আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-০৬

0
282

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৬

পরদিন সকাল থেকেই অধরা ঘুরঘুর করছে আশ্বিনের পিছু পিছু। প্রথম দিকে অধরার এমন কিছু করার বিন্দু মাত্র আগ্রহ না থাকলেও, গোপন সূত্রে সে খবর পেয়েছে যে হাসান স্যার তার অগোচরে তারই গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মানুষ ঠিক করে রেখেছেন। তাই বাধ্য হয়ে তাকে স্যারের কথা মতো আশ্বিনের আশেপাশে থাকতে হবে।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে সে চলে যায় আশ্বিনের খোঁজ নিতে। অধরা চলে যেতেই জারিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
‘কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। হাসান স্যার তো অধরার ভালোর জন্যই অধরাকে আশ্বিন ভাইয়ের আশেপাশে থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, দিন শেষে আশ্বিন ভাইয়া না আবার অধরার মতো চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে যায়। তাহলে তো আম ছালা সবই যাবে।’
জারিফের কথায় সম্মতি দেয় সাদমান আর অনিক। তবে ইশা মোটেও এমন কিছু ভাবছে না, অধরার প্রতি বিশ্বাস আছে তার।

অধরার ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও আশ্বিনের ক্লাস এখনও শেষ হয়নি। তাই অধরা কিছুক্ষণ ধরে তাদের ক্লাসরুমের আশেপাশে পায়চারি করে, কিন্তু তবুও ক্লাস শেষ হওয়ার নামই নেই।
‘এক দিনেই ডাক্তার বানিয়ে ফেলবে নাকি? কখন ক্লাস শেষ হবে? দেখা না করে তো হোস্টেল ফিরে যেতেও পারছি না। ধুর!’
বিরক্তির চরম সীমান্ত পৌঁছে যেই না অধরা চলে যেতে নিবে ঠিক তখনই আশ্বিন সহ তাদের ক্লাসের সবাই বেরিয়ে আসে। দূর থেকে আশ্বিন অধরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদ্দুরকে বিদায় দিয়ে তার কাছে আসে।
‘কখন এসেছো?’
‘পনেরো মিনিট আগে।’
‘সরি। আসলে, আমাদের আজ জরুরী ক্লাস থাকায় একটু দেরি হয়েছে।’
প্রতিউত্তর দেয় না অধরা। আশ্বিনও তার উত্তরের অপেক্ষা না করে পুনরায় তাদের ক্লাস রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিনের দেখা দেখি অধরা ধীরে ধীরে তাদের রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। আশ্বিন তখন ল্যাবরেটরি রুম থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন সরঞ্জাম ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে রাখছে।
‘তুমি চাইলে আমাকে সাহায্য করতে পারো।’
পুলকিত হয় অধরা। সে এক ছুটে এসে আশ্বিনের কাজে সাহায্য করতে শুরু করে। কাজের ব্যাস্ততার অভিনয়ে দু একবার আড়চোখে ফিরে দেখে সে আশ্বিনকে। ছেলেটা সত্যিই বড় নিশ্চুপ!
‘আমার কিন্তু মনে পড়েছে, আমি আপনাকে কোথায় দেখেছিলাম। রেণুর বিয়েতে, তাই না?’
‘হুম। ঠিক ধরেছো।’
মিনিট কয়েক নিরবতা বিস্তর করে দুজনের মাঝে। কথার জবাবে কোন উত্তর দিতে না পারায় উসখুস করছে অধরা।
‘আসলে হয়েছে কি, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অনিক রেণুকে অনেক ভালোবাসতো, তাদের ব্রেকআপ হয়ে যাওয়ার পরও সে আশায় ছিলো সব ঠিক হয়ে যাওয়ার। কিন্তু তার আশা ভেঙে যায় রেণুর বিয়ের কথা শুনে। প্রথমে অনিক নিজে গিয়ে রেণুকে অনেকবার বোঝাতে চেয়েছিলো,অনুরোধ করছিলো। কিন্তু লাভ হয়নি। তাই আমরা চেয়েছিলাম রেণুকে বোঝাতে যে অনিক তার জন্য ভেঙে পড়েনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নাচের জন্য যে স্টেজ ভেঙে পড়বে তা ধারণাও ছিলো না আমাদের।’
হেসে উঠলো আশ্বিন, তবে তা নিঃশব্দে। সরঞ্জাম গুলো হাতে তুলে কাধে ব্যাগ নিয়ে সে বেরিয়ে আসে রুম থেকে, পিছু পিছু আসে অধরাও।
‘স্টেজ ভেঙে যাওয়ায় কেউই তেমন অবাক হয়নি। চাচা কোনরকম ভাবে স্টেজ করেছিলেন, তাই নাচ গান তো পরের কথা কাউকে স্টেজে উঠতেও দিচ্ছিলেন না তিনি।’
‘রেণুর বর এখন কেমন আছেন?’
‘ভালো। ভাগ্য ভালো যে গুরুতর আহত হয়নি।’

চুপ হয়ে যায় অধরা। আশ্বিনের পিছু পিছু এসে ল্যাবরেটরি রুমে সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে আসে দুজন।
‘গতকাল স্যার আমাকে বলেছেন তোমার সব কর্মকান্ডের কথা। দেখে বোঝা কঠিন যে তুমি এতোটা চঞ্চল। যাই হোক, শুনেছি ক্যাম্পাসে তোমার মুখ নাকি সবার কাছেই পরিচিত? ব্যাপারটা তো কাজে লাগাতে পারো। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সবাই তোমার সম্পর্কে ভালো জেনে আসলে তুমি ভবিষ্যতে সবার লিডার হতে পারবে। সবাই তোমার কথা মেনে চলবে। আর…।’
কথাটা আর শেষ করা হলো না আশ্বিনের। দুজন পাশাপাশি হেঁটে সিঁড়ির কাছে আসতেই স্বজোড়ে চিৎকার করে ওঠে অধরা। থতমত খেয়ে যায় আশ্বিন। আচমকা কি হলো তার? অধরার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মেয়েকে শাসন করে কথা বলছে,
‘এই! বাগানের ফুল ছিঁড়ছো কেনো? জানো না ফুল ছেঁড়া নিষেধ? যাও ক্লাসে ফিরে যাও, নয়তো আমি বিচার দিবো তোমাদের নামে।’
মেয়ে দুটি ফুল রেখেই দৌঁড়ে চলে যায় ভেতরে। আর রেখে যায় আশ্বিনের চোখ মুখে বিস্ময়!
‘তারা কি তোমার ক্লাসমেট?’
‘আরে না, সেকেন্ড ইয়ার। আমার সিনিয়র। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি যেন বলছিলেন ভাইয়া।’
আর কিছু বলা হয়না আশ্বিনের। মাটির দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরার দিকে ফিরে তাকায় সে। অধরাকে কি বোঝাবে সে? সে তো নিজে একাই একশো। তবে, এটা বুঝতে বাকি নেই হাসান স্যার যেমন অধরাকে দেখতে চান সেই অধরা হতে তার অনেক সময়ের প্রয়োজন।
——————-

বসার ঘরে থেকে হৈচৈ শব্দে অতীতের স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে আসে অধরা।

রুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে বসার ঘরে এসে দেখে সবাই জড়ো হয়ে কাউকে ঘিরে ধরে বসে আছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে আর বেগ পেতে হয়নি তার। আশ্বিন সকলের জন্য উপহার আর হাত ভরা বাজার করে নিয়ে এসেছেন। তাই উপহার পেয়ে ছোটরা বাড়িঘর তোলপাড় করে তুলেছে। অপরদিকে বড়রা সবাই ব্যস্ত জামাই আদরে। অথচ কতক্ষণ হয়ে গেল অধরা এসেছে, খাওয়ার জন্যও ডেকে দেয়নি কেউ।
‘বাবা, এতকিছু নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিল? তুমি এসেছো এতেই তো আমরা খুশি।’
‘এতকিছু কোথায় আম্মু? তেমন কিছুই তো নিয়ে আসতে পারলাম না।’
মুখ ভেংচি দেয় অধরা। এতো আদিখ্যেতা তার সহ্য হচ্ছে না। দুদিনের বরের গুরুত্ব দেখছি তার থেকেও বেশি হয়ে গিয়েছে!
কড়াভাবে একনজর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে রুমে ফিরে আসে সে।

সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
রাতের খাবারের পর অধরার সব ভাই বোনেরা সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আছে অধরার রুমে। দুলাভাইয়ের সাথে গল্প গুজব গান বাজনা করে পরিবেশটা উৎসব মুখর করতে চাইছে তারা। কিন্তু অধরা এসব মানতে নারাজ।
তার ঘরে এসে কেনো এতো কাহিনী করতে হবে তাদের?
রাগে দুঃখে বারান্দার দোলনায় দোল খেতে খেতে পাশের থাই গ্লাস দিয়ে আড়চোখে রুমে বসে থাকা আশ্বিনকে দেখছে সে। কি সাবলীল ভাবে সবার সাথে মিশে গিয়ে গল্প করছেন উনি। অথচ তার সাথে থাকা কালীন কখনো প্রয়োজন ব্যথিত একটা কথাও বলতেন না এই মহাশয়।
দোলনায় হেলান দিয়ে দোল খেতে খেতে মুহূর্তেই চোখ লেগে আসে তার। অজান্তেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় অধরা।

বৃষ্টির পানির ছিটা এসে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় অধরার। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে আবছা ভাবে কাউকে তার মুখ বরাবর বসে থাকতে দেখে সে। মুহূর্তেই সেই ছায়া দূরে সরে যায়, ভালোভাবে চোখ মেলে দূর চেয়ারটায় আশ্বিনকে বসে থাকতে দেখে।
‘ভেবেছিলাম তুমি বৃষ্টি বিলাস করছো, তাই ভাবলাম একসাথে করি বৃষ্টি বিলাস। তারপর এসে দেখি তুমি ঘুম বিলাসে ব্যস্ত। এমন রোমান্টিক আবহাওয়ায় ঘুম কিভাবে আসে তোমার?’
উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙে অধরা। হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে কাধে ব্যাথা হচ্ছে তার। আশ্বিনের দিকে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে,
‘আপনাদের আড্ডা শেষ হয়েছে তাহলে..। আর আবহাওয়া রোমান্টিক হলেও বা কি আসে যায়? আমার কি সেই ভাগ্য আছে?’
অধরা কথাটা বলেই দোলনা থেকে উঠে রুমের দিকে যেতে চাইলে আশ্বিন তার হাত ধরে ফেলে,
‘অধরা, এখনো রাগ করেই থাকবে? আমি তো নিজের ভুল স্বীকার করেছি।’
‘এতো সহজে সব ভুলে যেতে বলছেন? আপনি নিজেই কি বলেননি আমাকে আর কখনও আপনার সামনে এসে না দাঁড়াতে?’
মুহূর্তেই দমে যায় আশ্বিন। অধরা মিথ্যা বলছে না, সেদিন রাগের মাথায় অধরাকে অনেক কথাই বলেছিলো সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে দাঁড়ায় অধরার মুখ বরাবর। চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠে,
‘অধরা, আমি কোন পরিস্থিতিতে কেনো এমন কিছু বলেছিলাম তুমি সব জানো। তখন ভয় আর রাগের মাথায় আমি যা বলেছি তার জন্য পরবর্তীতে অনেক বার ক্ষমা চেয়েছি। তুমি চাইলে এখনও চাইবো অধরা।’
অধরা মেকি হাসি দিয়ে বারান্দার গ্লিল দিয়ে বাহিরে ফিরে তাকায়। বৃষ্টির বেগ এখন কম, তবে আবহাওয়া জানান দিচ্ছে বড় ঝড়ের পূর্বাভাস।
‘আমার আপনার প্রতি রাগ নেই আশ্বিন। তবে, আফসোস আছে। এতো কাছ থেকে আমাকে দেখার পরেও আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমার উপর বিন্দু মাত্র বিশ্বাস আপনার ছিল না, অথচ মারিয়ার কথায় সত্যটা যাচাই না করেই তাকে বিশ্বাস করেছেন।’
দুজনের মাঝেই বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। অধরার মন সায় দিচ্ছেনা এখানে দাঁড়িয়ে অতীতের ভুল শুনতে। সে নীরবে হেঁটে চলে আসে রুমে। খাটের এক প্রান্তে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে সে। চোখ বেয়ে নেমে আসে কষ্টের নোনাজল।

মধ্যরাত!
বাহিরে ঝড় বাতাস সেই সাথে বিদ্যুতের শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় অধরার। কখন যে চোখ লেগে এসেছে খেয়াল নেই তার। উঠে বসে পাশ ফিরে দেখে আশ্বিন নেই, রুমের কোথাও নেই। এতরাতে কোথায় গিয়েছে সে? উঠে দাঁড়িয়ে রুমের বাইরে যেতে নিবে তখনই তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে বারান্দা থেকে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অধরার। ঘড়িতে রাত তিনটে। এতো রাতে কার সাথে কথা বলছে আশ্বিন? আবারও কি মারিয়া?
ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দার দরজার আড়ালে উঁকি দেয় সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বৃষ্টির তালে তালে আপনমনে গান গেয়ে যাচ্ছে আশ্বিন।

“ওহে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে
রাখিব আখিতে আখিতে।।
ওহে এতো প্রেম আমি কোথা পাবো নাহ
এতো প্রেম আমি কোথা পাবো না।
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
আমার সাধ্য কিবা তোমারে,
দয়া না করিলে কে পারে
তুমি আপনি না এলে,
কে পারে হৃদয়ে রাখিতে,
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেনো পাই না।”

অধরা আড়াল থেকে শুনে যাচ্ছে আশ্বিনের গান। মুহূর্তেই মন ভারি হয়ে আসছে তার। আশ্বিনের গান শেষ হয়েছে মিনিট দুএক, নীরবেই বসে আছে সে।
‘আড়াল থেকে বেরিয়ে এসো অধরা। তোমার উপস্থিতি আমি অনুভব করি। লুকিয়ে থেকে আমার অনুভূতিকে অস্বীকার করাতে পারবে না তুমি।’
ভড়কে যায় অধরা। ধুপ ধুপ হৃৎস্পন্দন নিয়ে সে এগিয়ে আসে আশ্বিনের কাছে। ঘোরের রাজ্যে বসবাস করছে আশ্বিন, চোখ জোড়া তার বন্ধ।
‘এতো রাতে এখানে কি করছেন আশ্বিন?’
উত্তর দেয় না সে। চোখ মেলে একমনে তাকিয়ে থাকে অধরার দিকে। অস্বস্তি হচ্ছে অধরার। কি বলবে সে?
‘আমি মায়ার বাঁধনে বেঁধেছি অধরা।
আমি প্রেমের বাঁধনে বেঁধেছি।
আমি তোমায় ভালবেসেছি।’
স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে অধরা। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তার। শীতল এক কম্পন দিয়ে উঠছে হৃদয় জুড়ে। স্মিত হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে আশ্বিন অধরার মুখ পানে।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)