#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৭]
সিদাত অনয়ের ফ্ল্যাটে এসে সারা-দিন ঘুমিয়ে কাটালো। গত রাত ঘুম হয়নি তার অস্থিরতায়। অনয় সিদাতকে ফ্ল্যাটে রেখে অফিস গেছে। মোটামুটি ভালো পর্যায়েই চাকরি করছে অনয়। অনয়ের বাবা-মাও গ্রামে থাকে। অনয় চাকরির খাতিরে শহরেই থাকছে। সে মেসে থাকতে পারতো। কিন্তু মেসের পরিবেশের কারণে অনয় মেসে যাওয়ার সাহস করেনি। এছাড়াও সিদাতের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।
অনয়ের ফ্ল্যাটে শুধু অনয় একা নয়, সিদাতও থাকে। অর্থাৎ দু’জন ভাগাভাগি করে আর কী। এ-কারণে দুজনেই ভাগ করে ভাড়া দেয়। সিদাত ঘুমিয়ে উঠলো দুপুর বারোটায়। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো। রেডি হওয়া শেষে অনয়ের ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই তরীর মুখোমুখি হলো। তরী সবেই দরজা খুলে বের হলো। হাতে বালতিভর্তি ভেজা জামা-কাপড়। তরী সিদাতকে দেখে অপ্রস্তুত হয়। সঙ্গে সঙ্গে মুখে ওড়না টেনে লম্বা, লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। আর হতভম্ভ সিদাত তখনো একই জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। ঘুম থেকে ওঠে প্রথমেই তরীর চোখ জোড়া দেখতে পেলো। দিনটা কী আজ ভালো যাবে?
আনমনে হেসে ফেললো সিদাত। পরমুহূর্তে হাসি থামিয়ে নিজের গালে আলতো করে চড় মারলো। বিরক্তিতে কপাল কুচকে মিনমিন করে বললো,
–“রাতে না ঘুমিয়ে মাথাটা পুরোই গেছে।”
সিদাত অনয়ের ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে দিলো। অনয়ের কাছে এক্সট্রা চাবি আছে। সিদাত তার চাবিটা পকেটে পুরতে পুরতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। নামতে গিয়ে বারবার গত রাতের ঘটনা মনে পরে যাচ্ছে। তরীকে দেখে সিদাতের বিষণ্ণ মন ফুরফুরে হয়ে গেলেও এক অজানা অস্থিরতা, মুগ্ধতা সে অনুভব করছিলো। যার কারণে সে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি।
গতকাল সিদাত অনয়কে একপ্রকার জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করেছিলো,
–“এই অনয়। বল না, নিকাব রাণীর নাম কী?”
অনয় তখন কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে চোখ বদ্ধ অবস্থায় জড়ানো কন্ঠে বলেছিলো,
–“জানি না তো বাল! সর তো। ঘুমোতে দে।”
বলেই অনয় আবার ঘুমিয়ে পরে। আর অস্থির সিদাতের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। গতকালকের এসব কাজের জন্যে সিদাত বড্ড লজ্জিত। না জানি, অনয় আবার তাকে কী ভেবে বসে। যেভাবে বদ্ধ পাগলের মতো আচরণ করেছিলো। তবে এখন মনে হচ্ছে তরীর নাম জানার দরকার নেই। তার “নিকাব রাণী” সম্বোধনেই মেয়েটাকে বড্ড মানায়।
তরী ছাদে এসে রেলিঙের কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিলো। এই বদ ছেলেটার সাথে এত ঘন ঘন দেখা কেন হয় তরী বুঝতেই পারে না। সিদাতের বাহিক্য রূপ দেখে মোটেও বিশ্বাস হয় না যে এই ছেলে সেদিন তারই বাসায় মাতাল অবস্থায় পরে ছিলো। “মাতাল” শব্দটা মনে এলেই তরীর নাক জ*ঘন্য ভাবে কুচকে যায়। অথচ গলার স্বর দেখো। কথা বলায় হেব্বি পটু। তরীর জানা নেই সিদাতের পেশা কী। তবে সাবিয়ার থেকে এটুকু জেনেছে সিদাত রাজনীতিতে নেই। অবশ্য রাজনীতিতে থাকলে তো আগে-পিছে ক্তু চ্যালারা থাকতো। এই লোক আবার একাই হেঁটে-খেলে বেড়ায়।
এসব নানান ভাবনা ভাবা শেষে নিচে তাকাতেই দেখলো সিদাত বেরিয়ে গেছে। তরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বালতিভর্তি জামা-কাপড় এক এক করে রশিতে টাঙিয়ে দিতে শুরু করলো। আজ অবশ্য তরী ভার্সিটি যায়নি।
——————
সিদাতের আজ বেশ তাড়া। সে বক্ষের বোতাম লাগাতে লাগাতে দ্রুত পায়ে সাইফের ঘরে ছুটলো। সাইফ কলে কথা বলছে। সিদাত চট করে সাইফের কান থেকে মোবাইলটা নিয়ে কল কেটে দিলো। সাইফ এমন অবস্থায় অস্ফুট স্বরে বললো,
–“আরেহ! আমার জরুরি কল ছিলো!”
সিদাত সেসব না শুনে বললো,
–“আমার বাইকের চাবি দাও ভাইয়া। আজ আমাএ ইমার্জেন্সি শো আছে। প্লিজ!”
সাইফ সিদাতের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
–“সাত দিনের সবে একদিন ফুরিয়েছে৷ এখনো ছয় দিন বাকি!”
সিদাত কতক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলো সাইফের দিকে। সাইফ সিদাতের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আবার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সিদাত এই সুযোগে বিছানার পাশের ছোটো বক্সের উপর থেকে চাবিটা নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
–“হ্যাভ এ গুড ডে ব্রাদার!”
সিদাতের হাতে নিজের গাড়ির চাবি দেখে সাইফ কথা বলা অবস্থায় উচ্চস্বরে “সিদাত” বলে ডেকে ওঠে। কিন্তু সিদাত শুনলে তো। সাইফ শূন্য দরজার দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
–“আজ আমার সর্বনাশ হলো! এখন কার গাড়ি নিয়ে বের হবো? সিদাতের বাইক নিয়ে? ওহ গড!”
শো শেষ করতেই অনয়ের কল এলো। সিদাত তখন সবে আরামদায়ক চেয়ারে গা এলিয়েছে। সিদাত অনয়ের কল রিসিভ করে ভারী গলায় বললো,
–“হ্যাঁ বল।”
অনয় বললো,
–“মেয়েটার নাম বোধহয় তরী। তালা খোলার সময় শুনতে পেয়েছিলাম! কেউ যেন ডাকছিলো।”
সিদাত তড়িৎ সটান মেরে বসে। নড়েচড়ে বললো,
–“তুই না সেদিন বললি ও বাড়িতে দুটো মেয়ে। হতেও তো পারে ছোটো বোনের নাম তরী?”
অনয় ঠোঁট কামড়ে বললো,
–“হতেও পারে।”
সিদাত নিরাশ হয়ে বললো,
–“ফোন রাখ!”
অনয় চট করে বললো,
–“এই থাম। তোর মন কী খাচা ছেড়ে বেরিয়েছে নাকি বন্ধু?”
সিদাত থতমত খেয়ে বললো,
–“মানে?”
–“মানে বুঝো না? কাল থেকে নিজে অস্থির হচ্ছো সাথে আমাকেও পাগল করছো। এসব কিসের লক্ষণ আমি জানি না বুঝি?”
বলেই অনয় ফোনের ওপাশ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। হাসি কোনোরকমে থামিয়ে আবার বললো,
–“মন পাখি এত দ্রুত উড়ান দিবে, তা তো কল্পনাও করিনি বন্ধু। তাহলে মেনে নে, আমি-ই জিতেছি!”
সিদাত মানতে পারলো না। সে খুব রাশভারী গলায় বললো,
–“কচু জিতেছিস। একটু কিউরিওসিটিকে তুই প্রেমে রূপ দিচ্ছিস, আমি তো…”
সিদাতকে মাঝপথে থেমে যেতে দেখে অনয় ঠাট্টা করে বললো,
–“আমি তো কী? বল বল!”
সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“বন্ধুত্ব করতে চাই। আর কিছু না!”
——————–
তরী দীর্ঘক্ষণ চারুকলার ক্লাসরুম গুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মোটা একটি বই বক্ষে জড়িয়ে নির্নিমেষ চেয়ে আছে সেই ক্লাসগুলোতে। নির্বাক, হতাশায় ভরপুর চাহনি। চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীরা কাঁধে ঝুলিয়ে এবং হাতে সরঞ্জাম নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে কারো, কারো হাতে রঙ লেগে আছে। তরী সেসবই পর্যবেক্ষণ করলো। ভেতরটা কেমন শূন্য, শূন্য লাগছে। যেন মেঘ জমছে। তরী চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো। মাঠের এক পাশ কাটিয়ে যেতেই কিছু মেয়ের হাসা-হাসি শুনতে পেলো। মেয়েগুলো ছেলেদের গায়ে ঢলে পরছে। তরীর এতে গা গুলিয়ে এলো। একে তো ছেলেদের মতো পোশাক পরেছে, কোনোরকম লজ্জাবোধ নেই। তার উপর পরপুরুষের স্পর্শে নিজেদের স্মার্ট দাবী করে। যা সত্যি-ই তরীর কাছে ভীষণ অপছন্দের।
তরী বুঝতে পারলো ওদের হাসা-হাসি তাকে নিয়েই। আজ নতুন না, প্রায়-ই ওরা তরীকে নিয়ে হাসা-হাসি করে। তার পর্দা, বোরকা নিয়ে বিদ্রুপ করে, বিশ্রী কটাক্ষ করে। যা তরীকে ভীষণ রকম বিব্রত করে। তরী তাদের পাশ কেটে গেলে-ই একটা মেয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
–“ওই দেখ, আমাদের হালাল আপা যাচ্ছে। সালাম আপা, আপনার জন্যে বোরকাময় শুভেচ্ছা।”
ছিঃ। কতটা বিশ্রী এবং নিচু তাদের মানসিকতা। তরী তখনো এসব নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয় না। তর্ক করা তরীর স্বভাবে নেই। সে নীরবে আজীবন বলে গেছে, “ব্যবহারে বংশের পরিচয়।”
তারা তাদের অসভ্য আচরণকে প্রতিনিয়ত সভ্য বলে আখ্যায়িত করছে। তবে তরী এবারও কিছু বললো না। চলে আসলো। এই মেয়ে দুটো জ্বালাতন করছে গত বছর থেকে। প্রথম বর্ষে কোনো ঝামেলা হয়নি। দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝিতে মেয়ে দুটো তরীর পাশে এসে বসেছিলো। এবং কোনো ভণিতা ছাড়াই বলেছিলো,
–“এইযে, তোমার মুখের ওই নিকাবটা খুলো দেখি। তোমাকে দেখবো। কী লুকাচ্ছো আমাদের থেকে?”
ব্যাপারটা ভীষণ অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকর ছিলো। তরী সামনে তাকিয়ে দেখেছিলো দুটো ছেলে অদ্ভুত নজরে তার দিকে চেয়ে আছে। তরী গত দেড় বছরে বুঝে গিয়েছে মেয়ে দুটোর স্বভাব-চরিত্র। এজন্যে সেদিন তরী কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যাগ নিয়ে অন্য সিটে গিয়ে বসে পরে। সেই ব্যাপারটা তাদের ভাষায় “ইগো”-তে গিয়ে লেগেছে। এজন্য সেই সময় থেকে এখন অবধি তারা নানান ভাবে তরীকে ছোটো করার চেষ্টা করে।
তরী ভার্সিটির বাইরে আসতেই সিদাতকে দেখতে পেলো। পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে। তরী হতবাক। সিদাত তরীর দিকে চেয়ে চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,
–“তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম নিকাব রাণী! তোমার কী এক মিনিটের সময় হবে?”
তরী চোখ পাকিয়ে চাইলো সিদাতের দিকে। সিদাত চাহনিতে একরাশ ব্যাকুলতা ফুটিয়ে তুলেছে। তরী চোখ নামিয়ে সিদাতকে অগ্রাহ্য করলো। সিদাতকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই সিদাত “তরী” বলে ডাকলো। তরী থমকালো। সবার্ঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তরী যেন একদমই আশা করেনি সিদাত তার নাম ধরে ডাকবে। তরীকে থমকে যেতে দেখে সিদাতের বুঝতে বাকি রইলো না নিকাব রাণীর নাম “তরী!”
এই কয়েক দিনে সিদাত তরীর নীরব ভাষা বুঝতে শিখেছে৷ নিজের অজান্তেই। তরীকে থেমে যেতে দেখে সিদাত এক মুহূর্ত দেরী না করে প্রস্তাব দিলো,
–“আমার নীরব বন্ধু হবে নিকাব রাণী?”
~[ক্রমশ]