#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৩
#রাউফুন
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের সুন্দর ও জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। কর্ণফুলী নদী ও সাগরের মোহনায় অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এই বীচে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। বিশেষ করে বিকেল, সূর্যাস্ত ও সন্ধ্যার সময়টুকু অবশ্যই ভাল লাগে। অথচ এই মুহুর্তে দুজন মানব-মানবীর মনের মধ্যে চলছে তুমুলভাবে ঝ’ড়।
‘কে তোমার সারোগেটস মাদার মালা? তোমার বাবাটা কে?’
‘আমি এটা বলতে পারবো না প্রিয়। প্লিজ আমি চাই না তার নাম টা বলতে। আর এটাও চাই না তার সম্বন্ধে আপনার মনে কোনো রকম কোনো বাজে চিন্তা ধারা সৃষ্টি হোক।’
‘তুমি ছোট থেকে যার কাছে মানুষ হয়েছো সে কি তবে তোমার মা নয়?’
‘না না উনিই আমার মা। আরেকটা কথা আপনার জানা দরকার!’
‘কি কথা?’
‘আমি শাহনাজের সন্তানের মা হয়েছিলাম।’
এটা শুনতেই প্রিহান দু-কদম পিছিয়ে যায়। প্রিহান সেখান কার একটা পাথরের উপর বসে পরে। মালা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে সময় নিয়ে প্রিহানের পাশে বসে বলতে থাকে,
‘আমার যখন আঠারো বছর হয়েছে তখনই আমি সত্যিটা জানতে পারি। একদিন আম্মু আর আব্বুর ভীষণ ঝগড়া হচ্ছিলো আমাকে নিয়ে। তখন আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম। শাহনাজের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঢাকায় আসি আমাদের বাড়িতে। আম্মু সে-সময় পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়াই যান। উনার ইচ্ছে ছিলো বিদেশে পড়াশোনা করবেন। অনেক বড় কিছু হবেন। কিন্তু পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়াই যাওয়ার পথেই তার নিজের কাছে থাকা সমস্ত টাকা শেষ হয়ে যায়। এখন অস্ট্রেলিয়ার মতো এতো বড় একটা জায়গায় টাকা ছাড়া কিভাবে থাকবেন তিনি। আমার নানা নানুও আম্মুকে কোনো রকম খরচ দিতে ইচ্ছুক না। উনারা ছিলেন গ্রাম্য মানুষ, উনারা কখনোই চাননি তাদের মেয়ে পড়াশোনা করুন। সবার বিরুদ্ধে গিয়েও আম্মু পড়াশোনা করতে অস্ট্রেলিয়াই পারি জমান।
অস্ট্রেলিয়াই গিয়ে তিনি জানতে পারেন সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান পেতে অনেক ক্ষেত্রে সারোগেট মায়ের আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ ৩০-৫০ লাখ টাকাও হয়। এটা যখন আম্মু জানতে পারেন তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন উনি এটাই করবেন। আমার নানা নানি কোনো ভাবে তার মেয়ের প্রেগন্যান্সির কথাটা জানতে পারেন। আমার নানা নানি সব টা জানতে পারার পর হয় আরেকটা বিপত্তি। তাদের মেয়ে বিয়ের আগেই সন্তান সম্ভাব্য এটা মানতে পারেন নি। নানা অসুস্থ হয়ে পরেন মেয়ের বিয়ের আগেই সন্তান হবে এই কথা শুনে। আম্মু যার সন্তানের সারোগেটস মাদার হবেন তিনি জানতে পারেন আমার নানার অসুস্থতার কথা। উনার দয়া হয় এতে। আম্মু নিজের বাবার ওরকম শোচনীয় অবস্থা দেখে বিয়ে করেন ওই মানুষটাকে। আমার জন্ম হলে মা বেকে বসেন আমাকে দেবে না যদি না ওই মানুষটা তার প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন। কিন্তু মানুষটা তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন তাই তাকে ডিভোর্স দিতে পারেন না। এরপর আম্মু আমাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে যাতে আমার সারোগেটস ফাদার কষ্ট পান আর এটাই তার কাছে একটা রিভেঞ্জ নেওয়া ছিলো ওই ব্যাক্তির উপর।’
মালা মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে। প্রিহান দুই হাত বাড়িয়ে মালার চোখ মুছে দিলো। বুকের সঙ্গে চে’পে ধরে প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলে,
‘কি ভেবেছিলে এই প্রিহান হাওলাদার তোমার এই কথাটা শুনে তোমায় ছেড়ে দেবে? এতো দিনে এই চিনলে তোমার প্রিয় কে? তুমি তো অন্যান্য শিশুর মতোই স্বাভাবিক ভাবে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েছো। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই তুমিও বড় হয়েছো। এতে তো তোমার দোষ নেই। ধর্মীয় মতে যারা সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেন তারাই পাপী। তুমি তো সকল নিষ্পাপ বাচ্চার মতোই একজন স্বাভাবিক বাচ্চা হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছো তাই না? তাই তোমার এরকম কিছু ভাবার বিষয় নেই যে এটা শুনে তোমাকে আমি ছেড়ে দিবো। এই জীবনে তুমি আর প্রিহান হাওলাদার এর থেকে আলাদা হচ্ছো না। তুমি চাইলেও না। কথাটা মাথায় এবং মনে সেট করে নাও।’
‘আপনি জানেন আমি আগে ভাবতাম আম্মু আমাকে আমার অতিরিক্ত জেদের কারণ নির্যাতন করতেন। কিন্তু পরে জানতে পারি আমি তার টেস্ট টিউব বেবি বলেই আমাকে আম্মু সহ্য করতে পারেন নি কখনো। হতেই পারেন তিনি আমার সারোগেটস মাদার কিন্তু উনি তো আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন বলুন? আমাকে এতো আ’ঘা’ত করেছে যে মনে হয় আমি রাস্তার নে’ড়ে কু’কুর! আমাকে পনেরো বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় অথচ আম্মু আমার বর্তমান আব্বুকে বাঁধা দেন নি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার সুখ হবে। কিন্তু না অ’ত্যা’চা’র বাড়ে আমার উপর। শাহনাজের অ’ত্যা’চার ছিলো অমানবিক। শাহনাজ প্রায় রোজই নে’শা করতো। আমার এই ছোট্ট শরীরে আ’ঘা’তের পর আ’ঘা’ত করতো। এসব আমি মুখ বুজে মেনে নিতাম। কিন্তু একদিন ওই বাড়ির কাজের মেয়ের থেকে জানতে পারলাম উনার অনেক গুলো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। আমি বিশ্বাস করিনি প্রথমে। এরপর নিজের চোখে দেখলাম। শাহনাজ প্রতিটি মেয়ের সঙ্গে তিনি রাত কা’টা’ন। আমি তাও নির্লজ্জের মতো পরে ছিলাম। এরপর দুই বছরের মাথায় আমি জানতে পারি আমি সন্তান সম্ভাব্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে করেই হোক আমি এই সংসার টা টিকিয়ে রাখবো। রাখিও কিন্তু আমার সন্তানকে ওরা কোথাও লুকিয়ে ফেলে। আমি আমার বাচ্চাকে জন্মের পর এক পলক দেখিওনি জানেন? বাচ্চা হারানোর পর আমি আমি সহ্য করতে না পেরে শাহনাজকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসি।’
‘শিহ!! চুপ চুপ কাঁদে না। আমি তোমাকে তোমার স্যরি আমাদের বাচ্চাকে খুঁজে আনবো। কেঁদো না। একদম কাঁদবে না মাই ড্রাগনফ্লাই’স।’
মালা বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে বসে পরে প্রিহানের কোলে। সে চাইলেও বলতে পারবে না যে ঔশী আর কেউ না তার ই সন্তান। যাকে নিজের অজান্তেই প্রিহান মানুষ করেছে। এটা তো সে জানতে পেরেছে কিছুদিন হলো। এই কথাটা এখনি বলার সময় হয়নি প্রিহানকে। সে যে নিজেই এখনো শিওর না! তবে শেবা মেম যখন বলেছেন তখন এটা সত্যি কথা। সে বিশ্বাস করে এটা।
‘চলো এখন রিসোর্টে ফিরে যাবো। আরও বেশি থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।’
‘আচ্ছা চলুন। আমাকে নিয়ে আপনার মনে কোনো সংশয় নেই তো প্রিয়?’
‘এসব নিয়ে একদম ভাববে না আর আমার ভালোবাসা। আমি কখনোই কোনো কারণেই তোমার এই হাত টা ছাড়বো না। সো এসব মাথা থেকে দূরে ছুড়ে ফেলো। তোমার চোখের চাহনি, কথা বলতে বলতে হুটহাট হাসি, আমার মনে তোমার জন্য ক্ষনে ক্ষনে যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে এটা কি এই ঠুনকো কিছু সত্য জানায় ঠুনকো হতে পারে? যেমন সময় পেরিয়ে গেলে আর ফিরে আসেনা,
ইতিহাস শাক্ষী আছে একজন উম্মাদ প্রেমিক কখনোই তার প্রেমিকাকে ভুলতে পারে না। যে
ভালোবাসার মানুষটির চোখের দিকে তাকালে
পুরো পৃথিবী দেখতে পাই, আর সেই ভালোবাসা চলে গেলে, আমার গোটা পৃথিবী আঁধারে ঢেকে যাবে মালা। আমি যদি কখনো তোমার চোখের আড়াল হয় তুমি মন ভেঙ্গো না মালা। তোমার মনের আড়াল হলে, করো প্রেমে পড়ো না, একটু খানি দুঃখ পেলে ভুল বুঝো না। একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার প্রেমিকার মুখ,আর জ্যোৎস্না হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস!’
মালা সুখের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। দু চোখের কোলে পানি আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রিহানকে। পরদিন সকাল সকাল ওর বের হলো রিসোর্ট থেকে। সূর্য উদয় দেখবে বলে মালা বায়না ধরে।
এই সৈকতকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে বেশ কিছু পরিকল্পণা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পতেঙ্গা সৈকতকে আধুনিক ও বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে।
মালা আর প্রিহান প্রথমে সেখানের একটা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার খাই। কারণ তারা সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে। এরপর মালা আর প্রিহান সী বাইক আর ঘোড়ায় উঠে। দুপুর বারোটাই দুজন মিলে স্পীড বোটে উঠে। বার্মিজ মার্কেটে গিয়ে হরেক রকমের জিনিস কেনাকাটা করে তারা। পুতুলের জন্য চু’ড়ি, পায়েল, কয়েক রকমের আচাড় নিলো মালা। গহীনের জন্য টি-শার্ট। শাশুড়ী মায়ের জন্য একটা শাড়ী, দাদু-দাদি, ময়না আপু, প্রতিটি ব্যাক্তির জন্য তারা একটা না একটা উপহার নিয়ে নিলো। দুপুরে রিসোর্টে ফিরে এসে দুজনেই খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। আবার বিকেলে উঠে ঘুরতে বের হয় তারা। জেটি এবং প্রজাপতি পার্কে ঘুরে তারা। এরপর দুজনেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সুন্দর মনোরম বাতাসে নিজেদের ভেজাতে ব্যস্ত হয়।
এতো সুন্দর একটা দিন দেওয়ার জন্য মালা খুশিতে লাফিয়ে প্রিহানকে জড়িয়ে ধরে। সে সময় ফোন আসে মালার। মালা স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে তার ঠিক করা গার্ড ফোন করেছে। অতিব প্রয়োজন ছাড়া তো কোনো ভাবেই ফোন করবে না তারা। মালা প্রিহান কে বলে একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই সে শুনতে পায়,
‘মালা মেম আপনার ছোট বোন পুতুলকে কাল বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও!’
‘হোয়াট কাল বিকেল থেকে মিসিং আর এটা তোমরা আমাকে এখন জানাচ্ছো?’
‘স্যরি মেম। আমরা ভেবেছিলাম আপনারা ঘুরতে গেছেন তাই ডিস্টার্ব করতে চাইনি!’
‘তোমরা কি জন্য রয়েছো? আমার বোনের যদি কিছু হয় তোমাদের কিন্তু ছেড়ে দেবো না আমি। খুঁজে বের করো কোথায় আছে আমার বোন!’
‘আমরা খোঁজ নিয়েও জানতে পারছি না। কাল বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে হইতো কোনো ভাবে হারিয়ে গেছে। তাকে লাস্ট বার দেখা গেছে আপনার পার্লারের সামনে।’
মালার পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে যায়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সারা শরীরে লোমশ দাঁড়িয়ে যায় তার। সে প্রচন্ড গতিতে কাঁপছে। প্রিহান তার এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে মালা এভাবে কাঁপছো কেন?’
‘পুতুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রিহান। আমাদের যেতে হবে এক্ষুনি।’
‘এটা তোমাকে কে বললো? হতে পারে কেউ তোমার সঙ্গে মজা করেছে। রিল্যাক্স!’
‘মজা না প্রিহান! আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন। আমি সত্যি বলছি।’
#চলবে
#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৪
#রাউফুন
পুতুল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় উম্মাদের মতো আচরণ করছে। কিন্তু তার দুটো হাত শক্ত চিকন শিকলি (লম্বা তার’কা’টা) দ্বারা বাঁধা। যেটা দাঁতে কিংবা হাতে কা’টা অসম্ভব! হাতের জোড় খাটিয়ে খোলার চেষ্টা করাই তার দুটো হাতে লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে হাত কে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে আসবে। চেয়ার টা লোহার। চেয়ার টা এতোটাই ভারী যে নাড়ানো সম্ভব না। পুতুল হাজার চেষ্টা করেও এক চুল ও নাড়াতে পারেনি। তার মুখের মধ্যে কাপড় ঢুকিয়ে মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলেস্বরুপ দুই ঠোঁটের কোণে কে’টে গেছে। চাপা আর্তচিৎকারে গলার রগ কেমন ফুলে উঠছে তার। দু চোখ বেঁয়ে পানি পরছে পুতুলের। সে কি এখান থেকে মুক্তি পাবে না? নাকি এই মানুষ গুলো তাকে জানে মে’রে দেবে? আচ্ছা প্রশান্তও কি এই নোংরা কাজের সঙ্গে জড়িত? সে তো বলেছিলো সে এই পার্লারে কাজ করে। সে কি এতোদিনেও বুঝতে পারেনি ওই ওয়াশরুমে কোনো ফলস দেয়াল আছে?
সে মনে করতে চাইলো গতকাল বিকেলের কথা। হ্যাঁ সে প্রশান্তর সঙ্গে পার্লারে এসেছিলো। সে প্রথমবার ফেসিয়াল করাতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার-আগে পুতুলের ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পরে৷ সে যখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসবে তখনই টাইলসের ফ্লোরে পা স্লিপ করে পরে যায়। সে ব্যালেন্স করার জন্য দেয়ালে হাত রাখে এবং তার মাথাটা দেয়ালে লাগে আর হুট করেই দেয়ালটা নড়ে উঠে ভুমিকম্পের ন্যায়। ভ্রুকুটি করে তাকাই পুতুল। সে দেয়ালে কান পেতে শুনতে চাই কিছু। কোনো পুরুষদের বিভিন্ন রকমের গলার স্বর যা ছিলো অস্পষ্ট। ভালো ভাবে না শুনলে শোনা যাবে না।
সে দেয়ালে আঘাত করে দেখলো ঠক ঠক শব্দ করছে। খালি কলসি যেমন বাজে বেশি তেমনই খালি দেয়ালে শব্দ এরকম লহু হয়। এক লহমায় পুতুলের মাথায় যেনো অন্য কিছু খেলে গেলো। সে ভালো করে হাত ঘুরাতে চাইলো। সে দেখলো মোটা মতো একটা কাগজ মোড়ানো দেয়ালে। যা খালি চোখে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটা দেয়াল না অন্য কিছু। পুতুলের কৌতুহল বেড়েই চলেছে। হঠাৎ বাথরুমে এরকম একটা ফলস দেয়াল কেন থাকবে? সন্দেহের বসেই সে চেষ্টা করে কাগজ সরাতে চাইলো কিন্তু পারলো না। খুঁজে পেতে চাইলো কিছু একটা যাতে করে কাগজ টা সরাতে পারে। নাহ নেই কিছুই। সেই দেয়ালের মতো মোটা কাগজে হাত বুলাতেই হাতের সঙ্গে একটা গোল নব পেলো৷
সে হালকা করে নব টা ঘুরাতেই আঁচানক ফলস দেয়াল খুলে দরজা বেরিয়ে এলো। এমন কি দরজাটাও লক করা নেই। সে দরজার নব ঘুরাতেই দরজা খুলে যায়। সে আরও কোতুহলী হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো৷ প্রবেশ করতেই আপনাআপনি দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। ভয়ে আঁতকে উঠলো সে। ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সে না পেরে ভেতরে প্রবেশ করলো আরও। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ইতি মধ্যে। সে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে। সে কি নিচে নামছে? কিন্তু পার্লারটার বাইরে থেকে তো বোঝা যায়নি যে নিচে কোনো রুম আছে। সে তখনও বুঝতে পারেনি তার জন্য আসলে কি অপেক্ষা করছে। নিচে নামতেই দেখা গেলো এক ভয়ংকর দৃশ্য। পুতুল চিৎকার করে উঠে এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে। তখনই কয়েকজন ছুটে এলো। ততক্ষনে পুতুল অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। সে যখন চোখ খুলে তখনই দেখতে পায় সে এই চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় পরে আছে। সে এখন আফসোস করছে সে এখানে কেন আসতে গেলো? পুতুল তখন কত গুলো লোকের করুন অবস্থা দেখেছিলো। তাদের মতোই কি অবস্থা তার ও হবে? অতিরিক্ত কোতুহল বুঝি তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো?
তখন সে এমন দৃশ্য দেখে যে ভাবতেই সমস্ত শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পিঠ থেকে শুরু করে পেটে থেকে কাঁপুনি উঠেছে তার। লোকগুলোর মধ্যে একজনকে একদম বরফ পানিতে ডোবানো হচ্ছিলো আবার উঠানো হচ্ছিলো। আরেকজনের প্রায় নগ্ন করে উলটো ঝুলিয়ে রাখা। প্রায় পর পর অনেক জনের সারা শরীর ছিলো রক্তাক্ত। বিষাক্ত কা’টা হাতের তালুতে গাঁ’থা। ঠিক কতজন মানুষ এখানে রয়েছে তা জানা নেই পুতুলের। ভালো ভাবে দেখার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। সে এই লোকগুলোরই চিৎকারের আওয়াজ পেয়েছিলো ওয়াশরুমের সেই দেয়ালে কান পেতে। এই লোক গুলোকে এভাবে কেন রাখা হয়েছে? কেন? কারা আছে এর পেছনে? তবে কি পার্লার টা জাষ্ট একটা লোক দেখানো বিজনেস? পুতুল কারোর পায়ের শব্দটা পেয়ে ”উম উম” করে আওয়াজ তুললো।
একটা লম্বা, সরু পা দেখতে পেলো পুতুল। চোখ খুলে রাখতে পারছে না সে৷ কোনো রকমে তাকিয়ে দেখলো একজন এগিয়ে আসছে। সাদা লেডিস্ জিন্স, সাদা লেডিস গেঞ্জি, হাতে কত গুলো ব্যাচ!
সে অচেনা সেই মানুষটার মুখ দেখলো, মুখে সেন্টার ফ্রুটের মতো কিছু চিবুচ্ছে ইচ্ছে মতো। সে একটা মেয়ে! শ্যামলা চেহারা তার, ঠোঁট মুখ বিকৃত করে রাখা, যেনো মহা বিরক্ত সে! কিছুক্ষণ পর এক মগ পানি সপাটে ঢেলে দিলো পুতুলের মুখে। পানির ঝাপটা সামলে পিটপিট করে তাকালো পুতুল!
‘এই মেয়ে, তুমি এখানে কিভাবে পৌঁছালে? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? কোন গুপ্তচর তুমি? কার হয়ে এখানে এসেছো? কে তুমি?’
‘উউম উউম!’
‘এই রুমি, রুমি এই মেয়েটার মুখের কাপড় খুলে দে!’
‘জ্বী মেডাম!’ রুমি দৌঁড়ে এসে মুখ খুলে দিলো।
‘হ্যাঁ এবার যাহ। রেজাকে পাঠা খাবার আনতে! মোস্তফাকে বলবি মালাকে খবর দিতে আর তুই গিয়ে পোশাক নিয়ে আয় একটা!’
‘আচ্ছা!’
‘‘মালা!’’ নামটা শুনে বড়সড় এক বিস্ফোরিত হলো পুতুলের মন-মস্তিষ্কে। সে যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘এই মেয়ে এবার বল এখানে কেন তুই? কিভাবে আসলি এই গোপন ঘরে? কোনো সাধারণ জন-মানবের তো এই পথ খুঁজে পাওয়ার কথা না? তবে তুই কিভাবে পেলি?’
‘প-পানি খাবো, আ-আগে প-পানি দিন!’
মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করলো মেয়েটি।
‘রুমি পানি দিয়ে যা এক গ্লাস।’
রুমি এসে পানি দিয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে পুতুল বললো,
‘আ-আ-মার হ-হাত তো বাঁধা! কিভাবে পানি খাবো।’
‘মহা গড়মসি করিস তো। এতো ক্যাচাল ভালো লাগে না। যত্তসব!’
বলেই সে নিজেই পানি খাইয়ে দিলো পুতুল কে। পুতুল পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু শারা শরীরের কম্পন কমছে না এক বিন্দুও। কি হবে তার সঙ্গে? কি করবে এই মেয়েটা তার সঙ্গে? এসব ভেবে মাথা ফে’টে যাচ্ছে তার। চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে অবান্তর!
‘বল এবার, কে তুই?’
‘আ’আ-মি এখানে ভুল করে চলে এসেছি। পার্লারের ওয়াশরুম থেকে শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি পা স্লিপ করে পরে যেতে গিয়ে দেয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলায়। তখনই ধাক্কা খায় দেয়ালে৷ আর নিচ থেকে চেচানোর আওয়াজ আসছিলো তাই আ’মি–!’
‘এই মিথ্যা গল্প ফাঁদছিস আমাকে? এখান কার কারোর শব্দ তো বাইরে যায় না। তুই মিথ্যা কথা বলবি আর এই আমি শেবা মেনে নেবো? আমাকে কি তোর বোকা মনে হচ্ছে মেয়ে?’
পুতুল ভাবলো একবার কি বলবে প্রশান্তকে এই মেয়েটি চেনে কি না? হঠাৎই এই মেয়েটি মালা আপুর নাম কেন নিলো? এটা কোন মালা? না না তার বোন তো হতেই পারে না। তার বোন তো একটা পিঁপড়াকে মা’রা’র আগে দশবার ভাবে সে কি না এসবে জড়িত থাকবে? সে মনে সাহস সঞ্চার করে বলে,
‘আমি সত্যি বলছি। আমাকে যেতে দিন। আমি প্রশান্তর সঙ্গে এখানে মানে পার্লারে এসেছিলাম। আমি বুঝতে পারি নি এখানে নিচে গোপন রুম আছে।’
‘ এই চুপ! এই প্রশান্ত কে আবার? তোর সঙ্গে আবার অন্য কোনো গুপ্তচর আনিস নি তো?’
‘নাহ অন্য কেউ কিভাবে আসবে? আমি তো ওয়াশরুমে এসেছিলাম!’
‘তাহলে যার তার দ্বারা তো সম্ভব না এই দরজা খুঁজে পাওয়া। আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী মালা আসুক তোকে পরে দেখে নিবো।’
‘প্লিজ আমাকে যেতে দিন আপু! আমি তো আপনার ছোট বোনের মতো। প্লিজ যেতে দিন না আমাকে!’
‘হ্যাঁ তোকে যেতে দিয়ে আমাদের ম’র’ন ডেকে আনি তাই না? বাইরে গিয়ে তুই পু’লি’শ নিয়ে আসবি! তা তো হবে না। তুই ভুল করে হোক আর স্বেচ্ছায়, যেভাবেই এসে থাক না কেন, একবার কেউ এখানে আসলে সে আর জ্যা’ন্ত ফিরে যেতে পারে না। তুই ও যাওয়ার আসা ছেড়ে দে।’
‘আপু প্লিজ! আমাকে যেতে দিন না! আমি কাউকে বলবো না এই গোপন রুমটার কথা। আমার বাড়ির লোকজন সবাই চিন্তা করছে আমাকে না পেয়ে।’
শেবা শিষ বাজিয়ে, দুলতে দুলতে চলে গেলো নিজের মতো। যেনো সে পুতুলের আওয়াজ শুনতেই পাইনি। তার মনে কারোর জন্য কোনো মায়া নেই। সত্যিই এই মেয়েটির বয়স একদম কম। সে কোনো ভাবেই কোনো এজেন্সি বা, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউ হতেই পারে না। মালা আসলে এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবা যাবে। তবে ওঁকে ছে’ড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওঁকে ছেড়ে দেওয়া মানে আমাদের বিপদ সামনে।
পুতুলকে রুমি নামের মেয়েটা এসে খাইয়ে দিলো জোর করে। পুতুল খাবে না বললেও জোর করে খাইয়ে দিয়েছে মেয়েটা। পুরো উনিশ ঘন্টা সে এখানে বন্দি। খিদে তো পেয়েছে। কিন্তু সে খেতে চাচ্ছিলো না যদি খাবারে কোনো কিছু মেশানো থাকে। খেতে খেতেই সে আবছা আলোই কারোর মুখাবয়ব দেখতে পেলো। পুতুলের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস! এটা সে কাকে দেখছে? একদম আলাদা সাজ, আলাদা রুপ! আলোর ছটা সেই মেয়েটির উপর পরতেই পুতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। তার মনে হচ্ছে তার কণ্ঠনালী রোধ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে রা সরছে না। সে বিস্মিত হয়েই কোনো রকমে উচ্চারণ করলো,
‘আপু তুমি!’
#চলবে