প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-৩১+৩২

0
277

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩১
#রাউফুন

আর কেউ চিনুক আর না চিনুক কুলসুম বেগম ঠিক চিনতে পেরেছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে। তিনি আর কেউ-ই নন প্রিহানের দাদা রহমান হাওলাদার এর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান মাঝহারুল হাওলাদার। এতো বছর পর হঠাৎ-আসা, এখানে তার পদার্পণ টা ছিলো চমকে দেওয়ার মতো৷

মালা গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চিবুক বেয়ে চোখের নোনা পানি গড়িয়ে পরছে। এই মানুষ টা এখানে? এখানে কেন এসেছেন তিনি? কুলসুম মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাবা মাঝহারুল তুমি এতো দিন পর? এতোদিন পর আমাদের মনে পরলো বাবা? সেই যে গেলে এতো গুলো বছর পর দেখলাম তোমাকে।’

‘জ্বী আসসালামু আলাইকুম!’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। ভালো আছো বাবা?

‘হ্যাঁ মা ভালো আছি। আপনার শরীর ঠিক আছে মা? ওষুধ খাচ্ছেন ঠিক করে?

‘ হ্যাঁ গো বাবা ঠিক আছি। আল্লাহ তায়ালা বোধহয় তোমাকে দেখার জন্যই এতো বছর বাচিঁয়ে রেখেছেন আমাকে।’

‘এভাবে বলবেন না মা। আমায় কি করে চিনলেন মা?’

‘মায়েরা কি সন্তানকে ভুলতে পারে? আমি তোমাকে চিনবো না বাবা?’

‘আসসালামু আলাইকুম বাবা!’ মাঝহারুল হাওলাদার নিজের বাবার দিকে এগিয়ে এসে বললেন।

চমকে তাকালেন রহমান সাহেব। তিনি ভাবতেও পারেন নি এতো বছর পর তিনি তার ছোট সন্তানকে দেখবেন! তার চোখ ছলছল করে উঠে। তিনি গিয়ে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। সবার মুখে হাসি ফুটে।

‘এতো দিন কোথায় ছিলে বাবা? এই বুড়ো বাবাকে এতো দিন পর মনে পরলো?’

‘আপনাদের সব সময় মিস করি বাবা। আমি এখানে না থাকলেও এখান কার সব কিছুর খবর আমি নিতাম। আমি এখানে আসলে যদি বড় ভাইয়া ভাবেন আমি তার আদরে ভাগ বসাচ্ছি!’

‘তোমার কেন মনে হলো যে তোমার বড় ভাইয়া এতটা স্বার্থপর? তোমায় তো আমি কম খুঁজি নি মাঝহারুল? কোথায় ছিলে ভাই আমার!’

‘বড় ভাইয়া! আপনি আমাকে মনে রেখেছেন? কোনো ক্ষোভ, খায়েস রাখেন নি আমার প্রতি?’

‘আসো বুকে আসো ভাই আমার। এতো দিন হয়ে গেলো আর তুমি ক্ষোভ খায়েস মনে রাখার কথা বলছো? এবারে কান মলে দিবো কিন্তু। তার আগে তুমি বলো বড় ভাইয়ের প্রতি কোনো অভিযোগ রাখোনি তো?’

‘না ভাইয়া কি যে বলেন। মায়ের মৃত্যুর পর আসলে এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলেও নানা ভাইয়ের কথায় বিদেশে যেতে হয় আমাকে। আমার মায়ের নাকি শেষ ইচ্ছে ছিলো আমি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করি। না হলে আপনাদের কে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম না।’

ফারুক হাওলাদার এগিয়ে এসে নিজের ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। সবার সাথে কথা বললেন মাঝহারুল হাওলাদার। মালা ছিলো এর মধ্যে নিরব দর্শক। সে ভাবতেই পারেনি উনি এই বাড়ির ছোট ছেলে তিনি। প্রিহানের আপন চাচা। সে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো। যদি প্রিহান তার জন্ম পরিচয় সম্বন্ধে জেনে যায় তবে? প্রিহান কি তাকে আগের মতো গ্রহণ করবে? ভালোবাসবে?

‘কি হলো মেয়ে? সবাই আমার সঙ্গে কথা বললো তুমি বললে না?’

‘জ্ব-জ্বী! আসসালামু আলাইকুম!’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। তাহলে তুমিই আমার একমাত্র ভাইপোর ওয়াইফ!’

মালা সরু দৃষ্টিতে তাকালো। এমন ভাবে কথা বলছে যেনো আজকেই তাকে প্রথমবার দেখলো এই মানুষ টাহ। কিছু একটা ভেবে হোহো করে হেসে উঠলেন মাঝহারুল।

‘ মা আমি যদি এখানে কিছু দিন থাকি আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?’

‘এটা কেমন কথা বাবা? তোমার বাড়ি, তোমার ঘর, এই বুড়ো বুড়িকে জিজ্ঞেস করছো এটা আবার? এখানেই থাকবে যখন একবার চলে এসেছো এই বুড়ো বুড়ি তোমাকে আর যেতে দিচ্ছে না বাবা।’

‘তাহলে আমি একজন কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই! তাকে ডাকি?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই ডাকো। আমরাও দেখি।’

মাঝহারুল বাইরে গিয়ে একজন কে নিয়ে এলেন।

‘মিট মাই ওয়াইফ লিলি হাওলাদার। বাবা, মা ও আমার স্ত্রী।’

সবাই ভীষণ খুশি হলেন। লিলির জন্মই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। তিনি ঠিক করে বাংলা বলতে পারেন না।মুহুর্তের মধ্যে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেলো। লিলি সবার সাথে কথা বলে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মালার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার চোখ ছলছল করে উঠে মালাকে দেখে। তিনি আবেগের বসে জাপটে ধরে মালাকে। প্রায় শব্দ করেই কেঁদে উঠেন। সবাই একটু অবাক হয় লিলির আচরণে। লিলির চোখ দিয়ে পানি পরছে টপটপ করে। মালা কিছু টা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সবার সামনে তাকে সরিয়েও দিতে পারছে না। সবাই ভাবছে হইতো লিলি বিদেশি কালচারে বড় হওয়া মেয়ে তাই কাউকে জড়িয়ে ধরে আদর করাটা স্বাভাবিক কিন্তু চোখের পানি ফেলা? এটা কি স্বাভাবিক?মাঝহারুল হাওলাদার সবার হাবভাব লক্ষ্য করে বলেন,

‘আসলে আমাদের সন্তান সন্তুতি নেই তো তাই লিলি এরকম বয়সী কাউকে দেখলেই আবেগী হয়ে পরে। বিদেশী নারীরা সন্তান নিয়ে ভীষণ পজেসিভ। আর লিলিও ভীষণ ইম্পালসিভ। নিজের আবেগ সামলাতে পারে না ও। আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না হ্যাঁ!’

সবার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় মাঝহারুল এর সন্তান নেই এই কথা শুনে। মালা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেকি হাসার চেষ্টা করে। সে ভাবতেই পারেনি তার জন্মদাতা পিতা স্যরি এটা বলা ভুল হবে, সে তো এই মানুষটার টেস্ট টিউব বেবি। স্যারোগেসির মাধ্যমে তার পিতা হয়েছে মানুষ টা। যদিও সব সময় মেয়ে মেয়ে বলে তিনি অজ্ঞান অথচ সবাইকে বললেন সন্তান সন্তুতি নেই। আর এই যে ইনি? মিসেস লিলি তার এই বাবার বউ তাকে কেমন স্নেহ করছে। মালা মনে মনে চেয়েও বিরক্ত হতে পারছে না। কেমন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করে সে লিলিকে দেখে। অসুস্থতার জন্য মুখের ফিচার টা শুকিয়ে গেছে। তিনি শুকনায় মালার মতোই৷ বিদেশি মহিলারা নিজেদের ফিটনেস মেইনটেইন খুব ভালো ভাবেই করে। মালা তো ভাবতেই পারেনি এতোটা বয়স পরেও তিনি এতোটা শুকনো। সালোয়ার কামিজ পরিহিত মহিলাটিকে পেছন থেকে কেউ দেখলে বলবে না মহিলাটির এতোটা বয়স।

প্রিহান এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি সবটা দূর থেকে দেখে ভীষণ খুশি হয় সে। সে এসে সবার সাথে আলাপ করে। সে তো সব সময় চাইতো একটা পরিপূর্ণ ফ্যামিলি। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক কাপ কফির জন্য। বাইরে এসেই দেখে কি সুন্দর একটা মুহুর্ত হচ্ছে কত দিন পর। সে মন ভরে উপর থেকে সবটাই অবলোকন করছিলো। দেখতে দেখতেই চোখে পানি চলে আসে তার। সে কখনোই তার চোখের পানি কাউকে দেখতে দেইনি। একটা কঠোর ভাব নিজের চেহারার উপর ধরে রাখে সে। মালার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া টা যে সে লক্ষ্য করেনি তা কিন্তু নয়। হঠাৎ ছোট কাকা কে দেখে মালার মুখাবয়ব এমন পাংশুটে হয়ে গেলো কেন? কোনো কানেকশন আছে কি ছোট কাকার সঙ্গে মালার? বা সে কি আগে থেকেই চিনতো ছোট কাকাকে?

সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের রুমে না গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দেন। অনেক দিন পর বাড়ির ছোট ছেলে আসায় অনেকক্ষন আড্ডা দেন। দাদা, দাদি, ফারুক হাওলাদার, খোদেজা, প্রিহান, মালা, ঔশী, ময়নাও বাদ যায়নি আড্ডা থেকে। অনেক রাত পর্যন্ত উনারা আড্ডা দেন। এদিকে লিলি দু চোখ ভরে মালাকে দেখছে। মেয়েটা কি তাকে একবার মা বলে ডাকবে? যদি সে তার কাছে এই ছোট্ট আবদার টা করে তবে কি সে রাখবে? নাকি তাকে প্রত্যাহার করবে? তার বুকটা কেমক্ন হাহাকার করছে মালার মুখে একবার মা ডাক শুনার জন্য। মাঝহারুল নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আসার একটাই কারণ মালাকে চোখের দেখা দেখবে লিলি। স্ত্রীর শেষ সময়ে এসে কোনো কথা ফেলতে পারেন না তিনি। মেয়েটার এতো জেদ কতবার বললো গিয়ে দেখা করতে কিন্তু মেয়েটার জেদের কাছে হার মানতে হয় তাকে। মাঝহারুল হাওলাদার কে তো বাবাই মানে না মেয়েটা। তাই তো বাধ্য হয়ে তাকে এই বাড়িতে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

হঠাৎ মালার ফোন বেজে উঠলো। সে সবার কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ হওয়া মাত্রই সেই ব্যাক্তি আওয়াজ দিলো,

‘মেম আপনার ছোট বোন পুতুলের সঙ্গে একজনের সম্পর্ক আছে। আপনি নজর রাখতে বলেছিলেন না? আগে যে ছেলেটা ডিস্টার্ব করতো তাকে তো ধো’লাই দিয়েছি কিন্তু এখনকার জনের সঙ্গে কি করবো?’

‘তার ছবি পাঠাও আগে এরপর বলছি। আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয় তবে ছেলেটাকে আমি চিনি।’

‘আচ্ছা মেম পাঠাচ্ছি।’

মালা ছবি দেখে বললো, ‘ছেলেটাকে কিছুই করার দরকার নেই। আমি তাকে চিনি ওঁ খুব ভালো ছেলে। ওঁ পুতুলের কোনো ক্ষতি করবে না।আর হ্যাঁ আগের কাজ টা হয়েছে?’

‘ হ্যাঁ হয়েছে।হাকিম সহ বাকি ছয়জন এখন আমাদের আওতায়!’

মালা ঠোঁট এলিয়ে অন্য রকম হাসলো।ফোন কে’টে পেছনে ঘুরে প্রিহানকে দেখেই চমকে উঠে।প্রিহান কি তার কথোপকথন শুনে ফেললো? প্রিহানের চাহনি এমন লাগছে কেন? কেমন সন্দেহের দৃষ্টি তার। তাকে কি ভুল বুঝলো প্রিহান?

#চলবে

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩২
#রাউফুন

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে মালা?’ প্রিহানের সন্দেহের দৃষ্টি।

‘ওই রেস্টুরেন্ট থেকে ম্যানেজার এর ফোন এসেছিলো। আজ যায়নি কেন তাই ফোন করে জানতে চাইছিলো।’ কোনো রকমে জবাব দিলো মালা।

‘ওহ আচ্ছা।’

ফোস করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো মালা। যাক কিছু শুনতে পাইনি প্রিহান।

পরের দিন সকালে মালা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিলো সে সময় লিলি আসলেন। মালা তাকে দেখতে পেয়েই সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলো,

‘ডু ইউ নীড অ্যানিথিং?’

‘ক্যান ইউ গিভ মি আ’ কাপ অফ কফি!’

‘ইয়াহ্ শিওর। ইউ সীট ডাউন, আই’ল গীভ ইউ ফাইভ মিনিটস!’

কফি চাওয়া টা তো শুধুমাত্র বাহানা। লিলি শুধু চাইছিলো মালার কাছাকাছি থাকতে। লিলির চোখ কেমন ঘোলাটে হয়ে আসে মালাকে দেখলেই। তিনি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম বলেই বোধহয় আরও বেশি কষ্ট হয় তার। সময় মতো একে একে সবাই ব্রেকফাস্ট করতে চলে আসে। প্রিহান এখন প্রায় ফ্রী বললেই চলে। চাইলেই কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে পারবে। মন টাও কেমন একটু পানসে হয়ে আছে। ঘুরতে গেলে যদি মন টা ভালো হয়। ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই সে মালাকে ঘরে আসতে বলে। কথামতো মালা রুমে যেতেই প্রিহান সুন্দর একটা শাড়ী ধরিয়ে দেই তার হাতে। মালা শাড়ীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাদের বিয়ের পর কি কোথাও ঘুরতে গেছি? হয়তো তোমার সময় হয়নি না হলে আমার। তোমার এডভোকেট হাসবেন্ড এর সময় কোথায় বলো? আজ যখন সময় পেয়েছি, সব দিক থেকে রিল্যাক্স! তবে চলো ঘুরে আসি।’

‘এখনি যাবেন?’

‘হ্যাঁ এখনি। আজকে সারাদিন ঘুরবো তোমাকে নিয়ে। দশ মিনিট তোমার জন্য বরাদ্দ। রেডি হয়ে বের হবে। আমি রুমে রেডি হচ্ছি।’

‘আচ্ছা।’

ইয়েএএ প্রিহান তাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে? এই খুশি আর সে রাখবে কোথায়? মালার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে! মনে কেমন রঙিন প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। সে বাথরুমে গিয়ে নাচ শুরু করলো ঘুরতে যাওয়ার খুশিতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানান অঙ্গ ভঙ্গি করতে লাগলো। কিভাবে তাকে সুন্দর লাগছে, বা লাগবে। কিভাবে হাসলে ভালো লাগবে, কিভাবে গাল ফুলালে ভালো লাগবে, সব কিছু করলো। দেখতে দেখতে কতক্ষণ যে কে’টে গেলো তবুও সে বেরোলো না। নাচতে নাচতে শাওয়ার করছে মালা। শ্যাম্পু চুলের মধ্যে ঢেলে দিয়ে ঘসে যাচ্ছে। আজকে চুলের গন্ধে মাতোয়ারা করে দেবে প্রিহান কে। হাহাহাহ। নিজেই নিজের এমন উম্মাদের মতো আচরণে হেসে ফেলে। আচ্ছা এতো খুশি খুশি কেন লাগছে! আহ! কি লজ্জা! যখন তার চুল গুলো উড়বে না হাওয়ায়, তখন প্রিহান একেবারে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। আর সে লজ্জায় লাল নীল হবে!

‘এই মালা তুমি বেরোবে নাকি কান ধরে টেনে বের করবো? এভাবে ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছে কেন?’

মালার কানে তার কথা পৌঁছালো বলে মনে হলো না। এতক্ষণ সে কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে রুপমের সঙ্গে কথা বলছিলো। ওঁকে দিয়ে একটা রিসোর্টে রুম বুক করালো। আজকের রাত ওখানে কা’টিয়ে কালকেও ঘুরে তারপর বাসায় ফিরবে তারা। হ্যাড ফোন খুলেই ধপাস ধপাস শব্দ পায় ওয়াশরুম থেকে।

মালা একেবারে শাড়ী পরে বের হয়েছে। সী গ্রীন শাড়ীতে স্টোনের কাজ! লাল খয়েরী রঙের ছোঁয়ায় আঁচল করা। সে সুন্দর করে শাড়ী টি লেহেঙ্গা টাইপ করে পরেছে। প্রিহান খাটে বসে আয়নার মধ্যে মালাকে দেখলো! না চাইতেও দৃষ্টি সেদিকেই যাচ্ছে তার। মালার ভালো করে দেখতেই সে বিরবির করে, ”কি করেছে এই মেয়ে নিজের চোখের?”

‘এই মেয়ে চোখ এমন আগুনের মতো লাল কেন? বলেছি দশ মিনিটে বের হতে বেরিয়ে এলে দুই ঘন্টা পরে। দশ টাই গিয়ে বারোটাই কিভাবে বের হয় একটা মানুষ? নিজের চোখ গুলো দেখো একবার। ভয় করছে তোমার চোখ দেখে এখন!’

মালা গাল ফুলিয়ে আয়নায় নিজের চোখ দেখলো। ”আয়ায়ায়া!” করে জোরে একটা চিৎকার দিলো সে। সে তো প্রিহানকে পা’গ’ল করতে চেয়েছিলো কিন্তু এখন তাকে ভয় পাচ্ছে? প্রিহানের কি দোষ। নিজের চোখ দেখে তো সে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। ভড়কে যায় প্রিহান মালার চিৎকারে। অদ্ভুত ভাবে জিজ্ঞেস করে,

‘এই ওয়াশরুমে এতক্ষণ কি করছিলে? নাচছিলে নাকি? ওমন ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছিলো।’

‘কিছুই করছিলাম না।’ ফ্যাস ফ্যাস করে জবাব দিয়েই মালা সাজতে লাগলো। সাজুগুজু কমপ্লিট করে বলল,

‘আমি রেডি!’

‘থ্যাংক গড। অবশেষে রেডি হতে পারলে। চলো বেরোনো যাক।’

গোমড়া মুখে বেরোলো মালা। একবার চেয়েও দেখলো না তাকে লোকটা। এতো সুন্দর করে সাজলো সে কার জন্য? বিয়ের পর তার চেহারায় যেনো তার সেই আগের তারুন্য টা ফিরে এসেছে। হইতো প্রিয় মানুষটার সঙ্গে আছে বলেই সে এতো সুখি। প্রতি মুহুর্তে সুখ সুখ অনুভব করে সে।

তারা দুজন রিকশায় ঘুরবে আজ। প্রিহান ইচ্ছে করেই গাড়ি নিলো না সঙ্গে। দুপুরে একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে রিসোর্টের দিকে রওনা হলো তারা। রিসোর্টের রুমে গিয়ে মালা একটু ফ্রেশ হয়ে নিলো। তার মনে এখন অভিমান জমে আছে ভারী হয়ে আছে। চারটের দিকে বের হলো তারা আবার। ফুচকা, আইসক্রিম দুজনেই খেলো। ঘুরতে ঘুরতে মালার মন টা ফ্রেশ হয়ে গেছে একদম। সন্ধ্যে নামার আগে চট্টগ্রাম পতেঙ্গা বীচে গিয়ে দুজন দুজনার হাত ধরে বালির ওপর দিয়ে হাটলো খালি পায়ে৷ মালা সন্ধ্যের সূর্য ডুবার মুহুর্ত টা খুব এনজয় করছে।

‘সময় টা যদি এখানেই থেমে যেতো কেমন হতো?’

‘কি হতো আর তুমি আর আমি বুড়ি হতাম না কখনো!’ মশকরা করে ঠোঁট চেপে হাসলো প্রিহান।

‘আপনি কি সব রোমান্টিকতা ভুলে গেলেন প্রিয়?’ কোণা চোখে তাকিয়ে বলে মালা।

‘ভুলেছি বুঝি? তা রোমান্স কি এখানেই শুরু করতে বলছো? এখানে কিন্তু অনেক লোকজন আছে সমস্যা কিন্তু তোমার ই হবে। আমার কিন্তু কোনো সমস্যা নেই। শুরু করবো?’

‘উম সব সময় ত্যাড়া ব্যাকা কথা বার্তা। এই যে এতো সুন্দর করে সাজলাম, কার জন্য? একটা বার তাকালেন না পর্যন্ত ভালো করে? আমাকে কি এতোটাই খারাপ লাগে সাজলে?’

মুখ বিকৃতি করে মালা বালিতে বসে পরলো। রাগলে মুখশ্রী পাংশুটে দেখায় তার। প্রিহান ভ্রু কুটি সংকুচিত করে একপলক তাকিয়ে হাসে মালার অভিমান দেখে। ফিচেল হেসে বলে,’তখন যদি তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতাম তাহলে কি তোমার অভিমানী মুখ খানা দেখতে পেতাম?’

‘আমাকে গলানোর চেষ্টা করবেন না।’ কন্ঠে আক্রোশ মিশিয়ে বলে মালা। প্রিহান তার পাশে বসতেই মুহূর্তেই মালা সুধীর হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। প্রিহানের চিন্তা কোথায় সেটা বুঝতে পেরে স্মিত কন্ঠে বলে, ‘আমার অভিমানী ফেস আপনার ভালো লাগে?’

‘ভালোবাসার মানুষের সব কিছু, সব মুহুর্তের ফেস সুন্দর লাগে! রাগী, অভিমানী, লজ্জায় রাঙা ফুলের মতো স্নিগ্ধ মুখ, সদ্য গোসল করে আসা আলতো ভেজা মুখ, ভেজা চুল, ভেজা ঠোঁট!’

লজ্জায় তার মুখ ঈষৎ লাল দেখায়। অনুদ্ধত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি এসব খেয়াল করেন কই বুঝিনি তো আগে!’

‘প্রেমিকাকে না বুঝতে দিয়ে দেখার মতো মজা আর কোনো টাই নেই আমার ভালোবাসা।’

‘ওওহ আচ্ছা।’ ঠোঁট গোল করে বলে মালা।

‘আমার একটা পরী চাই মালা! ঠিক তোমার মতো সুন্দর! আজ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে মালা। যা আমাকে তোমার দিকে খুব টানছে। নিজেকে কন্ট্রোল করায় যে দায়।’

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র মালা হৃষ্টচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, ‘আপনি যখন বুঝতেই পেরেছিলেন আমি অভিমান করে আছি তবুও তখন বলেন নি কেন?’

প্রিহান আলতো করে জড়িয়ে ধরে মালাকে৷ হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে, ‘এখানে এসে জানাতে চেয়েছিলাম। একান্ত ভাবে, তাই!’

মালা গাল ফুলিয়ে বলে, ‘নট ফেয়ার।’

প্রিহান মালার গালে আলতো করে আধর ছুঁয়ে বলল,’ ভালোবাসায় সবকিছুই ফেয়ার। আন-ফেয়ার বলতে কোনো শব্দ নেই।’

মালা আরও কিছুক্ষণ কপট রাগ দেখাতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রিহানের স্পর্শে সেটা পারলো না। গলে গেল মন তার। কন্ঠ মিহি করে বলে, ‘আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই প্রিয়। আমার জীবনের কিছু তিক্ত সত্যি!’

‘হুম বলো?’

‘আগে বলুন আমায় কখনো ছেড়ে যাবেন না প্রিয়!’

‘আমি শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোমার সঙ্গে থাকবো মাই ড্রাগন ফ্লাই’স। কোনো পরিস্থিতিতেই ছেড়ে যাবো না তোমাকে। এসব ছাড়ার কথা বললে কিন্তু খু’ন করে ফেলবো বলে দিলাম।’

‘আমার জন্ম স্যারোগেসির মাধ্যমে। আমি অস্ট্রেলিয়াই টেস্ট টিউব বেবি হিসেবে জন্ম গ্রহন করেছি ১৯৯৯ সালে!’ সোজাসাপটা বলে মালা প্রিহানের দিকে তাকাই।

কিয়ৎক্ষনের জন্য প্রিহান স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে। প্রিহানের এভাবে তাকানোই মালার ভয় হলো।প্রিহানকে হারানোর ভয়! যদি সত্যিটা জানার পর তাকে ছেড়ে দিতে চাই প্রিহান তখন? টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে তার চোখ থেকে। কন্ঠ কেমন রোধ হয়ে আসছে তার!

#চলবে