#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৫
#রাউফুন
মালা স্বস্থানে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের বোনের এমন অবস্থায় ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চলছে তার। কিন্তু সে যে পুতুল কে বুঝতে দিতে পারবে না যে সে এখানে কি করে? তার দেওয়া পার্লার আছে এটা তো এতোদিনে বাড়ির কাউকেই জানাইনি সে। তার রেস্টুরেন্টে চাকরি নেওয়াটা ছিলো পুরোটাই লোক দেখানো চাকরি। যাতে করে কোনো পুলিশি কে’সে ফাসলে সহজেই ছাড়া পেতে পারে, এটা বলে যে সে তো নাইট সিফটে ওই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। কিন্তু সে তো দিনের পর দিন ওখানে যাওয়ার নাম করে এই গুপ্ত রুমে আসতো।
তার আসল রুপ টা তো কেউ-ই জানে না। এখন সে কি করে পুতুলের সামনে নিয়ে আসতে পারে৷ না না অন্য কিছু ভাবতে হবে।
সে দ্রুত এগিয়ে গেলো। গিয়েই পুতুলের হাত, পায়ের বাঁধন প্লাস দিয়ে শিকল কে’টে খুলে দিলো৷ পুতুল হতভম্ব, হতচকিত, বিমুঢ় হয়ে আছে। তার বোন মালার পোশাক এমন অদ্ভুত কেন? ফর্সা টকটকে তার আপু কেমন কালো সেজেছে৷ ভিন্ন ড্রেস, আর ভিন্ন সাজ হলেও সে তো ঠিকই চিনেছে নিজের বোনকে।
‘একি মালা তুমি শেবা মেডামের সঙ্গে কথা না বলে কিভাবে এই মেয়েটা খুলে দিতে পারো?’
মালা চোখ গরম করে চাইতেই রুমি চুপসে গেলো৷ পুতুলকে মুক্ত করে দিয়ে আগলে ধরলো বুকের সঙ্গে। এরপর সপাটে চ’ড় বসালো রুমির গালে। রুমি নত মস্তকে বললো,
‘মালা মেডাম আপনি আমাকে মা’রছেন কেন? শেবা মেডাম ই তো বলেছেন যেনো এই মেয়েকে বেঁধে রাখি।’
‘চ’ড় টা মে’রে’ছি আমাকে তুমি বলার জন্য। আর এটা ভুলে গেলে কিভাবে আমরা কোনো নিরীহ মানুষকে এভাবে নির্মম ভাবে কষ্ট দিই না! কোন সাহসে ওঁকে এতোটা জ’ঘ’ন্য ভাবে বেঁধেছো?’
‘আমাকে তো শেবা মেডাম ই বলেছিলো!’
ফোসফাস করে উঠলো মালা। চুপচাপ প্রস্থান করতে যাবে তখনই আরেকটি পরিচিত মুখের সামনে পরে গেলো সে। চমকে উঠে উচ্চারণ করলো সে,
‘প্রশান্ত তুমি? তুমি এখানে কেন?’
‘আগে আপনি বলুন আপু, আপনি এরকম, সাজে কেন?’
‘ওওহ শিট ম্যান! তুমি কেন আসলে এখানে! এখানে এসে তুমি বিপদ বাড়ালে। শিট! শিট, শিট!’ রুঢ় ভাবে উচ্চারণ করলো মালা।
পুতুলকে এই অবস্থাতে দেখে প্রশান্তর পা থেমে গেছে। থরথর করে কাঁপছে সে। সে মালাকে স্বাভাবিকভাবে দেখে মেনে নিতে পারেনি। নিজের বোনের মিসিং হওয়ার খবর শুনে যে ওতো দূর থেকে ছুটে এসেছে সে কি করে তার বোনকে না খুঁজে এই পার্লারে এসেছে? মালাকে হুট করেই ওরকম সাজে বাথরুমের দিকে যেতে দেখে ফেলে প্রশান্ত। মিনিট দশেক পেরিয়ে গেলেও যখন মালা বেরোলো না সে তখন লাজ লজ্জা ভুলেই নক করে ওয়াশরুমে। কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা টা খুলে রাখা আছে। সে ইতস্তত করেই ভেতরে ঢুকে। কিন্তু মালাকে না দেখতে পেয়েই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে৷ একটা জলজ্যান্ত মানুষ ওয়াশরুম থেকে গায়েব হলো কিভাবে? সে যতটা জানে মালা ওয়াশরুন থেকে বেরিয়ে আসেনি? তার সন্দেহ হতেই সেই ফলস দেয়াল এর আড়ালে থাকা গুপ্ত দরজার খোঁজ পাই। আর সেও ভেতরে প্রবেশ করে চলে আসে। প্রশান্ত বিচলিত হয়ে পুতুলকে টেনে নিয়ে আঁকড়ে ধরলো দুই হাতে। মালাকে এখন তার বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।
‘প্রশান্ত দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে যাও৷ যেভাবে এসেছো সেভাবে যেতে পারবে না। অন্য একটা সুড়ঙ্গ আছে এইদিকে। জলদি বেরিয়ে যাও এদিক টা আমি সামলে নিবো।’
প্রশান্ত মালার দিকে সন্দিগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। পুতুল অতিরিক্ত চিন্তা আর শারিরীক দুর্বলতার জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছে। প্রশান্ত বেরোতে চাইলে তাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো শেবা! মালা ‘আআহ!’ বলে মৃদু চিৎকার করলো। রাগে দপদপ করছে মাথার ভেতরটা। সে চাইছিলো শেবার অগোচরে ওদেরকে এখান থেকে বের করতে। কিন্তু তার আগেই চলে এলো শেবা।
‘এখানে কি হচ্ছে? ওহ মালা দেখো তো এই মেয়েটাকে চেনো?’
‘মেম পুতুল আমার বোন। ওঁ এখানে ভুল করে চলে এসেছে। বাচ্চা মেয়ে ওঁকে যেতে দিন।’
‘কিহ? এই মেয়েটা তোমার বোন?’
‘হ্যাঁ মেম। ওদেরকে যেতে দিন।’
‘শাট আপ। কোন সাহসে তুমি ওঁদের কে যেতে দেওয়ার কথা বলছো? ওঁদের কে যেতে দিলে আমাদের কি হবে?’
‘মেম, মেম, প্লিজ! ওঁদের যেতে দিন। ওঁরা ইনোসেন্ট! আমি, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ওঁরা এখানকার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না। আমি বারণ করে দিবো। প্লিজ মেম ওঁদের যেতে দিন।’ অনুনয় করে বলছে মালা।
‘তোমার বোন একলা হলে না হয় ভেবে দেখতাম। কিন্তু সাথে ওই যে ছেলেটা ওঁকে আনা তোমার উচিত হয়নি। ওঁকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। নিশ্চিত ওঁ কোনো না কোনো বেগরবাই করবেই।’
‘ছেলেটাও কিছু বলবে না মেম আমি আপনাকে এন-শিওর করছি।’
‘এই রেজা, মোস্তফা, কুমার, ওঁদের দুইজন কে আলাদা রুমে আটকে রাখ।’
মুহুর্তের মধ্যেই দুজন এসে প্রশান্তকে আর পুতুলকে ধরে নিয়ে গেলো। প্রশান্ত চিৎকার করে ওদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বললো। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। ওঁদেরকে একটা খুপরির মতো রুমে বন্দি করা হলো। এই রুমের শুধু দশ ফুট উঁচু ওয়াল করা, দেয়াল আছে, জানালা নেই একটাও। এই জানালা বিহীন রুমে মনে হচ্ছে তারা শ্বাসকষ্টে ম’রে যাবে। এখান থেকে কি করে বের হবে তারা? প্রশান্ত পুতুলকে চেপে ধরে আছে বুকের সঙ্গে।
‘আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমাদের রক্ষা করুন।’
প্রশান্ত মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকছে। আল্লাহ্ ছাড়া তাদের এই বিপদ থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সে বুঝতে পারছে না মালা এসবে কিভাবে জড়িত থাকতে পারে? এতো ভালো একজনের আড়ালে এমন কুৎসিত একজন লুকিয়ে আছে? সে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
•
চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরলো মালা। তার ফুলের মতো বোনের কি অবস্থা হয়েছে এটা। যে বোনকে সে কখনো ফুলের টোকা দিতে দেইনি তার এমন করুন অবস্থা কিভাবে মানবে সে? মালা শেবার পা ধরে জাপটে বিলাপ করে বলে,
‘প্লিজ শেবা আপু, প্লিজ ওঁদের দুজনকে যেতে দিন৷ আমি তো বলছি ওঁরা দু’জনেই মুখ বন্ধ রাখবে।একটু বিশ্বাস করুন আমার কথা।’
‘নাহ এটা করতে পারি না আমি। তোমার বোন প্রায় একদিন থেকে মিসিং। তার মানে পুলিশকে ইনফর্ম করা হয়েছে। আর এই কেস টা পুলিশ অব্দি গেছে মানে আমাদের খুঁজে পাওয়ার চান্স আছে। আর আমি এটাও জানি ওঁদের ছেড়ে দিলে একবার না একবার ওঁরা ঠিক মুখ খুলবে। আমার এতোদিনের সাম্রাজ্য আমি এভাবে শেষ হতে দিবো ভাবলে কি করে?’
‘আমি তো বলছি ওঁরা বলবে না কাউকে। ওঁদেরকে আমি বুঝিয়ে বলবো। ওঁদেরকে ছেড়ে দিন না।’
‘বেশি বাড়াবাড়ি করো না হ্যাঁ? তুমি ভুলে যেও না তোমার মেয়ের খোঁজ কিন্তু আমি ছাড়া কেউ জানে না।’
‘আমিই এখানে থাকবো না। আপনার কথাও শুনবো না মেম। কারণ আমি জানি আমার মেয়ে কে? আমি জানি ঔশীই আমার মেয়ে। যাকে আপনি চার বছর আগে এক জায়গায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সব জেনে গেছি আমি।’
‘তুমি এতো কিছু কিভাবে জানলে?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো শেবা।
‘আপনার মেমোরি কার্ডটা ঔশীর কাছে ছিলো মেম। আর আমি যখন ওটা ঔশীর কাছে পাই তখনই আমি বুঝে গেছিলাম ঔশী আমার মেয়ে। আপনিই তো বলেছিলেন আপনার লকেটেই আছে ওই ধ’র্ষ’কদের এভিডেন্স। আর লকেট পেলেই আমি আমার মেয়েকে খুঁজে পাবো।’
‘হাহ এখান থেকে বেরোতে পারবে না তুমি। চার বছরে তুমি এখানকার অনেক কিছু জানো, অনেক কিছু করেছো, তার এ টু যেড কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ সহ আছে! হাজার হাজার এভিডেন্স দেখাতে পারি। আমাকে এতোটা বোকা ভেবো না।’
শেবা শয়তানি হাসি দিলো মালার দিকে তাকিয়ে। করুন চোখে তাকিয়ে রইলো মালা। দুইদিন ওভাবেই কে’টে গেলো। মালা শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা করছে যে কখন প্রশান্ত আর পুতুলকে এখান থেকে বের করবে। এদিকে সে এখান থেকে প্রশান্ত আর পুতুলকে ফেলে বাড়িতেও যেতে পারছে না। না জানি প্রিহানের কি অবস্থা হয়ে গেছে। সে নিজেই নিজের উপর রাগে ফে’টে পরছে।
•
প্রিহান পা’গ’লের মতো খুঁজে বেরাচ্ছে মালা, আর পুতুলকে। মেয়েটা হঠাৎ করেই যেনো উধাও হয়ে গেছে। দু-দিন থেকে খুঁজে চলেছে। বিন্দুমাত্র ট্র্যাস করতে পারছে না ওঁদের কাউকেই। মালার ফোন লোকেশন ট্র্যাক করা গেছে। দুইদিন আগে একটা পার্লারের সামনে লাষ্ট লোকেশন দেখা গেছিলো মালার। কতবার এসে পার্লার সার্চ করে গেছে পুলিশ কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।
মালা একটুর জন্য ফোন টা অন করেছিলো কিছুক্ষন আগে। এখনো অন আছে ফোনটা। আবারও লোকেশন এই পার্লার অব্দি পাওয়া গেছে। সে ফোন হাতে পার্লারের সামনে আসে। সে যত আগাচ্ছিলো ততই সিগন্যাল ব্রেক করছিলো। পার্লার টা আবার তন্নতন্ন করে খুঁজলো প্রিহান। সেই মুহুর্তে প্রিহান পুলিশকে ফোন করে আসতে বললো। প্রিহান পার্লার থেকে বেরিয়ে পার্লারের পেছন দিক টাই গেলো৷ যদি পেছনে কিছু পাওয়া যায়। পেছনে জঙ্গলে ঘেরা। সে প্রায় খুঁজতে খুঁজতে এক কিলোমিটার দূরে পৌঁছে গেলো। মালার ফোন লোকেশন এক্সাক্টলি এই জায়গায় থেমেছে। সে দুই পা এগোতেই ধপাশ করে পরে গেলো একটা গর্তে। গগণ বিদারী চিৎকার করে উঠে প্রিহান। আবার নতুন কোন বিপদ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?
#চলবে
#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৬ (বোনাস পার্ট)
#রাউফুন
প্রিহান গর্তটাই পরে গড়িয়ে পরলো একটা অন্ধকার ঘরে। কিছু পরার শব্দে মালা, সহ সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। শেবা সেই নরক ঘরে আছে। যেখানে সব ধ,র্ষ,ক পুরুষের শাস্তি নিজে হাতে দিয়ে থাকে তারা। সেখান থেকে পুরুষালি কণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে। শেবা সেখানে থাকাই তাকে দেখতে পেলো না প্রিহান। রুমি সহ বাকি গার্ডদের চক্ষু চড়ক গাছ প্রিহানকে দেখে। মালা যেনো আকাশচুম্বী বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। কোনো রকমে প্রশ্ন করলো সে,
‘মালা তুমি এখানে?’
মালা অনঢ়। আল্লাহ্ সকল বিপদ এভাবে কেন ধেঁয়ে আসছে? বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে। কালো মেক-আপ তুলে ফেলেছিলো মালা। মালাকে এখানে দেখে প্রিহান যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘আপনি এখানে?’
‘কেন এসে কি খুব অসুবিধে করে ফেললাম আমি? তুমি এখানে কেন বলতে পারো? গর্তে পরে গিয়ে দেখি অনেক কিছু দেখতে পেলাম। কেচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে এলো।’
‘আপনাকেও এখানে আসতে হলো। আগে আপনি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি পরে সবটা ক্লিয়ার করছি প্রিহান।’
পুরুষালি আর্তনাদ প্রিহানের কর্ণকুহর হতেই সে কোনো কিছু না ভেবেই সেই রুমের দিকে চলে গেলো। মালার কথা এই মুহুর্তে কেন যেনো শুনলো না সে। সেই নরক ঘরে গিয়ে সে যা দেখলো এতে তার চোখ র’ক্তের ন্যায় লাল হয়ে গেলো। কতগুলো মেয়ে সাদা পোশাক পরে অনেক গুলো ছেলেকে উলটো ঝুলিয়ে চা’বু’ক দিয়ে পে’টা’চ্ছে। প্রতিটি মেয়েকে পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে। আর লোকগুলোর রক্তাক্ত শরীর, গলা চিড়ে চিৎকার, প্রতিবার ঠান্ডা পানিতে চোবানো হচ্ছে তাদের প্রত্যেককে। তাদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদে কানে তালা লেগে গেলো প্রিহানের। মেয়ে গুলো কি নির্মম ভাবে চাবুক চালাচ্ছে। জীবনের প্রথমবার স্বচক্ষে এমন করুন অবস্থা দেখে প্রিহান সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়। শেবা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে প্রিহানকে। তার চিনতে অনেক সময় লাগলো তার নিজের রক্তের ভাইকে।
‘এই তোরা থামবি না। জা’নুয়ার গুলোকে পে’টাতে থাক। যাতে জীবনে কোনো নারীর দিকে তাকাতে না পারে।’
হুকুম করেই সে নিষ্ঠুরভাবে নিজের ভাইকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গিয়ে লোহার চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধলো। মালা দৌঁড়ে গিয়ে আটকাতে চাইলো শেবাকে।
‘কোনো পুরুষকে আমি সহ্য করতে পারি না। সে হোক আমার নিজের বাপ, ভাই, কিংবা অন্য কোনো বেগানা পুরুষ! সা’লা ব’দ’মা”ইস এর দিল। সব পুরুষ এক।’
বিস্ময়ে চমকে উঠে মালা লঘু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বলছেন এসব শেবা মেম?’
‘কিছু না। এই যে একে দেখছো এই লোকটা আমার নিজের ভাই। ওঁ আমাকে নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছিলো। পুরনো রাগ জমে আছে ওর উপর আমার৷’
‘কিহ! আপনি প্রিহানেব বোন?’
‘ হ্যাঁ সে আমার ভাই প্রিহান হাওলাদার। আর আমি ছিলাম ওঁর একমাত্র ছোট বোন শেবা হাওলাদার!’
মালা কিয়ৎক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘আপনি আপনার নিজের ভাইকে এভাবে নিষ্ঠুরের মতো বাঁধলেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাঁধলাম!’
‘এতোটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারেন আপনি?’
‘হাহ আমি নিষ্ঠুর? আর এডভোকেট প্রিহান হাওলাদার কি করেছিলো? ওঁ কি করে পেরেছিলো নিজের ছোট্ট আদরের বোনকে সাজা দিতে? ওর হাত কাঁপে নি সেদিন? ওর জবান বন্ধ হয়নি? যখন ভরা আদালতে আমাকে সবার সামনে দোষী প্রমাণ করে যাবত জীবন সাজার হুকুম পাইয়ে দিয়েছিলো!’
শেবার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। তার মনে কিছু পুরনো ক্ষত দগদগে হয়ে আছে এখনো। মালা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো। এক দিকে প্রশান্ত, পুতুল আর এখন প্রিহান। কি করবে সে এখন? গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো মালা। সব কিছু তার সাথেই কেন হচ্ছে? এখনি সব এক সাথে কেন হতে হলো? হতচিকত হয়ে বসে রইলো মালা।
‘এই মালা চেচাচ্ছো কেন?’
‘শেবা মেম প্রিহান আপনার ভাই, সে যে আমার স্বামী৷ আমি ওর এই অবস্থা কিভাবে দেখবো? কিভাবে বলতে পারেন?’
‘প্রিহান? প্রিহান তোমার স্বামী? মানে প্রথমে বোন,তারপর বোনের প্রেমিক, তার স্বামী? এই মালা তুমি কি ডাবল গেইম খেলছো আমার সঙ্গে? শুনো তুমি যদি ভেবে থাকো ওঁদের এখান থেকে মুক্ত করবে তাহলে সেটা ভুলে যাও। আমাকে ওঁদের প্রতি আরও নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করো না। জাষ্ট রিমেম্বার মাই ওয়ার্ড!’
বলেই শেবা চলে গেলো। হতভম্ব মালা সেখানেই পরে রইলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে প্রিহানের এই অবস্থা দেখে সে হন্তদন্ত হয়ে পানি নিয়ে এলো। প্রিহানের চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলো মালা। অনেকক্ষণ পর প্রিহান স্বাভাবিক হলো কিছুটা। দু-চোখকে ধাতস্থ করতেই মালাকে দেখলো প্রথমেই। তার দু চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে সমানে। সবচেয়ে ভালোবাসার, প্রিয় মানুষ টার এমন নিদারুণ সত্য, চুড়ান্ত সত্য যে মানতে পারছে না প্রিহান৷ কিভাবে মানবে? তার যে বড্ড পু’ড়’ছে হৃদয়টা! যে মনে এই মানুষটার প্রতি তার ভালোবাসার জোয়ার বইতো এখন সেখানে কেন তোলপাড় হচ্ছে? কেন এই সত্যির মুখোমুখি হতে হলো তাকে? সে নিজেকে সামলে অম্লান বদনে বলে,
‘মালা তুমিও এসবে জড়িয়ে আছো? তুমি এতো নিষ্ঠুর, নির্দয়?’
‘আপনি কেন এখানে আসতে গেলেন প্রিহান? কেন? কেন?’
‘আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এখানে না আসলে কি তোমার আসল রুপ টা আমার কাছে এভাবে পরিষ্কার হতো? ছিঃ তোমার মতো মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করছে।’
‘যত যায় হোক আপনি আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টাকে অস্বীকার করতে পারবেন না।’
‘যে সম্পর্কে প্রথম থেকেই মিথ্যে ছিলো সেই সম্পর্ক কিভাবে টিকবে! আমি কিভাবে তোমাকে চিনতে ভুল করলাম? এতো, এতো কেন মিথ্যা বলেছো?’
‘আপনিও তো মিথ্যা বলেছেন।’
‘আমি মিথ্যা বলেছি?’
‘হ্যাঁ বলেছেন!’
‘কি মিথ্যে বলেছি আমি?’
‘শেবা আপু আপনার বোন এটা তো কখনো বলেন নি? এটা কি তবে মিথ্যা নয়? শেবা আপু আপনার বোন তবুও আপনি নিজে হাতে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। আরও অনেক অনেক মিথ্যা আপনি বলেছেন। অনেক!’
‘আমার মিথ্যা গুলা কি নিতান্তই তোমার করা সব কিছুর কাছে তুচ্ছ নয়? আমার মিথ্যা গুলা তো শুধুই মিথ্যা কিন্তু তোমার মিথ্যা গুলা অ’ন্যা’য়। পা’প! অনেক বেশি ওজনের পা’প। যার ভাড় বইতে পারবে তুমি? তুমি শুরু থেকেই আমাকে ঠ’কা’চ্ছো মালা। কেন করলে আমার সাথে এমন টা। কেন?’
‘আমি কেন কি করছি সে-সব আপনার না জানলেও চলবে। আমি কিন্তু আপনার থেকে দূরেই থাকার চেষ্টা করেছি। কাছে আপনি এসেছিলেন প্রথম।’
‘এসব ছেড়ে দাও তুমি। আমার জন্য শুধু!’
মালা চোখ এদিক সেদিক ঘুরিয়ে কথা ঘুরাতে বলে, ‘আপনি চুপ করে থাকুন। ওঁরা আশেপাশেই আছে যদি ওঁরা জানতে পারে তবে অনেক কিছু হতে পারে। আমি আপনার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগতে দেবো না।’
‘আমি কথা বলবো। একশো বার বলবো। ওঁরা আমার গায়ে আঁচড় দিক। আ’ঘা’ত করুক যা খুশি করুক। এই আ’ঘা’তে যে আমার কিছুই হবে না। এই যে ভেতরে আঁচড়ের পর আঁচড়, ক্ষতের পর ক্ষত, বক্ষ মাঝে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার কাছে এটার ব্যথা ক্ষীন মাত্র।’
কিছুক্ষন চুপ থেকে প্রিহান আবার বলে, তুমিই বা এতো ভাবছো কেন আমার জন্য। তুমিই হইতো নিজে হাতে আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছো।’
“আমি বাঁধিনি। তবে আপনাকে এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে দেওয়া যাবে না।’
‘একবার বলো যে তুমি কেন এমন একটা কাজ করো?’
‘এখনো সময় হয়নি কিছু বলার। আপনাকে চুপ থাকতে বললাম তো।’
‘তুমি বলবা না তাই তো।’
‘না বলবো না।’
‘বলো না প্লিজ! অনুরোধ করছি।’
‘খেয়ে নিন এখন।’ মালা খাবার এনে এগিয়ে দিলো প্রিহানের সামনে।
‘খাবো না।’
‘জেদ করবেন না।’
‘জেদের দেখেছো কি।’
‘আমি কি দেখিনি আপনার জেদ?’
”চাপা কেন করছো তুমি?’
‘আপনিও তো চাপা কম করছেন না। হাত পা বাঁধা সেদিকে খেয়াল নেই এদিকে মুখ ঠিক চালাচ্ছেন।’
‘আমাকে এখান থেকে যেতে দাও ওই নিরীহ মানুষ গুলোকে নিয়ে।’
‘কে নিরীহ? ওই লোকগুলো? হাহ্ আপনি জানেন না ওঁরা কি! তাছাড়া আমি আমার কাজের সঙ্গে বেই’মানি করতে পারি না।’
‘আর আমার সাথে? আমার সাথে বেইমানি করে গেছো সেটা?’
‘এখানে আমি কাজ করছি আপনার থেকে পরিচয় হওয়ার আগে থেকে, আপনার সাথে সম্পর্কের আরও আগে থেকে!’
‘ওহ তার মানে তোমার কাছে আমার থেকেও এই বা’জে,নোংরা, নিষ্ঠুর কাজগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই তো?’
মালা নিরুত্তর রইলো। সে এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারবে না। তাই চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করলো। প্রিহান অসহায়ের মতো ওঁকে চলে যেতে দেখলো। মালা ঘরের দরজা টা আটকে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিলো। চোখ ফেটে কান্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসছে তার। সে বসে পরলো দরজা ঘেসে। হাউমাউ করে উঠলো ভেতরটা।
‘আপনার চেয়েও যে আমি আমার সবচেয়ে আপন একজের জন্য এখানে, এই কাজে যুক্ত হয়েছি। নারীর টান যে বড় টান প্রিয়। আমার জীবন টা আজ এতোটা অগোছালো, এতোটা ছন্নছাড়া কেন? এসব তো জানতে চাইলেন না প্রিয়? হিসেব যে এখনো অনেক বাকি আছে প্রিয়। এখন এখান থেকে বেরোলেই যে ম’র’ন কো’প আপনাকে বেঁধে ফেলবে। তাই আমাকেই যে আপনাকে এই সামান্য কষ্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রিয়। আমি যে আপনার স্ত্রী। যার অস্তিত্বের শুর আছে কিন্তু শেষ নেই। আপনাকে রক্ষ করা আমার কর্তব্য। আপনি আমাকে খুজতে এসে নিজেই বিপদের সম্মুখীন হলেন। কেন এলেন এই নরকে? এখানে একবার কেউ প্রবেশ করলে যে তার এখান থেকে বেরোনো দুষ্কর!’
কথা গুলো আওড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মালা। দরজায় গা হেলিয়ে বসে রইলো সে। দু হাতে মাথার চুল গুলো শক্ত করে চেপে ধরে চাপা আর্তনাদ করলো। যে চিৎকার শুধু সেই শুনতে পেলো। টপটপ করে বাঁধাহীন ভাবে চোখের অশ্রু পরছে।
#চলবে