#অভিনয়
#পর্ব_৪
#মুমতাহিনা_তারিন
হাতে বিষের বোতল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে পারু । চাচা বিলে গেছে এই কড়া রোদে চাচিমা সকালে খবর খেয়ে ঘুম পড়েছে। উঠানের মাঝে যে দেয়াল তাতে হেলান দিয়ে বসে আছে পারু। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পারু কিন্তু কান্নাকাটি করে চোখ লাল করে নি । অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায় । পারু ও পাথরের মত হয়ে গেছে কোনো কষ্ট অনুভব হচ্ছে না ।কিছুই যেনো বোধ হচ্ছে না ওর । এই পাঁচিল যেমন দুই বাড়িকে আলাদা করে দিয়েছে ঠিক তেমনি দুইজনের মনে অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি হয়েছে।
মুরগি গুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনু সেদিকে ।
‘ পারু সাদা রংটা তোর সাথে যায় না ঐটা রেখে দে অন্য রং দেখ ‘
ভ্যানে করে সুন্দর উড়না বিক্রি করছিল গ্রামের এক লোক। রিপা দেখে দৌড়ে চলে আসছে পারুকে ডাকতে । দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছিল পারু । রিপা এসে টেনে তুললো পারুকে চাচিমা আগেই চলে গেছে উড়না দেখতে । কাপড় চোপড় অনেক বেছে খুঁটে কেনে চাচী যা ভালো করেই জানে আছে পারুর। তাই ধীরে সুস্তে মুখ ধুয়ে উড়না মাথায় দিয়ে চলে গিয়েছিল রাস্তায় । রিপা আর পারু উড়না পছন্দ করছিল । বরাবরই সাদা রং পারুর খুব ভালো লাগে কিন্তু নিজের চাপা রঙের কাছে ইচ্ছাগুলো মাটি চাপা পড়ে যায়। এ জন্য আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ হাতের সাদা উড়না টা রেখে অন্য রং দেখা শুরু করলো। তার ছোট্ট জীবনে চাপা রং নিয়ে অনেক কথায় শুনতে হয়েছে এখন সব সয়ে গেছে পারুর ।
‘ পারুভাবি এই নিল রঙটা তোর সাথে ভালো লাগবে ‘
‘ তাহলে এইটাই নেয় ‘
রাস্তার পাশে শাওন আর কিছু গ্রামের ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছিল দূর থেকে সব কিছুই লক্ষ্য করছিল শাওন ।
‘ কাকা সাদা উড়না টা আমাকে দেন ‘
রিপা ঠোঁট টিপে হাসছে আর পারুকে নিজের আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে ।
আশেপাশের মহিলারা একবার শাওনের দিকে তাকিয়ে আবার নিজেদের মতো কেনাকাটায় ব্যাস্ত হয়ে গেছে কেউ কেউ তো পারুকে নিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলা ও শুরু করেছে । প্রথম প্রথম পাশের বাড়ির লোকেরা পারুকে নানা ভাবে অপদস্ত করতো শাওন কে নিয়ে। শাওনের যে কম কথা শুনতে হয়েছে সেটা না । সবাই ওকে নিয়ে একটু মজা করতো বেশি মজা করতো বন্ধুরা । সে সব কিছুই পাত্তা দেই নি ওরা । সবাই তখন ভালোভাবেই জানে শাওনের সাথেই পারুর বিয়ে হবে। শাওনের মা তখন বিয়ের ব্যাপারে খুব উৎসুক। পারুর চাপা রঙের হলেও মুখে মায়া মায়া ভাব গুণের কোনো কমতি নেই পারুর । তাই তাহেরা বানু তখন এক পায়ে খাড়া পারুকে বৌমা করতে । শাওন কাকা কে টাকা দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে হেলে দুলে মাটির উঠান পার করে নিজেদের বাড়ি ঢুকলো।
‘ পারুরে তোর হলো কপাল একটা হচ্ছিল না এখন দুটো
‘
‘ শাওন কি বলেছে আমার জন্য কিনছে খালার জন্য তো কিনতে পারে ‘
‘ হয় খালার জন্য কিনছে ‘
মুখ ভেংচি কেটে বললো রিপা । বিকেলে রিপা পারু বসে ছিল পুকুর পাড়ে। হাতে প্যাকেট আর সাদা জবা নিয়ে হাজির শাওন । আশপাশ সাবধানী চোখে দেখে নিয়ে রিপার পাশে গিয়ে বসলো শাওন ।
রিপা উঠে গিয়ে বললো আমি একটু ঐদিকে আছি তোরা থাক । পারু হাত চেপে ধরে যেতে বারণ করা সত্তেও মিটমিট করে হাসতে হাসতে চলে গেলো রিপা।
‘ তুই কিনলি কেন? আমারে কি সাদা পড়লে মানায় নাকি!’
পারুকে কোনোরূপ স্পর্শ না করে সাদা জবাটা সুন্দর করে কানে গুঁজে দিলো শাওন । লক্ষ্য করলো পারুর মলিন হওয়া মুখটা মুহূর্তই যেনো ফুটে উঠলো ।
‘ তোরে সাদা পরলে খুব পবিত্র লাগে । মনে হয় একটা ছোট বেলী ফুল । মানুষের কথায় কান দিবি না একদম ‘
‘ আমি তো কালো,,, সুন্দর না তাও কেনো এত ভালবাসিস?’
‘ ভালোবাসি তাই ভালোবাসি তুই আমার কাছে সব থেকে সুন্দর ‘
‘সবাই যখন বলবে এতো সুন্দর ছেলের এমন বউ তখন খারাপ লাগবে না? ‘
‘ সবাই তো সুন্দরি বউ চায় আমি না হয় একটু বান্দরী বউ নিলাম ‘
‘ আমি বান্দরী!!!’
পুরোনো দিনের কথা ভেবে মুখে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠলো পারুর । শরীর ঘেমে একাকার মাটির বারান্দার তারের উপর থেকে জামা কাপড় বের করে গোসল করতে গেল পারু । ও অনেক ক্লান্ত একটু শান্তি চাই ওর।
_________________
পারুর কণ্ঠ শুনে নয়ন নিজেকে সাভাবিক করে শাওনকে ছেড়ে দিল । পারু চলে গেছে রিপা এখন ও হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে । কাচা তেতুল গুলো নিচ দিয়ে গড়াগড়ি করছে হাতে রিপার লবণ । নয়ন লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে ।
‘ আরে রিপা কখন আসলে ‘
‘ অ্যা হ্যাঁ একটু আগে,, আচ্ছা থাকো তোমরা আমি নিচে যায় ‘
‘ এই রিপা শোন এক মিনিট দাড়া….’
রিপা আর পিছে তাকায় নি । লজ্জা লাগছে কিভাবে পারুর সামনে যাবে ও!পারুর মলিন মুখটা ওর চোখের সামনে ভাসছে।
নয়ন সেইদিন খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে চলে গেছিলো । ওই ঘটনার পর শাওন কেমন ঝিম মেরে পড়ে আছে । রিপা ও ভালো মন্দ কোনো কথায় বলে নি শাওনকে । চুপ হয়ে গেছে রিপা ,,,তাহেরা বানুর সাথে ও কোনো কথা বলছে না সে।
রিপা ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নানা বাড়ীর উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেছে নানা বাড়ি যাবে বলার সাথে সাথেই তাহেরা বানু রাজি হয়ে গেছে ।মেয়ে কেমন চুপ হয়ে গেছে দেখেই কিছু আন্দাজ করছিল। রিপা আপাতত পারুর সামনে পড়তে চায় না । যাওয়ার আগে তাও ওকে চলে যাচ্ছে বলে গেছে,, কিছুদিন পর আসবে । পারু বুঝতে পারছে সব কিন্ত কিছু বলি নি ।
_____________
কেটে গেছে এক সপ্তাহ পারু আর শাওনের সাথে কোনো রূপ কথা ও বলি নি আর ওই বাড়ি যাই ও নি । চাচী বার কয়েক জিজ্ঞাসা করছে কিছু হয়েছে কিনা কিন্তু পারু চতুরতার সাথে এড়িয়ে গেছে ।
‘ শোনো তনুজা ভাবছি তাহেরা আপার সাথে কথা বলার কথা । এখন তো শাওন চাকরি পেয়ে গেছে এতদিন বাড়ি ছিল না তাই কোনো কথা হয়নি এখন যখন বাড়ি আছে তাহলে পারুর বিয়ের কথা বলি । পারুর বয়স হয়ে যাচ্ছে তো তুমি কি বলো?’
‘ হ্যাঁ আমার ও তাই মনে হচ্ছিল । শাওন শহরে যাওয়ার আগে আপা তো বলেই রাখছিল ওর চাকরি হলেই বিয়ে পড়িয়ে দেবে । তারপর এই ঘর বাড়ি বানানোর ঝামেলা হওয়ায় আর তো বিয়ের বিষয়ে কোনো কথা হলো না ‘
‘ কবে যাবো বলো ওদের বাড়ি । কালকে আমি আর দোকানে বসবো না আর মাঠে ও যাবো না । তাহলে কালকে যাবা?’
‘ হাঁ তাহলে কালকেই যাবো ‘
______________
আজকে সকালে রিপা বাড়ি এসেছে। আর কতদিন লুকায় থাকবে? ভোর ভোর দিকে এসেই ঘুম পড়েছিল ও।
গ্রামে মফিজ নামে একজনের মিলাদ পারুদের বাড়ির তিন বাড়ি পরে। তাই সকাল সকাল এসে পারুকে ডেকে নিয়ে গেছে পেঁয়াজ রসুন কেটে দিতে হবে । সব বাড়ি থেকেই একজন দুইজন করে গেছে সাহায্য করতে । পারুর হাতের কাজ ভালো তাই তনুজা কে বলেই নিয়ে গেছে পারুকে ।
এই দিকে সালাম মিয়া( চাচা ) তিন কেজি মিষ্টি ,এক কেজি দই আর ফল এনেছে বাজার থেকে । দুইজন খুশি মনেই গুছিয়ে রওনা দেছে তাহেরা বানুর বাড়ি এখন আর এক উঠান তো না একটু ঘুরে যেতে হয় ।
তাহেরা বানু জানালার কাছে বসে ছিল সালাম মিয়া আর তনুজা কে আসতে দেখে ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে ছুটলো শাওনের রুমে ।
‘ বাবু তুই নিচে আসিস না বুঝলি কিছু লাগলে রিপাকে বলে দিবি ‘
‘ কেন আম্মা?’
‘ আমি বলছি তাই ‘
এমনি ও শাওনের মন মেজাজ ভালো না তাই আর কথা বাড়ায় নি রিপা ও ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে।একটু পরেই পারুর সাথে দেখা করতে যাবে ও।
‘ রিপা কবে আসলি? আমাদের বাড়ি গেলি না যে তুই নেই পারুটা মুখ গম্ভীর করে ঘুরছে এই কয়দিন ।’
‘ চাচী আজকেই আসলাম ভাবলাম একটু পরে যাবো ‘
রিপা অবাক হয়ে গেছে পারুর চাচী কোথাও যায় না হুট করে চাচী ওদের বাড়ি আসছে তাও এতো মিষ্টি নিয়ে কারণটা বুঝতে পারছে না।আর বিয়ে সম্পর্কে ওরা ত কেউ কিছুই জানে না । তাই বিয়ের বিষয় কথা হতে পারে সেইটা ওর ভাবনার বাইরে ।
‘ কেমন আছেন ভাবি শাওন বাড়ি নেই?’
‘ আছে ও একটু অসুস্থ্য তাই শুয়ে আছে ‘
তাহেরা রিপা কে ইশারায় মিষ্টি গুলো রান্নাঘরে রেখে নাস্তা আনতে বললো । বাধ্য মেয়ের মত রিপা রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ভর্তি করে খাবার এনে টি টেবিলে রেখে এক পাশে দাঁড়ালো।
‘ আসলে আপা পারুর বিয়ের তো বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে আরো বাইরে থেকেও প্রস্তাব আসছে । কয়জনকে ফেরাবো বলেন! এখন তো শাওনের চাকরি হয়ে গেছে ঘর বাড়ী আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক ও করছে । এখন আপনার কি মত?’
‘ আমার কি মত মানে?’
‘ পারু আর শাওনের তো বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই আর আমাদের ও তাহলে শুভ কাজে দেরি করে লাভ কি বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলাটা ভালো না ?’
‘ দেখেন ভাই আমি অত ঘুরায় পেঁচায় বলছি না যা বলার সামনাসামনি বলি । আমার ওমন সোনার টুকরা ছেলে পড়াশুনায় যেমন ভালো ছিল এখন ভালো চাকরি ও করে তার সাথে কি পারুর যায়?? পারু না পড়াশুনা তে ভালো,,না কোনো গুন আছে তারপরে আবার মা বাপ নেই । তাও যদি রূপ থাকতো তাহলে ভাবতাম একটু তার বেলায় ও শূন্য চাপা রং আমার বাবুর সাথে কোন দিক দিয়ে যায় ওর? আমি বিয়েতে রাজি না ভাই আর শাওনের ও এ বিয়েতে কোনো মত নেই ‘
কিছুটা ঝাঁঝ মিশিয়ে কথা গুলো বললেন তাহেরা বানু ।তাহেরা বানুর কথা শুনে সালাম মিয়া আর তনুজা বেগমের মুখে যেনো এক গুচ্ছ মেঘ ভর করলো । শাওন কে কোনো অংশে কম দেখে নি তারা। তাহেরা বানুকে নিজের বোনের মতো ভাবত তনুজা বেগম । সালাম মিয়া চুপ না থেকে আবার বলে উঠলেন।
‘ কিন্তু আপা আপনি তো প্রস্তাব….’
‘ ভাবি সমস্যা নেই । ছেলে আপনার বিয়ে দেওয়া না দেওয়া আপনার ব্যাপার । আমরা ভুল করে ফেলেছি ভাবি পারুর সাথে সত্যি শাওনের মত ছেলের যায় না। ‘
‘ আপা মাফ চাচ্ছি কিছু ভুল বলে থাকলে । আজকে আমরা উঠি আপা ।’
‘ না না সমস্যা নেই ভাই । আবার আসবেন ‘
তাহেরা বানু মনে মনে অনেক খুশি হলেন এমন ভাবে সব সামাল দিতে পারবেন উনি বুঝতে পারে নি । শাওনের অবহেলা দেখে তাহেরা এক প্রকার ধরেই নিয়েছেন পারু কে আর শাওনের ভালো লাগে না । যতই হোক পুরুষ মানুষ নয়নের মত সুন্দরী মেয়ে রেখে কোন ছেলে পারুর মত কালো মেয়ের পিছে ঘুরবে । নয়ন তাহেরার মনের মত লাল টুক টুকে মেয়ে এমন মেয়েই তো তাহেরা চাইতো । কিন্তু শাওনের পাগলামি দেখে একপ্রকার মেনে নিয়েছিল পারুকে ।
সমস্ত ঘটনায় রিপা যেনো এক নিরব দর্শক । নিজের মায়ের আর ভাইয়ের এমন পাল্টি খাওয়া দেখে ও একেবারে বাকহীন হয়ে গেছে । মায়ের কথা না হয় বাদ দিল ও কিন্তু শাওন!!!!
চলবে