#রোদের_পর_বৃষ্টি
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৬
জারিফের কথা শেষ হলে নওরিন যা করলো তার জন্য জারিফ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। নওরিন ওর হাত দিয়ে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারে জারিফকে। জারিফ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নওরিন এমন কিছু করবে ও কখনো ভাবে নি। কিন্তু ও জানে ও নওরিনের সাথে অপরাধ করেছে। তাই এটা ওর প্রাপ্য। জারিফ গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে।
নওরিন জারিফের কাছে এসে ওর কলার ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
~ আমাকে কি তুই বাজারের মেয়ে ভেবেছিলি? দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমাকে ভোগ করেছিস। তাও অন্য মেয়ে ভেবে। ছিঃ ছিঃ। ঘৃণা হচ্ছে আমার। যে তোর মতো একটা খারাপ ছেলেকে আমি ভালবাসছি। আমি চেয়েছিলাম, যে তোর যখন শরীর পছন্দ তাহলে আমি সেটা দিয়েই তোকে আমার কাছে রাখবো। তোকে ভালো বানাবো। আর তুই কিনা আমাকে অন্যজন ভেবে ভেবে ভোগ করেছিস। (এলোপাথাড়ি মার দিতে শুরু করে জারিফকে) তুই আমার ভালবাসাকে অসম্মান করেছিস। আমার মন নিয়ে খেলেছিস তুই। তুই জীবনেও কোন দিন সুখী হবি না। অভিশাপ দিলাম তোকে। আর কোন দিন আমার কাছে আসবি না৷ কোন দিন না। তুই যা করেছিস তার কোন ক্ষমা নাই। আর বিদায়? যাহ চির বিদায় দিলাম তোকে।
নওরিন খুব কান্না করতে করতে ওর গাড়িতে উঠে চলে যায়। জারিফ মাটিতে হাটুর উপর বসে পড়ে। কান্নায় ভেঙে পড়ে ওর ভুলের জন্য। নওরিনের সাথে খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে ও। যার সত্যিই কোন ক্ষমা নেই। জারিফ বাসায় আসে। খুব ভেঙে পড়ে ও। এদিকে নাদিয়া আবার জারিফের ফোন অফ পেয়ে সোজা ওর বাসায় চলে আসে। এসে দেখে জারিফ অন্ধকার রুমে বসে একা একা কাঁদছে। একটা পুরুষকে এভাবে কাঁদতে দেখাটা সত্যিই খুব বেমানান। নাদিয়ার বুক ফেটে যাচ্ছে জারিফের এই কান্নায়। নাদিয়া জারিফকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। জারিফ নাদিয়াকে সব বলে। নাদিয়া জারিফের চোখ মুছে দিয়ে বলে,
~ আপনি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এটাই বড়। এখন সে ক্ষমা না করলে আর কি করবেন? আপনিতো অনুতপ্ত। এখন যদি তাঁর ক্ষমার জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে আবার সেই আগুনে যান তাহলে তো সেই আগের মতোই হয়ে যাবে। কান্না বন্ধ করে আমি যা যা বলি তা তা করেন। আপনাকে সব ছাড়তে হবে।
– নাদিয়া…তুমি আমাকে অন্তত ক্ষমা করে দিও। তুমি ছাড়া আমার অার কেউ নেই। এই টাকা পয়সা সয় সম্পত্তি এসব মূল্যহীন। আমার শুধু তোমাকে চাই। আমাকে একা করো না।
~ এই যে আমি আছি তো। সারাজীবন আপনার পাশেই আছি। আমার বাবার জীবন যে বাঁচাতে পারে সে অন্তত বিবেকহীন কিংবা অমানুষ নয়। হয়তো আপনি ভুল করেছেন তা শোধরাবারও সময় হয়েছে। উঠুন। ফ্রেশ হয়ে কিছু খাবেন। কালকে রিহাবে ভর্তি হবেন। সবার আগে সব নেশা ছাড়তে হবে। নাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একজন নেশাখোর কখনো বাবা হতে পারে না। উঠুন৷
জারিফের জীবনের লাগামটা নাদিয়া এবার শক্ত করে ধরে। বাসার সব মদ কিংবা নেশা জাতীয় সব আগুনে পুড়িয়ে ফেলে নাদিয়া। জারিফের পুরো বাসা পরিবর্তন করে ফেলে ও। প্রায় ৭/৮ মাস জারিফ রিহাবে থাকে। অনেক কষ্ট হয় ওর। কিন্তু যখন কারো জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে হয় তখন হাজারটা কষ্ট সহ্য করা যায়। আজ জারিফ সম্পূর্ণ মাদক মুক্ত। রিহাব থেকে আজ ওর মুক্তি। জারিফ রিহাবের বাইরে বেড়িয়ে আসে। এসে দেখে ওর বাবা আর নাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে জারিফ খুব খুশী হয়। ও দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। দুজনের চোখেই পানি। জারিফের বাবা ওকে বলে,
– বাবা আমাকে মাফ করে দে৷ অর্থ আয় করতে করতে আমি তোকে সময়ই দিতে পারি নি। এই যে তোরা নাদিয়া। মেয়েটা আমাকে সব বুঝিয়েছে। তোর মনে যে কতো কষ্ট সব বুঝতে পারছি। আমাকে মাফ করে দে বাবা।
– না বাবা। তুমি মাফ চেয়েও না। শুধু একটু কাছে অার চোখের সামনে থেকো।
– এখন থেকে তোর সাথেই থাকবো। আর আমাদের সাথে থাকবে আমার একমাত্র ছেলের বউমা, নাদিয়া মা।
নাদিয়া বাবা আর ছেলের ভালবাসা দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। ওর মন ভরে আসে। ওরা জারিফের বাসায় চলে আসে। আজ ৭/৮ মাস পর জারিফ ওর বাসায় এসেছে। ও ওর বাসায় ঢুকে পুরো অবাক। এমনকি ওর লোকদের দেখেও। সব পরিবর্তন। আগে সবকিছুতে কালো কালো একটা ভাব ছিলো। কিন্তু এখন সব রঙিন। জারিফের খুব ভালো লাগছে। নাদিয়া মিটমিট করে হাসছে।
সেদিন বিকেলে,
~ জারিফ…উঠুন। আপনাকে এক জায়গায় যেতে হবে।
ঘুমন্ত ক্লান্ত জারিফ উঠে বসে। আর বলে,
– কোথায়?
~ হুজুরের কাছে।
– কেন!
~ তওবা করবেন। এ যাবৎ যা করেছে সব কিছুর জন্য৷
– আচ্ছা। যাবো।
~ উঠে সুন্দর করে সাওয়ার নিয়ে এই পাঞ্জাবিটা পরে আসেন।
– জানো আমি কখনো পাঞ্জাবি পরিনি। এই প্রথম। সত্যি তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি।
~ কথা কম৷ যা বলছি তাই করেন।
– আচ্ছা আচ্ছা।
জারিফ সাওয়ার নিয়ে সাদা কাজ করা পাঞ্জাবিটা পরে নেয়৷ নাদিয়া জারিফকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। চিনাই যাচ্ছে না ওকে। এরপর নাদিয়া জারিফকে নিয়ে সোজা হুজুরের কাছে যায়। হুজুর জারিফকে তওবা পড়ায়। এবং অনেক কিছু বলে। জারিফ হুজুরের সামনে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ওয়াদা করে ও আর কোন খারাপ কাজ করবে না।
এরপর নাদিয়া জারিফকে নিয়ে বাসায় আসে। এখন সময়টা বিকেল। নাদিয়া আর জারিফ ছাদে দোলনায় বসে আছে। জারিফ ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া আস্তে করে বলে উঠে,
~ আমার দায়িত্ব শেষ। আপনি এখন একজন মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন। ঠিক মতো নামাজ পড়বেন। আল্লাহর ইবাদত করবেন। ইসলামিক নিয়ম অনুযায়ী আমি আর আপনার কাছে আসতে পারবো না। যদি কাছে রাখতে চান তাহলে বিয়ে করে রাখতে হবে। অন্যথায় আমি আজকের পর থেকে আর আপনার কাছে থাকতে পারবো না।
বলেই নাদিয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। জারিফ পিছ থেকে ওকে ডাক দেয়। আর বলে,
– কাল তোমার বাবা-মাকে বলো আমি আসছি আমার বাবাকে নিয়ে।
নাদিয়া একটা হাসি দেয়৷ জারিফের দিকে না তাকিয়েই চলে আসে। পরদিন জারিফ ওর বাবাকে নিয়ে নাদিয়ার বাবা-মার সাথে ওদের বিয়েটা ফাইনাল করে আসে। খুব ধুমধামে ওদের বিয়ে হওয়ার কথা হলেও নাদিয়ার ইচ্ছায় ওদের সম্পূর্ণ ইসলামিক নিয়মে বিয়ে হয়। কারণ নতুন এই জীবনের শুরুটা যদি আল্লাহকে নারাজ করে করা হয় তাহলে সামনের ভবিষ্যৎটা খুব খারাপ যায়৷ আর সেটা নাদিয়া চায় না। তাই ওদের বিয়ে ইসলামিক ভাবেই হয়।
আজ ওদের বাসর রাত। একটু আগেই নাদিয়াকে নিয়ে এসেছে জারিফ। জারিফ এখন খুব শান্ত নম্র আর ভদ্র। ও নাদিয়াকে ঠাস করে কোলে তুলে নিয়ে ওর রুমে ঢুকে। তারপর নাদিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে জারিফও নাদিয়ার সামনে গিয়ে বসে। ও আর নাদিয়া চুপচাপ বসে আছে। নাদিয়ার অসম্ভব লজ্জা লাগছে। অন্যদিকে জারিফের মন ভারাক্রান্ত। হবে মনের ভিতরে অশান্তি নেই। আছে একরাশ প্রশান্তি। নাদিয়া লজ্জায় জারিফের দিকে তাকাতে পারছে না। কিন্তু জারিফ মন ভরে আজ নাদিয়াকে দেখছে। হিজাব পরা নাদিয়াকে বেশ সুন্দরী লাগছে। একমাত্র নাদিয়াই সবসময় বোরখা আর হিজাব পরতো। জারিফ নাদিয়ার মিষ্টি ঠোঁটটার কোণায় ছোট্ট কালো তিলটার দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া খুব সাহস করে জারিফের দিকে তাকায়। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাদিয়া মুচকি হাসে। আর বলে,
~ চলুন ফ্রেশ হবো। এভাবে ভালো লাগছে না।
– আচ্ছা৷
~ দাঁড়ান।
বলেই নাদিয়া বেড থেকে নেমে আলমারি খুলে জারিফের জন্য ওর পছন্দের একটা টিশার্ট আর প্যান্ট এনে জারিফের হাতে দিয়ে বলে,
~ জান এগুলো পরে ওজু করে আসেন৷ নামাজ পড়বো।
– ওমা এখন আবার কীসের নামাজ! ইশার নামাজ না পড়লাম।
~ পাগল এটা আমাদের সাংসারিক জীবন যাতে সুখের হয় তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে ২ রাকাত নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করবো। এটা নিয়ম। আল্লাহ খুশী হবেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে চলো।
~ আমি আবার কই যাবো?(অবাক হয়ে)
– কেন চেঞ্জ হতে। আমরা একসাথে যাবো। চলো। (মজা করে)
~ পিটাই সোজা করে ফেলবো। আমার লজ্জা লাগে না বুঝি। যান অন্য রুম থেকে চেঞ্জ করে আসেন।
– আচ্ছা ম্যাম যাচ্ছি।
জারিফ দ্রুত চলে যায় নাদিয়ার ধমক খেয়ে। নাদিয়া খুব হাসে। ও ফ্রেশ হতে চলে যায়। যখন বাইরে আসে দেখে জারিফ ওর রুমে বসে আছে। নাদিয়াকে দেখে জারিফ বাকরুদ্ধ! নাদিয়া নীল শাড়ী পরেছে। ওর ঘন কালো মেঘের মতো চুল গুলো সব ছেড়ে দেওয়া। জারিফ মুগ্ধ হয়ে দেখছে শুধু। নাদিয়া আড় চোখে জারিফকে দেখে লজ্জা পায়। নাদিয়া তাড়াতাড়ি রেডিমেড হিজাব পরে বলে,
~ এই যে পরে দেইখেন আমাকে। আগে আসেন নামাজ পড়ি।
– আচ্ছা।(মুচকি হেসে)
এরপর নামাজ শেষ হলে নাদিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠিক করে নিচ্ছে। জারিফ দূর থেকে ওকে দেখছে। একটা অন্যরকম ভালো লাগা ভালবাসা অনুভূতি হচ্ছে। জারিফ এখন পর্যন্ত নাদিয়াকে ভালবাসি বলে নি। ওর প্ল্যান অনুযায়ী ও আজকে বলবে। একটু পরই। নাদিয়াকে দেখতে দেখতে জারিফের মনটা কেমন খারাপ হয়ে আসে৷ পূর্বের সব খারাপ কাজ গুলো কথা মনে পড়ে মন বিষন্ন হয়ে আসে। হঠাৎ করে নাদিয়া বলে উঠে,
~ এখন যদি মন খারাপ করেন বউও কিন্তু মন খারাপ করে বসে থাকবে। পরে কিন্তু আর আদর টাদর করতে পারবেন না। বলে দিলাম। হিহি। (মজা করে)
জারিফ হাসে। ও সব ভুলে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে নাদিয়ার পিছনে যায়। নাদিয়া ওর চুল আঁচড়াচ্ছিলো। জারিফা পিছনে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। নাদিয়ার চুল থেকে আসা মিষ্টি ঘ্রাণ ও নিতে থাকে৷ এই প্রথম জারিফ নাদিয়াকে আলিঙ্গনে উদ্দেশ্য ছুঁয়েছে৷ যেটা সম্পূর্ণ হালাল। জারিফ পাগল হয়ে যাচ্ছে৷ এদিকে নাদিয়ার মাঝেও ঝড় শুরু হয়েছে৷ পুরো শরীরে অজানা এক শিহরণ অনুভূতি হচ্ছে জারিফের প্রতিটি স্পর্শে।
জারিফ নাদিয়াকে ওর দিকে ঘুরিয়ে ফেলে। নাদিয়া জারিফের বুকের দিকে তাকিয়ে আছে লজ্জায়। জারিফ নাদিয়ার গাল দুটো ধরে ওর চোখে চোখ রাখে। দুজনের চোখে মুখে নেশায় ভরা। জারিফকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। নাদিয়া মন ভরে ওকে দেখছে। ও খেয়াল করে জারিফের চোখ ছলছল করছে। ওকে অবাক করে দিয়ে জারিফ নাদিয়ার কপালের সাথে ওর কপাল লাগিয়ে বলে,
– ভালবাসি তোমাকে। খুব খুব ভালবাসি আমার বউ।
নাদিয়া মুহূর্তেই সক খায়। ও ভাবে নি জারিফ এমন কিছু বলবে। নাদিয়া জারিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। জারিফও। ও নাদিয়ার মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে,
– আমার জীবনের আলো তুমি। ভালবাসা তুমি। ভালো লাগা তুমি। আমার হাসি আমার ভালো থাকা। সব তুমি। তোমার স্পর্শে আমি শান্তি খুঁজে পাই নাদিয়া। অনেক শান্তি।
~ আর আমি খুঁজে পাই সীমাহীন ভালবাসা। যা একান্তই আমার জন্য।
– বলো আজ রাতটা তুমি কীভাবে পার করে চাও?
~ বলবো?
– হুম বলো।
~ আপনার বুকের সাথে মিশে যেতে চাই। আপনার আদর ভালবাসা পেতে চাই। আপনার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই।
– ওরে লুচু মেয়ে৷ তাই নাকি। আচ্ছা আচ্ছা। (মজা করে)
নাদিয়া একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। তাই মনের কথা সব বলে দিয়েছে। এখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। জারিফ আবার মজা করে বলে,
– আমার বউয়ের আদর লাগবে হুম? আমার মাঝে হারিয়ে যেতে চায়? আর কি কি চায় আমার বউ শুনি।
~ এএএএএ….আপনি অনেক পঁচা। খালি লজ্জা দেন। যান আর কথা নাই আপনার সাথে।
বলেই নাদিয়া জারিফকে ছেড়ে যেতে নিলে জারিফ নাদিয়াকে ধরে একটান মেরে ওর মিষ্টি ঠোঁটটাকে একদম ওর করে নেয়। নাদিয়া যেন এটার অপেক্ষায়ই ছিল। দুজন সমান তালে নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুকে জয় করে আজ ওরা মিলিত হয়েছে। মিশে যাচ্ছে একে অপরের মাঝে। দীর্ঘ একটা রাত৷ এখনো অনেক সময় বাকি।
সেদিন রাতের পর থেকে অনেকটা সময় চলে যায়। বলতে গেলে আজ ৬ মাস হয়েছে। নাদিয়া এখন মা হবে। ওর পেটে জারিফের অনাগত সন্তান। নাদিয়া ৪ মাসের প্রেগন্যান্ট। একসময় নাদিয়া জারিফের কেয়ার করতো। এখন জারিফ নাদিয়ার কেয়ার করে। অসম্ভব যত্ন করে নাদিয়ার। ওর খাওয়া দাওয়া, ঘুম, ওয়াশরুম সব জারিফ খেয়াল রাখে৷ সারাদিন নাদিয়াকে সময় দেয় জারিফ। নাদিয়া খুব খুশী এমন একজন স্বামী পেয়ে। খুব ভালোই যাচ্ছিলো ওদের সময়।
কিন্তু এই ভালো সময় হঠাৎ করেই খারাপ সময়ে পরিণত হতে থাকে। নাদিয়ার যখন ৬/৭ মাস চলে ওর শরীর ধীরে ধীরে খুব খারাপ হতে থাকে। প্রচন্ড পেইন আর পুরো শরীরে বারবার পানি চলে আসে৷ নাদিয়ার আর ওদের অনাগত সন্তানের অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। জারিফের চোখ ফুলে নীল হয়ে গিয়েছে কান্না করতে করতে। নাদিয়ার দিকে তাকানোই যাচ্ছিলো না। বড় বড় ডাক্তারের ট্রিটমেন্টের আওতায় আছে নাদিয়া। তাও কেন জানি ওর শরীর ধীরে ধীরে খারাপই হচ্ছে। হাসিখুশী পুরো পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। জারিফকে দেখে এখন চিনাই যায় না। নাদিয়ার এমন অবস্থা যে পেইনের কারণে ওর মায়াবী সুন্দর মুখখানা পুরো নীল হয়ে গিয়েছে। জারিফ আর নিতে পারছে না। নামাজ, রোজা, যাকাত, ছদগা সব করেও নাদিয়া ভালো হচ্ছে না।
এভাবে চলতে চলতে নাদিয়ার ডেলিভারির সময় হয়। এখন নাদিয়ার অবস্থা অসম্ভব খারাপ। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলে দিয়েছেন যে, যেকোন একজনকে বাঁচানো যাবে হয়তো। আবার দুজনই মারা যেতে পারে। কিন্তু কে বাঁচবে তা আল্লাহ ছাড়া অার কেউ জানে না। নাদিয়া চাচ্ছে ওর বাচ্চাটা বাঁচুক। জারিফ চাচ্ছে দুজনই বাঁচুক। নাদিয়ার বাবা-মা আর জারিফের বাবা চাচ্ছে দুজনেই বাঁচুক। কিন্তু হয়তো বাঁচানো যাবে একজনকে৷
নাদিয়া এখন আইসিইউ তে। জারিফ অঝোরে কান্না করছে বাইরে বসে। হাউমাউ করে কান্না করছে। কি থেকে কি হয়ে গেল! ও বুঝতে পারছে এটা কারো অভিশাপ। যার জন্য ওর জীবন থেকে সব চলে যাচ্ছে। জারিফ নাদিয়াকে হারাতে চায় না। তাহলে সব শেষ। এসব ওর পাপের শাস্তি। যা নাদিয়া পাচ্ছে। জারিফের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। অনেক দুর্বল ও। জারিফ পাগলের মতো করছে। ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি কোন ভাবে ওকে শান্ত করতে পারছে না। জারিফ শুধু বলছে,
– এসব আমার পাপের শাস্তি। আল্লাহ তোমার দোহাই লাগে আমার নাদিয়াকে বাচিঁয়ে দেও৷ তোমার দোহাই লাগে আল্লাহ দুজনকে নিও না।
টাকা পয়সা ধনসম্পদ আজ সব কিছু মূল্যহীন। খুব অসহায় আজ সবাই। ওই উপরওয়ালা যা ভালো চাইবেন তাই করবেন। সে ছাড়া আর কেউ নেই। দীর্ঘ চার ঘন্টা পর ডাক্তাররা বেড়িয়ে আসেন। তাদের চোখে মুখে দুঃখের স্পষ্ট ছাপ৷ জারিফের বুকের ভিতরটা এত্তো জোরে কম্পিত হচ্ছে যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাও সবাই যখন বলে,
– ডক্টর কি হয়েছে?
– অামরা একজনকে বাঁচাতে পেরেছি। তবে তাঁর অবস্থাও খুব খারাপ।
জারিফা হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে,
– কে ডক্টর কে?
– আমরা অনেক চেষ্টা করছি দুজনকেই বাঁচাতে৷ কিন্তু পেরেছি শুধু মাকে। আপনার ছেলেটাকে আমরা বাঁচাতে পারি নি। ক্ষমা করবেন। সবাই দোয়া করুন মায়ের জন্য। তাঁর অবস্থাও অনেক খারাপ।
ডাক্তাররা চলে যায়। জারিফ আর ওর পুরো পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। পাপ কখনো ছাড়ে না। প্রকৃতি তার রিভেঞ্জ নিবেই। জারিফ আর নিতে পারে না। ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে আর একসময় অজ্ঞান হয়ে যায়। পুরো পরিবারের জীবনটা যেন অন্ধকারে ঢেকে যায়।
একদিকে জারিফ অসুস্থ আর অন্যদিকে নাদিয়া। জারিফের বাবা আর নাদিয়ার বাবা-মা মিলে অনেক কষ্ট পরিশ্রম করে ওদের পাশে থেকে ওদের সুস্থ করে স্বাভাবিক করে৷ এই জালিম দুনিয়াতে একমাত্র আপন জন যদি কেউ থাকেন, তারা হলেন বাবা মা। জারিফ আর নাদিয়ার বাবা-মা ভেঙে পড়েন নি। সন্তানদের হাত ধরে তাদের আবার সুস্থ জীবনে এনেছেন। বাঁচার আলো দেখিয়েছেন। ওদের স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ এক বছর কেটে যায়।
নাদিয়া আর জারিফ একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। দুইজন যেন জীবন্ত লাশ। দুজনেই হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে। জারিফ আস্তে করে বলে উঠে,
– সব আমার পাপের শাস্তি। একজনের অভিশাপ আমাদের জীবনের সব সুখ কেড়ে নিল। চলো তাঁর কাছ থেকে এবার ক্ষমাটা নিয়ে আসি। নাহলে হয়তো আল্লাহ অামাকে কখনো মাফ করবেন না।
নাদিয়া জারিফের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ হয়ে। জারিফ আবার অনেক কষ্টে নওরিনের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে। ওরা এখন নওরিনের সামনে বসে আছে। নওরিন দুজনকে দেখে স্তব্ধ হয়ে আছে। ও কিছু বুঝতে পারছে না। ওর মধ্যে এখন আর রাগ নেই কেন জানি। জারিফ কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। ওরা চুপচাপ বসে আছে নিচে তাকিয়ে। নওরিন বলে উঠে,
~ তোমাদের দুজনের এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে? আমি তো সরেই গিয়েছি তোমাদের জীবন থেকে। তারপর আবার কি হয়েছে? একি ভাবি কাঁদছেন কেন?
– আমাকে তো তুমি ক্ষমা করো নি। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার শাস্তি আমি পেয়েছি। খুব বড় একটা শাস্তি। আর আমার ভুলের জন্য ও অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমাদের জীবন অন্ধকার হয়ে গিয়েছে নওরিন। সব সুখ শেষ।
~ মানে কি? কি হয়েছে? আমাকে খুলে বলো।
জারিফ কেঁদে দেয়৷ আর সব বলে। নওরিনের চোখ ভিজে যায়৷ ও ভাবে নি জারিফের সাথে এমন কিছু হবে। আসলে খুব কষ্ট পেয়েছিল নওরিন। কিন্তু এখন এসব শুনে ওর পুরো চোখ অশ্রুতে ভরে আসে৷ ও উঠে নাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে স্বান্ত্বনা দেয়৷ আর জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
~ আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। আমার অভিশাপও তুলে নিলাম। আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দেক। আমাকেও তোমরা মাফ করে দেও। ভাবি আমাকেও মাফ করে দেন।
~ আপু আমার ছেলেটা…. ও কোথায় চলে গেল? (কান্না করতে করতে)
নওরিও খুব কান্না করছে। ও কখনো ভাবে নি এমন কিছু হবে৷ ওর খুব খারাপ লাগছে। নওরিন বলে,
– তোমরা আবার বেবি নেও৷ আল্লাহ ভরসা এবার আর কিছু হবে না। সুন্দর একটা বেবি হবে তোমাদের। দেখো তোমরা।
~ আপু আপনি ওনাকে মাফ করে দিয়েছেন তো?
~ করেছি বোন করেছি। আর ওর উপর আমার কোন রাগ ক্ষোভ নেই৷ ও ওর শাস্তি পেয়েছে৷ তোমরা আবার নতুন করে শুরু করো। আমার ভালবাসা তোমাদের সাথে আছে।
~ ধন্যবাদ আপু।
এরপর জারিফ আর নাদিয়া আবার বেবি নেয়। এবার আর কোন সমস্যা হয়না। ওদের ডেলিভারির সময় নওরিন ওদের সাথেই থাকে। জারিফ আর নাদিয়ার অসম্ভব সুন্দর মায়াবী একটা মেয়ে হয়৷ যেন একদম জান্নাতের টুকরা। যার জন্য জারিফ ওর মেয়ের নাম দেয়, জান্নাত। জান্নাত ওদের জীবনে আবার আলো নিয়ে আসে। ওদের সব কষ্ট দুঃখ দূর করে দেয়। খুশীতে ভরে উঠে ওদের জীবন। জারিফ ওর এক বন্ধুর সাথে নওরিনের বিয়ে দেয়। নওরিনও আজ অনেক খুশী। পরিশেষে সবার জীবনেই আবার সুখ চলে আসে৷ রোদের পর বৃষ্টি এসেছিলো জারিফের জীবনে। পাপের শাস্তি পেয়ে দুঃখ নেমে এসেছিলো। কিন্তু সেগুলো বৃষ্টিতে ঝড়ে যায়৷ আজ ওদের জীবনে নতুন সূর্য উঠেছে৷ ওরা আবার একবার নতুন ভাবে সুন্দর জীবন শুরু করে জান্নাতকে নিয়ে।
– সমাপ্ত।
—-> এই গল্পটা লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের সমাজে অনেকেই নারীর দেহ প্রেমী হয়। তাদের খুব লোভ মেয়েদের দেহের প্রতি। যেভাবে হোক একটা মেয়েকে সে নষ্ট করবেই তাঁর চাহিদা পূরণের জন্য৷ অনেক মেয়ের মন ভেঙে জীবন শেষ করে দিয়ে সে তাঁর চাহিদা মেটায়। যা নেহাৎ জঘন্য পাপ। সে জানে না প্রকৃতি তাঁর প্রতিটি পাপের হিসাব রাখে। আর জীবনের একসময় সেসব পাপের শাস্তি তাকে ভোগ করতে হয়। যেমনটা আমার এই গল্পের জারিফ পেয়েছে। একজন বাবা তাঁর সন্তানকে হারিয়েছে। একজন মা যে কিনা ১০ মাস ১০ দিন তাঁর সন্তানকে পেটে ধরেছে সে তাঁর সন্তানকে হারিয়েছে। যা মেনে নেওয়া খুব খুব কষ্টের। এই লেখা পড়ে সে কষ্ট আমি আপনি কখনো কেউ উপলব্ধি করতে পারবো না। কখনো না। তাই এই গল্পটি তাদের জন্য শিক্ষা হিসেবে লিখেছি যাতে আপনারা বুঝতে পারেন, আজ আপনি যা করছেন জীবনের একসময় এর হিসেব আপনাকে দিতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা জারিফকে হয়তো মাফ করে দিয়েছেন নাদিয়ার জন্য। কিন্তু আপনাকে ক্ষমা নাও করতে পারেন। আপনার পরিণত হয়তো খুব ভয়াবহ হতে পারে৷ তাই নারী জাতিকে সম্মান করুন। তারা কোন খেলার বস্তু নয়। তাদের দেহ শুধু উপভোগ করার না। তাদেরও মন আছে। তাদের ভালবাসুন। আগলে রাখুন। এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহর পথে আসুন৷ সে আপনার প্রতি খুশী থাকলে যেটা কখনো কল্পনা করেন নি সেটাও পেতে পারবেন। ধন্যবাদ।
পুরো গল্পটি কেমন লেগেছে আপনাদের তা জানবেন কিন্তু। আমি অপেক্ষায় থাকবো আমার প্রিয় পাঠক/পাঠিকাদের মূল্যবান মন্তব্যের আশায়। ধন্যবাদ সবাইকে এতোটা সময় ধরে সাথে থাকার জন্য। সামনেও থাকবেন আশা করি। আর,
বাসায় থাকুন-আল্লাহর ইবাদত করুন-সবার জন্য দোয়া করুন।
© আবির খান।