#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৭
সকালের মৃদু রোদ জানালা ভেদ করে ঢুকে এসে আচড়ে পড়ছে ঘুমন্ত আশ্বিনের চোখ মুখে। ঘুমের ঘোরেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে আশ্বিন। মুহূর্তেই সেই রোদকে আড়াল করতে পর্দা টেনে দেয় অধরা। গতকাল রাতে আশ্বিনের বলা কথাগুলো তার রাতের ঘুমকে হারাম করেছে, অথচ মহাশয়ের চোখে কি দারুণ প্রশান্তির ঘুম!
রুম থেকে বেরিয়ে আসে অধরা। আজ বিকেলে ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকা যেতে হবে তাদের। ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিয়েছে সে। বসার ঘরে বাবা বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। অধরা নিঃশব্দে গিয়ে বসলো উনার পাশে।
‘শুভ সকাল,অধরা মা।’
‘শুভ সকাল,বাবা।’
‘হঠাত দেখি এতো সাত সকাল উঠে পড়েছে আমার মেয়েটা। আশ্চর্য ব্যাপার! বিয়ের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তন করছো নাকি?’
‘তেমন কিছু না বাবা। এমনি’
‘আচ্ছা। শুনেছি আজ ঢাকা ফিরে যাচ্ছো? ভেবেছিলাম সপ্তাহ খানেক থাকবে, কিন্তু আমাদের কোন কথা তুমি শোন কোথায়? যাই হোক, ঢাকা ফিরে গিয়েই হোস্টেল থেকে নাম কেটে আশ্বিনের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠবে। তোমার শ্বশুর বাবার সাথে এই নিয়ে আমার কথা হয়েছে।’
‘হুম।’
ছোট করে উত্তর দিলো অধরা। হোস্টেল ছেড়ে আশ্বিনের ফ্ল্যাটে ওঠার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার। তবুও তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সব করতে হবে, পরিবারের সবাই যখন তাদের সম্পর্কে খুশি তখন তাদের কষ্ট দিয়ে কোনরূপ বিরোধিতা মূলক কাজ করতে চাইছে না সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার সাথে টুকটাক গল্প করে সে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে দুজন রওনা দিয়েছে আশ্বিনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাল রাতের পর দুজনেই প্রয়োজন ব্যথিত একে অপরের সাথে কোনরূপ কথা বলেনি। এমনকি গাড়িতে পাশাপাশি বসেও দুজন নিশ্চুপ। অধরা আড়চোখে বারবার আশ্বিনের গতিবিধি লক্ষ্য করছে, কিভাবে আপনমনে ধ্যান ছাড়া হয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছেন উনি!
বাড়ি ফিরতেই মামুনি আর আরশি হয়ে ধাওয়া করে অধরাকে। সেখানে গিয়ে কি হলো, না হলো সব তথ্য জেনে নেয় অধরার কাছে। এই দুদিনের পরিচয়ে অধরা যতদূর বুঝেছে মা মেয়ে দুজন একে অপরের বান্ধবীর মতোই, এখন তাদের দলে যোগ করতে চাইছেন অধরাকে। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে অধরা।
রুমে বসে অধরাকে টুকটাক কাজে সাহায্য করে গল্পে মেতে আছে আরশি। তার ভার্সিটির সকল বন্ধুদের গল্প করে ইতিমধ্যে অধরার বন্ধুমহলের খবরও জেনে নিয়েছে সে।
‘ভাবি, তুমি মারিয়া আপুকে চেনো? চেনার তো কথা, তোমার এক বছরের সিনিয়র হয়তো।’
থমকে উঠে অধরা। আরশি কীভাবে জানে মারিয়ার কথা? কেননা অধরা আশ্বিনকে যতদূর চেনে সে কখনোই নিজ থেকে মারিয়াকে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিবে না।
‘তুমি চেনো মারিয়াকে?’
‘সেটা আর বলতে? মেয়েটা সারাক্ষণ ভাইয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। একবার তো ভাইয়ার খোঁজখবর নিতে ময়মনসিংহ চলে এসেছিলো। আম্মু তো দেখেই অবাক, একদম পছন্দ করে না মারিয়া আপুকে।’
মারিয়া এখানে এসেছিলো? কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অধরার। বিস্ময়ের চরম শীর্ষ উঠে এসেছে সে।
‘এখানে কেনো এসেছিলো?’
‘জানি না আমি। তবে যেদিন এসেছিলো সেদিন ভাইয়ার আচরণে বুঝেছি, অনেক রেগে ছিলো ভাইয়া তার উপর। মারিয়া আপুকে দেখেছি কান্না আহাজারি করে ভাইয়ার কাছে অনেক বার ক্ষমা চাইতে।’
‘তারপর? তোমার ভাইয়া কি বলেছিলো?’ ‘ভাইয়াকে তো চেনোই, কেমন গম্ভীর। শুধু বলেছিলো ঢাকা ফিরে যাও। আমি এই নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আসলে, আমি আর আম্মু লুকিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে চেয়েছিলাম যে তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো কিনা। কিন্তু না, কথা বার্তায় এমন কিছুই মনে হয়নি।’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা। এখন সব হিসেব তার কাছে পরিষ্কার। এতসব কাহিনী করেও ওই মেয়ে প্রথম থেকেই আশ্বিনের পিছু ছাড়েনি। রাগ হচ্ছে অধরার। কেনো যে এসেছিলো তাদের মাঝে এই মারিয়া নামক অধ্যায়!
মনে পড়ে গেল অতীতের একটি স্মৃতি।
অতীতে:
মাস খানেক হয়েছে স্যারের কথা মতো অধরা আশ্বিনকে অনুকরণ করে চলছে। প্রথম দিকে আশ্বিনের মতো এক শান্তশিষ্ট, নীরব দর্শক ছেলের আচরণ বিরক্ত লাগলেও, এই মাস খানেকের মধ্যেই তার আশ্বিনের এই গুণ ভালো লাগতে শুরু করেছে। কীভাবে ঠান্ডা মাথায়, কম কথা বলে, সবার সাথে মিশে গিয়ে মানুষের আপন হতে হয় তা আশ্বিনকে দেখলে বোঝা যায়।
ক্লাস শেষে মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে অধরা আর তার বন্ধুমহল।
‘কদিন ধরে দেখছি অধরা আশ্বিন ভাইয়াকে চোখে হারায়। অথচ আমাদের তার চোখেই পড়ে না।’
সাদমানের কথায় সম্মতি দিয়ে অনিক অধরার দিকে তাকিয়ে,
‘তুই তো দেখছি স্যারের আদর্শ ছাত্রী হয়ে গিয়েছিস অধরা। এতো ভালো কবে হয়ে গেলি তুই?’
‘আমি সবসময়ই ভালো ছিলাম। তোরা কখনো আমাকে চিনতে পারলি না। হায় আফসোস!’
অধরা ভাব নিয়ে কথাটা বলতেই ইরা হেসে উঠে এতে সম্মতি জানায়। তখনই ক্যাম্পাসের সিঁড়ি দিয়ে একটি মেয়ে নেমে আসে। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশেপাশে সবাই যেন ধ্যান ছাড়া, যেন সে সকলের দৃষ্টিকে আটকে রেখেছে নিজের মাঝেই। এতো সব চাহনীকে অস্বীকার করে, সে পাশ কাটিয়ে নির্বিকার ভাবে হেঁটে চলে যায়।
‘মেয়েটা কে রে ইশা?’
‘নাম মারিয়া জান্নাত। সেকেন্ড ইয়ার। ভয়াবহ রকমের সুন্দরী। শুনেছি সব ছেলেদের ক্রাশ।’
অধরার প্রশ্নে প্রতিউত্তর দিতেই জারিফ রেগে ইশার দিকে তাকায়।
‘কিসের সব ছেলেদের ক্রাশ? এইসব মেয়ে মোটেও আমার আর অনিকের ক্রাশ হতে পারে না। তাই না অনিক? তবে সাদমানের ব্যাপার হলে, আলাদা কথা।’
সাদমান বেচারা সবে মাত্র পানি খেতে নিচ্ছিল, জারিফের কথায় মুখ থেকে পানি ছিটকে পড়ে যায়।
মুহূর্তেই হেসে উঠে অনিক জারিফ আর সাদমান তাকিয়ে থাকে রাগী ভাবে।
—————-
আশ্বিনের পাশে বসে লাইব্রেরীতে একটি লিস্ট করছে অধরা। আশ্বিন খুব মনোযোগ সহকারে খুঁজে খুঁজে একটি একটি করে নাম বলছে, অধরা তাৎক্ষণিক ভাবে সেই নাম কাগজে লিখে ফেলছে।
হঠাত হিল জুতোর খট খট শব্দ করে কেউ একজন লাইব্রেরীতে প্রবেশ করে। শব্দ পেয়ে অধরা খাতা থেকে মুখ তুলে পাশ ফিরে দেখে মারিয়া! সে সবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে আশ্বিনের কাছে এসে,
‘কেমন আছো আশ্বিন? অনেক দিন পর দেখা..।’
মুখ ফিরিয়ে দেখেনি আশ্বিন। সে নিজের মতো করেই কাজ করে যাচ্ছে। অধরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তাদের কাহিনী দেখছে।
‘এইতো ভালো আছি মারিয়া। তোমার কি খবর? অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে এসেছো।’
‘হুম। জানোই তো, বড় আপুর বিয়ে। দেশের বাইরে গিয়েছিলাম শপিং এর জন্য। আশ্বিন, তুমি বিয়েতে আসোনি কেনো? জানো কতো অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য?’
ভেংচি কাটে অধরা। এতো ভাব দেখানো মেয়ে তার কোন কালেই পছন্দের নয়। খাতার ভেতরে মুখ গুঁজে আড়চোখে তাকিয়ে মারিয়ার কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছে সে। একজন সিনিয়র ছেলেকে কিভাবে এতোটা সাবলীল ভাবে নাম ধরে ডাকতে পারে সে?
‘আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই যাওয়া হয়নি। যাই হোক, অধরা এই তিনটি নামও লিখে ফেলো।’
আশ্বিনের কথায় মারিয়ার নজর আসে অধরার দিকে। আশ্বিনকে একটা মেয়ের সাথে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে যায় তার।
‘তুমি কে?’
‘ও হলো অধরা। ফার্স্ট ইয়ার।’
মারিয়ার প্রশ্নে অধরা কিছু বলার আগেই আশ্বিন উত্তর দিয়ে দেয়। চমকে উঠে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে অধরা আশ্বিনের দিকে। কিসব হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তবে মারিয়া যে রেগে আছে, সেটা তার চোখ মুখে একদম স্পষ্ট।
‘কেমন আছেন মারিয়া আপু?’
উত্তর দেয়না মারিয়া। খট খট করে হেটে এসে বসে পড়ে সে আশ্বিনের পাশ বরাবর। খানিকটা দূরে চেপে যায় আশ্বিন। মারিয়ার এমন গায়ে পড়া স্বভাব ভালো লাগছে না তার।
‘কত্তো বড় সাহস! আমার চোখের সামনেই কীভাবে একটি নিরীহ ছেলেকে বিরক্ত করছে এই অসভ্য মেয়ে? নাহ, এ হতে দেওয়া যাবে না। আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।
অধরা চুপচাপ কিছুক্ষণ মারিয়ার গতিবিধি লক্ষ্য করে। মেয়েটা আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করে চলেছে আশ্বিনকে। আর সহ্য হচ্ছে না অধরার।
‘মারিয়া আপু, কিছু মনে করবেন না। আমি আর আশ্বিন ভাইয়া খুব জরুরী একটি কাজ করছি। আপনি নাহয় পরে এসে কথা বলবেন।’
রেগে উঠে মারিয়া। কড়া একটা চাহনি দিয়ে ফিরে তাকায় অধরার দিকে। অধরা সেই দৃষ্টিতে পাত্তা দেয়না। তার মতো এই বি/চ্ছু/র সামনে মারিয়ার মতো আলুর চপ কিছুই না।
‘খুব জরুরী কাজ হলে এটা তোমার মতো এক পিচ্চির করার প্রয়োজন নেই। আমাকে দাও আমি করে দিচ্ছি, আর তুমি এখান থেকে আসতে পারো।’
‘সত্যি করে দিবেন বলছেন?’
‘হুম। দাও আমার কাছে।’
হেসে উঠে অধরা। যা ভেবেছিলো তাই হয়েছে। সে খুশি মনে সব কাগজপত্র মারিয়ার হাতে তুলে দেয়।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপু। আসলে আপনার মুখ দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আপনি অনেক দয়ালু মেয়ে। এখনকার দিনে এমন সিনিয়র আপু পাওয়া খুব টাফ। যাই হোক, আপু কাজগুলো শেষ করে দয়া করে হাসান স্যারের কাছে জমা দিয়ে দিবেন। ঠিক আছে?’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আশ্বিন তাকিয়ে আছে অধরার দিকে। আর কেউ না বুঝলেও আশ্বিন ভালো মতোই বুঝে গিয়েছে অধরার মাথায় কিছু একটা তো চলছে। কিন্তু কি?
আশ্বিনের এই চিন্তার মাঝেই অধরা ব্যাগ গুছিয়ে কাধে নিয়ে এসে আশ্বিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে ফেলে।
‘চলুন আশ্বিন ভাইয়া। মারিয়া আপু সব ঠিকঠাক করে ফেলবে, চিন্তা নেই।’
ভড়কে উঠে মারিয়া। অধরার এভাবে আশ্বিনের হাত ধরায় অবাক হয়েছে সে। আজ পর্যন্ত সে নিজেই কখনো এই সাহস করেনি, অথচ অধরা..! আশ্বিন কেনো কিছু বলছে না?
‘এই মেয়ে! তুমি আশ্বিনের হাত ধরেছে কোন সাহসে? আর আশ্বিনকে এখানে থেকে নিয়ে যাবে কেনো? আমি শুধু তোমাকে যেতে বলেছি।’
‘এটা বললে তো হবে না আপু। হাসান স্যার বলেছেন আমাকে চব্বিশ ঘণ্টাই আশ্বিন ভাইয়ার সাথে থাকতে। যেখানে আশ্বিন ভাইয়া, সেখানেই আমি। আর যেখানে আমি, সেখানে আশ্বিন ভাইয়া। তাই না..?’
উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই আশ্বিনের। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের হাতের উপর অধরার হাতের দিকেই। মুহূর্তেই কেমন যেন ঠান্ডা শীতল হয়ে আসছে এই হাত। কেমন এক অনুভূতি মেশানো আছে এই স্পর্শে।
আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। অধরা দুচারটা কথা বলেই, তার হাত টেনে তাকে নিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে।
লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসেই অধরা আশ্বিনের হাত ছেড়ে দেয়। নিজেকে বড় বীর বাহাদুর মনে হচ্ছে অধরার।
‘দেখেছেন ভাইয়া, কীভাবে আপনার মতো এক অসহায়কে একা পেয়ে বিরক্ত করছিলো ওই মেয়ে। সৌভাগ্য যে আমার বুদ্ধি বেশি। তাই তো আপনাকে সময় মতো নিয়ে চলে এসেছি। উফ, আই এম সো প্রাউড অফ মি। চলুন যাই এই খুশিতে আইসক্রিম খেয়ে আসি।’
অধরা কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই খুশিতে নাচতে নাচতে লাফিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে শুরু করে। আশ্বিন এতক্ষণ আহাম্মকের মতো অধরার কথা শুনছিলো। কি বললো এই মেয়ে? তাকে অসহায় পেয়ে মানে..?
কি বলে, কি করে, কোন কিছুরই ঠিক নেই।
আশ্বিন অজান্তেই হেসে উঠে অধরার দিকে তাকিয়ে। সেও অধরার পিছু পিছু নেমে বলে উঠে,
‘আসলেই একটা পাগলী!’
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)