হোম পলিটিক্স পর্ব-০৪

0
370

#হোম_পলিটিক্স

#পর্ব_৪

#আফসানানীতু

মনির সাহেব নাস্তা খেয়ে চায়ের আশায় বসে আছেন। এই বাড়িতে সকালের নাস্তা ঠিক আটটায় টেবিলে চলে এলেও, খাবার পরে কোন এক অজ্ঞাত কারণে চা আসতে দেরি হয়। ব্যাপারটা তার স্ত্রীর ক্ষেত্রে যতটা সত্য ছিল এখন তার ছেলের বউয়ের ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। ছেলের বউকে নিয়ে তার বলার কিছু নাই। সে বাচ্চা মানুষ, এই সংসারে এসেছে বেশি দিন হয়নি। কিন্তু তার স্ত্রী আনোয়ারার তো ব্যাপারটা জানা আছে যে, নাস্তা খাবার সঙ্গে সঙ্গে চা না পেলে তার ভালো লাগেনা। অথচ সে ব্যাপারটা আমলেই নেয় না।

তিনি পেপারটা খুলে দ্বিতীয় দফা পড়া শুরু করেন। এমন সময় আনোয়ারা একটা চায়ের কাপ এনে তার সামনে টেবিলে রাখেন।
– তোমার চা।
– যাক বাবা, তোমাদের এতক্ষণে মনে পড়েছে আমাকে চা দেয়ার কথা!
– সকাল সকাল খোঁচাখুঁচি না করে চা খেয়ে নাও তো।
আনোয়ারা বিরক্ত মুখে জবাব দেন।
– হ্যাঁ, তাইতো করতে হবে! ভুলেই গিয়েছিলাম খোঁচাখুঁচির এখতিয়ার এই পরিবারে একলা তোমার। আনোয়ারা কিছু না বলে নিজের চায়ে চুমুক দেন। মনির সাহেব নিজের চায়ে চুমুক দিয়ে মুখটা কালো করে ফেলেন।
– এটা কি সিলেট থেকে নিয়ে এসেছিলাম যেই চা পাতা, সেটা?
আনোয়ারা হ্যা বোধক মাথা নড়েন।
– এই চায়ে তো সুন্দর গন্ধ হবার কথা। অথচ চায়ে না আছে গন্ধ না আছে কোন স্বাদ! এতদিন হয়ে গেল, তবু বুঝলে না চায়ের প্রতি আমার অন্যরকম একটা দুর্বলতা কাজ করে। এটা একটু যত্ন করে বানালেও তো পারো।

যদিও চাটা আনোয়ারা নিজেই বানিয়েছেন তবু তিনি সেটা স্বীকার করেন না। পুরো দোষ রুচিতার উপর চাপিয়ে দিয়ে বললেন,
– চা আমি বানাইনি, তোমার আদরের ছেলের বউ বানিয়েছে। সে সময় কত করে বললাম পরীকে শফিকের বউ করে আনো। তা তো শুনলে না। পরী যা সুন্দর চা বানায় জানো? শুধু চা কেন, সংসারের সব কাজই সে খুব সুন্দর মত পারে। সেইখানে এই মেয়ে তো কিছুই পারে না। খালি মোটা মোটা বই মাথায় নিয়ে ঘুরিয়েছে বাপ মা, সংসারের কোন কাজই সে পারে না। সব কাজে তাকে গাইড করতে হয় আমার, তবু কোন কাজ ঠিকমতো হয় না!
মনির সাহেব তিক্ত কন্ঠে বলেন,
– একই সাবজেক্ট নিয়ে তুমি কত ভ্যা ভ্যা করতে পারো বলতো? রুচিতা যেমনই হোক শিক্ষিত মেয়ে, ভদ্র ফ্যামিলির।
– তো আমার বোনের পরিবার কি অভদ্র?
– অভদ্র না হলেও অশিক্ষিত। পরীর শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই খারাপ!
– কেন, সেও তো অনার্সে পড়ছে।
– পড়ছে, কিন্তু এটাকে কোন পড়ালেখা বলে না। ম্যাট্রিক ইন্টারের রেজাল্ট খুবই বাজে তার, ইন্টারে তো একবার ফেলও করেছে! এমন মেয়েকে যদি আমি ছেলের বউ করে আনি, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবেছ একবার? একটা বাচ্চাও যদি ওই রকম হয় তাহলে কেমন হবে? শুধু চেহারা দেখলেই হবে না, বুদ্ধিও দেখতে হবে। সবকিছু মিলিয়েই মানুষ, বুঝলে?
– তা তোমার বোনের মেয়ে হৃদিতার মধ্যে বুঝি এ সব গুন আছে?
ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে জানতে চান আনোয়ারা।
– অবশ্যই আছে! হৃদিতা ডাক্তারি পড়ছে, লক্ষী মেয়ে! দেখতে রুচিতার মত অত সুন্দর না হলেও ভালো মেয়ে। অভিরূপের সঙ্গে ওকে মানাবে।
– বললেই হল! একটা মোটা বইয়ের কারখানা বাসায় এনে ঢুকিয়েছি, এখন আবার আরেকটা নিয়ে আসি! মাথায় সারাক্ষণ বই নিয়ে ঘুরবে আর শেষমেষ আমাকে বানাবে বাসার বান্দি দাসী। তোমাদের সব বুদ্ধি আমার জানা। আমি একটা সংসারী মেয়ে চাই, বুঝলে?
– সংসারী মেয়ে না বলে বল যে তুমি একটা কাজের বুয়া চাও। সংসারের কাজের জন্য লোক লাগলে ভালো দেখে একটা সংসারী বুয়া রাখো। ছেলের বউ কি ঘরের বুয়া যে তাদের দিয়ে কাজ করাবার জন্য যেমনই হোক শ্রমিক শ্রেণী থেকে হলেও ধরে আনতে হবে?
– খবরদার, বাজে কথা বলবে না! তুমি যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে ছোট করতে চাইছো, সেটা আমি বুঝতে পারছি না মনে করেছ?
– আমি কাউকে ছোট করতে চাচ্ছি না আনোয়ারা। তবে তুমিও বুঝে রাখো, নিজের ঘরের কাজ করলে কেউ বাদি দাসী হয়ে যায় না। সবচেয়ে বড় কথা বাসায় একজন মেম্বার বাড়লে তাকে দিয়ে সব কাজ করাবো সেই আশায় বসে থাকলে তো হবে না, আমার নিজের কাজ আমাকেই করতে হবে।
– তো তুমি নিজের চাটা নিজেই বানিয়ে খেতে পারো। সেটার জন্য আমার আশায় বসে থাকো কেন?
– কেননা বাইরেরটুকু আমি সামলাই তাই আশা রাখি ঘরের কাজটুকু তুমি সামলাবে।
– আমার ছেলেরা কি এটা আশা করতে পারে না?
– অবশ্যই আশা করাটা ভুল কিছু না। তবে এখানে বোঝার একটু ভুল হচ্ছে তোমার। তুমি ঘরের কাজ সামলাবে মানে এই না যে তোমাকেই করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আমি দিয়ে দিচ্ছি। যদি পারো বুয়াকে দিয়েও ঘরের কাজ করাতে পারো। এই যেমন ধরো, আজকে চা যদি বুয়াও বানিয়ে আনতো এবং খাওয়ার যোগ্য হত তাহলে আমি খেয়ে নিতাম। বউয়ের হাতের চা আমাকে খেতেই হবে নইলে মরে যাব এমন শর্ত রাখার মত বোকা লোক আমি না। যাই হোক, অভিরূপ কি হৃদিতার ব্যাপারে কিছু ডিসিশন জানিয়েছে?
আনোয়ারার মেজাজ এমনি গরম হয়ে ছিল তার ওপর আবার তার স্বামীর এই অপ্রিয় বিষয়টি নিয়ে আলাপ বাড়াবার চেষ্টা দেখে সে রীতিমতো লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– তুমি নিজেই তোমার ছেলের সাথে তোমার পেয়ারের হৃদিতার ব্যাপারে আলাপ কর। আমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ কি? আমি তো খুঁজবো কাজের বুয়া,ছেলের বউ না।
আনোয়ারা রেগে মেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান, তাই দেখে মনির সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবেন, তার স্ত্রীর মতো বুনো ঘোড়াকে সে তার পুরো দাম্পত্য জীবনে পোষ মানাতে পারল না, এটা হয়তো তারই ব্যর্থতা।

***
নাফিসার মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে জাফরকে আখের রস তৈরির মেশিনটার ভেতর ঢুকিয়ে আখের মত চেপে চেপে তার রসগুলো বের করে ফেলতে! একটা মানুষ এত বোকা হয় কি করে?
– আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার মোবাইলে কোন স্ক্রিন লক নাই?
– নাই,না! আমি ব্যবহার করি না আর কি।
জাফর বিরস বদনে জবাব দেয়।
– একটা দাম্রা বেটা…
বলেই নাফিসা থেমে যায়। তারপর নিজের ভাষাকে সংযত করে বলে,
– এত বড় একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে হয়ে আপনি মোবাইলে কোন স্ক্রিন লক করেন নাই?
– আসলে দরকার পড়ে না। আমি হোস্টেলে যে রুমে থাকি সেখানে বাকি দুজন রুম মেট আমার জুনিয়র। ওরা ভুলেও কখনো আমার মোবাইল ধরে না। আর তাছাড়া মোবাইল সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, তাই লক করার প্রয়োজন পড়ে না। রাতে ঘুমের সময় মোবাইলটা চার্জে দিয়ে ঘুমাই, তাও তখন সেটা আমার মাথার কাছেই থাকে।
– লক করার যদি প্রয়োজন না’ই থাকতো তাহলে মোবাইল কোম্পানিগুলো লক সিস্টেম রাখছে কেন বুঝান আমারে। একটা মোবাইল আপনি কোন রকম স্ক্রিন লক ছাড়া রেখে দিছেন, আবার সেই মোবাইল দিয়ে আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ছবি চালাচালি করেন? আপনাদের কলিজা তো পুরাই গরুর কলিজার মতো বিগ সাইজের, চার জনে ভাগ করে খেলেও শেষ হবে না!
অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে জাফর।
– জাফর ভাই, আমার কথা শোনেন। চলেন আমরা পুলিশের কাছে যাই।
– তোমার মাথা খারাপ হয়েছে! পুলিশের কাছে গেলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে না?
নাফিসা হতাশ কন্ঠে বলে,
– তাহলে দেন এক লাখ টাকা!
– এক লাখ টাকা যদি দিতেই পারতাম তাহলে কি আমি সরকারি হোস্টেলে ঠাসাঠাসি করে থাকতাম?
– টাকাও দিবেন না, পুলিশের কাছেও যাবেন না! তাইলে করবেন কী?
– পিয়া বলল তুমি একটা সমাধান দিতে পারবে তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি বলো কি করা যায়?
– আমি তো বললামই, চলেন পুলিশের কাছে যাই।
– তুমি যে পুলিশের কাছে যেতে বল, আজকাল পুলিশ কি এতটা সেফ? যদি তারাই পরবর্তীতে আবার আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে?
– পুলিশ আপনাদের ব্ল্যাকমেল করবে কেন? তাদের কি খেয়ে-দেয়ে আর কোন কাজ নাই? তাছাড়া আপনি কোন দেশের কোন টাটা বিড়লা যে টাকার জন্য আপনাকে প্রেসার দেবে? পুলিশ তো জানবেই আপনার টাকা পয়সা নাই, আপনি ফকির কিসিমের। জাফর অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে,
– তুমি বুঝতে পারছ না, পিয়ার বাবা মা জানলে পিয়াকে খুব মা*রবে!
– ও, গার্লফ্রেন্ডরে দিয়া গার্লফ্রেন্ডের মায়ের গয়না চুরি করাতে রাজি আছেন কারণ মায়ের গয়না তার গয়না।অথচ মহিলা নিজের মেয়েরে দুইটা চ*ড় দিবে সেটা সহ্য করতে পারবেন না! শুনেন, কোন বাবা-মা নিজের ছেলেমেয়েকে নিজ হাতে মা*রতে পারে না। হ্যাঁ, দুই চারটা থা*প্পড় দিতে পারে। তো দোষ যখন করছেন চ*ড় থা*প্পর তো খেতেই হবে! কিন্তু একবার ভেবে দেখেন, এই লোক তো আর আপনার মামু লাগে না। সে এক লাখ টাকা পেলেই যে আপনাকে সব ফেরত দিয়ে দিবে তার কোন নিশ্চয়তা আছে? যদি সে পরে আবার টাকা দাবি করে? তখন কোত্থেকে দেবেন?
জাফর চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
– ভ্যাবলার মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না জাফর ভাই। আমি পিয়াকে পুলিশের ব্যাপারে কিছু বলিনি, কারণ ও একটা ভীতুর ডিম। কথা বোঝার আগেই ভয়ে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে যায়। তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করছি। দেখেন, আপনি কিন্তু এখন এক্কেবারে তলোয়ারের ঠিক ফলার উপর দাঁড়িয়ে। যেদিক দিয়েই যান আপনাকে কাটা পড়তেই হবে। ভালো হয় নিজের লোকেদের হাতে কাটা পড়লে। অন্যের হাতে কাটা পরার দরকার কি? আমার আম্মা টুকটাক সমাজ সেবা করে এটা তো আপনি জানেন। অনেকগুলো সমাজসেবা সংস্থার সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। আপনারা যদি মনস্থির করতে পারেন তাহলে ব্যাপারটা আমি আম্মার সঙ্গে আলাপ করি। আম্মা নিশ্চয়ই এটার কোন সুরাহা করতে পারবে।
জাফর নাফিসার কথার জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করা গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর নাফিসা বিরক্ত কন্ঠে বলে,
– কি ব্যাপার, আপনাকে কি আমি এখানে গাড়ি ঘোড়ার সার্কাস দেখতে ডেকেছি? আমার কথার জবাব দেন। নাফিসা তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
– একটু পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আমার বাড়ি ফিরতে হবে তো তাই না?
– নাফিসা , আমাকে একটু সময় দাও। আমি ভেবে তোমাকে জানাচ্ছি।
– ওই লোক নাকি আপনাদের এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা দিতে বলছে?
– হ্যাঁ। পিয়া বলল তুমি নাকি বলতে বলেছো পনের দিনের সময় চাইতে? আমি তাই চেয়েছি।
– জবাবে কিছু বলেছে?
– দিলামই তো দুপুরে!
– ওই লোক আপনার সাথে যোগাযোগ করছে কি ফোনে? ফোন নাম্বারটা আমাকে দেন।
– লোকটা এত বোকা না নাফিসা। সে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জারে আমাকে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে। আমি সিন করে জবাব দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে ওই আইডি ডিএকটিভ করে দিচ্ছে। আজ দুপুরে আমার ডিসিশন জানতে চেয়ে নক দিয়েছিল। তখনই তাকে বলেছি পনের দিন সময় দিতে। কিন্তু সে তার জবাবে কিছু না বলে আইডি ডিএক্টিভ করে দিয়েছে আবার।
নাফিসা ঠোঁট মুড়ে খানিকক্ষণ ভাবে।
– আচ্ছা,ভয়েজ ম্যাসেজগুলো আমাকে দেন।

তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আইডি থেকে তিনবারে তিনটা ভয়েস ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। নাফিসা সেগুলো নিজের মোবাইলে নিয়ে বলে,
– ওই লোক যোগাযোগ করলে তার কাছে সময়ের জন্য কাকুতিমিনতি করেন, যেইভাবে পারেন সময়টা বাড়ান। আমি দেখি কি করা যায়।
– আমাকে অন্তত দুই দিন সময় দেও নাফিসা, আমি ব্যাপারটা নিয়ে আগে ভেবে দেখি।
– ভাবেন, ইচ্ছামত ভবের নদীতে সাঁতার কাটেন। তবে খবরদার পুলিশের ব্যাপারে পিয়ার সাথে কোন আলাপ করবেন না।
জাফর লক্ষী ছেলের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নাফিসার কথায়।

***
অভিরূপের মনটা আজ বেজায় ভালো। হুট করেই বেশ কিছু টাকা হাতে পেয়ে গেছে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। জবের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজও করে সে। একটা কাজ শেষ হওয়াতে আজ হুট করেই টাকাটা হাতে চলে এলো। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর অভিরূপ ঠিক করে সে এই টাকা দিয়ে তার মা আর ভাবীর জন্য শাড়ি কিনবে।
শাড়ি নিয়ে আড়ং থেকে বেরিয়ে সবে গাড়িতে উঠেছে, এমন সময় গাড়ির কাঁচে টোকার শব্দে মুখ তুলে তাকায় অভিরূপ। বাইরে সেদিনের সেই আধ পাগলাটে মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হয় সে। মেয়েটা ইশারায় তাকে গ্লাস নামাতে বলছে। কিন্তু মেয়েটির কথামতো গ্লাস নামানো উচিত হবে কিনা বুঝে উঠে পারে না অভিরূপ। সেদিন মেয়েটাকে রিকশায় তোলার পর কলেজের নাম ছাড়া আর কোন কথা বলেনি মেয়েটা। এমনকি কলেজে নামিয়ে দেবার সময়ও একবারের জন্যও তাকে ধন্যবাদ জানায়নি। রিক্সা থেকে নামলো আর গটগট করে কলেজে ঢুকে পড়ল! অথচ আজ আবার এসে গাড়ির দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে কোন মতলবে কে জানে!
এদিকে জানালার কাঁচ নামাচ্ছে না বলে মেয়েটা ইশারা বাদ দিয়ে এবার মুখ খোলে,
– কি ব্যাপার, দরজা খুলছেন না কেন?
– সরি আমাকে যেতে হবে।
– তো দরজা খোলেন, আমিও আপনার সঙ্গে যাবো তো।
প্রস্তাব শুনে অভিরূপ মনে মনে বেশ অবাক হলেও শান্ত কণ্ঠে বলে,
– সরি, সম্ভব না!
মেয়েটা এবার তাকে আরো অবাক করে দিয়ে হাতের স্টিলের ওয়াটার বটলটা দেখিয়ে বলে,
– দরজা খুলবেন না এটা দিয়ে পিটিয়ে আপনার আদরের গাড়িতে দাগ ফেলে দেবো?
অভিরূপের এবার বিষম খাবার মত অবস্থা! মেয়েটা দেখতে সুন্দর এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু মেয়েটার মাথায় নির্ঘাত ছিট আছে। নইলে কেউ এমন ভরা রাস্তায় অল্প পরিচয়ের কোন লোককে এভাবে হুমকি দিতে পারে? অভিরূপ দরজার লক খুলে দেয়, আর নাফিসা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে এসে বসে। কলেজ ব্যাগটা কোলে রেখে দরজা আটকে দিয়ে বলে,
– চলুন।
– চলবো মানে? কোথায় যাব?
– বাড়ে! আপনি এখন বাসায় যাবেন না? আমিও সঙ্গে যাব। আপনার পাশের বাসাতেই তো থাকি।
– দেখুন, আমি এখন বাসায় যাচ্ছি না।
– ইস্, বাসায় যাচ্ছেন না বললেই হল! এ সময় আর কই যাবেন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে চলুন বাড়ি ফিরে যাই।
– কিন্তু আমার অন্য জায়গায় কাজ আছে, আমি এখনই বাড়ি ফিরছি না। আপনি বরং একটা রিক্সা বা সিএনজি নিয়ে চলে যান।
– বললেই হল! দেখেন, ঐদিন আমি আপনাকে আমার রিক্সায় লিফ্ট দিয়েছি আজকে আপনি আপনার গাড়িতে আমাকে লিফট দেবেন। এতটা অকৃতজ্ঞ হন কি করে আপনি, আশ্চর্য!
– এক্সকিউজ মি! আপনি বলতে চাইছেন ঐদিন আপনি আমাকে রিক্সায় লিফ্ট দিয়েছিলেন?
– অবশ্যই! ঐদিন রিক্সা আমি ডেকেছিলাম, আমি বসার সুযোগ দিয়েছিলাম বলেই আপনি রিকশায় চড়তে পেরেছিলেন।
নাফিসা নাক উঁচিয়ে দাম্ভিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।
– আচ্ছা তো ভাড়া দেয়ার সময় কি সেটা মনে ছিল না? লিফট দিলেন আপনি আর ভাড়া গুনলাম আমি?
– ও বাবা, টাকার গরম দেখাচ্ছেন? এখান থেকে এখানে ভাড়া আর কত! বলেন তো এখনই দিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এইটা তো একেবারে সত্য যে ঐদিন আমি আপনাকে লিফট দিয়েছিলাম। এই কথার কোন প্রতিবাদ করা যাবে না। এখন চলুন বাড়ি যাওয়া যাক।

অভিরূপ নাফিসার আত্মবিশ্বাসে ভরপুর জবাব শুনে তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তাই দেখে নাফিসা তাড়া দেয়,
– কই চলুন!
অভিরূপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে পরাজয় বরণ করে গাড়িতে স্টার্ট দেয়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাফিসা খুশি খুশি কন্ঠে বলে,
– বাই দ্যা ওয়ে আপনাকে তো আমার নামটাই বলা হয়নি! আমি নাফিসা, আপনার নামটা যেন কি? নাফিসার এমন হঠাৎ বদলে বেশ মজা পায় অভিরূপ। কন্ঠে কৌতুক ঢেলে বলে,
– আপনি যে একটু পাগল গোছের সেটা আপনি জানেন নাফিসা?
– ওটা আমার বাড়ির সবাই আমাকে বলে, এটা কোন নতুন ব্যাপার না!
– তাহলে কোনটা বললে আপনার কাছে নতুন ব্যাপার বলে মনে হবে?
– এই যেমন আপনি যদি এখন আমাকে একটা আইসক্রিম অফার করেন আমি না করব না এবং একদম সদ্য পরিচিত হিসেবে আপনি যে আমাকে হুট করে আইসক্রিম অফার করেছেন তার জন্য অবশ্যই একটু অবাক হব!
অভিরূপ গাড়ি চালাতে চালাতে গলা ছেড়ে হাসে। তারপর ভরাট গলায় বলে,
– অভিরূপ, আমার নাম অভিরূপ। তবে বাড়ির সবাই আমাকে অভি বলেই ডাকে। সামনে মুভ এন পিক থেকে দুটো আইসক্রিম পিক করা যায়, কি বলেন নাফিসা?
– বাটারস্কচ আমার ফেভারিট ফ্লেভার। আপনার কোনটা?
অভিরূপ স্মিত হেসে বলে,
– আমার যে কোন একটা হলেই চলবে!

#আফসানানীতু