#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ২
অবনি কলেজের জন্য তৈরী হচ্ছিল। ওর মা শিরিন এসে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি কারণে মানা করেছিস ছেলেটাকে?
-কোন ছেলেকে?
-ওমা শেষবার যে আসলো! এতো জলদি ভুলে গেলি?
-একমাসে এতো ছেলের সামনে গেছি যে কোনটা কে ভুলে গেছি।
-নিলয় ছেলেটার কথা বলছি, ওকে কেন বাদ দিলি?
-আছে, সমস্যা আছে।
-কি সমস্যা?
-বলা যাবে না।
-ওমা, চরিত্র খারাপ নাকি?
-না।
-তাহলে?
-মা শোনো, একটা মানুষের চরিত্র খারাপ ছাড়াও আরো সমস্যা থাকতে পারে।
– কিন্তু ছেলেটা তো ভালো, শিক্ষিত, দায়িত্বশীল, পারিবারিক। ভালো পরিবার, ভালো চাকরী তারপরও তোর চোখে সমস্যা ঠেকলো?
-তোমাদের যদি এতোই ভালো লেগেছিল তাহলে আমার সাথে ছাদে কথা বলতে পাঠালে কেন?
-তোদের নিজেদের বোঝাপড়ার জন্য।
-হয়নি আমাদের বোঝাপড়া। কাহিনী খতম।
-খতম কোথায়? ওরা জানতে চেয়েছে কেন মানা করলাম আমরা।
-ওরা মানে কারা?পরিবার নাকি পাত্র নিজে জানতে চায়?
-তা তো জিজ্ঞেস করি নি।
-জিজ্ঞেস করো। পরিবার জানতে চাইলে বলো ওদের ছেলেকে মেয়ে পছন্দ করে নি আর পাত্র নিজে যদি জানতে চায় তবে…
-তবে কি?
-তবে কিছু বলার দরকার নেই আমি গেলাম, কলেজে দেরী হচ্ছে।
অবনি রাজশাহী কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। সাবজেক্ট ইংরেজি। পুরো নাম পারিসা জাহান, ডাক নাম অবনি। রোল নং ২৫০৪৯৬। ক্লাস কয়টায় শুরু, কয়টায় শেষ, কোন কোন সাবজেক্ট কোন কোন সময় শুরু হয় সব খবর নিলয় কলেজের অফিস রুম থেকে নিয়ে নিল। কিন্তু মোবাইল নাম্বার কোনোভাবেই দিতে রাজি হলো না দায়িত্বরত লোকটি। মোবাইল নাম্বার যোগাড় করা আজকাল কোনো ঘটনা? ঘটককে বললেই তো খুশি খুশি দিয়ে দিবে। কলেজ থেকে বেরুবার পথে ঘটলো সবচেয়ে বড় অঘটন। অবনির একেবারে সামনে পড়ে গেল নিলয়। মুখোমুখি হতেই চমকে উঠলো দুজনই। নিলয় সুবোধ বালকের ন্যায় চোখ নামিয়ে বেরিয়ে গেল।
অবনিকে উপেক্ষা করে নিলয়ের চলে যাওয়া স্বাভাবিক ঠেকলো না অবনির চোখে। নিলয়ের মিথ্যা ইগোতে আঘাত করার ইচ্ছে ছিল অবনির, তা সে ভালোভাবেই করেছে। কিন্তু আজ নিলয়ের দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা অবনির মনে অল্প হলেও নাড়া দিলো। অবশ্য যে ছেলে নূন্যতম ভালো আচরণ করতে জানে না তাকে নিয়ে ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অযথা চিন্তা বাদ দিয়ে অবনি সামনে এগুলো।
অবনির ক্লাশ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে অফিস থেকে দরকারী অজুহাত দেখিয়ে নিলয় বেরিয়ে এলো। কলেজ গেটের সামনে বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছটির আড়ালে খুব সাবধানে দাঁড়ালো। ছাত্রজীবনে এমন কাজ করার যেখানে একবিন্দু আগ্রহ জাগে নি সেখানে চাকরী জীবনে এসে এমন কাজ করতে হচ্ছে। লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত। কিন্তু মরার আগে অবনি নামক যন্ত্রণার সমাধান খোঁজাটা বেশি জরুরি।
ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে-মেয়েরা বের হয়ে আসছে। নিলয় তীক্ষ্ণ চোখে অবনিকে খুঁজছে। ওর বুকের স্পন্দন উত্তেজনায় দ্বিগুন হয়ে আছে। নিজেও জানে না এমন কর্মে তার কী এমন আরাধ্য লাভ হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অবনি আরো দুই বান্ধবী নিয়ে বেরিয়ে এলো। নিলয় সাথে সাথে নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে নিল। গেটের কাছে এসেই অবনি ফুচকার ভ্যানের সামনে দাঁড়ালো।
এই পড়ন্ত দুপুরে কেউ ফুচকা খায়? তাও আবার এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। নাহ, এই মেয়ে নির্ঘাত গ্যাসটিক বাঁধাবে কিংবা অলরেডি বাঁধিয়ে ফেলেছে। সামান্য রুচিবোধ থাকা মানুষও এমন কাঠফাটা গরমে ফুচকা খায় না। মেয়েটা একেবারে যাচ্ছে তাই!
ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটার বের করায় কিছুটা স্বস্থি পেল নিলয়। যাক এটুকু স্বাস্থ্যজ্ঞান অন্তত আছে। কিন্তু পরক্ষণে নিলয়কে হতাশ করে আরেক প্লেট ফুচকা নিল অবনি।
নিলয়ের ইচ্ছা হলো অবনির সামনে দাঁড়িয়ে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে, আর কত খাবি রে ফুচকা খাদক! পুরো ভ্যানটাই গলায় ঢুকিয়ে দে না। সুন্দরী মেয়েদের পেট খারাপ করেছে কথাটা কত জঘন্য শোনায়, তা কি বুঝিস?
হঠাৎ করে মস্তিস্কে বিপদসংকেত টিউ টিউ করে জানান দিলো । গেট থেকে নদী বের হচ্ছে । এই মরেছে, একবারো কেন মাথায় এলো না একই কলেজে নদীও পড়ে!
নিলয় নিজেকে আড়াল করার আগেই নদীর চোখে ধরা পড়লো। ভাইকে দেখে হাসিমুখে এগুতে লাগলো নদী।
নিলয় উল্টো ঘুরে দ্রুত পা চালালো।
-এই ভাইয়া, এই…
নিলয় গতি বাড়ালো।
ভাইয়া… থাম না… এই ভাইয়া….
এবার নিলয় রীতিমতো ছুট দিল। ইজ্জত আজ একেবারে ফালুদা!
নদী পেছনে ছুটতে ছুটতে চেঁচালো, ভাইয়া, দৌড়াচ্ছিস কেন?
নিলয় এবার ঝেড়ে দৌড় দিল রাস্তা বরাবর।
পরিচিত মিস্ত্রি বিল্লালকে রাস্তায় পেয়ে এক লাফে ওর বাইকে চেপে বসলো।
-বিল্লাল, জোরে টান দে.. ..
বিল্লাল তালবেতাল হয়ে কোনোভাবে বাইক সামলে বলল, কি হইছে নিলয় ভাই? আপনে এখানে কেন? কী ঘটনা?
-চুপ শা*লা, জলদি টান দে…
-ভাই, এই বাইকের তো স্পিড নাই। টেস্ট করতেই তো বাইর হয়েছি।
-তাইলে তুই নেমে পেছন থেকে ঠেলা দে। আমাকে জলদি পালাতে হবে।
-কই যাবেন ভাই? কি সমস্যা?
-বলা যাবে না। তুই টান দে নয় ঠেলা দে..
-আরে ভাই, মোচড় দিচ্ছে পেটে? বড়টা লেগেছে? সামনে পাবলিক টয়লেট আছে, কাজ সারতে পারবেন। কলেজের ভেতরেও টয়লেট…..
-চুপ শা*লা, কথা কম বল। আজ আমার দিনটাই খারাপ।
অফিস শেষ হলেও নদীর ভয়ে বাসায় ফিরলো না নিলয়। নিশ্চয়ই নদী ঘাপটি মেরে বসে আছে নিলয়ের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ বাইরে অযথা হাঁটাহাটি শেষে মাকে কল দিয়ে জানলো নদী তার বান্ধবী তিন্নির বাসায় গেছে।
এই সুযোগে ঘরে ঢুকেই নিলয় সবার আগে শার্টপ্যান্ট পাল্টে নিল। এগুলো কোথায় লুকাবে ভেবে বালতিতে বেশি করে সাবানের গুড়া দিয়ে ফেনা তুলে শার্টপ্যান্ট দুটো ভিজিয়ে দিল। কিন্তু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারলো না। পরক্ষনেই মনে হলো যে ত্যাদর বোন নদী, এসে ঠিক সব জায়গা পরোখ করে দেখবে। জলদি সাবানযুক্ত শার্টপ্যান্টগুলো তুলে পলিথিনে মোড়ালো। কোথায় লুকাবে ভেবে ভেবে শেষে আলমারির উপর রেখে দিলো। এটুকু কাজেই উত্তেজিত নিলয় ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে।
ততোক্ষণে নদী ফিরেছে। ভাইয়া ভাইয়া বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নিলয়ের রুমে ঢুকল। সোজা প্রশ্ন করল, আমার কলেজ কেন গিয়েছিলি?
-তোর কলেজ? মাথা কি তোর নষ্ট নাকি আমার নষ্ট?
-আমার মাথা ঠিকই আছে। তুই ঘটনা লুকাচ্ছিস। আমাকে দেখে পালালি কেন?
-আমি ওদিকে যাই ই নি। আমার অফিস ছেড়ে আমি কেন তোর কলেজ যাবো?
নদী কথা না বাড়িয়ে নিলয়ের হ্যাঙ্গার চেক করল, আলমারি ঘাটল, এমন কি বাথরুমের ভেজা কাপড়গুলোও নেড়ে দেখল।
-তোর আজকের পরনের শার্ট কই?
– ওখানে, বালতিতেই ভেজানো।
– আজ তুই এটা পরে বের হসনি।
– আমি এটাই পরেছি। অযথা গোয়েন্দা গিরি করবি না।
-এই অবেলায় কাপড় ভিজিয়েছিস কেন?
— কারন ওটাতে পাখি হাগু করে দিয়েছে।
– মিথ্যা কথা। তোর যে স্বভাব! হাগু পড়লে এসেই তুই ধুয়ে ফেলতি। এভাবে ভিজিয়ে রাখতি না।
নিলয় রাগ দেখিয়ে বলল, কারণ আমি চাই তুই নিজেও কিছু কাজ করা শিখ। বসে বসে মোটু হচ্ছিস। যা, আমার কাপড়গুলো ধুয়ে দে। জলদি ধুয়ে দে, এখুনি দে।
-আহারে… আমার ঠেকা পড়েছে। নদী রুম ছেড়ে পালালো।
নিলয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।