প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-২৭+২৮

0
293

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৭ (বোনাস পার্ট)
#রাউফুন

‘ময়না আপুর সামনে ওওভাবে আমাকে টেনে হিচড়ে কোলে তুলে আনলেন কেন?’

‘বেশ করেছি। মাথার ঠিক নেই। সারাদিন কাজ করি, কোর্টে কেস লড়ি, তর্ক-বিতর্ক চলে। ওসব না আমার মস্তিষ্কে কিলবিল করছে। এরপর বাড়িতে এসেও যদি দেখি বউ অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। রাত বারোটা অব্দি রুমেই আসছে না, মাথার ঠিক থাকে? আরে উকিলদের বউয়ের ভালোবাসা বেশি প্রয়োজন। বউয়ের ভালোবাসা পেলে মাথার জট খুলে। সারাদিনের ক্লান্তি, কিলবিল করা মাথা সব ঠিক হয়ে যায়। হাহ্ তোমাকে এসব কেন বলছি? তোমাকে বলা না বলা তো একই কথা।’

‘কেন? যান না জাকিয়া আপুর কাছে যান। আমাকে কি জন্য প্রয়োজন। যে নিজের বউয়ের উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না তার সাথে আমার কিসের কথা। কোনো কথা নেই সরুন।’

‘দেখো মালা আমি তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। লক্ষীটি বুঝার চেষ্টা করো। আমার তখন তাড়া ছিলো। তারপর কেস টা নিয়ে কতটা ডিস্টার্বড ছিলাম তুমি তো জানো। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও মাই ড্রাগনফ্লাই’স। প্লিজ!’ শান্ত ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো প্রিহান।

মালা চুপ করে রইলো। তাই তো তাকে ভুল বুঝে লাভ কি। জাকিয়ার দোষ এখানে। ও মহিলা যদি জটলা না বাঁধাতো তবে তো প্রিহান তাকে সন্দেহ করতো না। তাছাড়া প্রিহান উকিল মানুষ, সাধারণত কেস লড়তে লড়তে তার মনে একটুতেই সন্দেহের দানা বোণে। এক্ষেত্রে প্রিহানের উপর রাগ দেখিয়ে নিজেদের সম্পর্ক নষ্ট করে লাভ নেই। মালাকে চুপ করে থাকতে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রিহান।

‘আরে এতো জোরে কেউ জড়িয়ে ধরে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তো। মনে হচ্ছে পাজর, পিঠ, হাড্ডি মাংস সব এক করে দেবেন।’

‘চুপ ডিস্টার্ব করবা না।’ বলেই মালাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে প্রিহান। গালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে! উম্মাদের মতো চুমু দিচ্ছে। তার ওষ্ঠে লম্বা চুমু দিলো প্রিহান, অনেক্ষন পর ছেড়ে দিলো সে। মালা হাপাচ্ছে রীতিমতো। প্রিহান মালার দুই চিবুকে আদুরে ছোঁয়া দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাঁপাচ্ছে। মালা শুধু হাইপার হয়ে যাওয়া মানুষ টাকে দেখছে।

‘আহাহ ছাড়ুন না!’ মিছে রাগী স্বরে বললো মালা।

‘এখন মাথার কিলবিল করা কমেছে। যাও গিয়ে ময়না আপুর সঙ্গে গল্প করো। যাও।’

ক্ষুব্ধ হয়ে হুট করেই সরিয়ে দিলো সে মালাকে। অভিমানের পারদ তরতর করে বাড়লো প্রিহানের। সবার জন্য সময় আছে শুধু তার বেলায় একটুও সময় নেই। এই পর্যন্ত সে কিছুই বলেনি কিন্তু আজ? আজকে এই মেয়েটাকে এতোটাই মিস করেছে যে এসে থেকে ছটফট করেছে। কিন্তু সে কি আর বুঝে? সকালে কি হয়েছে না হয়েছে এটার জের ধরে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। সে তো আর তাকে ভুল বুঝেনি? সে কাজ টা করেছে কিনা এটাই জিজ্ঞেস করেছে। যদিও সে মনে প্রাণে জানতো মালা এরকম একটা নগন্য, নেক্কার কাজ কখনোই করবে না। তবুও জাকিয়ার উপরে রাগ টা সে-সময় মালার উপর কিছু টা প্রয়োগ করে ফেলেছে। সে মানছে এটা তার ভুল হয়েছে সে জন্য তো মালার কাছে ক্ষমাও চাইলো।

‘আদর ই তো করলেন না যায় কি করে? খালি চুমুতে পগারপার হুহ্।’

প্রিহান পিটপিট করে তাকালো মালার দিকে।

‘অভাবে তাকানোর কি আছে?’

‘তুমি রোমান্স করার চেষ্টা করছো?’

‘কোথায়?’

‘ হ্যাঁ তাই তো? তোমার দ্বারা কি আর রোমান্স হবে? তোমার থেকে রোমান্স আশা করা মানে উলো বনে মুক্ত ছড়ানো।’

‘তাই?’ বলেই সে গাল ফুলিয়ে বসে থাকা প্রিহানের দিকে ঠোঁট কা’ম’ড়ে তাকালো। সে তাকে সিডিউস করার চেষ্টা করলো। এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে দু পা দিয়ে প্রিহানের কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে পরলো ওর কোলে। মালার প্রথম বার এভাবে প্রিহানের কাছে আসাতে হতচকিত হলো, ভড়কালো। সে অবিশ্বাস্য চোখে মালাকে দেখলো। বুঝার চেষ্টা করলো আসলে মালা চাইছে টা কি৷ আজ যেনো মালার চোখ অন্য কিছু বলছে। প্রিহান মনে মনে ঠিক করলো মালা যা করছে করুক তাতে সে রেসপন্স করবে না।শুধু দেখতে চাইলো মালা কত দূর অব্দি যেতে পারে। এদিকে মালা তার কার্যক্রম করে যাচ্ছে। সে প্রিহানের আলগা করে রাখা হাত দুটো নিয়ে নিজের কোমড়ে চেপে ধরলো। ঘাড়ে আস্তে করে লিক করলো মালা আর এতেই প্রিহান মালাকে ঘুরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উম্মাদের মতো চু’মু দিলো। চুমু দিতে দিতেই নেশালো কন্ঠে প্রিহান বলে,

‘তুমি কিন্তু খুব ভালো সিডিউস করতে জানো! এভাবে তো রোজ আদর করতে পারো। এন আই লাভ ইউর সিডিউস এক্সপ্রেশান।’

বলেই কম্বল টেনে নিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেললো। মালা মুচকি হেসে প্রিহানের দুই গালে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো। এরপর ঠোঁটে আরেকটা স্ট্রং কিস করলো।


‘পুতুল শুনলাম তুই নাকি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলছিস না? তোর আপুকে দিয়ে বলিয়েছিস যেনো তোকে না পড়াতে যায়? এসবের মানে কি? তুই জানিস ভাইয়া কতটা কষ্ট পাচ্ছে? খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না, গোসল করছে না, সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে, কারোর সঙ্গে কথাও বলছে না। আমি চেপে ধরতেই আমাকে বললো, তুই নাকি কথা বলছিস না তাই এই অবস্থা।’

মাহিয়ার কথা শুনেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না পুতুল। সে জানে না কি করবে? মানুষ টা এমন উম্মাদের মতো আচরণ কেন করছে? সে কি একবার কথা বলবে প্রশান্তর সঙ্গে? নাকি কথায় বলবে না আর!

‘পুতুল আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি। আর তুই অন্য ধ্যানে মগ্ন! আগে ভাইয়ার কথা বললে তোর মধ্যে যে খুশি, উচ্ছ্বাস, তোর চোখে মুখে যে আনন্দের ফোয়ারা দেখা যেতো এখন তা কেন নেই? তার মানে কি তুই এখন আর ভাইয়াকে ভালোবাসিস না?’

‘মাহিয়া তোর সঙ্গে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও এভাবে কি করে ভাবছিস? আমি চাই না আমার জীবনটাও তোর মতো নষ্ট হোক।’

‘দেখ পুতুল, জান পাখি, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। প্রশান্ত ভাইয়া আমার ভাই বলেই বলছি না। ভাইয়ার মতো মানুষ হয় না৷ ভাইয়াকে কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেখিনি। তুই প্রথম মেয়ে যাকে কিনা ভাইয়া মুগ্ধ চোখে দেখেছে। আমি জানি ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে। আর সব ছেলে কিন্তু এক না। নয়নের নজর আগে থেকেই নিকৃষ্ট ছিলো। আমি ওর ভালোবাসায় উম্মাদ ছিলাম তাই ওর সেই চাহনির মানে বুঝতে পারিনি। আচ্ছা তুই তো ভাইয়াকে দেখছিস এতোদিন হলো কখনোই কি তোর মনে হয়েছে ভাইয়া তোর দিকে কু’দৃষ্টিতে তাকিয়েছে?’

‘আমি পারবো নারে মাহিয়া। তোর সঙ্গে ঘটে যা-ওয়া নোং’রা ঘটনা জানার পর আমার পক্ষে সত্যিই সম্ভব না কোনো ছেলের সংস্পর্শে যাওয়া। আমি চাইছি না প্রশান্তর মুখোমুখি হতে। যদি আমাদের মিলন হওয়ার থাকে তবে নিশ্চয়ই হবে। তোর ভাইয়া আর আমার ভালোবাসা যদি খাটি হয় একদিন সেই মানুষ টা ঠিক আমার হবে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করবো৷ তাকে বলে দিস এ কথা। আমি জানি তার কষ্ট হবে কিন্তু আমারও যে কষ্ট হবে না তা কিন্তু নয়। আমারও প্রশান্তর জন্য হৃদয়টা ভীষণ পুড়ছে।’

‘তুই আরেকবার ভেবে দেখ! আজকে না হয় তুই একবার দেখা করে যা পুতুল প্লিজ সোনা।’

পুতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ঠিক আছে চল যাচ্ছি! তবে শুধুমাত্র তোর জন্য!’

‘তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো ভেবে পাচ্ছি না। কারণ আমি আমার ভাইয়ার এই করুন অবস্থা সইতে পারছি না রে! আম্মাও সবটা বুঝতে পারছে কিন্তু বলার মতো কিছু পাচ্ছে না।’

বিষন্ন মনে পুতুল মাহিয়ার সঙ্গে ওঁদের বাড়ি গেলো। গিয়েই দেখলো প্রশান্ত তার রুমে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছিলো প্রশান্তর শরীর বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। এই এক দিনে এটা কি হাল হয়েছে। প্রশান্তকে দেখে তার ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।সে প্রিহানের এমতা অবস্থা সহ্য করতে পারলো না।খাটের পাশে বসে হুহু করে কেঁদে উঠলো।

রিনরিনে কন্ঠের কাঁন্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো প্রশান্তর। মিটমিট করে চোখ খুলেই পাশে তাকালো প্রশান্ত। তার চোখ গুলো ভীষণ পরিমাণে লাল হয়ে আছে। প্রশান্ত কেমন মূর্ছা গেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষ টাকে দেখতে পেয়ে প্রাণ ভরে খানিকক্ষণ সময় নিয়ে দেখলো? এটা কি হেলোসিনেট হচ্ছে তার সঙ্গে?

‘তুমি কি সত্যিই এসেছো ডল? তুমি এসেছো ডল?’

প্রশান্তর মুখে ডল ডাক শুনে একটু চমকালো পুতুল। প্রশান্ত কি তাকেই ডল বলছে? প্রশান্ত উঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু সে জোর আর তার রুগ্ন শরীরে নেই। অনেক কষ্টে উঠার চেষ্টা করেও পারলো না।

‘যখন উঠতে পারছেন না তখন শুয়েই থাকুন। শরীরের এই অবস্থা কেন করেছেন? খাওয়া দাওয়া কেন করছেন না? এভাবে কি সব কিছুর সমাধান হবে?’

‘আর শরীর, যার জন্য বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাস, যাকে নিয়ে নিজের মনের প্রখর অনুভূতি, সেই যদি না থাকে তবে এই শরীর দিয়ে কি হবে?’

কথা শেষ করতে পারলো না প্রশান্ত। হরবর করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো। বমিটা পুতুলের গায়ে করে দিয়েছে প্রশান্ত। পুতুলের স্কুল ড্রেসের খুবই বাজে অবস্থা৷ সে কাধের ব্যাগ টা রেখে নেতিয়ে পরা প্রশান্তর দুই কাধে হাত রেখে তার নাভীতে চেপে ধরলো যাতে বমিটা আর না হয়। প্রশান্ত আরেকদফায় বমি করলো। পুতুল মাহিয়াকে হাক ছেড়ে ডাকলো জলদি এই ঘরে আসার জন্য। বমির এক পর্যায়ে প্রশান্তর গলা চিড়ে মুখ থেকে রক্তের ছিটেফোঁটা বের হলো!রক্তের ছটা দেখেই মুহুর্তের মধ্যে পুতুল চিৎকার করে উঠলো। সে প্রশান্তকে দুই হাতে জাপটে ধরলো।প্রশান্ত জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো পুতুলের কোলে।

#চলবে

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৮
#রাউফুন

পৌষের শেষভাগ৷ হিম বাতাসের অহর্নিশ আনাগোনা। পাতা কাঁপছে থরথর করে। তুলোরাশি মিইয়ে আছে নিস্তব্ধ আকাশের অন্তরালে৷ মধ্যখানে অর্ধবৃত্ত চাঁদটি তাকিয়ে আছে নিষ্পাপ পলকে। দীর্ঘ রজনী কাটছে আলসেভাবে। গায়ে পাতলা এক চাদর জড়িয়ে বই সামনে নিয়ে পড়ছে পুতুল। কিন্তু মন টা তো সেই একজনের কাছেই পরে আছে। ভীষণ ছটফট করছে তার মন টা। হাতের বাটন ফোনটার দিকে একবার সে তাকালো। প্রশান্তর মুখ থেকে বমির সঙ্গে রক্ত দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলো পুতুল। আসলে পেটে কিছু না থাকাই সব কিছু উলটে আসছিলো প্রশান্তর৷ তাই গলা চিড়ে চৌচির হয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। মানুষটার জ্ঞান না ফেরা অব্দি শান্তি পাচ্ছিলো না পুতুল৷ ডক্টর দেখানো হয়েছিলো তাকে। ডক্টর বলেছে জোরে বমির প্রকোপে গলা চিড়ে রক্ত বেরিয়েছে৷ ওষুধ লিখে দিয়েছে ডক্টর। পেট ভরে খাবার খাইয়ে দিয়েছিলো পুতুল নিজের হাতে। যদিও প্রশান্তর ভীষণ কষ্ট হয়েছে খাবার গিলতে। গলা চিড়ে যাওয়ার দরুন ভাত গিলার সময় গলা জ্বালা করেছে ভীষন।

প্রশান্তদের বাড়ি থেকে আসার আগে মাহিয়া প্রশান্তর ফোন নাম্বারটা গুজে দিয়েছে তার হাতে। ব্যাগ থেকে নাম্বার টা বের করে কল লাগালো সে মন মস্তিষ্কের সাথে এক দফা যুদ্ধ করে। রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হলো!

‘হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বলছি!’

‘আমি? আমি কে?’

‘আমি পুতুল বলছি!’

প্রশান্ত নড়েচড়ে বসলো।সে ভীষণ অবাক হয়েছে। কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে!

‘পুতুল! তুমি? তুমি আমার নাম্বার কোথায় পেলে?’

‘আস্তে, আস্তে কথা বলুন। আপনার গলা ভে’ঙে গেছে। উত্তেজিত হবেন না। এমনিতেই আপনার শরীর অনেক খারাপ!’

‘পুতুল!’

‘হুম!’

‘তুমি সত্যিই আমাকে কল করেছো? আমার কেমন যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না।’

প্রশান্তর গলা ভারী শোনালো। পুতুল এতে আরও দুর্বল হয়ে পরলো।

‘কাঁদছেন কেন? শান্ত ভাবে শুধাই পুতুল।

‘তুমি বুঝলে কি করে?’

‘আপনার নিঃশ্বাস ভারী শোনালো!’

‘তাও তো এতো সহজে বুঝার কথা না!’

নিশ্চুপ রইলো পুতুল। কিয়ৎক্ষন পর পুতুল নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার শরীর এখন কেমন?’

‘একটু আগেও না মনে হচ্ছিলো আমার মতো অসুখী বোধহয় আর কেউ নেই জানো? মনে হচ্ছিলো বিনা মেঘে বজ্রপাত হচ্ছিলো। ভেতরটা কেমন পুড়ছিলো। জ্বালা করছিলো ভীষণ ভাবে। এই পীড়া যেনো নেওয়া যাচ্ছিলো না। আর এই মুহুর্ত থেকে আমি খুব খুশি। মন ভালো থাকলে শরীর ও ভালো থাকে। আর আমার শরীর, মন ভালো করার ওষুধ তো তুমি পুতুল!’

ভীষণ অস্বস্তিতে মুশড়ে গেলো পুতুল। বুকের বা পাশ টা কেমন যেনো করছে। ধুকধুক করছে কেমন। আচ্ছা সে কি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে?

‘হ্যালো পুতুল? আর ইউ দেয়ার?’

‘ইয়াহ! আচ্ছা রাখছি হ্যাঁ? আপনি রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেবেন।’

‘কাল আসবে?’

‘কাল? আমার হবে না কাল!’ ইচ্ছে করেই বারণ করলো সে প্রশান্তকে। যদিও তার মন ঠিক তার উল্টোটাই বলছে। মন বলছে, ”একবার যা! গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আয় মানুষ টাকে।” কিন্তু না মস্তিষ্ক জানান দিলো, ”না যাওয়ার দরকার নেই। তোর এতো কিসের চিন্তা তাকে নিয়ে?”

‘ওই যে আবার চুপ করে আছো? শুনো কাল যদি তুমি না আসো না আমিও রাতের খাবার খাবো না, ওষুধ খাবো না। আমি অনাহারে থাকি এটা যদি না চাও তবে কাল তুমি আসবে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা আমি আসবো।’ দ্বিধাদ্বন্দে পরেও বলে দিলো পুতুল।

‘প্রমিস!’

অনেক্ষন ভেবে চিন্তে চোখ বন্ধ করে বললো, ‘আচ্ছা প্রমিস!’

‘এখন রাখছি!’

‘শোনো ডল!’

লোকটা তাকে এমন ভাবে ডাকছে যেনো এই ডাকটাই কোনো জা’দু মেশানো আছে। এতোটাই ভালো লাগলো পুতুলের কাছে। সে আলতো করে বললো,

‘হু!’

‘আই লাভ ইউ পুতুল!’

‘আই লাভ ইউ টু!’

প্রশান্ত ভাবতেও পারেনি পুতুল উত্তর দেবে। বুকের সঙ্গে ফোন টা চেপে ধরে কিছু বলতে নিলেই দেখলো লাইন ডিস-কানেক্ট করে দিয়েছে পুতুল। দুই ঠোঁট এলিয়ে হেসে উঠলো প্রশান্ত। এক অন্য রকম সুখে চোখ বুজে নিলো সে।

উত্তরটা দিয়েই এক সেকেন্ড ও দেরি করেনি পুতুল। খট করে কে’টে দিয়েছে কল! তার সারা শরীর হীম হয়ে আসছে কেমন যেনো। এক অন্য রকম অনুভুতির জ্বালে ভেসে যাচ্ছে সে। তার হৃদয় পুলকিত হচ্ছে রঙিন প্রজাপতির মতো। সে গুটিগুটি পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। রাত সারে নয়টা বাজে। সে কিছুক্ষন বই নেড়ে চেড়ে দেখলো। মোটে পড়াশোনা হলো না তার। এরপর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। যদিও ঘুম তার চোখে ধরা দিলো না একটুও একজনের ভাবনায় বিভোর মন।


প্রিহানের আঁখি জোড়ায়ও তন্দ্রা লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্টে৷ নেত্রপল্লব লেগে আসছে বারংবার। শত চেষ্টা করেও তন্দ্রাভাব কাটাতে না পেরে অসন্তোষ সে। ম্রিয়মাণ নয়নে তাকিয়ে রইলো সিলিংফ্যানের দিকে। কাল কোর্টে শেষ শোনানি। হাই কোর্টে মামলার শেষ ফয়সালা শোনানো হবে। অথচ প্রিহান ক্লু-লেস।

ঔশীর রুমে গেছে মালা। এখনো আসছে না সে। প্রিহান হাত ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে সময় দেখলো। রাত দশটার কাছাকাছি বাজে। এখনো কেন আসছে না মালা। এদিকে ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। অতিরিক্ত চিন্তা করলে তার প্রচুর ঘুম পায়। এই স্বভাব টা তার অনেক দিন থেকে। ঘুমে কাতর প্রিহান না চাইতেও বিছানায় ঢলে পরলো।

মালার হাত টা চেপে ধরে ঔশী গভীর দৃষ্টিতে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘কি হয়েছে ঔশী সোনার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার সোনাটার কি মন কেমন করছে?বেজার কেন মুখটা?’

‘আচ্ছা মিস্টেরিয়াস আন্টি মায়েরা কি তোমার মতোই হয়? জানো আমি ছোট থেকেই মাম্মাকে দেখিনি। মাম্মার কথা, মাম্মামের গল্প কেউ আমাকে শোনাইনি! এই যে লকেট টা দেখছো না? এটা নাকি আমার মাম্মামের ছিলো। আমার যখন অনেক বেশি মন খারাপ হয় তখন এটা আমি আমার বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরি। আমার মনে হয় এটা আমার কাছে থাকলে আমার মাম্মাম আমার কাছে আছে।’

মালা ভালো করে লকেট টা দেখলো। এই লকেট তো সে এর আগে দেখেনি তবে এটা ঔশীর কাছে কি করে এলো? মালা ঔশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

‘মা!আমার সোনা মা টাহ। আমি আছি তো। একটুও মন খারাপ করো না তো। আমি তো তোমার মায়ের ই মতো। তুমি আমাকে আজ থেকে মিস্টেরিয়াস মাম্মা ডাকবে ঠিক আছে?’

‘আচ্ছাহ। তুমি তো আমাকে কত্তো ভালোবাসো! ঠিক মায়েরা যেমন হয় সেরকমই। তাই আমি তোমাকে মিস্টেরিয়াস মাম্মা ডাকবো।’

‘ঠিক আছে আমার সোনা মেয়ে। ঘুমাও তো এখন লক্ষীটি হয়ে।’

‘আচ্ছা তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আমার জলদি ঘুম আসবে।’

মালা স্নেহের সঙ্গে ঔশীর কপালে দৃঢ় চুম্বন এঁকে দিলো। মুহুর্তেই চোখ ভিজে উঠে মালার। সে চাইলেও যে এখন ঔশীকে সত্যি টা বলতে পারবে না। কি করবে সে? এই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটির এমন কষ্টের কথা যে আর সহ্য হচ্ছে না। ঔশী ঘুমিয়ে গেলে মালা আস্তে আস্তে উঠতে নিলে ওর হাতে সঙ্গে লেগে ঔশীর হাতের মুঠোয় আগলে রাখা লকেট ছিটকে পরলো। লকেট টা সে তুলতে গেলেই দেখলো চেইনের লকেটের মুখ টা খোলা। আর তার ভেতর থেকেই কালো মতো কিছুটা বেরিয়ে আছে। মালা আলগোছে সেই জিনিসটা উঠালো। লকেটের মুখ টা বন্ধ করেই ভ্রু কুচকে তাকালো হাতের সেই কালো জিনিসটার দিকে। এটা একটা মেমোরি কার্ড। পিলে চমকে উঠে মালার।

‘লকেটের ভেতর মেমোরি কার্ড? কি আছে এটাতে? কি এমন আছে যে এটা এভাবে এরকম একটা লকেটের মধ্যে রাখা হলো?’

মালা লকেটটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে মেমোরি কার্ড টা নিজের ফোনে ভরলো। প্রথমে গ্যালারিতে গিয়ে অনেক গুলো ছবি দেখতে পেলো। একটা মেয়ের অসংখ্য ছবি। শাড়ী, চুরিদার, সালোয়ার কামিজ, সব ধরনের ড্রেস পরাই প্রায় দুশোটার উপরে ছবি আছে। তারিখ দেখলো মিনিমাম দুই হাজার সতেরো-আঠারোর দিকের ছবি। মেয়েটাকে সে চেনে। ইয়েস সে চেনে মেয়েটাকে। কে বুঝতেই তার মাথা যেনো ঘুরে গেলো। শেবা মেম! শেবা মেমের ছবি এখানে? এই মেমোরিটা কি তবে শেবা মেমের ছিলো?

সারা শরীর কেমন যেনো অসাড়তায় বিমুঢ় হয়ে গেলো। সে ঘাটাঘাটি করে ভিডিওতে গেলো। কিছু পুরনো গান আর মুভি আছে। হঠাৎ অদ্ভুত একটা ভিডিও চোখে পরলো মালার। সে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা প্লে করতেই ত্রিশ সেকেন্ডে যেতেই হাত থেকে ছিটকে ফোন টা পরে গেলো। ভিডিওটি করার সময় যে হাত টা কেঁপেছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কি দেখলো সে এটা? পেট থেকে শুরু করে এমন ভাবে সারা শরীরে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে যেনো সে জ্ঞান হারাবে! নাড়িভুঁড়ি উলটে আসতে চাইছে। দু চোখ দিয়ে যেনো উপচে পরছে চোখের পানি। সে ফোন টা তুলে দৌঁড়ে গেলো ঘরে। ওয়াশরুমে গিয়ে গল গল করে বমি করলো সে। শাওয়ার এর নিচে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে থেকে কখন যে ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেলো বুঝতেই পারলো না। এক পর্যায়ে ভিজতে ভিজতে সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো তার।ঝিমিয়ে পরলো সে সেখানেই।

ধপাশ করে কিছু পরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো প্রিহানের।ধড়াস করে উঠলো বুকের ভেতর টা।সে শব্দের উৎস খুঁজে পেয়ে দৌঁড়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।ওয়াশরুমের দরজাটা খোলায় আছে। সেখানে মালা অজ্ঞান হয়ে পরে আছে।

#চলবে