#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১৩
#রাউফুন
পরের দিন সকালে পর্দার ফিনফিনে কাপড় ভেদ করে রোদের আলো এসে ঠিকরে পরে মালার মুখে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে সে। অজান্তেই মৃদু হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটে। সেটাও আগের রাতের কথা ভেবে। সে বিছানার চারপাশে হাত বুলিয়ে দেখে প্রিহান নেই৷ সে ভাবে প্রিহান হইতো তার কাজে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আসলে প্রিহান হলে বসে অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। আর তার হাতে ছিলো কিছু পেপারস। মালা তার দিকে এগিয়ে গেলো। যেতেই প্রিহান জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার ঘুম ভাঙলো ড্রাগনফ্লাই’স?’
‘হ্যাঁ। ডাকেন নি কেন আমায়।’
‘তোমার ঘুম টা নষ্ট করতে চাইনি মাই ড্রাগনফ্লাই’স!’
‘এই আপনি আমাকে হঠাৎ এই অদ্ভুত নামে ডাকবেন না তো। ভালো লাগে না আমার।’
‘আসলেই তোমার ভালো লাগে নি?’
‘উম নাহ।’
‘ড্রাগনফ্লাই’স মানে হলো ফড়িং!’
‘আপনি আমাকে ফড়িং ডাকছেন এক্সাক্টলি কি ভেবে?’ কোমরে হাত দিয়ে বললো মালা।
‘আরে পুরো শুনবে তো নাকি।’
‘ঠিক আছে বলুন।’
‘আমি না, ছোট বেলায় খুব চেষ্টা করতাম ফড়িং ধরার জন্য। কত্তো ছুটেছি ফড়িংয়ের পিছনে। ধরতে পারি না, পারি না, সে নিয়ে আমার খুব মন খারাপ ছিলো। একদিন অনেক বেশিই চেষ্টা করি কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়। তখন আমি কষ্ট পেয়ে, উদাস হয়ে বসে ছিলাম। ঠিক তখনই একটা ফড়িং আমার হাতে এসে বসে। তুমি বিশ্বাস করবে না মালা, আমি, আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছিলাম সেদিন। কারণ আমার মনে হয়েছিলো অনেক কষ্টের পর ফড়িং টি আমার কষ্ট বুঝেছিলো তাই সে নিজেই আমাকে ধরা দিয়েছে। তোমার ক্ষেত্রেও কিন্তু সেরকম ই। তোমাকে ধরতে গেলেই ফড়িং এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে, ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু দেখো এখন তুমি আমাকে ঠিকই ধরা দিয়েছো ঠিক ফড়িং এর মতো। তাই তুমি আমার ফড়িং! মাই ড্রাগনফ্লাই’স!’
‘উম ইন্টারেস্টিং তো!’
‘মালা তোমার জন্য একটা ড্রেস কিনেছি। এই প্রথম বার মেয়েদের ড্রেস কিনলাম। এর আগে কখনোই মেয়েদের জন্য ড্রেস কিনি নি। বিছানায় রাখা আছে ওটা পরে আমাকে দেখাও তো। আর পছন্দ হয়েছে কিনা সেটাও বলো।’
‘আচ্ছা।’
‘হুম তুমি রেডি হয়ে গেলে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।’
মালা ড্রেস বের করে দেখলো এটা ভীষণ সুন্দর একটা ড্রেস। জামাটার অনেক রাউন্ড, খুব সুন্দর চুরিদার টা। এটা পেয়াজ কালারের মধ্যে হলুদ কাজ করা। সাথে হলুদ উড়না, চুমকি আর পাইর বসানো পুরো উড়নায়। ওর ভীষণ পছন্দ না হলেও ড্রেস টা নজর কাড়া!ও ফ্রেশ হয়ে ওটা পরে নিলো। বাইরে বেরোতে গিয়ে উড়না লম্বা হওয়াই তাতে পা লেগে পরে গেলো ধপাস করে। কারোর পরার শব্দ শুনে প্রিহান ছুটে এলো।
‘আরে আরে পরলে কি করে।’
‘আসলে উড়না টা ভীষণ লম্বা। তাছাড়া এরকম ড্রেস আগে পরিনি। তাই অসুবিধা হচ্ছে।’
‘ঠিক আছে। এটা পরতে হবে না তাহলে। আসলে আমি তো জানতাম না এরকম ড্রেসে তুমি কম্ফোর্ট না।’
‘আরে না না। আমি এটা পরেই থাকবো। আপনার দেওয়া আমাকে প্রথম উপহার এটা তাই পরবোই আমি।’
‘ঠিক আছে। হাঁটতে পারবে?’
‘চেষ্টা করছি।’
মালা উঠে হাঁটার চেষ্টা করেও পারলো না।তা দেখে প্রিহান ওঁকে কোলে তুলে নিলো।
কোলে উঠার পর মালা বললো, ‘আমি খুব বোরিং ফীল করছি আপনার কোলে উঠে। চুপ না থেকে কিছু বলুন।’
‘এই প্রথম বার শুনলাম স্বামীর কোলে উঠে কেউ বোরিং ফীল করে৷ আন-রোমান্টিক মাইয়া।’ প্রিহান হতাশার শ্বাস ফেলে বললো।
‘ধুরু মিয়া, গান বা কবিতা, যা কিছু মাথায় আসছে বলুন তো। ম্যালা ফ্যাচ ফ্যাচ করবেন না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা চেষ্টা করছি।’
”ফড়িং তুমি ফড়ফড়িয়ে
উড়ো কোন অজানায়,
দুষ্ট বালক অবাক হয়ে
তোমার দিকে তাকায়।
মুগ্ধ হয়ে ধরতে তোমায়
ছুটে তোমার পিছে,
ক্লান্ত হয়ে দুপুর বেলা
বসে গাছের নিচে ।
ষড় পায়ে বসো তুমি
পাখা মেলে উড়ো,
স্বাধীনতা পেয়ে তুমি
ইচ্ছে মতো ঘুরো ।
আমার সখির প্রিয় তুমি
ছোট বেলার সাথী,
সখির সাথে মিলে আমি
ফুলের মালা গাঁথি ।
তোমার লেজে সুতা বেঁধে
ছোট্ট মেয়ে খেলে,
পুকুর পাড়ে ঝিঁঙে ফুলে
বসো পাখা মেলে ।
ঘাসের ডগায় দেখলে তোমায়
শৈশব পরে মনে,
হলুদ পরী সেজে তুমি
উড়ো আকাশ পানে।”
‘ফড়িং ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসলো না?’
‘হেহেহেহে এই মুহুর্তে তো না।’
মালা মুচকি হেসে বললো, ‘হুম দারুন কিন্তু কবিতা টা! যদিও ছন্দ কে’টে’ছে মাঝে।’
‘এখন আমি এই মুহুর্তে এর থেকে ভালো কবিতা মনে করতে পারছি না।’
‘বাইরের লোকে আপনাকে যে রকম বলে আপনি তো একদম ই সেরকম নন দেখছি।’
‘তাইই? তাহলে শুনি কি মনে করা হয় আমার ব্যাপারে!’
‘এই যে আপনি নাকি খুব রাগী, হাসতে জানেন না, গম্ভীর হয়ে থাকেন, কথা বলতে জেনেও বোবা হয়ে থাকেন, সবাইকে ধমকের উপরে রাখেন। এখন তো দেখছি খুব কেয়ারিং হাসবেন্ড আর হাসি-খুশি,মানে পুরোই আলাদা একজন মানুষ।’
‘বাইরের জগতের জন্য এই রুপটাই ঠিক আছে। কিন্তু তোমার কাছে আমি শুধুই প্রিহান হয়ে থাকবো। তোমার কাছে সব কিছুই উলটো হবে, ঠিক যেমন টা আমি আমার মনের ভেতর থেকে। একটা কথা বলে রাখি এবং এটা মনে রাখবে, যায় হয়ে যাক না কেন আমাকে কখনোই মিথ্যা কথা বলবে না। আমি কখনোই মিথ্যা মেনে নিতে পারি না। মিথ্যা বা অন্যায় আমার রক্তেরচাপের কারণ। যদি কোনো দিন দেখি তুমি এরকম কিছু করেছো, আমি কিন্তু সারাজীবন তোমাকে ক্ষমা করবো না।’
মালা কোনো রকমে বললো, ‘আম-আমিও তো খানিকটা সেরকম ই।’
প্রিহান গাড়ির কাছে গিছে এক হাতে গাড়ি খুললো খুব কষ্টে, তারপর আস্তে আস্তে মালাকে গাড়িতে বসালো সে। নামানোর সময় তার ঠান্ডা নাক মালার গালে স্পর্শ হলো। কেমন একটা ফিলিং হয় এতে মালার। মনের দিক থেকে যে প্রিহান কতটা উদার এটা সে প্রথম রাতেই উপলব্ধি করতে পেরেছে কিন্তু তবুও তার মনে ভালোবাসার উপস্থিতি টের পাইনি প্রিহানের জন্য। এটা কি আদোও পারবে সে?
•
মালার কথামতো ওঁরা দু’জনেই আগে মালার বাসায় পৌঁছালো। ওঁদের এক সঙ্গে দেখে রাশেদা আর আনিস সাহেব দুইজনে হতভম্ব। মালা স্বাভাবিক ভাবেই দরজা থেকে ভেতরে গেলো। প্রিহান ও ওর পিছনে পিছনে প্রবেশ করলো। হঠাৎ মালার সঙ্গে প্রিহান হাওলাদার কে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। গহীন, পুতুল, সহ সবাই-ই একটু মনে করার চেষ্টা করলো প্রিহানকে কোথায় দেখেছে। মনে পরতেই মালার বাবা আনিস সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
‘মালা এই ছেলেটা তো সেদিনের সেই ছেলেটা তাই না? যাকে হসপিটালে দেখেছিলাম! ওঁ তোমার সাথে কি করছে? নাহ মানে ছেলেটা আসতেই পারে কিন্তু আজকের ব্যাপার টা একটু আলাদাই মনে হচ্ছে!’
মালা বেশি ভনিতা করলো না। সে সরাসরি বললো,
‘উনি মিষ্টার প্রিহান হাওলাদার। কাল উনাকে আমি বিয়ে করেছি!’
ছোট খাটো একটা বিস্ফোরণ হলো এই মুহুর্তে। সবার মুখের রা সরে গেছে। সবাই অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে।
‘কিহ?’ অস্ফুটে বললেন রাশেদা।
ছোট্ট গহীন আর পুতুলের মুখে আনন্দের ফোয়ারা দেখা গেলেও মালার বাবা-মার মুখ ছিলো গম্ভীর, নিস্তব্ধ! যেনো তারা এটা মেনে নিতে পারছেন না।
‘তুমি কাল তবে আমাকে সত্যি টা বলো নি? আমি যখন ফোনে জিজ্ঞেস করলাম যে কোথায় তুমি, ফিরছো না কেন? তখন কেন বললে না?’
‘আম্মু আপনাকে বললে কি আপনি তখন স্বাভাবিক ভাবে রিয়েক্ট করতেন?তাই ভাবলাম সামনাসামনি সব টা বলবো।’
‘ছিঃ লজ্জা করছে না তোমার?নির্লজ্জের মতো নিজের বিয়ের কথা আমাদেরকে জানাচ্ছো? আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছো এখন আবার তোমার স্বামীকে নিয়ে সরাসরি আমাদের বাড়িতেই উঠলে?’
‘তোমার শশুড়বাড়ি থেকে কি বিয়েটা মেনে নেইনি কেউ-ই?’
‘দুঃখিত আংকেল, আন্টি।যদিও আমার কথা বলা ঠিক হবে না তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি।যেহেতু এখানে কথাটা আমার বাড়ি নিয়ে হচ্ছে তখন বলছি। আমার বাড়ির সবাই আমার স্ত্রীকে মেনে নিয়েছেন। এবং তারা সবটাই জানেন।আর রইলো এখানে আসার ব্যাপার টা আপনাদের মেয়েই এসেছে আপনাদের কাছে।তাই তার সিদ্ধান্ত টাকে আমি শুধু সম্মান করেছি।’
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম না মালার মা, তুমি তোমাদের মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারো নি? দেখলে তো কেমন আমাদের মান-সম্মানের তোয়াক্কা না করেই একা একাই বিয়েটা করে ফেললো!’
‘আব্বু আপনার পছন্দ মতো তো বিয়ে করেছিলাম, সেখানে কি আমার আদোও সুখ ছিলো?এখন যখন আমি আমার নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করেছি সেহেতু এতো কথা হচ্ছে কেন?’
‘চুপ একদম। এই বিয়ে টা আমি মানি না!’ ডেস্পারেটলি চেঁচিয়ে উঠে বললেন রাশেদা!
সবাই মিলে কেঁপে উঠলো তার চেঁচানোতে।ছোট্ট গহীন,আর পুতুল ভয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মালা ছলছল চোখে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো তার মায়ের দিকে।সে ভেবেছিলো অন্তত পক্ষে তার মা তার এই সিদ্ধান্তে পাশে থাকবে কিন্তু এটা সে কাকে দেখছে?
#চলবে