#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১৪
#রাউফুন
মালার হাত ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে গেলেন রাশেদা।সপাটে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। মা -মেয়ের কথা বলা প্রয়োজন ভেবেই চুপ করে রইলো প্রিহান।আর মালার বিস্ময় যেনো কা’ট’ছেই না।সেদিনই তো তার মা তাকে বলেছিলো,“জীবনের শেষ দিন অব্দি তোমার পাশে থাকবো!” আজ তার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে অন্যকিছু। মনে হচ্ছে যে, তার মায়ের এমন রুপ সে দেখবে যাতে তাকে শেষ বারের মতো আবারও ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দেবে৷ রাশেদা রুক্ষ মেজাজে বললেন,
‘এরকম টা তুমি কেন করলে?এরকম বেলাল্লাপনা না করলে কি হতো না?ঘে’ন্না লাগছে তোমাকে আমার ঘে’ন্না!প্রথম ভুল টা ছিলো তোমার বাবাকে বিয়ে করা আর এখন মনে হচ্ছে তোমাকে পে’টে ধরে, জন্ম দিয়ে আমি আমার জীবনের দ্বিতীয় ভুল টা করেছি।’
‘আম্মু!’কন্ঠঃরোধ হয়ে এলো মালার৷গলায় কা’টা’র মতো আটকে আছে বাক্যের দানা৷
‘আমাকে আম্মু বলবে না। আজ থেকে তোমাকে আম্মু বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলাম আমি!’
‘আম্মু এটা তুমি বলতে পারলে? আমি না তোমার মেয়ে। এভাবে কেন বলছো আম্মু? কিভাবে বলছো তোমার বুক কাঁপছে না একটুও?’
‘নাহ কাঁপছে না।কেন কাঁপবে?তোমার কি একবার বুক কাঁপলো না,তোমার পরিবারের কথা একবারও মাথায় এলো না? তোমার বিয়ে হয়ে গেলে, তোমার ছোট বোন,ছোট ভাইটার কি হবে?এই সংসারের কি হবে? কিভাবে চলবে সব কিছু!’
‘ওহ তাই বলুন! তার মানে সমস্যা টা আসলে এখানে?আপনি কি ভাবছেন, বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমি আর আমার পরিবার কে দেখবো না? ভয় পেয়ে গেছেন তাই না? এটা ভেবে যে বিয়ে করেছি বলে আমি যদি আর আপনাদের না দেখি। কোনো রকম খরচ না দিই তাই না? আপনার পরিবর্তন টা তবে শুধুই আমার রোজগারের জন্যই ছিলো। আমিও কি বোকা তাই না।’
‘বিয়ের পরে যে কেউ-ই বাপ-মা-ভাই বোন কে দেখে না এটা তুমি আমাকে শেখাতে এসো না। তুমি দেখতে চাইলেও তোমার আগের স্বামীর মতো দ্বিতীয় স্বামীও বাঁধা দেবে। তখন কি হবে আমাদের ভেবেছো? খুব তো বলতে বিয়ে করবে না, করবে না, তাহলে এখন কি হলো? আর কি তোর সইলো না? নিজেকে সামলে রাখতে পারলে না?’
‘ছিঃ আম্মু। চুপ করুন। আমার সহ্য হচ্ছে না আর। মা হয়ে মেয়েকে এরকম কথা কিভাবে বলছেন আপনি? একটুও বাঁধছে না আপনার মুখে?’
নিরলস, কঠোরভাবে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলেন রাশেদা উলটো দিকে ঘুরে। মালা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। তার মা কি তাকে কখনোই ভালোবেসেছিলেন আদৌও? মায়েরা নাকি সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারে। তাদের নাকি অলৌকিক ক্ষমতা থাকেন সন্তানকে বুঝার৷ তবে তার মা তাকে কেন বুঝতে পারছে না? তার ভেতরে ঠিক কি হচ্ছে, কি চলছে তার মনে, সেটা কেন বুঝতে পারছে না? মালার কাঁন্নায় গলায় দলা পাকিয়ে আসছে! সবচেয়ে বড় আঘাত টা বোধহয় সে আবার পেলো। এতোদিনে নিজেকে কত ভাবে কন্ট্রোল করেছে। অনেক দিন পর বোধহয় তার আঁখিদ্বয় তার দুয়ার খুলে অশ্রু ঝড়াচ্ছে। সে চোখ মুছে ফেললেও আবার গাল, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পরছে, মুক্তোর দানা মতো গলা বেয়ে নেমে জামার অংশ ভিজে যাচ্ছে! চোখের জল যেনো বাঁধ মানতেই নারাজ। সে হাঁটু গেড়ে বসলো তার মায়ের সামনে। সে তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরলে তার মা পা সরিয়ে নিলো। সে পুনরায় তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘আম্মু আপনার মনে আছে ছোট বেলার কথা, আপনি যখন আমাকে মা’র’তেন, আমি সেখান থেকে নরতাম না। কারণ মা’রা ছাড়া আপনি আমাকে ছুঁতেন না। আমি আপনার সেই প্রতিটি আঘাতকে, আপনার স্নেহের স্পর্শ বলে নিজেকে স্বান্তনা দিতাম। ভাবতাম অন্তত পক্ষে মা’রা’র সময় টা তো আপনি আমাকে ছুঁতেন! আমার কত টুকুই বা বয়স ছিলো বলুন? কিন্তু মনে হতো, আপনি আমাকে যদি একটুও কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন তবে বোধহয় আমি জে’দ করতাম না। আপনার মা’রে’র চিহ্ন এখনো রয়েছে আমার গায়ে। ওই টুকুন ছোট্ট একটা শরীর, এতো শক্ত আঘাত কি করে করতেন আম্মু? আম্মু আপনার কি একটুও কষ্ট হতো না, যখন আপনি আমাকে মা’র’তেন? কখনো বা’শে’র ক’ঞ্চি, ক-কখনো কা’ঠে’র অংশ, কখনো আম গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মা’র’ধ’র করতেন। বলেন না আম্মু, আপনার বুকে কষ্ট হতো না? আমার না খুব কষ্ট হতো জানেন? কত কেঁদেছি, কত জ্বঁর এসেছে আপনার মা’রে’র আ’ঘা’তের প্রভাবে, দাদী জল পট্টি দিতেন কিন্তু আপনি আসতেন না। বলেন না আম্মু আপনার কি ইচ্ছে হতো না আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে ঠিক কতটা জ্বঁর আমার গায়ে। বলেন না আম্মু,কেন জল পট্টি বেঁধে দিতেন না আমার অসুখ করলে, বলেন না আম্মু, বলেন না! এই দেখেন না৷ আজও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কত কাঁন্না করছি, আপনি আমার চোখ মুছে কেন দিচ্ছেন না? দিন না, দিন একটু চোখের পানি মুছে দিন। একটু আদর করেন না আম্মু। একটু আদর করেন। বুকে টেনে নিয়ে বলেন না, “আয় মা, এতো কাঁদিস কেন? পা’গ’লি মেয়ে! তোর আম্মু আছে তো।” এভাবে কেন বলেন না? কখনো কেন বুকে টানেন নি আমাকে? বলেন না চুপ করে কেন আছেন?’
কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে তার। নাক টেনে নিয়ে আবার মৃদুস্বরে গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো মালা। বুক ভিজে যাচ্ছে তার কাঁন্নার দাপটে। সে একটু থেমে আবার বললো,
‘কেন আম্মু, আমি কি এতোটাই জে’দি ছিলাম যে শুধু মাত্র জেদের জন্যই আমার গায়ে হাত তুলতেন। কই পুতুল আর গহীনকে তো কখনোই একটাও ফুলের টোকা দিতে দেখিনি। কিভাবে পারতেন আপনি? আমি, আমি না অনেক বাচ্চা দেখেছি যারা অনেক জে’দি। কই তাদের তো মা’র খেতে হয় না। ছোট বেলা থেকে আপনার আর আব্বুর কথা মতো চলেছি, নাবালিকা থেকে সাবালিকা না হতেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। আর সেখানেও একই দশা। হাহ্ কপাল! আর আজ যখন আমি আমার নিজের জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আপনার কাছে আর আদর্শ মেয়ে থাকলাম না। কেন আম্মু? কেন? আমার কি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই?’
হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। মায়ের পা চেপে ধরে কাঁন্না করছে৷ কষ্টে বুকটা ভে’ঙে যাবে মনে হচ্ছে তার। এই ব্যথা যে আর সওয়ার নয়! কাছের মানুষের দেওয়া আ’ঘা’ত’, প্র’তি’ঘা’ত যে নেওয়া যায় না!কিন্তু পাষান মাতার মন যেনো গললোই না মেয়ের কাঁন্নায়!সে এক ঝটকায় মালা কে সরিয়ে দিলেন।আর বললেন,
‘তোমার প্রতি আমার রাগ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না কোনোদিন৷কেন সেটা তুমিও জানো।’
‘এটা কি আমার দোষ যে আমার বাবা আপনাকে***!’
কথাটা সম্পুর্ন করার আগেই বেশ জোরে-সরে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলেন রাশেদা। ক্ষো’ভে ফেটে পরছেন তিনি।
‘আর একটাও কথা বললে তোমার জিহবা টে’নে ছি’ড়ে দেবো আমি। বেরিয়ে যাও এখান থেকে৷ তোমার মতো নেমকহারাম মেয়ের আমার প্রয়োজন নেই।’
কান্না করতে করতে দু-পা পিছিয়ে গেলো মালা। উড়না দিয়ে চোখ মুছে নিলো সময় নিয়ে। আলতো পায়ে মালা বেরিয়ে যেতে যেতে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কটাক্ষের স্বরে বলে উঠলো,
‘সত্যিই আমি নেমকহারাম আম্মু? আপনি মন থেকে মানেন তো কথাটা? আর হ্যাঁ একদম চিন্তা নেই, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে গা’ধা’র খাটুনি খেটেছি এই পরিবার টার জন্য, ছোট থেকেই আপনাকে কাজে সাহায্য করেছি। কি করিনি আমি?এখান থেকে ওখানে কোথায় যায়নি,এই পরিবার টাকে বাঁচাতে। পুতুলের স্কুল,প্রাইভেট,গহীনের স্কুল, প্রাইভেট খরচ এ টু যেড।আমি আমার সর্বশ্ব বিসর্জন দিয়েছি শুধু মাত্র আপনারা আমার জান,আমার প্রাণের সঙ্গে, আমার আত্মার সঙ্গে মিশে আছেন বলেই! আর ভবিষ্যতেও করবো চিন্তা করবেন না। আমি এই কথা গুলো সবার সামনে বলতে পারতাম কিন্তু আমি আপনাকে কারোর সামনে ছোট করতে বা হতে দিতে পারি না।আপনার আমার প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলেও আমার দায়িত্ব শেষ হবে না আমার ভাই-বোন,মা-বাবার জন্য!আসছি!’
মালা বেরিয়েই দেখলো প্রিহান এর মধ্যেই সবার সাথে খুব ভালো ভাবে মিশে গেছে৷এমন কি তার বাবাও হেসে হেসে কথা বলছে প্রিহানের সঙ্গে। লোকটা কি এটুকু সময়ের মধ্যেই তার বাবাকে জা’দু টাদু করলো নাকি?মানুষকে কাছে টানার অদম্য ক্ষমতা আছে বলতে হবে।চোখ মুখ মুছে নিলেও এর মধ্যে তার নাক,চোখ প্রচন্ড লাল হয়ে আছে। গহীন আর পুতুল ছুটে গিয়ে মালাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘আপু জানো প্রিহান ভাইয়া খুব ভালো।কি সুন্দর করে কথা বলে৷আমাকে বলেছে অনেক গুলো খেলনা কিনে দেবে।’
মালা গহীনের কপালে ছোট্ট করে চু’মু দিলো।পুতুল কাঁদছে।সে কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
‘আপু ভাইয়া বলছে আজই তোমাকে উনার সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে!তুমি কি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে?কষ্ট হবে না তোমার?’
‘হবে তো। খুব কষ্ট হবে! আমার জানদের ছেড়ে কি আমি কখনো থেকেছি?’
কথা শেষ করতে পারলো না সে। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। প্রিহান বিচলিত হয়ে এগিয়ে আসলো। এতক্ষণ সে মালার বাবার সঙ্গে কথা বলাই ব্যস্ত ছিলো।
‘কি হলো ড্রাগনফ্লাই’স। এভাবে কাঁদছো কেন? একি অবস্থা হয়েছে তোমার? চোখ মুখের এই অবস্থা কেন? ‘
‘কই কিছু না তো। আসলে সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি তো তাই কষ্ট হচ্ছে।’
‘আর আন্টি মানে মা কোথায়? উনি আসলেন না? সব ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ সব ঠিক আছে। আম্মুর একটুর জন্য অভিমান হয়েছিলো। আম্মুকে জানাই নি তো তাই!এখন সব ঠিক আছে।’
প্রিহান কেমন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে। মনে তো হচ্ছে না মালা সত্যি কথা বলছে।মেয়েটাকে তো কখনোই এভাবে বিবর্ণ,বিমর্ষ,নিস্তেজ দেখতে লাগেনি। সব ঠিক আছে তো?
#চলবে