#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৬
জাওয়াদ জামী
ছোট ফুপুর ফোন পেয়ে হাসি ফুটে কুহুর ঠোঁটে। মায়ের কোন স্মৃতিই ওর মস্তিষ্কে নেই। ছোট থেকেই বড় হয়েছে দাদা-দাদীর কাছে। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন নাতনিকে আগলে রাখতে। তারা যতদিন বেঁচে ছিলেন ছোটমা তাদের আড়ালে কুহুকে আঘাত করেছে। তারপর যখন দাদা-দাদী দুজনেই একে একে চলে গেল তখন কুহু এ বাড়িতে একা হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় ছোটমার প্রকাশ্য নি’র্যা’ত’ন। সেই সাথে হুমকি দেয় ফুপুরা যেন এসবের কিছুই না জানে। কুহুও তাই ফুপুদের কিছুই জানায়নি। ফুপুরা বছরে দুই-চার এসে বেরিয়ে যায়। কখনও কখনও কুহু যায় ফুপুদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে থেকে আসে কিছুদিন। এই ফুপুরাই ওর প্রান। কুহুর মায়ের শূন্য আসন তারাই পূরণ করেছে।
ফোন একনাগাড়ে বেজেই চলেছে কিন্তু কুহুর সেদিকে হুঁশ নেই। সে একমনে চিন্তা করছে।
ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। পরেরবার ফোনের শব্দ কানে আসতেই রিসিভ করে। ছোট ফুপুর সাথে অনেকসময় নিয়ে কথা বলে কুহু। ছোট ফুপু একটা নতুন জামা বের করে পরতে বলেছে। তার কথামত কুহু তাহমিদের দিদুনের দেয়া একটা নতুন জামা পরে।
এরইমধ্যে শিউলি আক্তার ডাকতে থাকে কুহুকে। কুহু দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। শিউলি আক্তার নিজ ঘরের বারান্দায় ছেলে-মেয়ের পাশে বসে আছে। দৃষ্টি, শিহাব হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। এই সন্ধ্যায় কুহুকে নতুন জামা পরতে দেখে বাঁকা হাসে দৃষ্টি।
” আপু তোমার ভালোই হয়েছে। বছরে কয়েকবার রিলিফের, দানের কাপড় পাও। সবাই জানে তোমার মা নেই তাই তারা ভালোই দান বরাদ্দ রাখে তোমার জন্য। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় যখন খুশি তখনই দানের কাপড় পরতে পার। ” দৃষ্টির টিটকারি যুক্ত কথা শুনে শিউলি আক্তার কিটকিটিয়ে হেসে উঠে। তার সাথে তাল মেলাচ্ছে দৃষ্টিও। শুধু শিহাব অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মা-বোনের দিকে।
দৃষ্টির কথা কুহুর বুকে বিঁধে। ওর মা নেই, অসহায় সেই জন্যই কি সবাই ওকে এত ভালোবাসে, পোশাক দান করে! ও কি সত্যি সবার দেয়া দানের কাপড় পরে! এতটাই অসহায় ও! কুহুর চোখ দিয়ে কখন যে টপটপ করে পানি পরতে শুরু করেছে তা বুঝতেও পারেনি।
ছোট্ট শিহাব এটা বেশ বুঝতে পেরেছে আম্মু আর আপু মিলে কুহু আপাকে কষ্ট দিচ্ছে। ও উঠে কুহুর কোমড় জড়িয়ে ধরে।
” তুমি কেঁদনা আপা। দেখ আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক জামা কিনে দিব। তুমি সেগুলো পরে শেষ করতেই পারবেনা। ” ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে কুহুর দুচোখ আনন্দের অশ্রুতে ভরে যায়। এই ছোট্ট ছেলেটা ওকে খুব বেশি ভালোবাসে তা ও ভালো করেই জানে।
” আমাকে ডাকলে কেন ছোটমা? কোন কাজ আছে? ”
” কেন রে নবাবজাদী কাজ না থাকলে তোকে ডাকা যাবেনা? আমি ডাকলে তোর শরিলে ফো’স্কা পরে বুঝি? তুই কোন লাটের মাইয়া আইছিস যে আমারে প্রশ্ন করস? দিছস তো সামান্য মেট্টিক পাশ তাতেই এত ভাব বাড়ছে! হায়রে কপাল, এমন দিনও আমার দেখন লাগতাছে! ” শিউলি আক্তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে।
কুহু ভেবে পায়না ওর যেকোন সামান্য কথায়ই কেন ছোটমা এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ওর বলা ভালো কথাও ছোটমা কেন বাঁকা ভাবে নেয়! ও কি এতটাই ঘৃণ্য!
শিউলি আক্তারের আহাজারির মাঝেই কুহু নিজের ঘরে আসে। ছোটমার ন্যাকামো দেখার ইচ্ছে ওর মোটেও নেই।
কায়েস রাতে বাড়িতে আসার সময় কয়েক কেজি মিষ্টি, ফলমূল, কুহুর জন্য নতুন পোশাক নিয়ে আসে। বাড়িতে এসেই কুহুকে ডেকে ওর জন্য নিয়ে আসা পোশাকগুলো হাতে দেয়।
এমনিতেই শিউলির মন মেজাজ খিঁচে ছিল তারউপর মেয়ের জন্য এরূপ আদিখ্যেতা দেখে তার মাথায় দা’উ’দা’উ করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠে।
” আদিখ্যেতা দেখছ! যেন তার মাইয়াই খালি পাস করছে! সামান্য মেট্টিক পাশই দিছে তাতেই এত পয়সা খরচ করন লাগবো! দিনরাত খাইট্যা পয়সা রোজগার কইরা একদিনেই সব শ্যাষ কইরা দিল! ” শিউলি আক্তার পারলে কায়েসকে চিবিয়ে খায়।
” শিউলি, একদিন বাজার করলেই আমার সব টাকা শেষ হয়ে যাবেনা। আমি যথেষ্ট রোজগার করি তাছাড়া আব্বাও আমার জন্য অনেককিছুই রেখে গেছে। আমি আমার মেয়ের জন্য খরচ করেছি এ নিয়ে তোমার মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে চাইনা। ” কায়েসও দ্বিগুণ রে’গে জবাব দেয়।
কিন্তু শিউলি স্বামীর কথা শুনলে তো।
” তুমি তোমার মাইয়ার জন্য আনছো। আমার পোলা-মাইয়ার জন্য কি আনছো? তোমার সব কিছুই তো ঐ কালীর জন্য বরাদ্দ। নিজের সন্তানগোর কথা একবারও ভাবো কোনদিন? ” কায়েসকে পাত্তা না দিয়ে আবার গলা চড়ায় শিউলি।
” কুহু, দৃষ্টি, শিহাব তিনজনই আমার সন্তান। তিনজনই আমার কাছে সমান। তোমাকে এর আগেও বলেছি আমার সন্তানদের মধ্যে তুমি বিভাজন সৃষ্টি করবেনা। আর বারবার কুহুকে তুমি ঐ নামে সম্মোধন করবেনা বলে দিলাম। কিছুদিন আগেই যখন শিহাব, দৃষ্টিকে নতুন কাপড় কিনে দিলাম তখন তুমি তো একবারও কুহুর কথা বলোনি? আমি কি তখন তোমাকে দোষারোপ করেছিলাম? আমাকে কিছু বলার আগে তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ। ”
” হ এহন আমারই সব দোষ। আমিই খারাপ। এতদিন যে ঐ মাইয়ারে কোলে-পিঠে কইরা মানুষ করলাম তার বেলায় কিছুই না। আমি আর থাকমুনা এই সংসারে। এই সংসারে ঝাঁটার বাড়ি দিয়া আমি বাপের বাড়ি যামুগা। ” শুরু হয়েছে সেই পুরাতন ডায়লগ। কায়েস বিরক্ত হয়ে নিজে৷ ঘরে যায়।
কুহুর এসব আর ভালো লাগছেনা। ওর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় দূরে কোথাও চলে যেতে যেখানে এই সৎমা নামক বি’ষা’ক্ত ফনা থাকবেনা। যেখানে তার করালগ্রাস থেকে মুক্ত থাকবে কুহু। যেখানে থাকবে শুধুই ভালোবাসা। কুহুর খুব ইচ্ছে করে এই পৃথিবীটা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। যেই পৃথিবীতে থাকবেনা কোন দুঃখ-কষ্ট, রাগ, ঘৃ’ণা, হিং’সা।
চুলে টান লাগায় ভাবনার জগৎ থেকে ছিটকে আসে কুহু৷ শিউলি আক্তার ওর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে কুহুর ঘরে নিয়ে আসে। কায়েসের রা’গ সে ঝাড়বে কুহুর উপর। কুহুকে উঠানে মা’র’লে কায়েস জানতে পারবে তাই ঘরে নিয়ে এসেছে।
” হা’রা’ম’জা’দি তুই তর বাপরে কইতে পারলিনা নতুন জামা নিবিনা? আমার দৃষ্টিরে না দিয়া তুই হাতে নিলি কেন? এত শখ নতুন জামা পরনের? ”
কুহুর দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরেছে শিউলি আক্তার। ব্যথায় কুহুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। শিউলি আক্তারের দুই আঙুল সাঁড়াশির ন্যায় চেপে রেখেছে কুহুর গাল। মুখের ভেতরের অংশ দাঁতের সাথে লেগে কে’টে গেছে বোধহয়। কুহু ব্যথায় ছটফট করছে। ওর শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে। এমনিতেই সকাল থেকে না খাওয়া, সেকারণে বেশ দুর্বল ছিল। আর এখন এভাবে ধরায় ওর শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়। দাঁড়ানো অবস্থায়ই ঢলে পরে শিউলি আক্তারের গায়ে। হঠাৎ এমন হওয়ায় শিউলি আক্তার ভয় পেয়ে গেছে। কুহুর গাল ছেড়ে দিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। টেবিলের উপর থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে কুহুর চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। শিউলি স্বামী ভয় পাচ্ছে এখন যদি কায়েস এখানে আসে তবে অনর্থ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর কুহু একটু স্বাভাবিক হলে শিউলি আক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বাহির থেকে টেনে দিয়ে নিজের ঘরে যায়।
কুহুর কান্না কিছুতেই থামছেনা। কি দোষ ছিল ওর? কেন এত অত্যাচারিত হয় বারবার? নিয়তি কেন ওর সাথে ছিনিমিনি খেলেছে? আরও কতদিন বন্দী হয়ে থাকবে বর্বরতার শেকলে? ওর কি মুক্তি কভু নেই? একটু সুখ কি ওর কাম্য নয়? একের পর এক প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে করছে আজ। কিন্তু উত্তর দিবে কে?
তাহমিদ আজ রাতে আবারও ছাদে এসেছে। পুরো ছাদ হাসনাহেনার গন্ধে ম ম করছে। হাসনাহেনার মাতাল করা ঘ্রানে এক নিমেষেই তাহমিদের মন ভালো হয়ে যায়। আঙুলের ডগা দিয়ে আলতোকরে ছুঁয়ে দেয় ছোট্ট গাছের প্রতিটা ফুল। অজান্তেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে তা টেরই পায়নি।
” ভীতু কন্যা দেখি ফুলও ভালোবাসে! বাব্বাহ্ তার পছন্দও দেখছি খাসা। এমন ফুলকে সে পছন্দ করেছে যে ফুল তার সুবাস দিয়ে সকলকে কাছে টানে। আচ্ছা ঐ ভীতুকন্যারও কি এই হাসনাহেনার মত সবাইকে এমনই ভাবে কাছে টানার গুণ আছে! ” তাহমিদের চোখের সামনে কুহুর ভীতু ভীতু রুপ ভেসে উঠেছে। জ্বলজ্বল করছে ওর চোখদুটো। আজ কি হয়েছে তার! বারবার ঐ ভীতু মুখটা মন-মস্তিস্কে ঘুরঘুর করছে! এত ভালো লাগছে কেন তার কথা চিন্তা করতে!
” আচ্ছা ঐ মেয়েটা যখন জানবে আমি ওর কথা চিন্তা করছি তখন ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? ও কি স্বভাবসুলভ ভাবেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাবে? ওর মুখটা দেখতে তখন কেমন লাগবে? ” তাহমিদের হো হো হাসিতে মুখরিত হতে থাকে পুরো ছাদ।
চলবে…
#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী
রাত নেমেছে ধরিত্রীর বুকে৷ ঘুমে মগ্ন ধরাধাম। রাতও ঘুমিয়েছে অন্ধকারের কোলে। শুধু ঘুম নেই কুহুর চোখে। নানান চিন্তায় ঘুমও ওর আশেপাশে ভিড়ছেনা। আজকাল বাবাকেও কেমন অচেনা লাগে! যে বাবা এক সময় কুহুর উপর ফুলের টোকাটিও সহ্য করতে পারতনা অথচ সেই বাবার সামনে এখন ছোটমা ওকে অহরহ গালাগালি করে। বাবা এসব দেখছে, মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প উচ্চবাচ্য করছে এই যা। আগের সেই বাবা আর আজকের বাবার মধ্যে অনেক তফাত। তবে কি পাশের বাড়ির দাদীর কথাই সত্যি! তিনি যে বলেছিলেন, মা মা’রা গেলে বাবারা পর হয়ে যায়। ওর বাবাও কি ধীরে ধীরে পর হয়ে যাচ্ছে! কথাটা ভাবতেই ওর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। বাবার এই দূরে যাওয়া ও কেমন করে সহ্য করবে! আরও কত ঝড় আসবে ওর এই ছোট্ট জীবনে! আর কত লড়াই করবে! তবে এতকিছুর মাঝে একটা শিক্ষা পেয়েছে, সেটা হলো টিকে থাকতে হলে লড়াই অপরিহার্য। আর একদিন বাবার অনুপ্রেরণা ওর লড়াইয়ের মূল শক্তি ছিল। কিন্তু এখন যদি এই বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া মাথার উপর না থাকে তবে লড়বে কেমন করে? যেখানে মাথার উপর ছায়াই থাকবেনা সেখানে খাঁ খাঁ রোদে, ঝড়-বৃষ্টিতে টিকে থাকাই যে কঠিন। এতকিছু ভেবে কুহুর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আর কতদিন এভাবে ফুপুরা ওকে আগলে রাখবে? তাদের নিজেদেরও সংসার আছে। আর সেই বা কেন বারবার ফুপুদের কাছে যেয়ে নিজেকে ছোট করবে! তবে কি ওর মুক্তি নেই? নিজেকে বন্দী রাখতে হবে অসহায়ত্বের বেড়াজালে! আজ দৃষ্টির কথা শুনে সত্যিই মনে হচ্ছে ও অন্যের দান গ্রহন করতেই জন্মছে। মাথার চুল খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে কুহু। ওর আ’র্ত’না’দ অন্ধকার ঘরেই গুমরে ম’রে। ইট-পাথরের দেয়াল ভেদ করে পৌঁছায়না ওর বাবার কাছে।
সারারাত না ঘুমানোর হেতু সকালে উঠতে পারেনা কুহু। মাথা প্রচন্ড ভারি হয়ে আছে। দুই গাল ফুলে গেছে। সেই সাথে ব্যথাও আছে। ঘুম ভাঙ্গলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছেনা। বিছানা হাতড়ে ফোন নিয়ে সময় দেখে। এগারোটা বাজে! সময় দেখে ওর চোখ কপালে উঠে। এত বেলা হয়েছে অথচ ছোটমা একবারও ডাকেনি! তার কোন আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছেনা! তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গেলেই মাথা ঘুরে উঠে। বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হয় কিছুক্ষণ। বসা অবস্থায়ই আবিষ্কার করে শরীরে হালকা ব্যথার অস্তিত্ব। আজ এত বছরে এই প্রথম ছোটমার ভয়কে উপেক্ষা করে পুনরায় বিছানায় পিঠ ঠেকায়। শোয়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমে দুচোখ বুজে আসে।
শিউলি আক্তার একটু ভয়ে ভয়ে আছে। কাল রাতে কুহুর যেমন অবস্থা হয়েছিল, যদি কিছু হয়ে যেত তবে ননদরা তাকে ছেড়ে কথা বলতনা। আবার সকালে যদি ওর বাবা কিছু বুঝতে পারত তবে বিপদ ছিল। ভাগ্যিস ওর বাবা সকালে মেয়ের সাথে কথা না বলেই দোকানে বেরিয়ে গেছে। আজ আর কুহুকে ডেকে কাজ নেই। তাই নিজেই সব কাজ সেরে নেয়।
কুহু সেইযে ঘুমিয়েছে চোখ খুলে দরজা ধাক্কানের আওয়াজে। এভাবে কে দরজায় আওয়াজ করছে! বিছানা থেকে নামতে গেলেই বুঝতে পারে জ্বরটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সেই সাথে দূর্বলতা রাজত্ব করছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। ততক্ষণে দরজায় ধাক্কানোর আওয়াজ জোরালো হয়েছে।
কুহু দরজার কপাট খুলে দিতেই কয়েকজন ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে।
” সোনা মা, কি হয়েছে তোর? দরজা খুলছিলিস না কেন? তুই ঠিক আছিস সোনা মা? ” আফরোজা নাজনীনের কান্না জড়ানো গলা শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কুহু।
” তুই আমাদের ফোন ধরছিলিনা কেন? তোর গালে কি হয়েছে? হঠাৎ জ্বর বাঁধালি কি করে? ” নাজমা পারভিন অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কুহুর দিকে।
” এই অসময়ে ঘুমিয়ে আছিস কেন? চোখমুখের কি হাল করেছিস! ” শাহনাজ সুলতানার কন্ঠেও উদ্বেগ।
আর এদিকে কুহু তিন ফুপুকে একসাথে দেখে কুহু কিছু বলার ভাষা হারিয়েছে। শুধু চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুধারা।
এই বিকেলে জ্বরের শরীরেও কুহুর গোসল করতে হয়েছে। নাজমা পারভিন পানি গরম করেছেন কুহুর গোসলের জন্য। ওর এমন উসকোখুসকো চেহারা দেখতে তার ভালো লাগছিলনা। তাই কুহুকে গোসল করে, চুল শুকিয়ে চুপেচুপে তেল দিতে হয়েছে।
তিনবোন কুহুর ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছে। নাজমা পারভিন আড়চোখে শিউলি আক্তারের মনোভাব লক্ষ্য করছেন। শিউলি আক্তার ভয়ে ভয়ে ননদদের জন্য রান্নার জোগাড় করছে। দৃষ্টি ওর মাকে টুকটাক কাজে সাহায্য করছে। শিহাব বড় ফুপুর কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ওর হাতের বাটিতে ফুপুদের আনা ফলমূল।
কুহু ফুপুদের আসার আনন্দে গতরাতের ঘটনা ভুলেই গেছে। ও একটু পর পর কোন কারণ ছাড়াই থেকে থেকে হাসছে।
” শিউলি, কি রান্না করছিস? ” গলা চড়িয়ে জানতে চান নাজমা পারভিন।
” তেলাপিয়া মাছের ঝোল, পুঁটি মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা। আইজকা এইগুলান দিয়াই খান। কাইল সকালে মুরগী জবাই দিমুনি। ” গদগদ হয়ে জবাব দেয় শিউলি।
” আমি তো শুনেছি তোর বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসলে তাদের বসিয়ে রেখেই হাঁস-মুরগী জবাই দিস। তারা যে কয়দিন থাকে একবেলাও তেলাপিয়া, পুঁটি মাছ পাতে দিসনা। তারা যদি খালি হাতে আমার বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে পাত পেড়ে খেতে পারে তবে আমরা কি দোষ করলাম? আমরাতো আর খালি হাতে আসিনি। নাকি তোর বাপের বাড়ির আত্মীয় – স্বজনদের মত উপযুক্ত আমরা নই? ” নাজমা পারভিন এমনভাবে কথাগুলো বললেন যেন তিনি শিউলি আক্তারের সাথে গল্প করছেন।
আর এদিকে ননদের ত্যাড়া কথা শুনে শিউলি আক্তারের ঘন্টা বেজে গেছে। সে দৃষ্টির কাছে রান্নার দ্বায়িত্ব দিয়ে দৌড়ে যায় পুকুরের দিকে। কাউকে বলে হাঁস ধরতে হবে।
” নাজু, তুই এসব কি বলছিস? ও যা রান্না করছে করুক না। এমনতো নয় যে তুই খেতে পাসনা। ” আফরোজা নাজনীন একটু বিরক্তির সাথে বলে উঠেন।
” বড় আপা, তুমি চুপ করে থাকো৷ আমি যা বলব বলতে দিবে। কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটবেনা। আব্বার বাড়িতে আমাদের অধিকার নেই! মনে রেখ আমাদের পাওনা সকল সম্পত্তি এখনও নেইনি। আমরা ওদের খাবনা, খাব আমাদের আব্বার। ও যদি ওর বাপের বাড়ির হাভাতেদের রাজ খানা খাওয়াতে পারে, তবে আমরাও পারি নিজ অধিকারবলে খেতে। ” নাজমা পারভিনের গলায় ঝাঁঝ টের পেয়ে চুপ থাকেন আফরোজা নাজনীন। কারন তিনি জানেন তার এই বোনের রাগলে কি হতে পারে।
” বড় আপা, আমিও বলব তুমি চুপচাপ থেকে শুধু দেখে যাও। ওকে মাথায় তুলতে তুলতে তুমি একবারে আসমানে উঠিয়েছ। এবার ওকে একটু মাটিতে নামানো দরকার। তাছাড়া দেখবে একদিন আমারাই এ বাড়িতে অতিথি হিসেবে গন্য হব। ” শাহনাজ সুলতানাও সায় দেয় মেজো বোনের কথায়।
শিউলি আক্তার পাড়ার একজনকে বলে অনেক কষ্টে একটা হাঁস ধরে জবাই করে এনেছে।
দুই মা-মেয়ে মিলে বাছতে বসেছে।
শাহনাজ সুলতানা কুহুকে খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর কুহু একটু ভালো বোধ করলে তিন বোন কুহু আর শিহাবকে নিয়ে বাইরে আসেন।
যেহেতু ছোট থেকেই দৃষ্টি ফুপুদের কাছে খুব একটা ঘেঁষে না তাই ফুপুরাও ওকে নিয়ে তেমন মাতামাতি করেনা। একসময় তারা খুব চেষ্টা করেছেন দৃষ্টিকে কোলে নিতে, তাদের কাছে রাখতে। কিন্তু দৃষ্টির দূরে থাকার কারনে তা হয়ে উঠেনি।
শিউলি আক্তার মুখ কালো করে হাঁস কাটছে।
” আম্মু, মেজো ফুপু তোমাকে এভাবে বলল কিন্তু তুমি কিছু বললেনা কেন? ” দৃষ্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় মায়ের দিকে।
” তুই চুপ থাক। এত বেশি কতা কস কেন তুই? চুপ কইরা কাম কর। ” শিউলি আক্তার ধমকে মেয়েকে থামিয়ে দেয়। কারন সে জানে তার মেজো ননদ কি জিনিস। সে মুখ খুললেই যেন ঝড় বয়ে যায়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই তুফান উঠতে সময় লাগেনা৷ তাই শিউলি আক্তার বেশ সমঝে চলে তাকে। আবার ছোট ননদও কম যায়না। শুধু বড় ননদই একটু নরম স্বভাবের।
ননদরা বাড়িতে আসার আগেই শিউলি আক্তার রান্না সেরে নেয়। অতঃপর বাড়িঘর ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করে। মেজো ননদ নোংরা দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করবে।
তাহমিদ সন্ধ্যায় দাদীর ঘরে আসে৷ তিনি বসে বসে তসবিহ পাঠ করছেন৷
” দিদুন, তোমার সাথে গল্প করতে আসলাম। ” আয়েশা সালেহার কোলে মাথা রেখে বলে তাহমিদ।
” তোর পড়াশোনা নাই? কয়দিন পর পরিক্ষা আর তুই এখন গল্প করতে এসেছিস! এত ফাঁকিবাজ হয়েছিস তুই! ”
” ওহ দিদুন, তুমি অন্তত এভাবে বলোনা। সারা বিকেল পড়েছি। এখন একটু রেষ্ট নিচ্ছি। আচ্ছা দিদুন বড়মা হঠাৎ ফুলতলা গেল কেন? ”
” কেনরে বাপের বাড়ি যেতে বুঝি কারন লাগে। বড় বউমা এত বছর ধরে সংসারে ঘানি টানছে। ওর তো একটু বিরতির প্রয়োজন হয়। খালি দ্বায়িত্ব পালন করেই গেল বেচারি । একটু অবসর কাটানোর সময় পায়নি। তাছাড়া কুহুর রেজাল্ট দিয়েছে। এই সুযোগে মেয়েটাকেও দেখে আসল আবার বেড়ানোও হল। ”
” দিদুন, কুহুর রেজাল্ট কি গো? ” অনেক সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করে তাহমিদ।
” তুই ওর রেজাল্ট শুনে কি করবি? তোর আশেপাশে দাঁড়ানোর মত রেজাল্ট হয়নি ওর। ” দিদুন কন্ঠে উষ্মা প্রকাশ পায়।
” আমিতো শুধু জানতে চেয়েছি আর তুমি এতেই রা’গ করছ! ” মুখ কালো করে জবাব দেয় তাহমিদ।
” ওর পয়েন্ট ৪.৭৫। আমি এসবের কিছুই বুঝিনা বাপু। তবে তোর বড়মা রাতে আফসোস করে বলল, মেয়েটা যদি আরেকটু সুযোগ পেত আরও ভালো করত। ”
তাহমিদ চুপচাপ দিদুনের কথা শুনে। ওর বুকের ভিতর কিছু একটা হচ্ছিল দিদুনের কথা শুনতে শুনতে। কিন্তু কি হচ্ছিল তা বুঝতে পারেনা।
” কি গো দৃষ্টির মা, তোমার জামাই কখন আসবে? আজকাল ব্যবসায় খুব মনযোগী হয়েছে দেখছি। স্বীকার করতেই হয় তোমার দম আছে। যে ছেলেকে আগে ঠেলেও কাজে মনযোগী করা যায়নি সেই ছেলেকে তুমি এসেই বদলে দিয়েছ। তোমার জামাই ভাগ্য গুনে একটা বউ পাইছে বটে। ” নাজমা পারভিনের কথা শুনে শিউলি আক্তার মনে মনে গদগদ হয়ে যায়।
” হেয় আমার জামাই ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে হেয় আপ্নের ভাই। আর আপ্নের ভাই খুব নরম স্বভাবের মানুষ। তারে একটু বুঝাইলেই সব বুঝে। ” হাসিমুখে জবাব দেয় শিউলি।
” হুম নরম স্বভাবের মানুষ জন্যই তো তুমি তাকে তোমার হাতের মুঠোয় নিয়েছ। যা কুহুর মা আইরিন করতে পারেনি। কিন্তু তুমি তা করে দেখিয়েছ। মা হারা মেয়েটাকে বাবার কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ। তোমার হিম্মত আছে। ভাগ্যবতী তুমি, তাই একটা ছোট পরিবার থেকে এই রাজত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছ। ” নাজমা পারভিনের কথা শুনে শিউলির মুখ চুপসে গেছে।
এই কারনেই মেজো ননদকে ভয় পায় সে। সে যখনই মুখ খোলে তখনই শিউলির কলিজায় পেরেক মেরে দেয়।
” তবে সুখ সবার কপালে সয়না বুঝলে। আর লো’ভী, অ’ত্যা’চা’রি, ডা’ই’নি’দের কপালে তো অবশ্যই নয়। কোনদিন যে টুপ করে গর্তে পরবে সেটা গর্তে না পরা অব্দি বুঝতে পারেনা। ” নাজমা পারভিনের কথা শুনে শিউলির বুকের ভিতর টগবগ করে লাভা ফুটতে থাকে কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেনা।
” আপা আপ্নে সব সময়ই আমারে এম্নে কতা কন। আপ্নের একটুও খারাপ লাগেনা? আর আমি এই বাড়িতে একা আসিনাই। আপ্নেরাই আমারে পছন্দ কইরা আনছেন। তারপরও এত কতা কন ক্যা। ”
” ভুল করেছি৷ তোমাকে দেখেশুনে ঐ বলদাটার বউ করে এনে ভুল করেছি। ভেবেছিলাম গরীব ঘরের কোন মেয়ে আনলে আর যাই হোক ঐ মেয়েটাকে আগলে রাখবে। কিন্তু আমার সেই ভাবনা ভুল ছিল। ”
” আমি কি তারে দেইখা রাখিনা! তারে ভালোবাসিনা! এম্নে কইতে পারলেন আপ্নে! তারে ভালো না বাসলে হেয় এতবড় হইছে কেম্নে! তারে এত ভালোবাইসাও, তার আদরযত্ন কইরাও আমি দোষী। দুনিয়ায় ভালোবাসার দাম নাই। ” গলা ছেড়ে আহাজারি করতে শুরু করেছে শিউলি।
আফরোজা নাজনীন বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নাজমার দিকে। এই মেয়েটা শিউলিকে কেন যে এত খোঁ’চা’তে থাকে! ওরা এসেছে দুইদিনের জন্য। দুইদিন পর ওরা যখন চলে যাবে তখন যে কুহুর উপর এর প্রভাব পরতে পারে তা কি বোঝেনা!
চলবে…