলেন ওর গলার তিলটা দারুন। আবার সেদিন আঁধারের মাঝে বলেছিলেন চাঁদ কুহেলীকে হিংসা করবে। কেন করবে! এই কথাগুলো কেনো বলেছিলেন? চন্দ্রিমা যা বলছে সত্যি! কুহেলী ভড়কায়। পরক্ষণেই আবার নিজেকে বকে দেয় ইচ্ছা মতো। এতো সব ফালতু ভাবনা তার মনে আসছে কি করে? আলো তো সমারোহকে পছন্দ করে। আর আলোর কথাবার্তায় মনে হয় সমারোহর সাথে ওর কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে। এতো সুন্দরী মেয়ে রেখে সমারোহর তাকেই কেনো ভালো লাগতে যাবে! কোনো কারন নেই।

আর সমারোহর পারসোনালিটির সাথে এসব চিঠি লিখা যায় না। গম্ভীর্যপূর্ণ মানুষটার মধ্যে কোনো প্রেম ভালোবাসার আবেগ আছে বলেই তো কুহেলীর মনে হয় না। চন্দ্রিমাকে দেখে বড় এক নিঃশ্বাস ফেলে কুহেলী।বলে,

‘ ল্যাব ক্লাস আছে? ‘

‘ মে বি।পাত্তা দিলি না তো আমার কথা? একদিন দেখবি এই চন্দ্রিমাই ঠিক বলছে, হুহ। ‘

‘ হুঁ, দিলাম না পাত্তা। ‘

‘ হায় খোদা! এমন দিন আসলো, বান্ধবীদের কাছে গিয়ে গিয়ে হাত পেতে পাত্তা চাইতে হয়। এক কাজ করি কোথায় একটু পাত্তা পাওয়া যায় কিনে নিয়ে আসি গিয়ে। ‘

কুহেলী হেঁসে ফেলে চন্দ্রিমার কথায়। চন্দ্রিমা ভেংচি কাটে। তারপর হঠাৎ কিছু মনে করার ভান করে বলে,

‘ আচ্ছা তোর সত্যিই মনে হয় না ভাইয়া তোকে লাইক করে? তাহলে আমার কেন মনে হয়! ‘

কুহেলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
‘ মাঝে মাঝে উনি অনেক আজব আজব কান্ড করেন জানিস! ‘

সেদিনের রাতে বই নিতে আসার ঘটনা চন্দ্রিমাকে খুলে বলে কুহেলী। চন্দ্রিমা বেশ ভেবে চিন্তে বলে,

‘ বাপরে উনি এতো রোমান্টিক কথা বলে কেমনে? মুখ দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না। তুই এক কাজ করিস সমারোহ ভাইয়ার প্রেসক্রিপশনের লেখাগুলো একটু চেক করিস পারলে। আর না হলে উনার ব্যাক্তিগত লাইব্রেরীর কোথাও না কোথাও তো তার হ্যান্ড রাইটিং পেয়েই যাবি। দেখে নিস একবার। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

‘ ইশঃ তোর লজ্জা লাগেনি? আমার তো সেই সিন কল্পনা করতেই…। ‘

‘ তুই একটা বদমাশ। ‘

‘ সত্যিই পাসনি লজ্জা! ‘

‘ তো পেয়েছি না আবার? কলিজা শুকিয়ে জান বেড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। ‘

‘ তোমাকে তো আমি বলিনি ভালোবাসি তাই না? ‘

‘ ভালোবাসলে মুখে বলাটা জরুরি নাকি? ‘

‘ অবশ্যই জরুরি। আমি বলিনি মানে আমি বাসিনা। দেটস এই! ‘

সেঁজুতি হুড়হুড় করে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।জীতু এতো সহজে কিভাবে বলে দিল সে ভালোবাসে না। কই তার উদাসী আচরণে অবহেলার ছাপ তো ছিল না কখনো! হ্যাঁ সেঁজুতি জানে জীতু বেখেয়ালি স্বভাবের। কিন্তু বেখেয়ালিপনার মাঝে একটুকরো ভালোবাসা ছিল না কোনোদিন এটা মানা অসম্ভব। সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতেই অনুনয় করে বলে,

‘ আরেকবার বলুন, ভেবে বলুন জীতু‌। আমার জন্য আপনার কখনোই কোনো অনুভূতি ছিল না?’

‘ হ্যাঁ ছিল। ‘

‘ তবে? ‘

‘ অনুভূতি ছিল, সাময়িক আকর্ষণ কাজ করতো সেটা যেকোন মেয়ের সাথে মিশলেই করবে। এটা ন্যাচারাল। তবে ভালোবাসা ছিল না। যুঁথি আমি তোমাকে স্ট্রং মেন্টালিটির মেয়ে ভাবতাম। তাই এতোটা মিশেছি। আমাদের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া আর কখনো কি ছিল কোনদিন? আমি তোমার প্রতি কোন বাজে আচরণ করেছি? কখনো আমার কাছাকাছি টানতে চেয়েছি?কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণও করিনি। তোমার কাছে ঘেঁষতে চাইনি তাহলে তুমি কি করে ধরে নিলে যে আমি তোমাকে ভালবাসি? ‘

‘ আপনার চোখ দেখে। আপনার চোখ বলেছে আমায়। ‘

‘ আচ্ছা,তাই নাকি? ‘ ঠাট্টামূলক হাসি হাসে জীতু।

সেঁজুতি মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে,
‘ দেখতে পাচ্ছেন আমি কাঁদছি? আমার চোখের জল কি আপনার হাসির কারণ! আমার পরিস্থিতি, আমার অবস্থা হাস্যকর মনে হচ্ছে? আমি কি হাসির পাত্র? ‘

জীতু আশেপাশে অস্থিরতা নিয়ে তাকায়। ভরা রাস্তার মাঝে চেঁচিয়ে উঠেছে সেঁজুতি। সেঁজুতি এমন মেয়ে না। অযথা সিনক্রিয়েট সে কখনোই করেনা। জীতু দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘ যুঁথি আস্তে কথা বলো‌, চেঁচাচ্ছো কেনো? আশেপাশের সবাই দেখছে আমাদের। ‘

‘ দেখুক! সমস্যা কোথায়?যখন হুটহাট এসে জরিয়ে ধরতেন তখনো তো দেখতো, কই তখন তো সমস্যা হতো না! যখন ঘন্টার পর ঘন্টা রিকশার হুড তুলে দিয়ে পুরো চিটাগাং শহর আমার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তখনো দেখতো। যখন শাড়ি সামলাতে না পেয়ে কোমরের কিছু অংশ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠতো আপনি বেঘোরে চেয়ে থাকতেন তখনো সমস্যা ছিল না। আজ আমি জোর গলায় কথা বলছি তাই সব সমস্যার আবির্ভাব? ‘

জীতু থ’মেরে যায় সেঁজুতির কথায়। সেঁজুতি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। জীতুও বসে তার পাশে। খানিকটা সময় চুপচাপ কেটে যায় দুজনার। সেঁজুতি হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। জীতুর খুব করে ইচ্ছা করে মাথায় হাত রাখতে মেয়েটার। রাখা হয়না। তার কোনো অধিকার নেই। চাকরিটা হয়নি। হলে হয়তো অন্যরকম হতো সব। চাকরিটা পেলে হয়তো সেঁজুতি কাঁদতো ঠিকই তবে তার বুকে মাথা রেখে। জীতুর বুকে ফাঁটে। তাও অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে থাকে সে।

জীতুর মনে পড়ে যায় তিন বছর আগের কথা। পহেলা বৈশাখের একটা ফাংশানে জীতু সেদিন প্রথম দেখেছিল সেঁজুতিকে। লাল শাড়ি পড়া এক অপূর্ব মায়াবতী সেদিনই জীতুর মনে জায়গা করে নিয়েছিল। জীতু সেদিন ভার্সিটির প্রোগ্রামের উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিল। পুরোটা সময় সে স্টেজ থেকে সেঁজুতিকেই কেবল দেখে গিয়েছিল। মিষ্টি মেয়েটার হাসিতে ঢলে পড়া। ঠোঁটের মাঝে ক্লিপ আটকে হাত উঁচু করে খোঁপা করা কাঁটার মতো বিঁধে ছিল জীতুর বুকে। ঝরঝরে তাজা লাল রক্ত ঝড়িয়ে ছিল এই সুন্দরী। সেঁজুতি সেদিন তাকে খেয়াল করেনি।

সময় সত্যিই নির্মম। যে সেঁজুতির মনের কাছাকাছি থাকার জন্য একসময় জীতু মরিয়া হয়ে উঠেছিল এখন সেই সেঁজুতিকেই তার ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এজন্যই হয়তো স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। ভালোবাসতে চায় না, ভালোবাসা তাদের মানায় ও না। মানায় কেবল বাস্তবতা বুঝে কঠোর থেকে কঠোরতর সিদ্ধান্ত নেয়া। বাবা পঙ্গু হয়ে গেছেন দেয় বছর হলো। চাকরি করতে পারেন না। বোনটা ছোট।মা-বাবা আর ছোট বোনটার খরচ তাকে দেখতে হয়। দু-তিনটা টিউশনি আর নাট্য দলের অভিনেতা হওয়ার বদৌলতে পাওয়া সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কোনরকমে সংসারের খরচের হিসাব কষা গেলেও সেঁজুতির বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস জীতুর নেই। সেঁজুতিকে খুশি রাখার সামর্থ তার নেই। আর না আছে বিয়ে করার অধিকার। সেঁজুতি হয়তো তার অল্পতেই খুশি থাকবে তবে জীতু তা চায়না। একমাস মুখে খাবার জুটলে পরের মাসের চিন্তায় যায় মাথার ঘাম পায়ে পরে তার আবার কিসের ভালোবাসা!

সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতে জীতুর বুকে হামলে পরে। জীতু নিজের সাথে চেপে ধরতে চেয়ের ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয় সেঁজুতিকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জীতু বলে,

‘ আমি তোমাকে বলেছি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমার পছন্দের মেয়ের সাথে। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। এই আচরণে তোমায় মানায় না। গায়ে হাত দাও কেন বারবার? অসহ্য লাগে। ‘

মেয়েটা নির্বাক চেয়ে থাকে। মানুষ কতো নিষ্ঠুর না! সেঁজুতির নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। কেমন মানুষকে সে ভালোবেসেছে? নিজে ভালো না বাসুক সে অন্যের ভালোবাসার দামটুকুও দিতে পারে না। মানুষ নাকি জানোয়ার! সেঁজুতির কাঁদতেও ঘৃণা লাগে। হাতের ছোঁয়ায় চোখের জল মুছে চট করে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ আমি কোনো স্বস্তা মেয়ে না যে আপনার গায়ে হাত দেব বারবার। আমার ও বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসেই। আপনার আগেই বিয়ে করে নেব ইনশা’আল্লাহ। দাওয়াত দেব। ভালো থাকুন আর অনেক অনেক শুভকামনা রইল আপনাদের জন্য। ‘

সেঁজুতি চলে যায়।জীতু এই প্রথম নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। সত্যিই সে কাপুরুষ! জীতুর চোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বদলে রক্ত ঝরে। হৃৎপিণ্ড খুঁড়ে বের হয়ে আসা টাটকা রক্ত! জীতু্র মন অবুঝ হয়ে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। ভালোবাসি বলতে ইচ্ছা করে। বারংবার মনের মাঝে আওড়ে যায় একবার ফিরে এসো, পেছন ফিরে দেখো আমি কাঁদছি যুঁথি! কাঁদছি আমি।
সেঁজুতি পিছন ফিরে তাকায় না। যে লোকটা তার অনুভূতির বরাবর অপমান করেছে তার থেকে সরে যাওয়ার শ্রেয়। রিকশায় চড়ে বসে স্থান ত্যাগ করে সেঁজুতি।
সঙ্গে হয়তো জীতুকেও!

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

২৫.

লাইব্রেরীর অনেকগুলো বই ঘাটিয়ে দেখেছে কুহেলী। বেশ অদ্ভুত কান্ড! লোকটার পড়া বইয়ে তার কোন লেখাই থাকবে না? কুহেলীর স্পষ্ট মনে আছে সেদিন যে বইটা নিয়েছিল তাতে বইয়ের রিভিউ সম্পর্কে একটা চিরকুট ছিল। কুহেলী বেশ হেসেছিল সেটা পড়ে, হ্যান্ড রাইটিংটা মনে নেই। সেটাও নেই এই মুহূর্তে। উধাও হয়ে গেল নাকি! অনেক খুঁজা খুঁজির পরও কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে বের হয়ে আসে লাইব্রেরী থেকে। সমারোহর ঘরের সামনে এসে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকে। সমারোহ এখন হসপিটালে ডিউটিতে। কিন্তু কারো ঘরে তার পারমিশন ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। বড় এক নিঃশ্বাস ফেলে কুহেলী সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে আসে।

ঘরে এসে অনেক ভাবনা চিন্তা করে হঠাৎই মনে পড়ে সমারোহর গ্রন্থাগারের টেবিলের ডেস্কে প্যাশেন্টের ফাইল রাখতে দেখেছে। সেখানে তো থাকলেও থাকতে পারে সমারোহর লিখা। কুহেলী আবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে লাইব্রেরী রুমে। কিন্তু লাভ হয় না‌। ড্রয়ার তালাবদ্ধ করা আছে। কুহেলীর এবার নিজের মাথার চুল টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। চন্দ্রিমাকে ময়লার স্তূপে ফেলে দিতে মন চাইছে। মেয়েটা অযথাই তার মাথায় এসব আবল-তাবল চিন্তাভাবনা ঢুকায়। বিরক্তি নিয়েই এসে টেবিলে বসে কুহেলী। অনেকগুলো ক্লাস সে পিছিয়ে গিয়েছে, সেগুলো রিকভারি করবে কিভাবে আল্লাহ জানে! দু-তিন ঘণ্টা পড়ার পর বইয়ের ভিতর হঠাৎ একটা কাগজ পায় কুহেলী। কি কি সব ঔষুধের নাম লেখা সেখানে।

চমকে উঠে কুহেলী। আরে, এই বইটাই সেদিন নিয়েছিলেন সমারোহ। পড়ার সময় হয়তো লিখেছেন। কুহেলী বই দিয়ে নিজের মাথাতেই ঠাস করে বারি দেয়। কি পাগল মেয়ে সে, তার কাছে আগে থেকেই সমারোহর হাতের লেখা ছিল। কিছু একটা ভেবে কাগজটা নিয়ে সেঁজুতির ঘরে যায় কুহেলী। সেঁজুতি তখন বেলকনিতে বসে কাঁদছিল। আব্বাকে সে বলে দিয়েছে বিয়েতে রাজি। ছেলেপক্ষ যেন দেখতে আসে, তার আপত্তি নেই। কিন্তু কলিজা ফেটে যাচ্ছে তার। এমনটা না হলে কি হতো না? মনের যে স্থানে সে‌ জীতুকে অনেক আগেই বসিয়ে দিয়েছে সে স্থান অন্য কাউকে দিতে হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে সেঁজুতির।

কুহেলীর গলা পেতেই দ্রুত চোখের জল মুছে ভিতরে আসতে বলে। কুহেলী সেঁজুতির পাশে এসে বসে বড়ই প্রফুল্ল ভঙ্গিমায় বলে,

‘ কি করছো আপু? ‘

‘ এইতো বসে আছি। ভালো লাগছিল না কিছু। ‘

‘ তোমার কি শরীর খারাপ? চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ‘

‘ কেমন? ‘

সেঁজুতির কন্ঠ শুনে আৎকে উঠে কুহেলী। কেমন ঠান্ডা স্তব্ধামারা গলা সেঁজুতির। কথায় যেন প্রাণ নেই। কুহেলী চুপচাপ চেয়ে থাকে সেঁজুতির দিকে। সেঁজুতি মুচকি হাসে। মলিন সে হাসির কোন প্রাণবন্ততা নেই। সেঁজুতি বলে,

‘ কিছু বলবে বলে এসেছিলে হয়তো। ‘

‘ হুম। ‘

কুহেলী সেই ঔষুধের নামের কাগজটা সেঁজুতিকে দিয়ে বলে,

‘ আপু এটা সমারোহ ভাইয়ার হাতের লেখা? ‘

সেঁজুতি ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে বলে,

‘ হ্যা, ভাইয়ার ই তো মনে হচ্ছে। কেনো বলো তো? ‘

‘ না আসলে কাগজটা পরে থাকতে দেখলাম। বুঝচ্ছিলাম না কার তাই। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

চুপসে থাকে সেঁজুতি। কথা বলার যেন কোনো ইচ্ছাই তার নেই। কুহেলী বুঝতে পারে মন খারাপ। তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলে,

‘ আচ্ছা আপু তুমি রাঁধতে খুব ভালোবাসো তাই না? ‘

‘ হুম। ‘

‘ আমাকে পাস্তা রেঁধে খাওয়াবে? তোমার হাতের এই রান্নাটা বেস্ট। ‘

‘ খাওয়াতে পারি তবে শর্ত আছে। ‘

‘ কি শর্ত? ‘

‘ আমি যা প্রশ্ন করবো সঠিক উত্তর দেবে। ‘

কুহেলী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কি এমন প্রশ্ন করবে! মাথা ডানে হেলিয়ে সম্মতি দেয়। সেঁজুতির ভালো লাগে। সহজ ভাষায় বলে,

‘ ভাইয়াকে তোমার ভালো লাগে? ‘

কুহেলী ভড়কে যায়। হঠাৎ চমকে উঠায় বিষম খায়। কাশতে শুরু করে। সেঁজুতির খুব জোর হাসি পায়। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। কুহেলী দুই হাতে গ্লাস চেপে ধরে রুদ্ধশ্বাস পানি খেতে গিয়ে নাকে মুখে উঠে যায়। কাশতে কাশতে এবার আরো বাজে অবস্থা। সেঁজুতি কোনো রকমে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে কুহেলীর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। স্নেহ মাখা গলায় বলে,

‘ হায়রে মেয়ে, পানিটা ও ঠিক মতো খেতেও পারে না। ‘

‘ আমি ঠিক আছি আপু। ‘

চোখ মুখ নামিয়ে বলে কুহেলী। কালমুহূর্ত পর সেঁজুতি পূর্বস্থানে বসে কুহেলীর চিবুক ছুঁয়ে বলে,

‘ তোমার মতো মিষ্টি মেয়ে আমি আর দুটো দেখেনি। ‘

কুহেলী লজ্জিত হয়। সেঁজুতি আবার বলতে থাকে,

‘ মেয়ে মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি জানো, এরা যেমন পুরুষকে প্রেমে ফেলতে পারে তেমন অন্যের ভালোবাসা কেড়েও নিতে পারে। মেয়ে মানেই হলো হিংসার কারখানা। তাই হারিয়ে ফেলার আগেই যাকে ভালোবাসো তাকে আঁচলে শক্ত করে বেঁধে ফেলো, বুঝলা? ‘

কুহেলী হা করে দ্রুত মাথা ডানে-বামে নাড়ায়। মানে সে বুঝেনি। সেঁজুতি ফিক করে হেসে বলে,

‘ বুদ্ধু একটা! অতো বুঝতেও হবে না। ছোট মানুষ যতো কম বুঝবা তত ভালো। যার বুঝার সে ঠিক বুঝে সামলে নিবে। মাঝে মাঝে মনে হয় জানো, এতো কিছু বুঝার ক্ষমতা কেনো দিল আল্লাহ? অবুঝ হতাম কিংবা পাগল! হেসে খেলে দিন পাড় হতো। সম্পর্ক কি, সম্পর্কের টানাপোড়েন প্যাঁচ যারা বুঝে না তারাই সুখি। সত্যিই হয়তো মেয়ে মানুষের অনুভূতি কম হলেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারে, বুদ্ধিমান মেয়েরা পারে না। ‘

সেঁজুতির কথায় প্রাণ নেই।কুহেলী সেঁজুতির কথার ফাঁকেই বলে,

‘ আপু তুমি বিয়েতে খুশি নও। তাহলে রাজি হচ্ছো কেনো? ‘

সেঁজুতি চমকের সাথে তাকায় কুহেলীর দিকে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘ কে বললো? অমন কিছু না। আব্বা যা ঠিক করবেন তাই হবে। চলো পাস্তা বানাই। আজ তোমাকেও শিখাবো। তুমি রাঁধবে, আমি দেখবো। সবাইকে খাওয়াবে। ‘

কুহেলী মৃদু হাসে। ঘরে এসে লেখাটার সাথে চিরকুট গুলোর হ্যান্ড রাইটিং মিলায়। নাহ, ভিন্ন রকমের লেখার ধরন। তাহলে হয়তো অন্য কেউ দিচ্ছে এগুলো। কুহেলীর মন খারাপ হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুল খোঁপা করতে করতে নিচে আসে। সেঁজুতির সাথে রান্নায় মন দেয়।

নয়না ঘুমাচ্ছে। তিন-চার দিন পর মেয়েটার চোখের পাতা দুটো এক হয়েছে।স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়েছে, চোখের নিচে কুচকুচে কালো দাগ। উসকোখুসকো চুল। মেয়েকে চিনতে কষ্ট হয় আনরুবার। আনরুবার পায়ে মাথা রেখে কি শান্তিতেই না ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। সারিকা নয়নার ঘরে আসে। আনরুবার সামনা-সামনি বসে নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খায় কপালে। তারপর আনরুবার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ বোনটা আমার কতো খুব কষ্ট পাচ্ছে। তোমাদের আরেকটু বেশি নজরে রাখা উচিত ছিল ওকে। সৌরভ ছেলেটাকে আমি দেখছি। আমার কাছে এতোটা খারাপ কিন্তু মনে হয় নাই আম্মা। আমাদের ওর ফ্যামিলির সাথে একবার কথা বলা দরকার। ক্যারিয়ার গড়বে ভালো কথা। বিয়ে হয়ে থাক।’

আনরুবা কিছু বলে না। সারিকা বলতেই থাকে,
‘ বাচ্চাটা কি থাকবে নাকি…? ‘

‘ আমার নাতি আমার কাছেই বড় হবে। কেউ এই বিষয়ে একটা কথাও বলবে না আর বলে দিলাম। ‘

সারিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলে আনারুবা। কথায় তার কপট রাগ। সারিকা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,

‘ আমিও তাই চাই আম্মা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জানলে কি একটা বিশ্রী অবস্থা হবে ভেবে বুক কাঁপছে আমার। ‘

আনরুবা অসহায় চোখে তাকান সারিকার দিকে। মেয়েটার শ্বশুর শাশুড়ি তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। সারিকার চোখে হতাশার ছাপ। আনরুবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। তার সন্তানদের জীবনে কি সুখের দেখা মিলবে না? তার ভাগের সুখটুকু যেন আল্লাহ তার সন্তানদের দেন। আনরুবা সারিকার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে বলে,

‘ তারা ভালো মানুষ, তোমার মুরুব্বি। তাদের সম্পর্কে খারাপ মনোভাব রাখবা না। দিদার তোমার খুব খেয়াল রাখে। ‘

লাজুক হাসে সারিকা। পরক্ষণেই হাসি উধাও করে বলে,

‘ সমারোহর বিয়ে কি দিবা না? ওর জন্য সান্দ্রর বিয়েও আটকে আছে। ‘

আনরুবা চিন্তিত হন। ছেলেকে বিয়ের বিষয়ে বলার মতো সাহস আনরুবার নেই। আলোর বিয়ের কয়েক বছর পর জোরে বলে বিয়ে দিতে চেয়েছিল সমারোহকে। সমারোহ রাগে তিনমাস বাড়ি ফিরেনি। এখন বললে আবার কি হয় কে জানে।
মায়ের উত্তরের আশায় বসে না থেকে সারিকা। বিক্ষিপ্ত সৃষ্টিতে তাকিয়ে গরম মেজাজে বলে,

‘ আলো কিন্তু অনেকবার মাফ চেয়েছে‌। আমি বলছি তোমায় সমারোহ এখনো ভালবাসে আলোকে। অভিমান করে আছে, করাটাই স্বাভাবিক। বিয়ে দিয়ে দাও দেখবে দু’এক মাস পর অভিমান অভিযোগ উড়ে যাবে সব। ‘

‘ওরে জোর করা যায়?’

‘ জোর না করলে সারাজীবন সন্ন্যাসী বানিয়ে রাখতে হবে ছেলেকে‌। সেঁজুতিকে ছেলে পক্ষ পছন্দ তো করেই রাখছে। এবার আল্লাহ আল্লাহ করে বিয়েটা হয়ে গেলে এরপর আলো আর সমারোহর বিয়ে দিবা এই শেষ কথা‌। ‘

‘ সমারোহর মতামত না থাকলে কেমনে দিব? ও কি বাচ্চা নাকি? ওর মতের অমিল হলে ও বিয়ে করবে না। ‘

‘ ওফ আম্মা, তোমরা কি ওরে মতামতের সময় দেও নাই? ছোটরা পাগলামি শুরু করলে বড়দেরই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জীবনটাতো আর ছেলে খেলা না। বিয়ে করার বয়স হইছে বিয়ে করবে। ‘

‘ কিন্তু…। ‘

‘ তোমারে আর কিছু বলতে হবে না। আমি ওরে সিদ্ধান্ত জানায় দিব। ওর যদি অন্য কোনো মেয়ে পছন্দ থাকে তবে সমস্যা নাই সেই মেয়ের সাথেই বিয়ে হবে‌। আর নয়তো আলোর সাথে। কিন্তু বিয়ে এবার করতেই হবে। ‘

পাস্তা রাঁধতে গিয়ে পুরো রাতের খাবারই রেঁধে ফেলে সেঁজুতি আর কুহেলী। আনরুবার শরীরটা সামান্য অসুস্থ হওয়ায় কিছু বলেন না তিনি। নয়না ও সামান্য সাহায্য করে। সব চাইনিজ আইটেম রান্না করা হয়।পাস্তা, ফ্রাইড রাইস, ফিশ কাবাব, চিলি চিকেন, বিফ কারি, ক্যাশিওনাট সালাদ আর ফিন্নি। সান্দ্র আর সমারোহ বাড়ি ফিরে রাত এগারোটায়। বাড়ির সবাই সেদিন না খেয়ে অপেক্ষা করে ওদের জন্য। সান্দ্র হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলে বসতে বসতে বলে,

‘ বাহ, এলাহী কান্ড! এতো সব রান্নার কারণ? ‘

সেঁজুতি মুচকি হেসে বলে,
‘ এমনি, মন চাইলো। ‘

সান্দ্র মুখ চোখ কুঁচকে কালো করে নাটকীয় ভাবে বলে,

‘ তুই রেঁধেছিস? এই সেরেছে। মুখে তুলা যাইবো একটাও! পেটে তো বিষক্রিয়া হবে। ‘

সান্দ্রর ভঙ্গিমায় হেসে ফেলে সবাই। অন্যান্য সময় সেঁজুতি রেগে গেলেও আজ কেনো যেনো একদম রাগতে ইচ্ছা করে না। বরংচ হেঁসে বলে ওঠে,

‘ আজকে কুহেলী রাঁধছে গর্দভ, আমি না। আমি শিখিয়ে দিছি। ‘

‘ ওহ রেয়েলি! সেদিন যে কুহেলীর হাতের ভর্তা খাইছি এখনো মুখে লেগে আছে। আমারে সবার আগে দাও। ‘

সান্দ্রর কথায় আনরুবা হেসে বলে, ‘সবুর কর।’

‘এতো ভালো খাবার থাকতে সবুর করে কেমনে! ‘

সমারোহ কুহেলীর দিকে এক পলক দেখে। আলোর যেন পিত্তি জ্বলে যায়। সামন্য পাস্তা প্লেটে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। চারিদিকে কুহেলীর এতো জয়ধ্বনি দেখে খাবারে বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার। বিতৃষ্ণা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যখন সমারোহর মুখেও কুহেলীর প্রশংসা শুনে। সমারোহ দু-তিন লোকমা মুখে তুলে নিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

‘ তুই শিখালি অথচ তোর চেয়ে ভালো রেঁধেছে। আমাকে আরেকটু চিকেন দিও কুহেলী। ‘

কুহেলীর লজ্জায় নাক, কান লাল হয়ে যায়। আকস্মিক ভাবে সে খেয়াল করে অন্য কারো প্রশংসায় তো এতোটা লজ্জা পাচ্ছে না! কাঁপা কাঁপা হাতে সমারোহকে খাবার সার্ভ করে সে।

সারিকা সবটা দেখে।বিষয়টা তেমন একটা ভালো না লাগলেও গিলে ফেলে। খাবারের মাঝেই বলে,

‘ তোর বিয়ের বয়স হয়েছে সমারোহ। আব্বা আম্মাকে আর কতো টেনশন দিবি? তোর কোনো পছন্দ আছে? আমরা চাই আলোর সাথে তোর বিয়েটা দিতে।’

সারিকার কথা শুনেও শান্ত থাকে সমারোহ। খুব সিগ্ধ শীতল কন্ঠে বলে,

‘ আমি এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই। ‘

সারিকা পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘ এর বেশি সময় দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেঁজুতির বিয়ের পর তোর আর আলোর বিয়ের ডেট ফাইনাল করবো। ‘

সারিকার কথায় আলো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যায়। আড়চোখে একবার দেখে নেয় কুহেলীর মুখখানি। স্তব্ধা মেরে আছে চেহারাটা। মোমের মতো মোহনীয় মুখে যেন ঘোর বর্ষার বিষন্নতার আছড়ে পড়েছে। কুহেলীর মোবাইলে বাড়ি থেকে ফোন আসায় কল এটেন্ড করার উছিলায় স্থান ত্যাগ করে কুহেলী।

কুহেলীর চলে যাওয়ায় কেনো যেন বেশ খারাপ লাগে সমারোহর। সবাইকে চমকে দিয়ে খাবারের প্লেট মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে সমারোহ বলে,

‘ আগেও বলেছি তোদের আমাকে নিয়ে না ভাবলেই ভালো হবে। সিদ্ধান্তটা তুই নিয়েছিস। আব্বা কিংবা আম্মা নয়। আর তারা নিলেও আমি আলোকে বিয়ে করবো না। আমার লাইফে আমি কি করবো না করবো তার সিদ্ধান্ত কেবল আমি নিব। আর কেউ না।তুই তো একদমই নেয়ার চেষ্টা করবি না। গট ইট? আই থিংক ইউ। ‘

চলবে.

(রি-চেক করার সময় হয়নি।)

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

২৬.

সেঁজুতির সাথে একান্তে কথা বলতে দেয়া হয়েছে ছেলেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা সে।নাম হিরণ চৌধুরী।একসময় প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র ছিল। কুচকুচে কালো চামড়ার মানুষটার ব্যক্তিত্ব যেন আকাশ ছোঁয়া। মলিন হাসিটাও যেন ফরমালিটি মেইনটেইন করে চলে। সেঁজুতির কথা বলতে ইচ্ছা করে না মানুষটার সাথে তাও রোবটের মত বলে চলে। হিরণের জায়গায় জীতু থাকলে হয়তো বুকে হামলে পড়ে অসংখ্যবার চুমু খেয়ে নিত। হিরণ অদূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ আপনাদের বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়। ‘

সেঁজুতি কিছু বলে না। প্রতিউত্তরে কেবলমাত্র হাসে।

‘ আপনার হাসি সুন্দর। ‘

হিরণের অকপটে বলে যাওয়া কথাগুলো বিব্রত করে সেঁজুতিকে। মুখে হাসি না আসলেও জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। হিরণ এবার একটু শক্ত হয়। গম্ভীর হয়ে বলে,

‘ আমার বিষয়ে কিছু জানার আছে? ‘

‘ না। ‘

‘ আপনি বিয়েতে মত দিয়েছেন? মানে কোনো প্রকার জোর করা হয়েছিল কি আপনার উপর? ‘

সেঁজুতি এবার হিরণের চোখে চোখ রাখে। হিরণ চোখ সরিয়ে নিতেই রোবোটের মতো সেঁজুতি বলে,

‘ আমার পরিবারে এমন কেউ নেই যে জোর করবে। আমি নিজের ইচ্ছেমতেই বিয়ে করতে চাইছি। ‘

‘ আপনার বড় বোনকে দেখলাম আপনাকে জোর গলায় কিছু বলছিলেন এখানে আসার পূর্বে। ‘

‘ বলেছে আপনাকে কোনো উল্টাপাল্টা কথা না বলতে কিন্তু আমি সত্যিটা বলবো। ‘

বিষ্মিতো হলেও তা প্রকাশ করে না হিরণ। সেঁজুতির কথার ভালো শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করে।

‘ আমি একজনকে ভালবাসতাম, ইনফ্যাক্ট এখনো বাসি। কিন্তু তিনি আমাকে ভালোবাসেন না। অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে তার‌। এসব জানার পরও কি আমাকে বিয়ে করবেন আপনি? ‘

‘ যদি না বলতেন তাহলে হয়তো করতাম না। ‘

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সেঁজুতি। হিরণের কথার আগা মাথা খুঁজে পায়না। হিরণ হালকা হেঁসে পকেটে হাত রেখে এসে সেঁজুতির সামনে দাঁড়িয়ে খুব স্মার্টলি বলে,

‘ আপনি স্পষ্টভাষী দেখে ভালো লাগলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি হয়তো কষ্টে আছেন। আপনার চোখ দুটো গভীর আর হাসিতে মায়া! আমার ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমার বাবা মার আপনাকে ভালো লেগেছে। আমার কোন সুন্দরী কিংবা স্মার্ট কাউকে দরকার নেই।আমি একজন জীবন সঙ্গিনী চাই যে নামাজি হবে, আমার ঘরকে পবিত্রতা দিয়ে বেঁধে রাখবে। আমার বাবা মাকে ভালোবাসবে আর, আর আমাকে তার মিষ্টি হাসির সুরে বেঁধে ভোলাবে। আশা করি আমি তাকে পেয়েছি। ‘

হিরণ ছাদ থেকে নিচে চলে যান। সেঁজুতি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। কষ্ট হচ্ছে। গভীর কষ্ট হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। লোকটা তাকে কতটা সম্মান দিয়ে কথা বললো! এক নিমিষেই কতোটা দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিল। জীতু এভাবে কখনো দেয়নি। সেঁজুতির অনুভূতিকে সম্মান করেনি। ভালোবাসেনি বলেই হয়তো করেনি! বিয়েটা তাহলে হয়েই যাচ্ছে?

হিরণের জন্য মেয়ে দেখতে এসে হিরণের ছোট ভাই হাসিনের জন্যও মেয়ে পছন্দ হয়ে যায় হিরণের মা’র। কুহেলীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান ভদ্রমহিলা। ভাবেন কুহেলী হয়তো আনরুবাই মেয়ে। কুহেলীকে হাসিনের বউ করতে চান কথাটা গোপনে কানে তোলেন আনরুবার‌। আনরুবার কেনো যেনো বড্ড রাগ হয়। রাগের বশে এসে বলে দেন,

‘ ও আমার মেয়ে নয়। আমার ছেলের হবু বউ। ‘

কথাটা বলে জিভ কাটে আনরুবা। ছেলের বউ কেমনে হলো! সান্দ্রর তো মাইশা আছে আর সেদিনের ঘটনার পর সমারোহ কে বিয়ের কথা বলার সাহস কারো নেই। যেহেতু তারা আত্নীয় হতে চলেছেন মিথ্যা বলাটা কি ঠিক হলো! পড়ে যদি কথা উঠে এসব নিয়ে? ভদ্রমহিলা ভুল বুঝতে পেরে চুপসে থাকেন। এমন পুতুলের মতোন বউ পাওয়াটা ভাগ্যের বিষয়। সেদিনের মত বিয়ের দিনক্ষণ পাকাপোক্ত করে বাড়ি ফিরে যায় ছেলে পক্ষ।

বাড়িতে কথা বলে মনটা খারাপ হয়ে যায় কুহেলীর। কুঞ্জার শরীর তখনো খুব খারাপ। সেদিনের কান্ডে মেয়েটা এতোটাই ভয় পেয়েছে মনে গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। খোর্শেদের শরীরটাও ভালো যায় না ইদানিং। মেয়েকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন মানুষটা অথচ এতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসার সাহস কিছুতেই করে উঠতে পারছেন না।

কুহেলী ভেবে দেখে এর পূর্বে এমন কোনো সময় ছিল না যখন আব্বার অসুস্থতায় সে পাশে ছিল না। চট্টগ্রাম আসার পর যে এতো কিছু হয়ে যাবে কে জানতো! ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। এখানে আসাটা তার মোটেই উচিত হয়নি।খয়েরি চোখের সুঠাম দেহের ডক্টর তার মন চুরি করে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আর পরিবারের মানুষগুলোর দুরবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। এই সকল কিছুর থেকে পালাতে চায় কুহেলী। খুব দূরে পালাতে চায়।

আব্বার সাথে কথা বলা শেষে জানালার ধারে মেঝেতে বসেই কাঁদতে থাকে কুহেলী। এবার সে বাড়ি যাবেই। কারো বারণ শুনবে না। অন্যের ভয়ে নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কষ্ট কতটুকু? নিজেকে কতোটুকু অসহায় মনে হয় তখন! এই বাড়িটা থেকেও পালাতে হবে তাকে। সমারোহ আলোকে বিয়ে করে নিলে তা দেখার ক্ষমতা হবে কুহেলীর! দম বন্ধ হয়ে এই ঘরের এক কোনায় পড়েই মারা পড়বে সে। কুহেলীর যেন মনে হয় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। বুকের ঠিক মাঝখানে বাম হাত চেপে ধরে কুহেলী। এতোটা ব্যাথা কেনো হচ্ছে!কোনো রোগ হয়েছে কি তার? এই ব্যাথার ঔষুধ কোথায়?

অস্থির হয়ে উঠে মেয়েটা। হাত পা ছড়িয়ে বসে মুখ দিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে চন্দ্রিমার নম্বর ডায়েল করে‌। চন্দ্রিমা কল রিসিভ করতেই হন্তদন্ত হয়ে বলে,

‘ আমার হলে একটা রুম লাগবে। ম্যানেজ করে দে চন্দ্রি। এই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি মরে যাব। ‘

অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন এক কন্ঠস্বর ভেসে আসে। কুহেলী খেয়াল না করেই বলে,

‘ আমি বাড়ি যাবো আব্বাকে দেখতে। দু একদিনের মধ্যেই যাব। ফিরে এসে হলে উঠবো। রাখি, আল্লাহ হাফেজ। ‘

কথা বলা শেষে মোবাইল বন্ধ করে দেয় কুহেলী। এই সময়টাতে সবাই ব্যস্ত উপহার সামগ্রী গোছাতে। রাতে সকলকে মাইশার বাসায় দাওয়াত করা হয়েছে। বাড়ির পেছন দিকে কেউ যাবে না। কুহেলী লম্বা মোটা একটা চাদর আর তোয়ালে নিয়ে চুপচাপ বাসার পেছনের বড় দরজা দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে চলে যায়‌। পুকুরে গোসল করা হয়নি অনেকদিন। সুইমিং পুলের পানি পরিষ্কার, ইচ্ছে মতো ডুব দিতে পারলে মনের ব্যাথা হয়তো কমবে।

হসপিটাল থেকে বাধ্য হয়ে দুপুরের পরের সময়টাতে ছুটি নিতে হয়েছে সমারোহর। ফলে হাফ নাইট ডিউটি করতে হবে। তাছাড়া উপায় ও ছিলনা। সান্দ্রর বিষয়টা ইম্পর্টেন্ট। সন্ধ্যার ডিউটি এক্সচেঞ্জ করা হয়েছে ডা.নাফিজের সাথে। তার সাথে একজন ইমার্জেন্সি প্যাশেন্টের বিষয়ে কথা বলতে বলতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সমারোহ। ততক্ষণাৎ চোখে পড়ে কুহেলীকে। মেয়েটা সুইমিং পুলের পানিতে ইচ্ছে মতো সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে। সমারোহ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে‌। ঠোঁট দুটো মৃদু প্রসারিত হয়‌। ফোন কেটে দিয়ে ব্ল্যাক প্যান্টের পেকেটে হাত ডুকিয়ে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে থাকে সমারোহ। কুহেলী হাসছে,পানি এদিক সেদিক ছিটিয়ে খেলা করছে। তাকে এই মুহূর্তে বেলে ডান্সারের মতো উচ্ছল প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে সমারোহর কাছে। দীর্ঘকায় চুলগুলো ল্যাপ্টে আছে গালে গলায়। অনেকটা সময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকায় হঠাৎ বুক কেঁপে উঠে সমারোহর। সে এভাবে কেনো তাকিয়ে আছে?নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সমারোহ। কুহেলীর মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে কখনো আলোকে ও দেখেনি।কক্ষনো না। সমারোহ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকায়। কি হচ্ছে তার সাথে কিছুই সে ঠাওর করতে পারছে না। তবে যা হচ্ছে অদ্ভুত হচ্ছে এবং তা আগে কখনও হয়নি। সমারোহর চোখ আবার আপনাআপনি চলে যায় কুহেলীর দিকে।

কুহেলী সাঁতার কাটার মাঝে হঠাৎই পানির মাঝে একটা প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে পেছন ফিরে উপরে তাকায়। দ্রুত সরে পড়ে সমারোহ। কুহেলীর চোখে পড়ে না কাউকে। উপরের ঘরটাতে একটা নেটের সাদা পর্দা উড়ে চলেছে কেবল। নিজেকে ধাতস্থ করে গায়ে চাদর জড়িয়ে পানি থেকে উঠে আসে কুহেলী। সমারোহ আবার নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে শূন্য সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নয়না আর কুহেলী ছাড়া সবাই গিয়েছে মাইশার বাড়ি। নয়না অসুস্থ আর কুহেলী তাকে দেখাশোনা করার উছিলায় থেকে যায়। আনরুবা রান্না করেই গিয়েছেন। কিন্তু নয়নার কিছু ঝাল খেতে ইচ্ছা করায় কুহেলী রান্নাঘরে আসে রাঁধতে। সারা বাড়ির লাইট অফ। কেবল উপরের দুই ঘরের লাইট জ্বলছে। কুহেলী ফ্রিজ থেকে সবজি বের করে কাটতে নিয়ে হঠাৎ খেয়াল করে ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে আওয়াজ আসছে। জায়গাটা অন্ধকার। তেমন একটা পাত্তা দেয়না কুহেলী। এক মনে কাজ করে চলে। হঠাৎ অনুভব করে তার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতের ছুরি নিয়ে ভয়ে পেছন ফিরে আক্রমণ করতে যাবে তখনই খেয়াল করে সেটা সমারোহ। চোখ বড় বড় হয়ে যায় কুহেলীর। এতো দ্রুত ফিরে এসে পড়েছে সবাই? না তো! আর কেউ আসেনি। তবে উনি একাই চলে এলেন!

ভাবতে ভাবতে সমারোহর মুখে তাকিয়ে দেখে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে সমারোহ। ধারালো ছুরির অল্প আঁচড়েই হাতের বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে সমারোহর। তাজা রক্ত বের হয়ে আসছে। সমারোহ হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘেঁষে বলে,

‘ পাগল মেয়ে একটা! ‘

ঘরে চলে যায় সমারোহ। কুহেলীর কান্না পায়‌। সবসময় লোকটার থেকে দূরে থাকতে চায় তা তো হয়ই না তার উপর এমন উদ্ভট কান্ড করে বসে। কুহেলী দ্রুত পানি কুসুম গরম করে নিয়ে যায় সমারোহর ঘরে। ততক্ষণে সমারোহ হাত ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে ফেলেছে। চোখ ছাপিয়ে পানি আসে কুহেলীর। লোকটা কতোটা ব্যাথা পেলো তার জন্য!‌ অপরাধবোধ কাজ করে ভিতরে। কুহেলী ভেজা কন্ঠে অনুনয় করে বলে,

‘ সরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি। ‘

‘ জানি আমি। তোমার আর নয়নার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও আর আম্মার রান্না গুলো ফ্রিজে রেখে দাও। ‘

‘ আপনি খেয়েছেন? ‘ বড়ই ভোলাভালা শোনায় কুহেলীর কন্ঠ।

‘ উহুম। ‘

‘ খাবার দিয়ে যাব? ‘

‘ একটুপর। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

কুহেলী ঘর থেকে বের হতে নিলেই সমারোহ পিছু ডাকে‌। কুহেলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমারোহ মৃদু হেসে বলে,

‘ অল্প কেটেছে। এতেই ভয় পেলে ডাক্তার হবে কি করে! বাড়ির সবাইকে দেখতে মন চাইছে? বাড়ি যাবে? ‘

কুহেলী বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সমারোহর দিকে তবে উত্তর দেয়না। সমারোহ আবার বলে,

‘ সেজুঁতির বিয়ে সামনের মাসে। তাছাড়া তোমার পরীক্ষাও আছে কয়েকটা। হয়ে গেলে আমি নিয়ে যাব। এখন বাড়ির চিন্তা ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মন দাও মিস.পাগলী। ‘

দেখতে দেখতে সময় কিভাবে কেটে যায় ঠাওর করা যায়না। সেঁজুতির বিয়ের মাত্র পনের দিন বাকি। গত দেড়মাসে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটা। ঠোঁটে-প্রাণে হাসির ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবলই মুখ জুড়ে অপ্রাপ্তির ছাপ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে অনেকটা। সকালে বেশ ঘটা করে কথা শুনিয়ে দিয়েছে কুহেলীকে। দোষ কেবল এইটুকু, আনরুবার কথায় হিরণের সাথে বিয়ের শপিং এ যেতে বলেছে সেঁজুতিকে। মেয়েটা বকা খেয়ে হাসি মুখেই বের হয়ে গেছে ঘর থেকে তবে বুকটা জ্বালা করছে সেঁজুতির। সে মোটেই এমন মেয়ে ছিল না!

একটা পিঁপড়ে মারতেই কাঁদতে শুরু করা মেয়েটাকে কি বানিয়ে দিয়েছে জীতু! কখনো সে কারো সাথে উঁচু গলায় কথা অবধি বলেনি। এই সেঁজুতিকে চিনতে সেঁজুতির নিজের ই কষ্ট হয়। কুহেলী তাকে এই অসময়ে সাপোর্ট করেছে অনেক। সেঁজুতি আর কুহেলীর সম্পর্ক এই অল্প সময়েই অধিক গাঢ় হয়ে গিয়েছে, তাই হয়তো অনায়াসে বকা দিয়ে ফেলতে পারছে! সেঁজুতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জলে সিক্ত চোখগুলো দেখে রাগে ফুঁসতে থাকে। যে জীতু তার এই অবস্থার জন্য দায়ী সে নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে! থাকারই কথা। সেঁজুতিও নিজেকে ভালো রাখবে তবে!

হিরণের সাথে বিয়ের শপিং এ যাওয়া আর নিজের শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া একই রকম সেঁজুতির কাছে। তবুও সে যাবে। ভালো থাকতে হবে যে! জামা পাল্টে মিষ্টি রঙের একটা জামা পড়ে নেয় সেঁজুতি। তারপর কুহেলীর ঘরের সামনে গিয়ে বলে,

‘ ওই পিচ্চি, আসবো নাকি? ‘

‘ তোমার আবার অনুমতি লাগে নাকি? ‘

সেঁজুতি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হেঁসে বলে,
‘ তোমার বিয়ের পর অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকে যাব। তখন দেখবো অনুমতি লাগে নাকি হে! ‘

কুহেলী হাসে না। মনটা খারাপ, মুখখানি মলিন করে রাখে। বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে কুহেলী। আর খানিক পর পর পড়ার সুরে গুনগুন শব্দ করছে। সেঁজুতি এই কয়েকদিনে ভালোই বুঝতে পেরেছে কুহেলীর যখন মন বেশি খারাপ হয় তখন অসময়েও পড়তে থাকে। মানুষ এতো কেমনে পড়ে সেঁজুতি বুঝে না। পড়ালেখা তো সে করেছে বাধ্য হয়ে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বইয়ের ধারে কাছে পাওয়া যেতো না তাকে। আর এই এক মেয়ে! সারাটা দিন খালি পড়ে। তাও মানা গেল, তবে মন খারাপ হলেও পড়া যায়! ভাইয়ের রোগ তাদের তো ছুঁতে পারে নাই এই বাচ্চা মেয়েটারে সংক্রামিত করেছে নাকি! কুহেলীর মন খারাপ দেখে সেঁজুতি ফোরণ কেটে বলে,

‘ ভাবলাম যাব মার্কেটে। একটা মাত্র বিয়ে বলে কথা এখন মানুষ যদি এমন মুখ প্যাঁচার মতো করে বসে থাকে তাহলে আর যাই কেমনে! ‘

কুহেলী ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে বলে,
‘ আমি প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে থাকি? ‘

‘ হ্যাঁ থাকো। ‘

কুহেলী ঠোঁট উল্টে নিহত চোখে খানিক তাকিয়ে থাকে সেঁজুতির দিকে‌। এমনিতেই কতো বকেছে, তার উপর বললো প্যাঁচা! কুহেলী আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। সেঁজুতি কিছু বুঝে উঠার আগেই গড়গড়িয়ে জল নামে কুহেলীর চোখের কার্ণিশ বেয়ে। সেঁজুতি হতবিহ্বল হয়ে যায়‌। এমা! কান্না করা শুরু করে দিয়েছে? সেঁজুতি বিছানা ছেড়ে দৌড়ে কুহেলীকে ধরে বলে,

‘ হায় হায় হায়, মেয়ের এ কি কান্ড! এভাবে কাঁদে নাকি কেউ? আমি সরি। একদম সরি‌। ইচ্ছে মতো বকে দাও তো। তাও কেঁদো না। ‘

কুহেলী কোনো পাত্তাই দেয় না সেঁজুতির কথার। সেঁজুতি মন খারাপ করে বলে,

‘ আমার মনের অবস্থা ভালো ছিল না কুহেলী। নাহলে বকতাম না। অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। ‘

কুহেলী চোখ মুছে বাচ্চাদের মতো নাক টানে কয়েকবার। সেও কাঁদতে চায়নি। কিন্তু কেঁদে ফেলেছে। সেঁজুতি কখনো এমন আচরণ করেনি। আজ হঠাৎ করে করেছে বলে কুহেলী ভেবেছিল তার হয়তো কোনো বড় ভুল রয়েছে তাই সেঁজুতি তার উপর রেগে আছে। কিন্তু সেঁজুতির বিষন্নত মুখ দেখে সব কান্না উবে গেছে কুহেলীর। মিনমিনে গলায় বলে,

‘ তুমি শুধু তোমাকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছো না। আর তুমি ভালো নেই বলে তোমার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথেও মানিয়ে চলতে পারছো না। ‘

সেঁজুতি নিশ্চুপ। চুপসে যাওয়া সেঁজুতির চোখে তাকিয়ে কুহেলী বলতে থাকে,

‘ তুমি হিরণ ভাইয়ার সাথেও অন্যায় করছো বলে তোমার মনে হয় না? ‘

‘ তাকে আমি বলেছি জীতুর বিষয়ে। সবটা জেনেশুনেই তিনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন। ‘

‘ তুমি বিয়েতে খুশি নও তাহলে করছো কেনো? ‘

‘ আমি জীতুকে ভুলতে চাই। ‘

‘ এতো সহজে ভুলে যেতে পারবে? ‘

‘ হয়তো কখনোই না। ‘

কুহেলী ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘ সেঁজুতি আপু তুমি ভুল করছো। খুব বড় ভুল করছো। পড়ে সারাজীবন কেঁদেকেটেও এই ভুলের মাশুল দিতে পারবে না। ‘

‘ তাহলে কি করবো আমি বলো? কি করতে বলো আমায়? যে লোকটা আমাকে ভালোবাসেন না তার পায়ে পড়ে থাকবো ভালোবাসার জন্য? সে তো তার জীবন নিয়ে খুব খুশি। ‘

কুহেলী হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে বলে,

‘ আপু তুমি সবার আগে এই জীতু নামক ভুতটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। হিরণ ভাইয়া যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমার মনে হয় সে তোমাকে জীতু ভাইয়ার থেকে বেশি ভালোবাসবেন এবং ভালো রাখবেন। যে তোমার ভালোবাসাকে ভুল মনে করে সহজেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সে ভালোবাসার যোগ্য কখনোই হতে পারে না‌। আর তুমি বললে না তুমি জীতু ভাইয়াকে ভুলতে বিয়ে করছো? করো না! জীতু ভাইয়াকে ভুলতে হলে বিয়ে করো না। তাকে ভোলার জন্য হাজারটা উপায় খুঁজে পাবে কিন্তু বিয়ের পর হিরণ ভাইয়াকে খুশি রাখতে পারবে না। ভাইয়াকে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাইলে বিয়েটা করো নয়তো করো না। ‘

‘ কুহেলী আমি সত্যিই সহ্য করতে পারছিনা আর। নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো হারিয়ে যেতে থাকলে যে যন্ত্রণা হয় তা না হারালে বোঝা যায় না। ‘

কুহেলীর বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠে। হারানোর যন্ত্রণা কেমন হয়! সমারোহর সাথে আলোর বিয়ের কথাটা শুনে তার যেন বুক চাপ দিয়ে এসেছে, তেমন? কুহেলী সমারোহকে ভালোবাসে না তাও তখন দুনিয়া জুড়ে আঁধার নেমে এসেছিল। সেঁজুতি তো সেই মানুষটিকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরছে তাহলে তার ক্ষত আরো গভীর! কুহেলীর খারাপ লাগাটা একধাপ বাড়ে। এমন কেনো জগৎ! মানুষ যাকে ভালোবাসে, যাকে চায় তাকে কেনো পায়না? পরোক্ষণেই ভাবে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনার কাছে মানুষ নামক ক্ষুদ্র প্রাণীটির অযথা চিন্তাভাবনা বড়ই অবুঝ। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখা উচিত। তিনি সবচেয়ে ভালোটাই রেখেছেন সবার জন্য।

সেঁজুতি চোখের জল মুছে চলে অনবরত। সত্যিই তো বলছে কুহেলী। সে কি ভুল করছে না! এর আগে ভুল করেছে জীতুকে চেয়ে। এখন আর কোনো ভুল করবে না। কুহেলী চেয়ার ছেড়ে উঠে সেঁজুতির কাছে গিয়ে বলে,

‘ তুমি খুবই মিষ্টি আর ভালো। আল্লাহ তোমার জন্য শুধু ভালোটা রাখেন নি বলেই হয়তো তুমি জীতুদাকে পাওনি। আল্লাহ তোমাকে সর্বোত্তম’টা দিয়েছেন আপু। ‘

সেঁজুতি হা হয়ে চেয়ে থাকে কুহেলীর দিকে। মেয়েটা তার থেকে বয়সে কতো ছোট! অথচ তার চিন্তাভাবনার জগৎ বিস্তৃত। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাসই বলে দেয় তার অন্তরের পবিত্রতা ঠিক কতোটুকু। কুহেলীর সাথে কথা বললে যে কেউ-ই নিজেকে স্পেশাল মনে করতে বাধ্য। সেঁজুতি হেসে উঠে বলে,

‘ আমি চেষ্টা করবো। হিরণকে নিয়েই ভাববো। জীতু থাকবে না আমার ভাবনায়।’

কুহেলী হাসে। সেঁজুতি উঠে তাড়া দিয়ে বলে,

‘ নয়নার তো পাঁচ মাসে পড়লো। এতো হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না। সান্দ্র ভাইয়া আর তুমি যাবে আমার সাথে। ‘

‘ আমি…! ‘ সচকিত হয় কুহেলী।

কুহেলীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভেংচি কেটে সেঁজুতি বলে,

‘ হ্যাঁ তুমি। আমি একা একা এতো কিছু পছন্দ করতে পারবো না। আমার পছন্দ ও খুব একটা ভালো না। আর তাছাড়া আমি জীবনে আজ পর্যন্ত কিছু পছন্দ করে ডিসিশন নিতে পারি না কি কিনবো। তুমি সাহায্য করবে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

মেরুন আর সাদা মিশেল ঢিলেঢালা টপস, প্লাজু আর মাথায় স্কার্ফ পড়ে নেয় কুহেলী। সেঁজুতি হালকা সাজিয়েও দেয় তাকে। চোখের কার্ণিশে কাজল আর ঠোঁটে পাতলা করে লিপস্টিক। চুল খোঁপা করে দেয় খুব যত্ন সহকারে। নিউ মার্কেটের সামনে দেখা হয় সবার। হিরণের সাথে হাসিন আর লায়লি ভাবী এসেছেন। লায়লি হিরণের ফুফাতো ভাইয়ের বউ। সেঁজুতিকে দেখেই হিরণের মুখে ফুঁটে উঠে অমায়িক হাঁসি। সেঁজুতি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। সে হাসি মলিন। অনেক দোকান ঘুরা ঘুরি করে সামান্য কিছু কেনাকাটা করা হয়। বেশিরভাগ জিনিসই আগে থেকে কেনা হয়ে গিয়েছে কেবল সেঁজুতির গুলো ছাড়া। হিরণ চেয়েছিল সেঁজুতির সবকিছু যেন তার পছন্দ মতোই হয়। কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফেরা হয় রাত দশটা নাগাদ। সান্দ্রর আবার নাইট ডিউটি ছিল বলে তার আর রেস্ট নেয়ার হয় না।

শরীরে বসে থাকার মতোও একফোঁটা শক্তি বাকি নেই কুহেলীর। প্রত্যেকটা কোষ যেন বলছে ঘুমিয়ে পড় কুহেলী, মরার মতো ঘুমা। কিন্তু তা কি আর হয় নাকি! এতো এতো পড়া মে জমে আছে সে সব কমপ্লিট করতে হবে। পড়ালেখার চাপে গত একমাসেই কুহেলীর চোখের নিচে পড়েছে গাঢ় কালো ছাপ। কে যে বলেছিল তাকে ডক্টর হতে! জীবন তেজপাতা। গোসল করে দুই মগ কফি নিমিষেই সাবাড় করে দিয়ে বইয়ের একগুঁয়ে পাতায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।

রাত তখন দুইটা কি আড়াইটা। পড়ার ফাঁকেই কুহেলীর কানে আসে মধুর এক কন্ঠ। কুহেলী চমকে গিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। গলাটা হয়তো সমারোহর। গত দিনগুলো খুব বেশি ব্যস্ততার সাথে কেটেছে তাদের। অসুস্থতার কারণে পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলো শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে কুহেলীর। এমন ও হয়েছে রোজ সমারোহর পাশে বসে থাকেও তাকে একবার ফিরে যাতে দেখতে ইচ্ছে না করে তাই মনে মনে পড়া আউরিয়েছে কুহেলী। মেডিক্যাল থেকে ফেরার পথে কেবল দু-চারটে বাক্য! ব্যাস, এইটুকুই তাদের মাঝে যোগাযোগ। একই প্রতিষ্ঠানে, রোজ একই সাথে গিয়ে, একই বাড়িতে থেকেও নিবিড় দুরত্ব।
গানের গলার স্বর খুবই স্বল্প শোনা যাচ্ছে এখানটাতে। কুহেলীর খুব ইচ্ছা করে এমন গভীর রাতে সমারোহর কাঁধে মাথা রেখে গান শুনতে। অথচ মুহূর্তেই বৃথা ভাবনাগুলোকে মনের অন্তর্হিত গোপন কুঠুরিতে তালাবদ্ধ করে ফেলতে হয়। এ বড়-ই বেদনা-দায়ক।

এক-পা দো-পা করে ছাদের দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় কুহেলী। ছাদের দরজা বন্ধ। তাহলে কি বাগানে বসে গাইছে সমারোহ! কুহেলী এক দৌড়ে আবার ফিরে আসে নিজের ঘরে। লাইট অফ করে দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাগানে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগে সমারোহকে। আঁধারের অতল গহ্বরে তলিয়ে আছে মানুষটা। কুহেলী ঠিক-ই আঁধার হাতরে খুঁজে নেয় তাকে। জানালার ধারে বসে গান শুনে মন জুড়ায়। সমারোহর কন্ঠে নেশা আছে। অমোঘ আকর্ষণে কুহেলীর ভেতর কাঁপে। সমারোহ জোরালো পুরুষালী গলার গানে মাতাল হয় কুহেলী। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চেয়ে থাকে মেঘ ভর্তি তারা বিহীন আকাশে। চোখের কার্ণিশ বেয়ে অকারণে বেয়ে পড়ে জল। শূন্যতারা নাড়া দিচ্ছে বলে হয়তো। কুহেলীর বড্ড খালি খালি লাগে নিজেকে। একজন তার পাশে থাকা উচিত নয় কি যার প্রশস্ত বুকে ছোট্ট আরাম প্রিয় বিড়ালের ন্যায় ল্যাপ্টে থাকবে কুহেলী! নয় কি?

শিমুপাড়ায় এবার গাঁ জ্বালানো গরম পড়েছে। বসন্তের সৌন্দর্য গ্রহনের পর বৈশাখ ও পেরিয়েছে। বৈশাখের শেষে আর জৈষ্ঠ্যের প্রথমে চার-পাঁচ দিন টানা মাথার উপর খাঁড়া‌ রোদ দিয়ে গেছে সূর্য। গরমে আম-কাঁঠাল পেঁকেছে। কাল বৈশাখীর আভাস চারিদিকে। বিকেল থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আরাম একটু! খোর্শেদ বাড়িতে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে গরুর মাংস দিয়ে। খেয়েদেয়ে সবাই শুয়ে পড়লেও চোখে ঘুম নেই খোর্শেদের। হাসনাহেনা নাক ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে তার নাকের পাটা একবার ফুলে আরেকবার চিমসে আসে। খোর্শেদ সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠানে এসে দেখে রজব বসে আছে সেখানে। খোর্শেদ রজবের কাছে গিয়ে বলে,

‘ ঘুমাসনাই কেন? ‘

রজব চমকে উঠে খোর্শেদের কন্ঠস্বরে। হালকা ভয়ও পায় বোধহয়। বুকে ফুঁ দেয়। মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ উইঠ্যা আইলেন কেন? আপনের শইল ভালা না, ভালা কইরা খান না ঘুমান না তাইলে চলবো কেমনে কন? ‘

খোর্শেদ মৃদু হাসেন। মোড়ায় বসে রজবের পিঠ চাপড়ে বলেন,

‘ আমার আবার শইল? বাচমুই কয়দিন। তোদের সবার একটা গতি করতে পারলে আমার শান্তি। ‘

রজব অবাক হয়ে চেয়ে বলে,
‘আমাগো আবার কি গতি করন লাগবো? ‘

‘ কি গতি আবার, পড়ালেখা তো করলি না। তোরে বাজারে দোকান কিন্না দিমু একটা, সেইটা চালাবি। বিয়াও তো দিতে হইবো! মাইয়্যা দুইটারে প্রতিষ্ঠিত করতে হইবো , বিয়া দিতে হইবো। কতো কাজ আমার! এগুলা না কইরা মরলে কি শান্তি পামু? ‘

খোর্শেদের কথায় চুপসে থাকে রজব। কুহেলীর কথা ভাবে একবার। খোর্শেদের চোখে পরে বিষয়টা। আগের বাঁদর রজব ইদানিং শান্তশিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা ভালো তবে, চিন্তার ও। খোর্শেদ রজবের মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে,

‘ কি রে কি হইলো? ‘

‘ তুমি মরবা কেন? আমাদের ছাইড়া কোত্থাও যাইবা না কইয়া দিলাম। ‘

খোর্শেদ হো হো করে হেঁসে উঠেন রজবের কথায়। রজব লজ্জা পায়‌। মাখো মাখো চোখে তাকায় খোর্শেদের দিকে। খোর্শেদ অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে বলেন,

‘ তুই কি আর জীবনে শুদ্ধ ভাষা শিখবি না? ‘

‘ শুদ্ধ ভাষা শিখলে আপনে তো আর হাসবেন না আমার কথা শুইন্যা। ‘

খোর্শেদ বড় স্নেহে রজবের পিঠে হাত বুলাতে থাকেন‌।রজব জড়তা নিয়ে বলে,

‘ এক বছরই তো হইয়া যাইবো কত্তদিন পর‌।কুহেলী আপা কি আইবো না? ‘

খোর্শেদ চুপটি মেরে থাকেন। এর উত্তর হয়তো ‘না’ হবে। নরপশুদের মাঝে তার মেয়েকে সে এখনই আনতে চান না‌।তবে এই মুহূর্তে এসব বলে রজবের পাগল মনকেও কষৃট দিতে চান না।রজব আবার রাগ নিয়ে বলে,

‘ গেরামের মাইনষে কুহেলী আপারে নিয়া বাজে কথা কয়। কয় আপা নাকি শহরে গিয়া হাজারটা পোলার লগে ঘুইড়া বেড়ায়। আপার নাকি চরিত্র খারাপ। ডাক্তারি মাইয়্যারা পড়লে ভালা না। আমার ভাল্লাগে না এইসব। ‘

খোর্শেদ প্রতিউত্তরে হেঁসে কেবল বলেন,

‘ মানুষের বৈশিষ্ট্যই এটা’রে রজব‌। এখন যারা যারা আমার প্রিয় কুহেলীরে নিয়া কুৎসা রটনায়, কুহেলী গেরামে ফিরলে তারা গিরগিটির মতো রং পাল্টাইবো দেখিস। ‘

চলবে.

(রি-চেক করার সময় হয়নি।)