ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
231

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৩
পরের দিন সকালে সৌমিক অফিসে চলে যাওয়ার পরেও মিতা দের ছাদের দিকের জানলাটা খুললো না অপর্ণা, সামান্য কারণে সৌমিকের সঙ্গে তার মতোভেদ হোক এটা চাইছিলো না সে। আগের দিনের মতোই দুপুরে খাওয়ার পরে সে পড়তে বসেছিলো, পড়তে পড়তে যে কখন বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো অপর্ণা টেরও পায়নি, সম্বিত ফিরলো অনিন্দিতার ডাকে, সে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

কি মনোযোগ দিয়ে পড়ছিস রে! কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তুই দেখতেই পাচ্ছিস না!

অপর্ণা খুশি হলো অনিন্দিতা কে দেখে,

দিদিভাই! ঘুম হয়ে গেছে? এসো এসো ভেতরে এসো!

অনিন্দিতা ঘরে এসে খাটের এক পাশে বসলো, চারিদিকে তাকিয়ে বললো,

ঘর গুছিয়েছিস নাকি? বেশ পরিস্কার লাগছে তো!

অপর্ণা হাসলো,

কি আর করবো বলো, কতক্ষন পড়বো আর! কিছু তো করতে হবে, তাই গোছানো ঘর কেই আবার গোছাই! মা তো পুরোপুরি কিছু দায়িত্ব দিচ্ছে না আমাকে! দিদিভাই! আমার না বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে, আমার জন্যে ওদের মা ছেলের মধ্যে অশান্তি হচ্ছে, আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না! তুমি জানো না আমি সারাদিন কি খারাপ লাগা নিয়ে কাটাই, একেক সময় মনে হয় কাউকে না বলে চলে যাই বাড়ি!

ধুর বোকা! ওদের নিজেদের মধ্যে যা হচ্ছে হতে দে! ঋজু তো তোকে যেতে বলেনি তাহলে তোর ওসব নিয়ে ভাবার দরকারই নেই! তুই নিজের মতো থাক, আর তো কটা দিন! এখন আর দায়িত্ব নিতে হবে না, পড়াশুনা কর! ফিরে এলে বুঝবি কতো কাজ! তখন উল্টে পালাই পালাই করবি!

অপর্ণা হেসে ফেললো,

সত্যি! তুমি যে একা হাতে কতো কিছু করো, আমি অবাক হয়ে যাই! তুমি অফিস করে এতো কিছু সামলাও কি করে গো? আর কতো দিন ছুটি আছে তোমার?

অনিন্দিতা একটু অবাক হলো,

আমি চাকরি করি এটা তোকে কে বললো?

অপর্ণা হাসলো,

কেনো! আমাকে দেখতে গিয়ে তো বলেছিলো সবাই! তাই তো নাকি তুমি আমাকে দেখতে আসতে পারো নি!

অনিন্দিতা মাথা নাড়লো,

না রে! তুই ভুল জানিস! বিয়ের আগে করতাম, বিয়ের কিছুদিন পরে ছেড়ে দিয়েছি!

অপর্ণা অবাক হলো,

এমা! কেনো! চাকরি কেউ ছাড়ে নাকি! ইস! কলকাতায় থাকো, কতো সুবিধা তোমার! তাও চাকরি ছেড়ে দিলে! আমাদের ওখান থেকে লোকে কতো কষ্ট করে চাকরি করতে আসে জানো!

অনিন্দিতা ম্লান হাসলো,

কলকাতায় থাকলেই কি আর চাকরি করা যায়! তার জন্যে বাড়ির সাপোর্ট লাগে বুঝলি!

কেনো? দাদা কি তোমাকে চাকরি করতে দেয় না, নাকি এখানে সবাই আপত্তি করে?

অনিন্দিতা হাসলো,

কেউ বারণ করে না, আপত্তিও করে না! কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যে তুই কিছুতেই চাকরি করতে পারবি না!

অপর্ণা অবাক হলো,

মানে!

ধর যদি তোকে সকালে নটায় অফিসে পৌঁছাতে হয় তাহলে প্রায় রাত তিনটে থেকে উঠে সব কাজ করে তবে অফিসে বেরোতে পারবি। ফিরতে যত দেরি হোক না কেনো তোকেই এসে তোর দায়িত্বে থাকা কাজগুলো করতে হবে! বাড়িতে অতিথি এলে ছুটি নিতে হবে, সে অফিসে যত অসুবিধাই থাকনা কেনো! যদি কোনোদিনও দেরি হয়ে যায় তাহলেও কেউ তোকে তোর কাজ একটুও কমিয়ে দিয়ে সাহায্য করবে না! এগুলো ঠিক বলে বোঝানো মুশকিল, তুই যখন এখানে থেকে পড়াশুনা করতে শুরু করবি তখন এই সমস্যাগুলো বুঝতে পারবি! বিয়ের পরে মাস দুয়েক করেছিলাম, প্রতিদিন লেট, নিত্য নতুন সমস্যা, বাড়িতে অশান্তি, শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিলাম!

অপর্ণা বুঝতে চেষ্টা করছিলো,

তাই বলে ছেড়ে দিলে, আমি হলে কিছুতেই ছাড়তাম না! দাদা কিছু বললো না?

অনিন্দিতা মুখ নিচু করলো,

ও বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে চায় সব সময়! বললেই বলবে তোমাকে তো কেউ চাকরি ছাড়তে বলেনি, তুমি ছাড়লে কেনো? কিন্তু সমস্যার সময় এগিয়ে আসবে না কখনো! অথচ চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিলো জানিস তো! বাবা নেই, মাকে একটু হেল্প করতে পারতাম ওটা দিয়ে, বোনের পড়াশুনার খরচ আছে, মায়ের একার পক্ষে এতটা টানতে খুব অসুবিধা হয়!

অপর্ণার মনটা খারাপ হয়ে গেলো,

মাসিমা তো খুব অসুবিধায় থাকেন তাহলে! চালান কি করে সবটা?

অনিন্দিতা চকিতে বাইরের দরজার দিকে তাকালো, গলা নামিয়ে বললো,

তোকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলবো, কাউকে বলবি না প্লিজ! ঋষি দেয় অনেকটা, কিন্তু এখানে কেউ জানে না! জানতে পারলে প্রচণ্ড অশান্তি হবে জানি বলেই কিছু একটা করার কথা ভাবি সব সময়! কিন্তু কিযে করবো আর কখন সময় পাবো কাজের মধ্যে সেটাই বুঝতে পারিনা!

দাদা তো খুব ভালো তাহলে, কিন্তু চাকরি ছাড়ার সময় কিছু বললেন না!

বিস্মিত গলায় বললো অপর্ণা, অনিন্দিতা মাথা নাড়লো

নাহ! ও কোনো বিতর্কে জড়াবে না! সবাই কে খুশি করে চলতে চায়! ঋজু কিন্তু ঋষির মতো নয় জানিস তো! এই বাড়িতে ওই একমাত্র মায়ের ভুল গুলো কে ভুল বলে! বাকিরা মুখ বন্ধ করে থাকে!

অপর্ণার খারাপ লাগছিলো সে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,

আচ্ছা দিদিভাই, এই পাশের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কি তোমরা কথা বলো না? ওই বাড়ির মেয়েটা নাম মিতা, আমার সঙ্গে ছাদ থেকে কথা বলছিলো তাই মিনতি মাসি বললো!

অনিন্দিতা কেমন যেনো চমকে তাকালো,

মিতা এসেছে নাকি! তোর সঙ্গে কথা বললো? কি বললো তোকে?

অপর্ণা হাসলো,

হ্যাঁ, এসেছে তো! ওই তো বললো ও নাকি দিল্লিতে থাকে! বললো ও ঋজুর বেস্ট ফ্রেন্ড!

অনিন্দিতা একটু থতমত খেলো,

হ্যাঁ, ছিলো আগে, এখন মায়ের সঙ্গে বোধহয় ওর বাবার কোনো সমস্যা হয়েছে, তাই ওদের সঙ্গে মা কথা বলে না! আর মা যার সঙ্গে কথা বলে না তার সঙ্গে এ বাড়ির সবার কথা বলা বারণ! তাই আমরা কেউ বলি না, ঋজুও না!

অপর্ণা অবাক হলো,

আচ্ছা! তাই ও বললো ও নাকি আগে সৌমিকের বন্ধু ছিলো!

অনিন্দিতা খাটের চাদরে আঁকি বুকি কাটতে কাটতে বললো,

একটা কথা বলবো, রাগ করবি না তো? তুই না ওই মিতার সাথে কথা বলিস না! মা জানতে পারলে রাগারাগি করবেন!

অপর্ণা হাসলো,

জানতে পারলে কি গো! জেনে গেছে ইতিমধ্যেই, মিনতি মাসি বলে দিয়েছে! কাল আমাকে ডেকে কথা বলতে বারণ করেছিলেন মা! কিন্তু আমি সৌমিক কে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি কথা বললে ওর আপত্তি আছে কিনা, ও তাতে কোনো আপত্তি জানায়নি!

অনিন্দিতা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চাপলো,

ঋজু আপত্তি জানায়নি! তাহলে আর কি বলবো! তবে দিদি হিসেবে একটা কথা বলবো যে সব বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করার কোনো দরকার নেই বুঝলি! মা যখন চান না তখন ঋজু আপত্তি না করলেও তুই কথা বলিস না! আর ঋজু একটু অন্য রকম বুঝলি তো! ও অতো ভেবেচিন্তে কিছু করে না, ও মাকেও মাঝে মাঝে খুব কড়া সমালোচনা করে! মা ও যেটা বলে সেটা মেনে নেন, বলা ভালো ওর জেদের জন্যে মেনে নিতে বাধ্য হন! কিন্তু তাই বলে তোর জেদ কে কিন্তু কিছুতেই মেনে নেবেন না! মিছিমিছি অশান্তি বাধবে, ঋজু তো বলেই খালাস! ও তো অফিসে চলে যাবে তুই কিন্তু বাড়িতে থাকবি, অশান্তি তোকেই ফেস করতে হবে এটা মাথায় রাখিস!

অপর্ণা হাসলো,

হুঁ! মাথায় আছে সেটা, সেই জন্যেই তো আর ওই জানলাটা খুলছি না! না খোলা থাকলে আর কথা বলার সুযোগ পাবে না! কিন্তু কি এমন হলো দিদিভাই যে বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে মুখ দেখা দেখি বন্ধ হয়ে গেলো?

অনিন্দিতা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো,

ওরে বাবা! কথায় কথায় কতো দেরি হয়ে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো! নিচে যাই, চা বসাতে হবে!

অনিন্দিতা চলে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে একটা অচেনা নম্বর থেকে অপর্ণার নম্বরে ফোন এলো, হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকে সৌমিকের গলা পাওয়া গেলো,

আমার একটু দেরি হবে ফিরতে, রবির বাড়ি হয়ে ফিরবো, ও ডেকেছে আমাকে, বললো স্বপনের ব্যাপারে কথা বলবে। মাকে একটু জানিয়ে দিও আমার ফিরতে দেরি হবে!

অপর্ণা অবাক হলো, ওর নম্বর সৌমিকের কাছে ছিলো! ও তো এখনও সৌমিকের নম্বর জানে না! একটু চুপ করে থেকে বললো,

এটা কি তোমার নম্বর? আমার কাছে আসলে তোমার নম্বর টা ছিলো না, তাই বুঝতে পারছি না!

সৌমিক অবাক হলো,

মানে? তোমার কাছে আমার ফোন নম্বর নেই! তুমি চাওনি কেনো এতদিন! আমি তো ভাবছিলাম তুমি নিশ্চয়ই বাড়ির কারো কাছে চেয়ে নিয়েছো! আমি তো কবে তোমার মামার কাছ থেকে তোমার নম্বর চেয়ে নিয়েছি!

অপর্ণা লজ্জিত হলো, অস্বস্তি নিয়ে বললো,

সরি! সত্যি আমারই ভুল হয়েছে! চেয়ে নেওয়া উচিত ছিলো! আচ্ছা স্বপনের কথা কি বলছিলো রবি দা?

সৌমিক গলায় তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করলো,

জানিনা এখনও, গেলে জানতে পারবো! তবে কি আর বলবে, ওই ওকে ধমকেছে মনে হয়! ফিরে এসে বলছি তোমাকে, এখন রাখছি!

অপর্ণা ফোন রেখে দৌড়ে নিচে নামলো, তাকে নামতে দেখে চায়ের টেবিলে বসা প্রত্যেকেই চোখ তুলে তাকালো, মিনতি সাবধান করলো,

ছোটো বৌমা! আস্তে! পড়ে যাবে কিন্তু!

রীনা বিরক্ত মুখে তাকালেন,

ওই ভাবে দৌড়ে নামছ কেনো! পড়ে গেলে তো শ্বশুরবাড়ির নামেই বদনাম হবে! কি হয়েছে?

অপর্ণা সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়লো, শাশুড়ির তীর্যক খোঁচা সহ্য করে নিয়ে বললো,

সৌমিক ফোন করেছিলো, বললো ওকে রবিদা ডেকেছে তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হবে!

রীনা টেবিলে রাখা হাত সরিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসলেন, মিনতির দিকে ইশারা করে বললেন,

বাড়ির ফোন টা কি খারাপ নাকি? দেখোতো একবার!

মিনতি ঘাড় নাড়লো,

না, ঠিকই তো আছে! একটু আগেই তো ফোন এলো!

রীনা ভ্রু কুঁচকে অপর্ণার দিকে তাকালেন,

বাড়ির ফোনে না করে তোমার ফোনে করেছে কেনো! এরকম তো হবার কথা নয়! রবি কি জন্যে ডেকেছে ওকে? বললো কিছু? সাংঘাতিক কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই! তাই ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না!

অপর্ণা আর আগের দিনের মতো বোকামি করলো না, নিরীহ মুখে ঘাড় নাড়লো,

না সেরকম তো কিছু হয়েছে বলে মনে হলো না! শুধু বললো দেরি হবে আসতে আর সেটা আপনাকে জানিয়ে দিতে! হয়ত বন্ধুর সঙ্গে এমনই গল্প করতে যাচ্ছে!

রবি ঘরেই আছে জানা ছিলো আগেই সৌমিক সোজা দোতলায় উঠে এলো, পর্দা সরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

দেরি হয়ে গিয়েছিলো তাই অফিস থেকে সোজা এলাম, কাকিমা কে চা বসাতে বল!

রবি সৌমিক কে ঘরে ঢুকতে দেখে অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো,

তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি, আমি ভাবছিলাম বাড়ি হয়ে আসবি! মা বাড়িতে নেই, বেরিয়েছে!

সৌমিক হাসলো,

তাতে কি? চল বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি! তুই চায়ের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলি নাকি? মুখটা ওরকম করে আছিস কেনো?

রবি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো,

মিতা এসেছে, নিচে চা করছে! আসলে তুই যে এতো তাড়াতাড়ি এসে যাবি ভাবিনি আমি!

আমি কাল আসবো!

সৌমিক দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো, দরজা দিয়ে বেরোনোর আগেই মিতা এক হাতে চায়ের ট্রে আর এক হাতে দরজার পর্দা সরাতে সরাতে ঘরে ঢুকে এলো, সৌমিকের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

কেমন আছিস?

সৌমিক চমকে উঠে তাকিয়েই চোয়াল শক্ত করলো,

ভালো!

মিতা হাসলো,

তোর বউয়ের সঙ্গে আলাপ হলো, বেশ ভালো মেয়ে! আমার কথা বলেছে তোকে?

সৌমিক একটুও হাসলো না, গম্ভীর হয়ে বললো,

হুঁ!

সৌমিক এর গম্ভীর মুখ দেখে মিতার মুখও গম্ভীর হলো, খানিকটা তীর্যক গলায় বললো,

তোর মার তো দেখলাম এই বউও পছন্দ হয় নি! তা এর বাবা কে কি কি বললো?

সৌমিক উত্তেজিত হলো, চাপা গলায় বললো,

অহেতুক তোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই! তুই তো দেখছি সব জানিস! এতো যখন জানিস তখন তো এটাও বুঝেছিলি যে মায়ের ব্যবহারের পেছনে আমার কোনো হাত ছিলো না!

মিতা ঘাড় নাড়লো,

নাহ! সেটা বুঝিনি! তুই যদি ভেবে থাকিস তোর মা আমার বাবা, মা কে যা খুশি বলবে আর আমি সেটা মুখ বন্ধ করে মেনে নেবো তাহলে তুই ভুল ভেবেছিস!

কথাগুলো যে শুধু বলার জন্যেই বলছিস সেটা তুই ভালোই জানিস! তোর বাবা, মা অপমানিত হয়েছেন বলে কিন্তু আমিও মা কে অনেক কিছু বলেছিলাম…

আরে! দাঁড়া দাঁড়া! তুই তোর মাকে ঘরের বন্ধ দরজার আড়ালে কি বলেছিলি সেটা তোর মুখে শুনেছি শুধু, নিজের চোখে কিছু দেখিনি কিন্তু! অথচ তোর মা কিন্তু গোটা পাড়ার সামনে আমার বাবা, মা কে অপমান করে গিয়েছিলো!

সৌমিক কে থামিয়ে দিয়ে বললো মিতা, সৌমিক মাথা নাড়লো,

জানতাম সেটা, সেই জন্যেই আমি তোর বাবা, মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উনিও তো একই ব্যবহার আমার সঙ্গে করলেন, যা আমার মা করেছেন! সেই কথাও তো গোটা পাড়া জেনেছিল! তাহলে আর ফারাকটা কোথায় থাকলো! উল্টে উনি আমাকে হাজারটা শর্ত দিলেন।

তো? শর্ত দেবে না? ওই ব্যবহারের পরেও আমি তোর বাবা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো? ওনাদের সঙ্গে থাকবো? কি ভাবিস তুই আমাকে, আমাদের কি কোনো সম্মান জ্ঞান নেই নাকি?

সৌমিক হাত তুললো,

এক সেকেন্ড! তুই কি আমাকে এতো দিন পরে ভিলেন সাজাতে চাইছিস!

মিতা চায়ের কাপ সৌমিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে তীর্যক হাসি হাসলো,

তুই ভিলেন কোথায়, তুই তো নায়ক! তোকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্যেই তো তোর মায়ের এতো প্রচেষ্টা ছিলো! আমি দিল্লি চলে যাওয়াতে যে উনি কতো খুশি হয়েছেন সেটা আমার থেকে বেশি আর কে জানে!

সৌমিক মাথা নাড়লো, কড়া গলায় বললো,

চা খাবো না! শোন অপমানিত যতটা তোর বাবা হয়েছেন, ঠিক ততটা অপমানিত আমিও তোর বাবা, মায়ের কাছে হয়েছিলাম! যদি যোগাযোগ না রাখাটাই অপমানের বদলা হয় তাহলে তোর হিসেব মতোই তোর বাবা, মায়ের সঙ্গেও আমার অপমানের বদলা নিতে তোর যোগাযোগ রাখার কথা নয়! কিন্তু আমি সেটা একবারও তোকে বলিনি কিন্তু! আমি কখনো চাইনি আমার জন্যে তোর বাবা, মায়ের সঙ্গে তুই সম্পর্ক নষ্ট করে দে! এই আলোচনা অনেক হয়েছে এর আগে, বহুবার মুখোমুখি বসে কথা বলেছি, কিন্তু সমাধান কিছু বেরোয় নি। এখন আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আর এসব নিয়ে নতুন করে আলোচনা করতে চাই না!

মিতা ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ! আমিও চাই না, আমি এসব থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি এখন! নতুন ভাবে শুরু করছি সব আবার!

সৌমিক নিজেকে সামলে নিলো,

ভালোই তো! আমিও চাই তুই ভালো থাক! তোকে একটা রিকোয়েস্ট করছি, অপর্ণার সঙ্গে কথা বলার তোর দরকার নেই! মা এটা ভালো ভাবে নিচ্ছে না!

মিতা শ্লেষের হাসি হাসলো,

মা ভালো ভাবে নিচ্ছে না নাকি ভয় পাচ্ছিস? ভাবছিস যদি কিছু বলে দিই আমাদের কথা!

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

না, তোকে যতটুকু চিনি তাতে জানি এই কাজ তুই কখনো করবি না! সেটুকু বিশ্বাস আমার আছে! কিন্তু অপর্ণা অহেতুক ঝামেলায় পড়বে, মায়ের সঙ্গে অশান্তি হবে! আমি চাই না অপর্ণা তোর জন্যে ঝামেলায় পড়ুক!

মিতার মুখে কালো ছায়া পড়লো,

ঠিক আছে! নিশ্চিন্তে থাক তোর বউয়ের সঙ্গে আর কখনো কথা বলবো না! ওকে বলে দিস ও ও যেনো না বলে!

সৌমিক এর উত্তরের অপেক্ষা না করেই মিতা রবির দিকে তাকালো,

তুই নিশ্চয়ই জানতিস ঋজু আসবে, তবু আমাকে বলিস নি একবারও? খামোকা বাড়িতে ডেকে অপমান করালি! তুইও আর কখনো যোগাযোগ রাখিস না আমার সঙ্গে!

এতক্ষনে রবির সম্বিত ফিরল, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,

মিতা! বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি! আমি ভাবিনি ঋজু এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে!

মিতা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

আসবে যে সেটুকুও তো বলতে পারতিস অন্তত! তাহলে আজ আসতাম না তোর বাড়িতে! যাকগে! আমারই কপাল খারাপ! যাকে বন্ধু ভাবি সেই বিপদে ফেলে! আসি!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৪
মিতা বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রবি দৌড়ে নিচে নামলো, কিন্তু তার হাজার অনুরোধেও মিতা দাঁড়ালো না, রবির দিকে তাকিয়ে বললো,

আমি এতদিন ভেবেছি ঋজু না থাকলেও তুই অন্তত আছিস, এখন বুঝলাম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ছিলাম এতদিন! আসলে তুই বোধহয় কখনোই আমার বন্ধু ছিলিস না! যখনই তোকে আমি পাশে চেয়েছি তুই ঋজুর হয়েই কথা বলেছিস সব সময়!

রবি দরজা আটকে দাঁড়ালো,

বিশ্বাস কর, এই কথাটাই আবার ঋজুও আমাকে বলে! আমি নাকি তোর হয়ে কথা বলি! আমি কি করি বলতো! তোদের দুজনের রাগারাগির মাঝখানে পড়ে আমারই খারাপ লাগে! প্লিজ এরকম করিস না, তুইও আমার খুব প্রিয়!

মিতা জলভরা চোখে তাকালো,

আমিও সেটাই ভাবতে চাই কিন্তু তোরা দুজনেই আমাকে বুঝিস না আসলে! আমিও কিন্তু ভেবেছিলাম যে ঋজুর মা আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তার জন্যে আমি ওনাকে কখনই ক্ষমা করতে পারবো না ঠিকই তবে তার জন্যে ঋজুর সঙ্গে সম্পর্ক আর খারাপ করবো না! দু বছর কিন্তু অনেকটা সময়, আমি ওই দিনগুলোকে, খারাপ লাগাগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি! এটুকু বুঝেছি জীবনটা অনেক বড়ো, এই ছোটো ছোটো খারাপলাগা গুলো আঁকড়ে ধরে থাকলে নিজেরই এগোতে অসুবিধা হয়। আমি এগুলোকে মুছে ফেলতে চাই বলেই কিন্তু নিজে থেকে যেচে ঋজুর বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে ছিলাম, ভেবেছিলাম একটা সময় তো প্রথমে আমরা শুধু বন্ধুই ছিলাম, তাই সেই সম্পর্ক টুকু তো থাকতেই পারে! কিন্তু আজ বুঝলাম ঋজু বোধহয় সেটুকুও রাখতে চায় না, তাই সরাসরি ওর বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিলো! যাক আসি রে! ভালো থাকিস!

রবি আর আটকানোর চেষ্টা করলো না, মিতার কথাগুলো শুনে সত্যি ওর খারাপ লাগলো। সৌমিকের ওপর হটাৎ করেই রাগ হলো খুব, দৌড়ে ওপরে এসে ঘরে ঢুকেই সৌমিক কে বললো,

বড্ড রুড তুই! এতদিন পরে দেখা হলো, একটু ভালো ভাবে কথা বলতে কি অসুবিধা ছিলো? অতীত ভুলে দুজনেই যখন এগিয়ে গেছিস তখন বন্ধুত্বটা বজায় রাখতে অসুবিধা কি?

সৌমিক মুখ তুলে তাকালো,

কিসের বন্ধুত্ব! বন্ধুত্ব রাখতে চাইলে কি এখনও দোষারোপ করে যেতো? ওর মায়ের ওপরে রাগ আছে মানছি কিন্তু সব সময় যদি সেই একই কথা টেনে আনে তাহলে বন্ধুত্ব আর থাকে কখনো? আর আজ এতদিন পরে ওর মনে হলো যে বন্ধুত্ব রাখা যায় তাহলে তখন সেটা মনে হয়নি কেনো? ও তো আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলো, আমি তাও তো অন্য নম্বর থেকে ফোন করে ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম! বন্ধুত্ব রাখার চেষ্টা কিন্তু আমার দিক থেকেও ছিলো তখন ও এগিয়ে আসে নি!

রবি খাটের পাশে বসে পড়লো,

খুব খারাপ লাগছে, এতদিন পরে এলো মেয়েটা আর শুধু সময়ের হিসেবে একটু গোলমাল হয়ে গেলো বলে ব্যাপার টা পুরো হাত থেকেই বেরিয়ে গেলো! মিতার চোখে জল দেখেছি, আর যতো বার ওই দৃশ্যটা মনে পড়ছে ততবার তোর ওপরে রাগ হয়ে যাচ্ছে! কি হতো যদি ও অপর্ণার সঙ্গে কথা বলতো? তুই নিজেই তো স্বীকার করলি যে তোর ওর ওপরে সেই আস্থা আছে যে ও এমন কিছু করবে না যাতে তোর আর অপর্ণার সম্পর্কে চিড় ধরে!

সৌমিক মাথা নামালো,

অপর্ণার সঙ্গে সম্পর্ক তো এখনও গড়েই উঠলো না, তাতে চিড় ধরবে কি করে! আজ জানলাম ও আমার ফোন নম্বর টুকুও সেভ করেনি এখনও! একে মায়ের সঙ্গে অপর্ণা কে নিয়ে আসা নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছে প্রতিদিন, তার মধ্যে মিতার সঙ্গে কথা বললে সেটা আরো বাড়বে! যে সম্পর্কটা নতুন করে তৈরি করতে চাইছি সেখানে এইসব বাইরের উটকো জটিলতা চাইছি না এখন!

অপর্ণা যাচ্ছে কবে? ওর তো সময় হয়ে এলো না?

সৌমিক সোজা হয়ে উঠে বসলো,

সেটা তো তোর ওপরেই নির্ভর করছে! মিতার কথা ছাড়, স্বপনের কি হলো সেটা বল!

রবি হাসলো,

কি আর হবে! খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম রসুলপুর যে থানার আন্ডারে পড়ে সেখানে আমার খুব পরিচিত একটি ছেলেই ওসি! ওকে দিয়ে থানায় ডেকে ওই অপর্ণার বন্ধুর খুনের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেবো বলেছি! ব্যাটা সত্যিই চুনোপুঁটি, যা ভয় পেয়েছে না আর অপর্ণার ধারে কাছেও আসবে না কখনো!

সৌমিক হেসে উঠলো,

যাক, বাঁচালি! আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে দিয়ে আসবো ভেবেছি ওকে, তাহলে সেটাই করি এবার!

মিতার কথা কিছু ভাবলি? পারলে কথা বলিস, ওর ভালো লাগবে!

রবির প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সৌমিক উঠে দাঁড়ালো,

চলি এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে! থ্যাংক ইউ!

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে মিনতি এগিয়ে যাওয়ার আগেই রীনা উঠে দাঁড়ালেন, টিভির রিমোট টিপে আওয়াজ টা কমিয়ে দিয়ে মিনতির দিকে হাত তুললেন,

আমি যাচ্ছি, তুমি নিজের কাজ করো!

দরজা খুলে সৌমিক কে দেখে রীনা সরে দাঁড়ালেন, সৌমিক দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল, পেছন থেকে রীনা ডাক দিলেন,

ঋজু! নিচে বসে চা খেয়ে যাও, আমার কিছু কথা আছে!

সৌমিক ফিরে এলো, ব্যাগ টেবিলে নামিয়ে রেখে সোফায় বসে বললো,

বলো!

রীনা অপর্ণার দিকে তাকালেন,

ঋজু কে চা দাও!

অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো, তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে রীনা ছেলের দিকে তাকালেন,

তুমি রবির বাড়ি গিয়েছিলে শুনলাম! কি এমন হলো যে তুমি অপর্ণার ফোনে ফোন করলে? বাড়িতে যখন ল্যান্ড ফোন রয়েছে তখন কাউকে আলাদা করে বলার প্রয়োজন হলো কেনো? তুমি যে দেরি করে আসবে সেটা কি আমাকে অন্যের কাছ থেকে জানতে হবে?

সৌমিক জুতো খুলছিলো, অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,

মানে! অন্য টা কে? অপর্ণা? ওর কাছ থেকে শুনেছ তো কি হয়েছে? এর আগেও তো কতোবার ল্যান্ড ফোনে না করে তোমার মোবাইলে খবর দিয়েছি, বাবা, দাদা, বৌদি তোমার কাছ থেকে শুনেছে, তখন তো এরকম কোনো কথা ওঠেনি!

রীনা গম্ভীর হয়ে গেলেন, প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

রবি কেনো ডেকেছিলো তোমাকে?

অপর্ণা চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো ইতিমধ্যে, সৌমিক হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে বললো,

ওই ছেলেটার খবর দিলো, বললো ওকে ধমকে দিয়েছে, ও আর কোনো ঝামেলা করবে না!

রীনা মাথা নাড়লেন,

যাক! শান্তি! আমি যা ভয়ে ভয়ে আছি সে শুধু আমিই জানি! কখন যে কি হয়ে যায়, দোষ তো এখনো কাটেনি! রত্না বলছিলো রজতের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, প্রায় দিনই নাকি অফিস থেকে শরীর খারাপ নিয়ে ফিরছে! এসব শুনলেই তো ভয় লাগে! ঝামেলা যখন মিটেই গেছে তখন বরং কালই দিয়ে এসো ওকে! আর দেরি করে দরকার নেই!

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

কাল কি করে হবে? আগামী সপ্তাহে যাবার ব্যাপারে তো কথা হয়েই গেছে! আমি ছুটির কথা বলে রেখেছি আগেই! এখন ইচ্ছে করলেই ছুটি এগোনো যায় নাকি! আর রজতদার শরীর খারাপের সঙ্গে অপর্ণার কি সম্পর্ক! যেটা করার সেটা কি করেছে? ডাক্তার দেখিয়েছে?

রীনার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো, ছোটো ছেলে যে তাঁর বরাবরের অবাধ্য, বড়ো ছেলের মতো সব কথায় সহমত পোষণ করে না সেটা তিনি ভালোই জানেন! স্ত্রীর বিরক্ত মুখ দেখে সৌমিকের বাবা তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন,

আহা! ও তো বলেছে দিয়ে আসবে সামনের সপ্তাহে, আবার নতুন করে কালকে বলছো কেনো! ছুটি কি বললেই পাওয়া যায় নাকি, এই তো বিয়েতে কতোগুলো ছুটি গেলো! তাছাড়া ও কাছাকাছি ট্রান্সফারের চেষ্টা করছে এখন এতো ঘন ঘন ছুটি নিলে হয় নাকি! আর এসব কি বলছো? রজত তো এখন ভালোই আছে, কালই আমার সঙ্গে ফোনে কথা হলো!

রীনা কখনই তাঁর মুখের ওপরে কথা বলা পছন্দ করেন না, হাত তুলে স্বামী কে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

সারাদিন টিভি দেখা আর কাগজ পড়া ছাড়া তোমার আর কোনো কাজ আছে? চারপাশের কোনো খবর রাখো তুমি? জানো মেজদির ওই পুরুত মশাই কতো গুণী মানুষ, ওনার কোনো কথা আজ পর্যন্ত ফলেনি এমন হয়নি! তিনি যখন নিজে কুষ্টি বিচার করে একথা বলেছেন তখন আমি সেকথা উড়িয়ে দিতে পারিনা কিছুতেই! সংসার আমার, এর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমার ওপরেই ছেড়ে দাওনা, সব বিষয়েই কি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে তোমার? এই যে বিয়ের রাতে তোমার অতো বড় বিপদটা ঘটলো, সেরকম যদি আবার কিছু হয় তাহলে কি ভালো হবে সেটা?

সৌমিক বিরক্ত ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লো,

উফফ! তোমার ঐ এক কথা! বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় অসতর্ক হলে ওরকম বিপদ যখন তখন ঘটতে পারে, এর সঙ্গে কুষ্টি দোষ, পয়া, অপয়ার কোনো সম্পর্ক নেই!

সৌমিকের বাবা তাড়াতাড়ি ছেলের দিকে ফিরলেন,

মায়ের কথা ধরিস না! মা আসলে বাড়ির সবাই কে নিয়ে বড্ড চিন্তা করে তো, তাই মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা থেকে ওরকম বলে ফেলে!

সৌমিক আর দাঁড়ালো না, চা শেষ করে দ্রুত ওপরে উঠে গেলো, তার পেছন পেছন অপর্ণাকে উঠতে দেখে রীনা ডাকলেন,

শুনেছ তো? সামনের সপ্তাহে বাড়ি ফিরে যাবে, গোছগাছ শুরু করে দাও!

অপর্ণা ঘাড় নাড়লো,

হুঁ!

অপর্ণা ওপরে এসে দেখলো সৌমিক ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বন্ধ জানলার দিকে তাকাচ্ছে, তাকে তাকাতে দেখে অপর্ণা হাসলো,

আমি জানি মুখে আপত্তি না জানালেও মনে মনে তুমি চাওনি যে আমি মিতা দির সঙ্গে কথা বলি! সেটা বুঝতে পেরেছি বলেই জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি!

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সৌমিকের মুখে একটা অস্বস্তির ছাপ পড়লো, সে কোনো উত্তর না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। অপর্ণা যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, সৌমিকের মুখের পরিবর্তন তার চোখে ধরা পড়লো, কিন্তু সে নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করলো না, মনের মধ্যে ওঠা প্রশ্নগুলোকে নিজের মতো করেই বিশ্লেষণ করতে লাগলো। সৌমিক মিতাকে কোনো কারণে পছন্দ করেনা সেটা বুঝতে পারার পরে তার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে লেগেছে, সে কি সৌমিকের অনুমতি ছাড়া মিতা কে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে ভুল করলো!! তার বোধহয় সৌমিকের সঙ্গে আলোচনা করে এটা করা উচিত ছিলো! একটু পরে বাথরুম থেকে ফিরে এসে সৌমিক সোফায় বসলো, উল্টোদিকের সোফায় বসে থাকা অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

স্বপন ছেলেটা কিন্তু রবির ভাষায় নেহাতই পাড়ার মস্তান, সামান্য ধমকেই ভয় পেয়ে গেছে! অথচ তুমি ওকে খুনি বলে ভাবছিলে!

অপর্ণা তখন মিতার কথা ভাবছিলো, অন্য মনস্ক গলায় বললো,

ও!

সৌমিক একটু অবাক হলো,

তুমি কিছু ভাবছো?

অপর্ণা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলো, প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

না তো! কি বলছিলে? স্বপন পাড়ার মস্তান? কিন্তু আমাদের ওখানে তো সবাই ওকেই সন্দেহ করছিলো! আর করার যথেষ্ট কারণও ছিলো।

সৌমিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো, অপর্ণার অন্য মনস্ক ভাব তার নজর এড়ায় নি, কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বললো,

আমার মনে হলো তুমি অন্য কিছু ভাবছিলে! আমার কথাগুলো মনে হয় ঠিক মতো শুনতে পাওনি! কিছু হয়েছে নাকি?

অপর্ণা কয়েক মুহূর্ত সৌমিকের দিকে তাকিয়ে বললো,

আমি একটা ভুল করে ফেলেছি, তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই মিতা দিকে আমার ফোন নম্বরটা দিয়ে ফেলেছি! আমি তখন বুঝিনি যে তোমাদের বাড়ির সঙ্গে ওদের কোনো সমস্যা আছে! আসলে ও এমন ভাবে নিজেকে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড বললো! আমিও সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম তখন, পরে সবার কথা থেকে বুঝছি আমি ভুল বুঝেছি!

সৌমিক মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত ভাবলো, তারপর অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

ভুলটা তোমার নয়, ভুলটা বোধহয় আমার! আমারই তোমাকে বলে দেওয়া উচিত ছিলো আগেই,আসলে আমি ভাবিনি এটা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হবে কখনো! মিতা খুব একটা ভুল কিছু বলেনি, ও আমি আর রবি সত্যিই একসময় ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলাম! কিন্তু এখন আর নই!

অপর্ণা চুপ করে সৌমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, সৌমিক সেটা লক্ষ্য করে বললো,

তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো এখন আর নই কেনো? তাহলে পুরোটা খুলে বলি! মিতা আর আমি শুধু বন্ধু ছিলাম না, আমরা একসময় বিয়ের কথাও ভেবেছিলাম দুজনে! কিন্তু মায়ের আপত্তি ছিলো, তাই নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছিলো, শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয় নি! সেই থেকেই আমাদের দু বাড়ির মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে!

অপর্ণার চারপাশটা কেমন যেনো দুলে উঠলো কয়েক মুহূর্ত, মিতার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো! সব জেনেও মেয়েটা ওকে নিজেকে সৌমিকের বেস্ট ফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিলো! আর সৌমিক! সেতো এতদিন কিছু বলেনি! আজ কেনো বললো? অপর্ণার মনে মনে ভীষণ অভিমান হতে লাগলো হটাৎ, আজ কি তবে সব কিছু জানাজানি হয়ে যেতে পারে ভেবেই সৌমিক ওকে সবটা বলতে বাধ্য হলো! ও তো কখনো এরকম ভাবেনি, নিজের কোনো কথা লুকিয়ে যেতে চায়নি কখনো!

অপর্ণা কে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সৌমিক কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো, নরম গলায় বললো,

জানি তোমার হয়ত খারাপ লাগছে, কিন্তু এটাই সত্যি! তাই আমি চাইনা নতুন করে মিতার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হোক!

অপর্ণার হটাৎ করে রাগ হলো, সৌমিকের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

খারাপ লাগবে কেনো, যা সত্যি তাই তো বলেছো! শুধু একটাই কথা জানতে ইচ্ছে করছে যে এই কথাগুলো বিয়ের আগে বলো নি কেনো? আমি কিন্তু কোনো কিছু গোপন করিনি তোমার কাছ থেকে! তখন কি ভাবোনি মিতা আবার ফিরে আসতে পারে? নাকি এখন ভয় পাচ্ছ যদি ও আমাকে কিছু বলে দেয়!

অপর্ণার গলার স্বরের পরিবর্তন সৌমিকের কানে লাগলো, সে একটু চুপ করে থেকে বললো,

বলার মতো তো কিছু ছিলো না! তুমি বলেছিলে কারণ তুমি এখনও তাকে ভালোবাসো, আমি তো বাসিনা, তাই বলার প্রয়োজন মনে করিনি!

তাহলে আজ বলছো কেনো? তুমি তো সব সময় বলো তুমি নাকি কাউকে কৈফিয়ত দাওনা কখনো, তাহলে আজ দিচ্ছ কেন?

ভাঙা গলায় বললো অপর্ণা, সৌমিক অপর্ণার হাতটা আস্তে করে ধরে ফেললো,

কখনো সত্যি কাউকে কৈফিয়ত দিইনি, কিন্তু এই প্রথম মনে হলো এই কৈফিয়ত টা আমার দেওয়া উচিত! যে সম্পর্কটা অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গেছে সেটা নিয়ে যে নতুন করে আলোচনা করার দরকার কখনো পড়বে সেটা বুঝতে পারলে আগেই হয়ত বলতাম! তবে বিশ্বাস করো, মিতা তোমাকে বলবে কিছু এই ভয়ে তোমাকে বলতে চাইছি এরকমটা কিন্তু নয়, কারণ আমি জানি যে এরকম কাজ ও কখনোই করবে না!

বাবা! তোমার এখনও এতো বিশ্বাস প্রাক্তন প্রেমিকার ওপরে! তাহলে মিছিমিছি বলতে গেলে কেনো, লুকিয়ে রাখতেই পারতে এখনও!

শ্লেষের গলায় বললো অপর্ণা, সৌমিক একটু চুপ করে থেকে, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

মিছিমিছি নয়! বুঝতে পারছিলাম তোমার কৌতূহল হচ্ছে, তুমি জানতে চাইছো সবটা তাই বললাম! এর সঙ্গে মিতার বলা বা না বলার কোনো সম্পর্ক নেই!

অপর্ণা হটাৎ করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, আলমারি খুলে জামা কাপড় বার করতে করতে বললো,

তোমার মা বলছিলেন আর আমিও ভাবলাম আমার কালকে ফিরে গেলেই সুবিধা হবে, কিছুদিন বেশি পড়ার সময় পাবো! তাছাড়া এখন যখন স্বপনের ঝামেলা মিটে গেছে তখন এখানে থাকার আর কোনো মানে হয়না!

সৌমিকও উঠে এলো, অপর্ণার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,

এটা তো রাগের এক্সপ্রেশন! তুমি রাগ করে বাড়ি যেতে চাইছো! যদি সত্যি পড়াশুনার জন্যেই যেতে চাইতে তাহলে হয়ত আমি যে করেই হোক তোমাকে দিয়ে আসতাম!

অপর্ণা পেছন ফিরেই ঘাড় নাড়লো,

নাহ! রাগ করবো কেনো! আমার এখানে থাকার আর প্রয়োজন নেই তাই রসুলপুরে ফিরতে চাইছি!

আমি এখন ছুটি পাবো না, সেটা তো তখনই বললাম!

তোমাকে যেতে হবে না, আমি মামা কে বলছি মামা আমাকে দিয়ে আসবে! এমনিতেও তোমার মা আর দিদি তোমাকে যেতে তো বারণ করছিলো তখন, বলছিলো স্বপন তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে! আমার জন্যে তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি সেটা কখনো চাই না! সেটা হলে আমার খুব খারাপ লাগবে!

সৌমিক আচমকা পেছন থেকে অপর্ণা কে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো, কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,

কেনো চাও না? আমি তোমার কে, যে আমার ক্ষতি হলে তোমার খারাপ লাগবে! একটা কথা বলবো? বিয়ের আগে বলেছিলে তোমার সময় চাই, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি আর সময় চাও না!

অপর্ণা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

কেনো?

সৌমিক অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে গাঢ় গলায় বললো,

আমরা কার ওপরে রাগ দেখাই বলো তো? যাকে আমরা ভালোবাসি, যার ওপরে রাগ দেখানোর অধিকার রাখি, তাকেই! আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো!

অপর্ণা জোর করে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে ভাঙা গলায় বললো,

মোটেও না! আমি কাউকে ভালোবাসি না, আমার কারো ওপরে রাগ নেই! এখানের কেউ চায় না আমি থাকি! তোমার মাও বলেন আমি অপয়া, আমার জন্যে তোমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে! আর তোমার তো বেস্ট ফ্রেন্ড এসেই গেছে এখন, আর আমাকে কোনো দরকার নেই!

সৌমিক আরো শক্ত করে অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো, সামনে এসে পড়া চুলগুলো কে কানের পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

কোথায়? আমার নতুন বেস্ট ফ্রেন্ড তো আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে! আমার তো তাকে খুব দরকার এখন! আমি তো তাকে কিছুতেই রাগ করে চলে যেতে দেবো না!

অপর্ণা এবার সৌমিক কে জড়িয়ে ধরলো, বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ধরা গলায় বললো,

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! তুমি একটুও আমাকে বন্ধু ভাবো না! যদি ভাবতে তাহলে এসব কথা আগেই বলতে! আমি কিন্তু তোমাকে সব বলেছিলাম!

সৌমিক দু হাতে অপর্ণার মুখ তুলে ধরলো,

ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো হবে না! এবার থেকে সব বলবো!

অপর্ণা জলভরা চোখে তাকালো,

প্রমিস?

সৌমিক হাত বাড়িয়ে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিলো, অপর্ণার ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট নামিয়ে আনতে আনতে অস্ফুট গলায় বললো,

প্রমিস!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৫
অপর্ণা!!

খুব চেনা গলার স্বরটা, ট্রেনের লাইন বরাবর হাঁটতে হাঁটতে অপর্ণা থমকে দাঁড়ালো, সৌমিক ততোক্ষনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওটা কে, ঘন নীল রঙের টি শার্ট টা তো ভীষণ চেনা! সমর তো! কিন্তু ওকি করে আসবে, ও তো বেঁচে নেই! ভাবতে ভাবতে অপর্ণা অবাক হয়ে তাকালো,

তুমি বেঁচে আছো সমর? আমি তো জানতাম না!

অস্পষ্ট মুখটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিলো, ট্রেন লাইনের পাশের জঙ্গলটা থেকে বেরিয়ে এলো সমর, বললো,

জানবে কি করে, তুমি তো আমাকে ভুলে গেছো! এই তো মাত্র মাস দুয়েক আগেই বলেছিলে তুমি, আমাকে ছাড়া কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না! এতো স্বার্থপর তুমি, বিয়ের পরেই ভুলে গেলে আমাকে!

অপর্ণা হাত বাড়ালো, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সমর কে ছুঁতে চেষ্টা করলো,

নাহ! ভুলিনি তো! কখনো ভুলবো না তোমাকে! কি যে হলো কাল, খুব ভুল হয়ে গেছে সমর, আর কখনো হবে না! যেওনা প্লিজ!

সমর আরো এগিয়ে একদম কাছ ঘেঁসে এলো, অপর্ণার কানের কাছে মুখ এনে বললো,

তুমি তো অপয়া, তোমার জন্যেই তো মরেছি আমি! তুমি যার জীবনে যাবে সেই মরবে, সৌমিকও বাঁচবে না!

অপর্ণা ফুঁপিয়ে উঠলো,

না, আমি অপয়া নই! বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে মারিনি! প্লিজ সৌমিকের কোনো ক্ষতি নাহয় দেখো!

সমর হাত তুললো, দূরে এগিয়ে যাওয়া সৌমিককে দেখিয়ে হাসলো,

দেখো ও কতোটা এগিয়ে গেছে, পেছনে আসা ট্রেনটা কে খেয়ালও করছে না!

অপর্ণা ঘুরে তাকালো, পেছনে আসা ট্রেনটা লক্ষ্য করে অনেক দূরে এগিয়ে যাওয়া সৌমিক কে ডাকতে চেষ্টা করলো, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না কেনো! অপর্ণা ছুটতে চেষ্টা করলো, ট্রেনের আগে ওকে সৌমিকের কাছে পৌঁছতে হবে, কিন্তু পা দুটো যেনো বড্ড ভারী, কিছুতেই টেনে তুলতে পারছে না!

কি হলো? কি বিড়বিড় করছো ঘুমের মধ্যে, ভয়ের স্বপ্ন দেখছো নাকি?

সৌমিক এর ধাক্কায় কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো অপর্ণা, এই ঠান্ডাতেও ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে! স্বপ্নটা বড্ড বেশি জীবন্ত, একদম চোখের সামনে দেখলো ও সমর কে! এতো কাছ থেকে যেনো পাশেই বসে আছে মনে হচ্ছে, অদ্ভুত একটা গ্লানিতে মনটা ভরে গেলো অপর্ণার। অপর্ণা কে উঠে বসতে দেখে সৌমিকও উঠে বসলো, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,

একদম ঘেমে গেছো তো, নাও জল খাও! স্বপ্ন দেখছিলে মনে হলো, কি সব বলছিলে ঘুমের মধ্যে! কি স্বপ্ন দেখছিলে? খারাপ কিছু?

হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাস টা হাতে নিয়ে সম্পূর্ন গ্লাস টা শেষ করে টেবিলে রাখলো অপর্ণা, কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম মুছে কষ্টের গলায় বললো,

আমি অপয়া সৌমিক, আমার জন্যে তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে!

সৌমিক অবাক হয়ে তাকালো,

কি সব বলছো, এখনও স্বপ্ন দেখছ নাকি! কি স্বপ্ন দেখছিলে?

অপর্ণা মুখ নামালো,

জানো ওকে কি সামনে থেকে দেখলাম, একদম আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। বিশ্বাস করো প্রতিটা মুহূর্ত কি ভীষণ জীবন্ত, আমার বিয়েতে ও ভীষণ কষ্ট পেয়েছে সৌমিক, আমাকে বলছিলো আমি ওকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম!

সৌমিক অপর্ণার দু হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,

স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাকে এতো সিরিয়াসলি নিতে নেই! এগুলো তোমার অবচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ! কালকের সন্ধ্যের ঘটনার জন্যে মনে মনে গিলটি ফিল করছো বোধহয়!

অপর্ণা ঘাড় নাড়লো,

জানিনা! অতো কিছু ভাবিনি তো, এমনকি ওকে নিয়েও ভাবিনি কিছু! তাও কালকের পরেই এরকম স্বপ্ন দেখলাম কেনো বলতো? যখন ও চলে গেলো, কতোবার ওর মুখটা মনে করতে চেয়েছি, আসেনি! চোখ বন্ধ করলেই শুধু টুকরো টুকরো শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে! অথচ আজ দেখো, কোনো কারণ ছাড়াই এরকম একটা স্বপ্ন দেখলাম! আচ্ছা ওকি আমাদের কাছাকাছি আসায় কষ্ট পেলো সৌমিক? আমরা কি কিছু ভুল করলাম? আমি কি ওকে ঠকালাম!

সৌমিক হাসলো, অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরে বললো,

কি পাগলের মতো কথা বলছো! এরকম আবার হয় নাকি! কোনো মৃত মানুষ আবার কষ্ট পায়? এসব তোমার কল্পনা! নিজের মনের মধ্যে নিজেই সৃষ্টি করছো!!

অপর্ণা নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে বললো,

কথাগুলো এখনও কানে ভাসছে, আমার জন্যে ও নাকি মারা গিয়েছে, আমি নাকি অপয়া! সত্যি কি আমি অপয়া সৌমিক? তোমাদের বাড়িতে আসার পরে তো তোমাদেরও ক্ষতি হয়েছে, আমার জন্যে যদি সত্যি তোমার কিছু হয়ে যায় তাহলে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না! পুরুত মশাইয়ের কথা না শুনেই এখানে চলে এলাম!

সৌমিক বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো, ঘরের আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,

অশিক্ষিতের মতো কথা বলো না! ওঠ তো! বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দাও! এগুলো দুর্বল মনের প্রকাশ! তোমাকে তো বেশ সাহসী ভাবতাম, এতো ভীতু তুমি! একটা সামান্য স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেলে! নিজেই তো কিছুদিন আগে বলেছিলে তুমি এসব বিশ্বাস করো না, তাহলে আজ কেনো!

অপর্ণা চুপ চাপ উঠে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এলো, খাটের এক পাশে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বললো,

সরি! আমার জন্যে তোমার রাতের ঘুমটা গেলো!! সকালেই তো আবার অফিস, শুয়ে পড়ো, আলো নিভিয়ে দিচ্ছি!!

সৌমিক অপর্ণার পাশে উঠে এলো, পাশের টেবিল থেকে সিগারেট বার করে জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,

আর ঘুম হবে না! ঘুম টা কেটে গেছে একদম! যা করলে! একটা কথা বলতো, আমি কি খুব তাড়াহুড়ো করে ফেললাম? তোমার কি আরো সময় দরকার ছিলো অপর্ণা? নাহলে এতদিন তো এরকম কোনো স্বপ্ন দেখনি, আজ কেনো? মনের মধ্যে কাল থেকেই এসব ভাবছো নিশ্চয়ই! আমরা যেটা নিয়ে বেশি চিন্তা করি তাই আমাদের স্বপ্নে আসে!

অপর্ণা মাথা নিচু করলো,

যদি কারো কথা ভাবলেই সে স্বপ্ন তে আসতো, তাহলে তো ওকে কতোবার দেখতে পেতাম আজ পর্যন্ত!! একটা সময় তো ছিলো যখন শুধু সারাদিন ওর কথাই ভেবেছি, তাও তো দেখিনি কিছু! আজই কেনো দেখলাম কে জানে!

সৌমিক মুখ থেকে ধোঁয়া বার করতে করতে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালো,

বুঝতে পারছি তোমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কোথাও যাবে অপর্ণা?

অপর্ণা মুখ তুললো,

কোথায়?

এই ধরো কাছাকাছি কোথাও, দু তিনদিনের জন্যে! বিয়ের পরে তো যাইনি কোথাও দেখো তোমার ভালো লাগবে! মনের পরিবর্তন হবে একটু। সারাদিন বাড়িতে বসে বোধহয় উল্টো পাল্টা চিন্তা করো সবসময়, এই সব পয়া অপয়া সংক্রান্ত কথাই মাথায় ঘোরে বোধহয়! এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে জোর করে নাহলে একবার গেঁড়ে বসলে আর বার করতে পারবে না!

অপর্ণা সৌমিকের কাঁধের ওপরে মাথা রাখলো,

নিজেরও কি অদ্ভুত লাগছে জানো! আমি নিজেই আজ পর্যন্ত এই সব ভুত, প্রেত, পয়া অপয়াতে বিশ্বাস করতাম না, সেই আমি আজ এরকম একটা স্বপ্ন দেখলাম!

সৌমিক ডান হাত দিয়ে অপর্ণা কে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

তোমার সেই বন্ধু এসবে বিশ্বাস রাখতো নাকি?

অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,

ভীষণ ভাবে রাখতো! ও পরজন্মে বিশ্বাস করতো, সব সময় বলতো যে অন্যায় করে তাকে পরের জন্মে শাস্তি ভোগ করতে ফিরে আসতে হয়! আমিই বরং হাসতাম, বলতাম তাহলে তো আর কখনো তোমার আমার জন্মানো হবে না, কারণ আমরা তো কোনো পাপ করিনি কখনো!

সৌমিক সিগারেটটা অ্যাস ট্রে তে গুঁজে উঠে দাঁড়ালো,

যাক তাহলে তোমার আমার বিয়ে হয়েই ভালো হয়েছে, আমরা কেউ পরের জন্মে বিশ্বাস করিনা! আমি তো সব সময় মনে করি আমাদের অন্যায়ের শাস্তি এই জন্মেই পেয়ে যেতে হয়, পরজন্ম বলে কিছু হয়না!

অপর্ণা হাসলো,

তুমি ওর একদম উল্টো! কোনো মিল নেই তোমাদের! আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো, আমি একদম দুজন বিপরীতধর্মী মানুষের সঙ্গে থাকছি! কথা, কাজ দুজনের সম্পূর্ন আলাদা! তাও দেখো আমি কিভাবে যেনো তোমাকেও ভালোবেসে ফেললাম!

সৌমিক উঠে দাঁড়িয়েছিলো, আবার বসে পড়ে মুচকি হেসে বললো,

আমাকেও ভালোবেসে ফেলেছো? তাহলে এটাই তো হানিমুনের পারফেক্ট সময়, চলো তাহলে রসূল পুরে যাওয়ার আগে দুদিন কোথাও ঘুরে তারপরে তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি!

অপর্ণা একদৃষ্টে সৌমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

আগে পরীক্ষাটা হয়ে যাক, তারপরে না হয় যাবো! ততদিনে আমার কিসব দোষ আছে বলছিলেন ঠাকুর মশাই, সেগুলোও কেটে যাবে!

সৌমিক মুখে বিরক্তির আওয়াজ করলো,

পরীক্ষার জন্যে যদি যেতে না চাও তাহলে আলাদা কথা, কিন্তু এই সব দোষ ত্রুটির কথা শুনলে বিরক্ত লাগে। তোমার হলো কি? স্বপ্ন দেখার পরে কিছুক্ষন মনের মধ্যে অস্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু এতক্ষন ধরে একই কথা বলছো কেনো?

অপর্ণা মাথা নামালো,

জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছো, কিন্তু আমি….

সৌমিক হাত তুলে থামিয়ে দিলো,

এক সেকেন্ড! আমার কথা এখনও শেষ হয়নি! প্রশ্নটা বিরক্ত হওয়ার নয়! আমার অপমানিত লাগছে এবার, মনে হচ্ছে আমি কোনো মৃত মানুষের সঙ্গে কম্পিটিশনে নেমেছি! সে মাঝে মাঝেই তোমার স্বপ্নে আসবে, ঠিক করবে তুমি পয়া না অপয়া, তোমার এখন হানিমুনে যাওয়া উচিত না নয়, আমাদের মধ্যে ফিজিক্যাল রিলেশন থাকবে না থাকবে না! মোটামুটি একজন কখনো না দেখা, কখনো না চেনা মৃত মানুষ আমাদের দুজনের জীবন কন্ট্রোল করবে! ঠিক আছে তাই হোক তাহলে, যবে তোমার দোষ কেটে গেছে বলে মনে হবে তোমার তবে আমাকে বলো আমরা কোথাও বেড়াতে যাবো না হয়!

অপর্ণা জলভরা চোখে তাকালো,

বিশ্বাস করো নিজের জন্যে নয়, শুধু তোমার জন্যেই ভাবছি! নিজের হলে বোধহয় এরকম কিছু মনে হতো না, কিন্তু তোমার ক্ষতি হতে পারে এটা যখনই মনে হচ্ছে তখনই যেনো যুক্তি, তর্ক সব হারিয়ে যাচ্ছে! মনে মনে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ছি! জানি এটা শুধুই স্বপ্ন, তবু মনে হচ্ছে এতদিন দেখিনি কেনো, আজই কেনো দেখলাম!

অপর্ণার চোখে জল দেখে সৌমিক নিজেকে সামলে নিলো,

ঠিক আছে, বুঝতে পারছি সেটা! কিন্তু এটাকে বাড়তে দিও না! অন্য দিকে মন দাও, নিজেকে ব্যস্ত রাখো পড়াশুনায়। আমি বলছি আমার কোনো ক্ষতি হবে না!

ভোর হয়ে আসছিলো, বাইরে পাখির ডাক শুনতে পেয়ে অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো, পায়ের তলার জানলাটা খুলতেই চোখের ওপরে আলো এসে পড়লো। সৌমিক একটু অবাক হলো,

আবার কি হলো, জানলাটা খুললে কেনো?

অপর্ণা হাসলো,

ধুস! চোরের ওপরে রাগ করে কেউ মাটিতে ভাত খায় নাকি! এতো সুন্দর রোদ আসে সকালে, মিতার জন্যে আমরা সেটা থেকে বঞ্চিত হবো কেনো? আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি যে জানলা বন্ধ করে থাকবো! কি আর হবে, হয়ত দু একটা কথা বলবে, এর বেশি তো কিছু নয়! সে আমি ম্যানেজ করে নেব! আর ও তো থাকেই না এখানে! আমার এই জানলাটা তে দাঁড়ালে রসুলপুরে আছি মনে হয়! বেশ একটা শান্ত, গ্রাম গ্রাম ভাব! বারান্দায় বেরোলেই তো রাস্তা, আর গাড়ি, ঘোড়া! বিরক্তি লাগে সারাদিন!

সৌমিক হাসলো,

আচ্ছা, যা ইচ্ছে করে তাই করো! শুধু দেখো এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে অশান্তি না হয়! মিতার সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই মা বিরক্ত হবে কিন্তু!

অপর্ণা হাসলো,

মায়ের সঙ্গে কোনো অশান্তি হবে না, মা তো আসলে একটা জিনিসেই ভয় পাচ্ছেন যদি আমি কিছু জেনে ফেলি! তিনি তো আর জানেন না যে তাঁর ছেলে ইতিমধ্যেই বউ কে সব বলে দিয়েছে! যদি জানতেন তাহলে একটা কেনো দশটা কথা বললেও বিরক্ত হতেন না!

সৌমিক বারান্দার দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে হাসলো,

তাহলে তো মাকে এবার সত্যি কথাটা বলতে হবে!

অপর্ণা বারান্দায় এসে সৌমিকের পাশে দাঁড়ালো,

মা কে বলবো কিনা জানিনা তবে মিতা দি যদি কিছু বলে, তাহলে কিন্তু বলে দেবো আমি সব জানি!

সৌমিক হাসলো,

বলবে না! কালই রবির বাড়িতে দেখা হয়েছিলো, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছি!

অপর্ণা চমকে তাকালো,

তুমি রবিদা র বাড়িতে মিতাদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে? তাহলে যে বললে রবি দা তোমাকে ডেকেছিলো?

নাহ! হটাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিলো, জানতাম না ও আসবে! বলছিলো তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে! ওর জন্যে তোমার মায়ের সঙ্গে গন্ডগোল হোক সেটা চাইনি বলেই ওকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছি!

অপর্ণা হাসলো,

দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি!

অপর্ণা দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছিলো এমন সময় দরজায় নক করার আওয়াজ হলো, দরজা খুলতেই রীনা ঘরে ঢুকে এলেন। রীনা সাধারণত এতো সকালে ওঠেন না, তাই মাকে ঢুকতে দেখে সৌমিক অবাক হলো, উদ্বেগের গলায় বললো,

কি হয়েছে মা? তুমি এতো ভোরে?

রীনা ঘরের চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন,

তোমাদের ঘরে এতো ভোরে আলো জ্বলছিলো কেনো? আমি বাগানে আলো দেখলাম, তোমাদের ঘরের জানলা থেকেই আসছিলো! আমি তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছি!

সৌমিক হেসে ফেললো,

আর বোলো না! অপর্ণা নাকি কি একটা স্বপ্ন দেখেছে! সে ভোর রাতে ঘেমে নেয়ে একসা! তাই ভয় কাটাতে আলো জ্বেলে দিয়েছিলাম!

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় শুনেছি! তা কি স্বপ্ন দেখলে? ভয় পেয়েছো মানে তো ভালো স্বপ্ন নয় নিশ্চয়ই?

সৌমিক বাধা দেবার আগেই অপর্ণা নিজেই মুখ খুললো,

খুব খারাপ স্বপ্ন মা, আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, স্বপ্ন টা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে!

রীনা কপালে হাত ঠেকালেন,

যাকগে আর মুখে উচ্চারণ করতে হবে না! বারবার খারাপ বললে খারাপই ঘটে! স্বপ্নেরই বা দোষ কি, তোমরা সব আজকালকার ছেলে মেয়ে, ওসব মানো না, জেদ দেখিয়ে ফেরত নিয়ে এলে! পুরুত মশাইয়ের কথা তো আর মিথ্যে হতে পারে না, তিনি যখন বলেছেন তখন তো সব দিক দেখে শুনে, কুষ্টি বিচার করেই বলেছেন! তাও তোমরা শুনলে না, এখন এসব খারাপ স্বপ্ন তো আসবেই! জানিনা কি দেখেছে, সেসব সত্যি না হলেই ভালো!

রীনা উঠে পড়লেন, যাবার আগে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

নিচে এসো, অনিন্দিতা চা বসিয়েছে!

সৌমিক মাথা নাড়লো,

হুঁ! আসছি!

শাশুড়ির কথা শুনে অপর্ণা শুকনো মুখে বসেছিলো, সৌমিক কে দেখে বললো,

ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয় নাকি? মা বললেন যে!

সৌমিক হাসতে হাসতে বললো,

আমার তো হয়নি! যদি হতো তাহলে তো তোমার বদলে এখানে খাটে মিতা বসে থাকতো এখন! আমি তো সেই ছোটো থেকে শুধু ভোরে কেনো, প্রথম রাতে, মাঝ রাতে, শেষ রাতে কতো বার ওকে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছি! কিন্তু সেসব স্বপ্ন কে ব্যর্থ করে তুমি খাটের দখল নিয়ে নিয়েছো!

অপর্ণাও হেসে ফেললো, টেবিলের ওপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা সৌমিকের মুখের ওপরে ছুঁড়ে মেরে উঠে দাঁড়ালো,

খুব শখ না! আসুক আর একবার তোমার স্বপ্নে ওই মিতা! দেখো কি করি ওকে, সত্যি খুন করে ফেলবো!
ক্রমশ