#নীলাঞ্জনা
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_শুভ্রতা_জাহান
“থালুজান থালুজান মা বলেতে আমলা নাকি গোলুল মানুস। তোমলাও কি গোলুল মানুস?”
কথাগুলো শুনে আমি আর বাবা দুজনেই বোকার মতো চেয়ে রইলাম বক্তার দিকে। কেনোনা তার কথার আগামাথা কিছুই আমরা বুঝতে পারিনি। কথা গুলো বলেছে আমার খালামনির সাড়ে তিন বছর বয়সি মেয়ে নীল। নাম নীলাঞ্জনা হলেও ছেলে না থাকায় খালামনি তাকে নীল বলেই ডাকেন। সেই সাথে বাকিরাও এটাকেই তার ডাকনাম বানিয়ে ফেলেছে।
আমাদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খালামনি এসে বুঝিয়ে বললেন তার মেয়ের কথাগুলো। সে বলেছে,
“খালুজান খালুজান মা বলেছে আমরা নাকি গরিব মানুষ। তোমরাও কি গরিব মানুষ?”
খালামনির কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো তা ঠিক করতে করতেই দেখতে পেলাম আমার বাবা ফেটে পড়েছেন অট্টহাসিতে। আমিও যোগ দিলাম। পিচ্চিটা বলে কি! গোলুল মানুষ? হাহাহা। আমি নীলকে দেখেছি সেই তার জন্মের এক মাস পর। এর পর আর আসা হয়নি খালামনির বাসায়। যদিও তাঁদের দুই গ্রাম পরেই আমাদের বাড়ি কিন্তু খালামনিদের গ্রামে অনেক খাল, বিল থাকায় বাবা আমাকে আসতে দেননি। কারণ আমি সাঁতার জানতাম না। এই ১০ বছর বয়সে ক্লাস ফাইভ এ ওঠার পর আমার সাঁতার শেখা। নীলের জন্মের পর সেই যে এসেছি আর এই এলাম। সেটাও খালামনির সাদ এর অনুষ্ঠান উপলক্ষে। খালামনির নাকি আবার বাবু হবে। তার জন্য এই উৎসব। যাতায়াত না থাকায় নীলের তোতলা হওয়ার বিষয়টা আমার অজানা। তাই ওর কথা শুনে বেশ মজা পেলাম। ওর কথা গুলোই এমন যে হাসি আটকানো মুশকিল।
আমাদের হাসতে দেখে আবার ঠোঁট ফুলানো শুরু করলে বাবা হাসি থামিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলেন। অতঃপর নীল এর মতো করেই বললেন,
“না মা আমলা গোলুল মানুস নই, আমরা সওদাগর মানুস।”
“তালে তুমি আমাতে পুতুল তিনে দেবে?”
“তোমার পুতুল চাই?”
“হুম তিনতু মা বলেতে আমলা গোলুল মানুস তাই আমাতে পুতুল দিতে পাব্বে না।”
বাবার প্রশ্নে ঠোঁট বাকিয়ে বললো নীল। ওর কথা শুনে আমি জোরে হেসে ফেললাম। আমার হাসি দেখে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে তেড়ে এসে বললো,
“এই এই তে তুমি? আল আমাল ততা ছুনে হাছো তেনো?”
“আমি কেনো হাসছি তা তোকে বলতে হবে?”
“তুমি তো ভালি অছব্য। মুকে মুকে তল্ক কলো।”
“এ্যাহ কোন দেশের মহারানী এনেল গো ওনার সাথে তর্ক করা যাবে না। এই তুই না গোলুল মানুষ? তা তোর এত পুতুলের শখ কেন হ্যাঁ? যা ভাগ, আমার বাবা তোকে পুতুল কিনে দেবে না।”
আমার কথায় নীলের চোখ ছলছল করে উঠলো। ঠোঁট উল্টে একবার আমার দিকে আর একবার বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই কাঁদতে কাঁদতে আমার মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরে দুই পায়ের মাঝে মুখ লুকালো।
মা তাকে কোলে তুলে নিলেন। চোখ মুছে দিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে আমার নামে একগাদা নালিশ করে দিলেন তিনি। এদিকে নীল যাওয়ার পর বাবাও আমাকে ধমকে বললেন কি দরকার ছিলো বাচ্চাটাকে কাঁদানোর। সবসময় বাঁদরামি করতেই থাকো তুমি নভ। এখন বাচ্চাটা কেঁদে কেটে একাকার হচ্ছে। যাও গিয়ে সরি বলো।
যাব্বাবা আমি আবার কি করলাম? আমি তো ঠিকই বলেছি। ও নিজেই তো বললো ও গোলুল না মানে গরিব মানুষ। তাহলে ওর পুতুল কেন লাগবে? এখন সব দোষ নভর! বাহ্। একেই বলে… কি যেন বলে? যাহ ভুলে গেলাম। এই মেয়ে তো মহা বিচ্ছু। আমাকে অসভ্য বলে গেলো আবার বকাও খাওয়ালো। কপাল করে পাওয়া বাবা মা আমার। আমার থেকে ওই নীলময়ীর প্রতি দরদ বেশি। ওই আবার মাজননী আসছেন। তিনিও না জানি কি কি শুনাবেন।
আমার সামনে পিচ্চিটাকে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন মা। তার চোখ মুখে রাগের আভাস। পিচ্চির চোখও কিছুটা ফোলা। আবার কান্না করায় ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। সাংঘাতিক!
“নভ তুমি আমার নীলাঞ্জনা মাকে বলেছো?”
“কই না তো মা। আমি তো শুধু বলেছি তুই যেহেতু গোলুল মানুষ তাই তোর পুতুলের দরকার নেই।”
“ও তোমাকে বলেছে পুতুল কিনে দিতে?”
“না, বাবাকে।”
“তাহলে তুমি কথা কেনো বললে?”
“মা আমি তো শুধু মজা করে…”
“সরি বলো নভ!”
“সরি।”
আমাকে মা বকছে দেখে আর তারপর ওনাকে সরি বলেছি দেখে মুখ ঝামটা দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেলেন তিনি। কি একটা অবস্থা ভাই! আমার থেকে ৬-৭ বছরের ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে ঘোল খাইয়ে দিলো।
যাকগে এখানে থাকলে নীলময়ীর বদৌলতে আরো বকা খাবো তারচেয়ে ভালো আমি খালুজানের কাছে যাই পুকুর পাড়ে। তার মাছ ধরা দেখলেও লাভ আছে। আচ্ছা আমি ওই বিচ্ছুকে নীলময়ী বলছি কেনো? ওর নাম তো নীলাঞ্জনা! তবে সত্যি বলতে নীলময়ী নামটা খারাপ না। বিচ্ছুটার মতোই কিউট। হাহাহা আমি বিচ্ছু বলেছি শুনলে আবার তেড়ে আসবে। আমি বরং যাই।
[ইনি হচ্ছেন নভ সওদাগর। নিহাল সওদাগর ও আনোয়ারা বেগম এর একমাত্র পুত্র। নভর বাবা নিহাল সওদাগর একজন ছোটোখাটো ব্যাবসায়ী। নিজের একটা দোকান আছে তার গ্রামে। বৃত্তশালী না হলেও গ্রামে বেশ সম্মানিত ব্যাক্তি। নীলাঞ্জনা শেখ,নভর মতে নীলময়ী বা বিচ্ছুটা হলো নভর মা আনোয়ারা বেগম এর বোন আলেয়া বেগম এর মেয়ে। আলেয়া বেগম এর স্বামী নওশাদ শেখ। নওশাদ শেখ নিজের জমিতে কৃষিকাজ করেন। সাথে পুকুরে মাছ চাষও আছে। তার অবস্থাও স্বচ্ছল]
“খালুজান আপনার কন্যা নীলময়ী আমাকে বকা খাওয়ালো।”
আমার কথা শুনে খালুজান জাল হাতে ঘাড় ঘুরিয়ে পুকুর হতে দৃষ্টি আমার পানে ফেরালেন। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“নীলময়ী কেডা গো বাজান? আমার মাইয়া তো নীলাঞ্জনা।”
“ওইতো একই হলো। আপনার ওই কন্যার জন্য বাবা, মা আমাকে বকলো। তারপর আবার সেও আমাকে অসভ্য বলেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো সরিও আমাকেই বলতে হয়েছে এবং তা দেখে আপনার কন্যা মুখ ঝামটা দিয়েছে!”
“তুমি ওর উপরে রাগ কইরো না বাজান। ও তো ছোট মানুষ তাই বুঝতে পারে নাই। ওর হইয়া আমি মাফ চাইতাছি।”
“আরে কি বলেন খালুজান। আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম। ওর ওপর রাগ করিনি আমি।”
“আইচ্ছা বাজান বসো তুমি এইহানে। বইসা মাছ ধরা দেহো।”
“খালুজান আমি তো শুনেছি আপনি বাবার সাথে লেখাপড়া করতেন। তাহলে এভাবে কথা বলেন কেনো?”
“আমার ভাল্লাগে বাজান। ছোট বেলায় আমার আম্মায় এমনে কথা কইতো। তিনি লেহাপড়া জানতেন না। কিন্তু আমার আব্বায় জানতেন। আম্মার এমনে গেরামের ভাষায় কথা কওয়ার লাইগা আব্বায় কম কথা শুনায় নাই। আমার জন্মের পরে আর কিছু কইতো না। কইয়াই বা কি লাভ? আম্মা তো আর শুদ্ধ ভাষা শিখতে পারবে না। হেরপর আমারে আমার আম্মায় স্কুলে পাঠাইলেন আর কইলেন আব্বার থেইকা বেশি লেহাপড়া কইরা তারে দেহাই দিতে। আমি আম্মার কথা রাখছি বাজান। আব্বার থেইকা বেশি পড়ছি। কিন্তু আমার আম্মা চইলা যাওনের পরে আর ওই ভাষায় কথা কই নাই। আম্মার পরে আব্বা ম্যালা দিন বাঁচছে কিন্তু সেও শান্তি পায় নাই।”
কথা গুলো বলতে বলতে খালুজানের গলা কেমন ধরে এলো। খেয়াল করলাম আমার চোখেও পানি চলে এসেছে। খালুজানের কথার পরিপেক্ষিতে নিয়ে নিলাম একটা সিদ্ধান্ত। তাকে বললাম,
“আইচ্ছা খালুজান অহন থেইকা আমিও আপনার সাথে এমনে কথা কইবো।”
“কেন বাজান?”
“আমারও ভাল্লাগে খালুজান। কিন্তু বাবা মায় রাগ করে। তাঁদের থেইকা আমাগো আত্মীয় গুলান বেশি প্যাচাল পাড়ে।”
“হাহাহা। ঠিকাছে বাজান। তোমার যেমন ইচ্ছা।”
খালুজান জাল দিয়ে তাঁদের পুকুর থেকে মাছ ধরছেন আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। তখনই তাঁদের পাশের বাড়ির একটা ছেলে ছুটে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে যেতে বললো। কেউ একজন নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ছেলেটার কথা শুনে খালুজান জাল ফেলে ছুটতে শুরু করলেন। তার পেছনে ছুট লাগলাম আমিও।
চলবে….?