অভিনয় পর্ব-০১

0
345

#অভিনয়
#সূচনা_পর্ব
#মুমতাহিনা_তারিন

গায়ে সস্তা শাড়ি হাত ভর্তি বেগুনি কাচের চুড়ি পড়তে ব্যাস্ত পারু। ভালো নাম পারমিতা তন্দ্রা । সবার কাছে পারু নামেই বেশি পরিচিত পারমিতা । আজকে প্রায় তিন বছর পর প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে । মনটা ফুরফুরা টিনের বেড়ার ফাঁক গোলে আসা ত্বক ঝলসে যাওয়া রোদও যেনো অসম্ভব ভালো লাগছে ।

বাবা কৃষক ছিলেন । কোনো এক তীব্র গরমের দিন হুট করে মারা যান তিনি ।বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কাছে ঠাই হয় নি পারুর । মামা রা সবাই পারুর মাকে নিয়ে গেছেন প্রায় এক যুগ হতে চললো। চাঁচার বাড়ি শেষ আশ্রয় হয় পারুর । চাচা মানুষটা নেহাত ভালো নইলে কোথায় যে একটু ঠাই হতো জানা নেই । চাচী খুব বেশি খারাপ এমন না । তবে খুব আদর যত্ন করেন তাও না । বাড়ির কাজ ভাগ করা দুইজনের । গ্রাম থেকে অনেক দূরে একটা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছে পারু।

টিনের ঘরের জানলাটা খুলে বড়ো একটা রাজপ্রাসাদ এর ন্যায় বাড়িটার দিকে দৃষ্টি দেয় পারু । রাজপ্রাসাদ কেনো? এমন বড়ো বাড়ি যে তিন গ্রামে নেই । দুইতলা বাড়ি সাদা রং করা । দ্বিতীয় তলায় কি সুন্দর ব্যালকনি । ব্যালকনি ওয়ালা ঘরটা নাকি শাওনের । ভেবে মুচকি হাসলো পারু । হাতে পিঠার টিফিন বক্স টা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে যায়।

‘চাচীমা আমি রিপা দের বাড়ি গেলাম একটু । মানে শাওন শুনলাম কালকে রাতে এসেছে আমি তো যায়নি সকাল ধরে । আমি যায়?’

‘হ্যা যা তবে জলদি আসবি বাইরে ধান সেদ্ধ করা আছে উঠানে অনেক কাজ । ধান উঠাতে হবে বিকেলের রান্নাটা ও তো করতে হবে । ‘

‘ ঠিক আছে ‘

পারুর হাতের পিঠা শাওনের খুব পছন্দের । যেদিন শাওন শহরে যাবে সেইদিন নিজে হাতে ওর জন্য পিঠা বানায় নিয়ে গেছিলো । কি তৃপ্তি নিয়েই না খেয়েছিল শাওন!

বিশাল বড় গেটের সামনে রিপা দাড়িয়ে । রিপা শাওনের বোন । পারুর সমবয়সী একসাথে বেড়ে উঠা ওদের ।

‘পারুভাবি এখন সময় হলো আমার ভাইকে দেখার ?’

‘সকাল ধরে অনেক কাজ ছিল রে । তুই তো জানিস ধানের কাজে কত ঝামেলা ‘

গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রিপা বললো ,

‘ভাইয়ার কিছু শহরের বন্ধুরা এসেছে জানিস মেয়েরাও আছে । ‘

‘শহরে ওইসব সাধারণ ব্যাপার বুঝলি আমরা যখন কলেজ যেতাম দেখতিস না । অন্য ছেলেদের কত মেয়ে বান্ধবী ছিল ।’
‘ আমি তো ভাবতেছি অন্য কথা,, দেখা গেলো আমার কালো ভাবি রেখে ভাইয়ার সাদা বউ চাইলো তখন তোর কি হবে রে ‘

হো হো করে হেসে ভাবুক দৃষ্টিতে আকাশের পানে চাইলো রিপা।

পারু কালো খুব বেশি কালো নেই শ্যাম বর্ণ থেকে একটু চাপা । অন্যদিকে শাওন ফর্সা,,লম্বা বলিষ্ঠ দেহের গঠন । যদিও গ্রামীণ আবহাওয়াতে থাকায় ফর্সা রংটা একটু চাপা পড়ে গেছিলো।

রিপার এমন মজার সাথে পরিচিত পারু তাই সে ও বিস্তর হাসলো ।

গেট পেরিয়ে মাঝ বরাবর লম্বা ইট পাতানো রাস্তা । পাশ দিয়ে ফুল গাছ লাগিয়েছে রিপা আর পারু । ছোটো ছোটো গাছ কুড়ি আসতে অনেক দেরি । বুকের ধুকপুক আওয়াজটা যেনো বেড়ে গেছে কয়েকগুণ । কেউ কান পেতে শুনলেই ভাববে ঢোল বাজাচ্ছে কেউ বুকের ভিতর ।
দরজা পেরিয়ে টাইলস দেওয়া ফ্লোর এ পা রাখলো পারু কি ঠান্ডা! বাইরের গরম টা বোঝায় যাচ্ছে না ভিতরে ।

‘কিরে পারু নাই রে এই ভর দুপুরে কিসের কাজ ?’

‘ কোনো কাজ না খালা রিপা বললো শাওন আসছে কালকে তাই পিঠা বানাই আনলাম ‘

‘ শাওন শাওন কেন করিস তোর বড়ো না? ভাই বলবি বুঝলি’

কিছুটা ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে বললো তাহেরা বানু । তাহেরা সম্পর্কে শাওনের আম্মা। আগে কত আদর করতো পারুকে । আর এখন যেনো সহ্য করতে পারে না । প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো পারুর কিন্তু এখন লাগে না । খালার বয়স হচ্ছে আরও মাঝেমাঝে অসুস্থ থাকে তাই হয়তো মেজাজ খিটখিটে থাকে ভেবে আর ঘাটায় না খালাকে তেমন ।

রিপা ও ওর আম্মার ব্যাবহারে মাঝে মাঝে আকাশ থেকে পড়ে । এইতো যখন থেকে ওদের অবস্থা ভালো হতে শুরু করেছে তবে থেকেই কারোর সাথে মেশে না । আগে পারুর চাচীর সাথে কি গল্পঃ করতো আশপাশের পাঁচ বাড়ির খালা মামীরা মিলে শীতে পিঠা বানাতো তাদের মাটির চুলায় এ খন কেউ আসলে চোঁখ মুখ কুচকে বাহানা দিয়ে ঘরে শুয়ে থাকে ।

উপর তলা থেকে হাসির রিনিঝিনি শব্দে মুখরিত হচ্ছে বাড়ি । রিপার হাতে পাঁচ সাত প্রকার নাস্তা । উপরে দিয়ে আসার আদেশ করেছে তাহেরা বানু । পারুর হাতে প্লেট কয়টা তুলে দিয়ে নিজে ও কয়টা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে শাওনের ঘরের সামনে । ভিতর থেকে মেয়েদের হাসি শোনা যাচ্ছে আর ছেলেদের ভরাট কণ্ঠ ।

পারু বাইরে থেকে ভাই কে কয়েকটা ডাক দিল । ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই । শাওন বাড়ি প্রথম এসেই কড়া ভাবে বলে দেছে । কিছুক্ষন পর ফর্সা বর্ণের ছিপ ছিপে গড়নের একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল । চোখে কাজল ,,ঠোঁটে গোলাপী রঙের হালকা লিপস্টিক চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া । কি সুন্দর দেখতে ! আশ্চর্য হয়ে দেখে যাচ্ছে পারু সামনে দাড়িয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েকে।

‘ ও তো কোথাও গেলো দেখলাম তুমি আমার কাছে দাও ‘ বলে হাত বাড়ালো মেয়েটি ।

হালকা হাসি উপহার দিয়ে রিপা ও প্লেট গুলো দিয়ে দিলো । জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে পারুর দিকে তাকালো মেয়েটি ।

‘ও কে?’

‘ ও হলো পারুভাবী। আমাদের পাশের বাড়িটাই ওদের ।আমার বান্ধবী ‘

একদমে কথা গুলে বলে দম নিল রিপা । আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পারুকে নিয়ে কেটে পড়লো । উদ্দেশ্য ছাদে যাওয়া । ও জানে শাওন এখন ছাদে আছে । পারুকে ঠেলেঠুলে ছাদে দিয়ে নিচে নেমে গেলো রিপা । আশ্বস্ত চোখে বলে গিয়েছে নিচে আছে ও।

ছাদের নীচে দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছিল মনের সুখে শাওন । হটাৎ কারো পায়ের শব্দে পিছে ফিরে তাকায় । চোখে ভেসে উঠে তিনশো বিশ টাকার কেনা সস্তা শাড়ী পরে থাকা রমণীর দিকে । গত তিন বছরে পরিচিত মুখটার আদল পাল্টায় নি। শুধু আগের থেকে নাদুসনুদুস হয়েছে পারু। হাতে টিফিন বক্স নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে খতিয়ে দেখছে শাওন কে । আগের থেকে ফর্সা রংটা আরো যেনো ফুটে উঠেছে শাওনের শরীরে । ঠোঁট দুটো হালকা কালো গোলাপী মিশেলের। এতো সুন্দর তার প্রেমিক পুরুষ!

‘কিরে তুই এখন এখানে কেন?’

কিছুটা ধমকে বলে উঠলো শাওন । শাওনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবে বুঝে পেলো না পারু । ভেবেছিল প্রথমে শুনবে কেমন আছিস ,,,,তোকে অনেক সুন্দর লাগছে এমন কিছু বাক্য । তাই থতমত খেয়ে গেল।

‘তোর জন্য পিঠা আনছি ‘

তুই তোকারি করা শুনে খানিক বিরক্ত হলো শাওন । বিরক্তি তার সারামুখে ফুটে উঠলো ছো মেরে হাত থেকে বক্স টা নিয়ে ধপা ধপ পা ফেলে নিচে চলে গেলো । একবার প্রয়োজন বোধ করলো না তার দেওয়া শাড়িতে কেমন লাগছে পারুকে সেটা বলার ।

চোখে কোণে জল নিয়ে একা ছাদে পড়ে রইলো পারু ।
_________

সকালে নামাজ পড়ে উঠেছে পারু। চারদিকটা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে ।কোমরে উড়না বেধে চুল গুলো উচু করে খোঁপা বেধে লম্বা ঝাটা নিয়ে উঠান পরিষ্কার করতে লেগে গেলো । হাঁস মুরগি খুপি থেকে ছেড়ে দিয়ে রাতের বাসন নিয়ে ছুটলো কল পাড়ে। কলের কাছেই বড়ো একটা ডোবা ময়লা আবর্জনা সব এখানে ফেলা হয় । দুটো কুকুর ডোবার একপাশে দাড়িয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে কি যেনো খাচ্ছে।
ছোটো ছোটো মুরগির বাচ্চা আছে কয়টা চাচিমার,,যদি কুকুর নিয়ে যায় সেই আশঙ্কা নিয়ে কুকুর গুলো তাড়াতে গেলো পারু । সামনে এগিয়ে হেই হেই বলে চেঁচিয়ে উঠলো ।
সামনে এগিয়ে গেলো কিছুটা কুকুর দুটো ভয়ে পালিয়ে গেছে । পিছে ফিরে কল পাড়ে আসতে গিয়ে আবার কি যেনো ভেবে পিছে তাকালো আরেকটু এগিয়ে লক্ষ্য করলো তার হাত পুড়িয়ে বানানো পিঠা গুলো ডোবার ময়লা পানির আসে পাশে ছড়িয়ে আছে । মাছি ভন ভন করছে উপর দিয়ে ।

চলবে।