#কৃষ্ণডাহুক – ১৪
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
মীরা দৌঁড়াচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না তবে সে দৌঁড়াচ্ছে। আদ্রিক তাকে ওই সময় কি বলল আই লাভ ইউ মীরা? আচ্ছা সে কি মীরার অতীত সম্পর্কিত কিছু জানে? তারচেয়ে বড় কথা অরিন আদ্রিককে ভালোবাসে! সে জেনে শুনে কিভাবে অন্য মেয়ের ক্ষতি করবে? একটা মেয়ের জন্য যেইভাবে তার সংসার ভেঙ্গেছে আজ তার জন্য হয়তোবা আরো একটি মেয়ের মন ভাঙ্গবে যেটা মীরা চায় না।
‘ মীরা দাঁড়াও! প্লিজ! ‘
মীরা থামলো। পরপর দুইবার শ্বাস ফেলে কঠোর দৃষ্টিটে আদ্রিকের দিকে তাকালো! কঠিন গলায় বলল,’ আপনার লজ্জা হওয়া উচিত! সেসময় মুখ বুজে সহ্য করেছি বলে এই নয় যে সবসময়ই সহ্য করবো আপনাকে। আপনাদের মতো ছেলেদের জন্যই আমার মতো হাজারো মেয়ের মন ভেঙ্গেছে! প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে। ‘
বলে থামলো মীরা। আদ্রিক শান্ত দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,’ মীরা! শান্ত হও। ‘
আরো কঠোর থেকে কঠোর হলো মীরার দৃষ্টি! কাটকাট গলায় বলল,’ কেনো শান্ত হতে বলছেন আমাকে আদ্রিক? আমার সম্পর্কে কতটুক জানেন আপনি? আপনি যে আমাকে ভালোবাসি বললেন কোন প্রসঙ্গে বললেন! আমি অরিন আপুর মতো শিক্ষিত নই, আমি সাধারণ একটা এতিমখানায় বড় হয়েছি। শ’খানিক বাচ্চার মধ্যে কখনো ভাত পেয়েছি আবার পাই নি! অতি সাধারণ আমি। ‘
আদ্রিক থমথমে গলায় বললেন,’ সাধারণের মধ্যেই অসাধারণ তুমি মীরা! অসাধারণ। ‘
‘ আমি ডিভোর্সি আদ্রিক! ‘
‘ মজা করছো? ‘
মীরা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,’ এখন কেনো মজা করছি কিনা বলছেন? আমার কথা বিশ্বাস হয় না? এমনটা হওয়ারই ছিলো। ‘
‘ মীরা, আপনি আমার ভালোবাসাকে ঠুকনো নজরে দেখছেন! আপনি ডিভোর্সি জেনে অবাক হয়েছি কারণ আদ্রিকা আমাদের কাউকেই এই ব্যাপারে কিছু বলে নি। ‘
‘ অরিন আপু আপনাকে অনেক ভালোবাসে! তবুও কেনো আপনি অরিন আপুকে বাদ দিয়ে আমার কাছে ভালোবাসা পেতে এসেছেন? খাঁটি সোনা ছেড়ে কেউ তামার কাছে আসে? ‘
‘ কখনো কখনো তামাও উপযুক্ত থাকে মীরা। ‘
মীরা বক্র হাসলো! ইয়ামিনও তাকে এইরকম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো আর সেই কথাগুলায় মীরা গলে যেতো কিন্তু এখন বুঝে মীরা। সেই বোকা সোকা মীরা আর নেই! ইয়ামিনকে ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই দুনিয়া কি বুঝতে শিখেছে! বুঝতে শিখেছে কিভাবে একা একা এই দুনিয়ায় বাঁচতে হয়। আচ্ছা তার কি খুব কষ্ট করতে হয়েছিলো? রিজিক তো আপনাআপনিই তার কাছে চলে এসেছিলো! কিন্তু একাকিত্বটা থেকেই গেলো! যে মূহুর্তে মীরার পাশে থাকার প্রয়োজন ছিলো কারো সে মূহুর্তে মীরা একা একা লড়ছে দুনিয়ার সাথে নয় নিজের সাথে লড়ছে।
‘ আপনার মতো কথা না আমার এক্স হাসবেন্ডও বলতো! কিন্তু শেষ পরিণতি কি হলো? বিচ্ছেদ! প্রেম করে বিয়ে ছিলো তবুও পরিণতি ভালো ছিলো না। ‘
আদ্রিক অসহায় চিত্তে তাকিয়ে বলল,’ আমাকে সুযোগ দেওয়া যায় না মীরা? ‘
‘ পরশু বাড়ি ফিরলে আপনার বিয়ের আয়োজন শুরু হবে আদ্রিক। আপনি বরং নিজের বিয়ের জন্য প্রস্তুত হন। ‘
বলেই আদ্রিককে ফেলে হাঁটা ধরলো মীরা।
–
বাড়ি ফিরে সবাই দেখলো মার্জিয়া বেগম বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। গত রাতের ব্যাপারে মীরা বা আদ্রিককে কেউই কিছু জিজ্ঞেস করেনি হয়তো তাদের বোধগম্য হয়েছে ব্যাপারটা তবে রাত থেকেই অরিন রাগে ফুঁসছে অরিনের রাগের কারণটা সবাই ঠিকই বুঝতে পেরেছে। মীরার ব্যাপারে কথা বলতে অরিন মার্জিয়া বেগমের ঘরে টোকা দিলো। মার্জিয়া বেগম হলুদের জন্য লোকদের কাজ বুঝাচ্ছিলেন ছেলের হবু বউকে দেখে সবাইকে চলে যেতে বললেন তারা যেতেই মার্জিয়া বেগম অরিনের হাত টেনে এনে তার পাশে বসিয়ে মুচকি হেসে বললেন,’ বউমা, কিছু হয়েছে তোমার? মন খারাপ যে? ‘
অরিন জোরপূর্বক হেসে বলল,’ আন্টি আসলে একজনের ব্যাপারে কথা বলার ছিলো। ‘
অরিনের কথায় চিন্তিত হলেন মার্জিয়া। কে আবার কি করলো ভাবতে ভাবতে অরিনকে প্রশ্ন করলেন।
‘ মীরা মেয়েটার হাবভাব আমার কাছে ভালো ঠেকছে না আন্টি। কেমন যেনো আদ্রিকের সাথে চিপকে থাকে। আদ্রিকের হবু হওয়ায় এইগুলো সহ্য হয় না আমার। ‘
আর ব্যখা দিয়ে বুঝাতে হলো না মার্জিয়া বেগমকে। তার যা বুঝার সে বুঝে নিয়েছে। মনে মনে একটু বিরক্তও হয়েছে সে মীরার প্রতি।
অরিনের যেতেই মার্জিয়া বেগম মীরার রুমে গেলেন। মীরা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের কথা ভাবছিলো। মার্জিয়া বেগমের ডাকে তার কাছে যেয়ে বলল,’ কিছু বলবেন আন্টি? ‘
‘ আদ্রিকের হলুদ কাল, জানো তো তাই না? ‘
মীরা মাথা নাড়ালো। মার্জিয়া বেগম বললেন,’ সোজাসাপটা কথা বলি, মনে নিও না। তুমি আদ্রিকের থেকে একটু দূরে থেকো, অরিনের পছন্দ হচ্ছে না। আসলে ছেলেটার সামনে বিয়ে, অরিন ওর হবু বউ। যার সাথে সারা জীবন থাকতে হবে তার জন্য মনে হালকা সন্দেহ থাকলেও সংসারটা টিকে না। বুঝতেই পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি। ‘
‘ পারছি। ‘
মার্জিয়া বেগম হালকা হেসে চলে গেলেন। উনার যেতেই মীরা দরজা বন্ধ হয়ে ধপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পড়লো। মার্জিয়া বেগমের কথায় মীরা কষ্ট পেয়েছে! সে তো কিছুই করে নি তবে কেনো তাকে ভুল বুঝলো অরিন?
–
‘ মীরা, তুমি এখনো গতপরশুর রাগ পুষে রেখেছো! ‘
‘ আপনার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হবে কাল থেকে। শুধু শুধু আমার পিছে পরে না থেকে নতুন জীবন নিয়ে চিন্তা করুন। ‘
আদ্রিক মৃদু জোরে বলল,’ আমি এই বিয়েটা করব না মীরা! ‘
‘ জেদের বসে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আপনি আদ্রিক! আপনি আর আমি এটা সম্ভব না কিছুতেই। ‘
আদ্রিক বক্র হেসে বলল,’ সম্ভব মীরা! আমি তোমাকে বিয়ে করবো পরশুদিনের মধ্যে! আমি তোমার সামনে নিজের ভালোবাসা প্রমাণ করেই ছাড়বো! আর তুমি নিজেই আমাকে ভালোবাসি বলবে। ‘
‘ আদ্রিক! পাগলামো বন্ধ করবেন দয়া করে? জীবন আপনার যত সহজ মনে আসলে তত সহজ না এই জীবন! ধরেন বিয়ে হলো, আমি ডিভোর্সি সেটা আপনার পরিবার জানলে আমাকে মেনে নিবে? আপনার দাদি জীবনেও মেনে নিবে না যেইখানে তিনি অরিন আপুকেই মেনে নিচ্ছে না। ‘
‘ সংসারটা আমি করবো, তারা নয়। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার খালি আমারই আছে আর কারো নয় মীরা। ‘
মীরা বুঝতে পারলো আদ্রিকের সাথে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। আদ্রিক তার কথা মানা ও বুঝার পাত্র নয়। তাই নিজের সময় ব্যয় না করে মীরা স্থান ত্যাগ করলো। আদ্রিক মীরার যাওয়ার পথে বক্র হেসে বিড়বিড় করে বলল,’ তুমি নিজেই আমাকে ভালোবাসি বলে নিজের স্বামী রূপে স্বীকার করবে মীরা! আর সেটা খুব জলদি হবে। ‘
আদ্রিকের মনে কি কুন্ডলী পাকাচ্ছে সেটা সে ছাড়া কেউ জানে না।
মীরা নিজের রুমে এসে বিছানায় শুলো। সাথে সাথে যেনো শ রাজ্যের ঘুম এসে চোখে হানা দিলো।
–
কৃষ্ণচূড়া ফুল নেওয়ার চেষ্টা করছে মীরা। তবে তার কম উচ্চতা থাকায় হাজার চেষ্টা করেও ফুল নিতে সক্ষম হচ্ছে না সে। হুট করে মীরা উপলব্ধি করলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মীরা তাকাতেই মীরার মাথা ধাক্কা খেলো কারো। মীরা বিরক্ত হয়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো সুদর্শন আদ্রিককে! আদ্রিককে দেখতে যেনো কত মোহনীয় লাগছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে মীরা আদ্রিকের দিকে তাকালো। আদ্রিক হেসে বলল,’ নজর দিচ্ছো মীরা? প্রিয়তমার নজর লাগলে তো আরো ভালো! আরো বেশি সুন্দর হয়ে যাবো আমি। ‘
মীরা ততক্ষণাৎ দৃষ্টি সরালো। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিতবোধ করলো মীরা। আদ্রিক কি ভাবলো তাকে? আদ্রিক হাসলো! মীরার গাল টেনে বলল,’ লজ্জা পেলে তুমি লজ্জাবতী গাছের মতো একদম মূর্ছে যাও! ভীষণ সুন্দর লাগে তোমাকে। ‘
চলবে?
#কৃষ্ণডাহুক – ১৫ ও ১৬
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
আলিশান বাড়ির ঘরজুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান! জানালা ছেড়ে শীতল বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে। মেদিনীর বুকে সায়াহ্ন নেমে এসেছে। সুন্দর আলিশান বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে। হলরুমজুড়ে সারা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। সাহিল হুমায়ূন মুখ গম্ভীর করে বলল,’ আদ্রিক? বিয়েটা করতে চাচ্ছো না কেনো? অরিনের মধ্যে কি খারাপ আছে? ‘
অরিন ফ্যাচফ্যাচ শব্দ তুলে কাঁদছে। অরিনের শব্দে বিরক্ত প্রায় সকলে। মীরা এককোণে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে রা নেই। আদ্রিক তার দিকে তাকয়ে সাহিল হুমায়ূনকে উত্তর দিলো,’ অরিনকে আমি বিয়েটা করবো বড় আব্বু! কিন্তু এই মূহুর্তে আমি প্রস্তুত নই! আমার কয়েকদিন সময় চাই। ‘
আদিল আদ্রিকের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, তেতে বললেন,’ গ্রামবাসীদের দাওয়াত দেওয়া হয়ে গিয়েছে আর তুমি বলছো এখনো তুমি প্রস্তুত নও? ‘
আদ্রিক আদিল হুমায়ূনের চোখে তাকিয়ে বলল,’ জ্বী প্রস্তুত নই! আমার অনুমতি ছাড়াই যেহেতু এই বিয়ে ঠিক করেছেন তবে কিছু তো ঝামেলা পোহাতে হবেই৷ ‘
বলেই আদ্রিক হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলো। সকলে স্তম্ভিত চোখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। মার্জিয়া চাপা স্বরে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে উঠলেন! মানসম্মান আর থাকবে কিভাবে গ্রামবাসীর সামনে?
_
মীরা নিজের ঘরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। শরীর ক্লান্ত তবে মনটা বেশ অক্লান্ত। নিজের অনুভূতির নাম জানে না সে তবে বেশ বুঝতে পারছে আদ্রিক নামক মানুষটার প্রতি তার অনুভূতি উপস্থিত। মীরার আচানক বুক ধক করে উঠলো! আদ্রিকও ইয়ামিনের মতো? ইয়ামিনের মতো নিকৃষ্ট হলে? নাহ! এই অনুভূতির কোনো নাম নেই! এই অনুভূতি শুধুই সহানুভূতি! মীরা শয়ন অবস্থায় কড়াঘাত পড়লো দরজায়। মীরা উঠে দরজা খুললো। আদ্রিকাকে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মীরা ভ্রুদ্বয় একত্রিত করে বলল,’ কি হয়েছে আপু? ‘
আদ্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’ আব্বু সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়েছে, মীরা! ‘
মীরা চমকালো, তারমানে আদ্রিকের বিয়ে হবে? কোথাও না কোথাও ব্যথা অনুভূত হলো মীরার কিন্তু সেটা পাথর দ্বারা চাপা পড়ে গেলো। মীরা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ আদ্রিকের বিয়ে হবে? ‘
‘ উহু, আমার বিয়ে হবে কাল। ‘
মীরা এবার অধিক চমকালো। বিস্মিতপূর্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকার শুকনো মুখশ্রী। মীরা থমথমে মুখে বলল,’ আংকেল এতো দ্রুত পাত্র পেলো কি করে? ‘
‘ পাত্র আব্বুর আগে থেকেই পছন্দ ছিলো আমার জন্য। পাত্ররও নাকি আমাকে পছন্দ। তাই আব্বু চাইছেন দ্রুত বিয়েটা সেড়ে ফেলতে আর কালকের মধ্যেই। যেহেতু এটা মানসম্মানের ব্যাপার। আমার বিয়ের পরপর দিয়েই আদ্রিকের বিয়ের কাজ শুরু করবে সম্ভবত। ‘
‘ তুমি কি এই বিয়ে নিয়ে খুশি নও? ‘
আদ্রিকা থতমত খেয়ে তাকালো মীরার দিকে। মীরার সন্দিহান দৃষ্টি! আদ্রিকা তড়িৎ মাথা নত করলো। ওড়না আংশিক আঙুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে তোতলিয়ে বলল,’ কি বলছো? পছন্দ না হওয়ার কি আছে? আব্বু তো খোঁজ নিয়েই বিয়ে দিচ্ছেন! অবশ্যই ছেলে সুন্দর হবে। ‘
‘ সুন্দর ধুয়ে পানি খাবে যদি চরিত্র ভালো না হয়? চরিত্রের উপরে কিছু নেই আদ্রিকা আপু। ‘
আদ্রিকা প্রতুত্তরে কিছু বলল না। নাহ! মন কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। চোখের কোণে নোনাজল চিকচিক করছে। মীরা লক্ষ্য করলো তা। সরু চোখে তাকালো আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা ভাণ ধরে মুখ ফিরিয়ে কৌশলের সহিত সন্তর্পণে চোখ মুছে নিলো।
মীরা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,’ এই বিয়েটা করতে চাও না? তুমি না চাইলে আমি আংকেল, আদ্রিক সবার সাথে কথা বলে দেখবো। ‘
আদ্রিকা চোখমুখ শক্ত করে বলল,’ মীরা এইটা আমাদের সম্মানের ব্যাপার। আদ্রিকের পরে যদি আমিও বিয়েতে না করে দেই তবে আমাদের মানসম্মান এই গ্রামে থাকবে না। আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ‘
মীরা মুচকি হাসলো! মেয়েরা কতই না কষ্ট করে পরিবারের জন্য! সেই পরিবারই একসময় তাদের পর করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। মেয়ে মানুষ মানেই কি পুতুল?
আদ্রিকা থমথমে মুখে উঠে চলে গেলো! এখানে আর এক মূহুর্ত থাকলে মীরা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিবে। যা সে কিছুতেই চায়না। আদ্রিকা সন্তর্পণে দরজা ছেড়ে নিজের ঘরে গেলো। কিন্তু লক্ষ্যই করল না দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলো। আদ্রিকার যেতেই অবয়বটিও জায়গা ত্যাগ করে।
_
বাড়ি বিয়ের আমেজে মুখরিত। চারপাশে ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে। বাড়ির গিন্নিরা শাড়ির আঁচল কোমড়ে বেঁধে ছুটাছুটি করছে। পুরুষেরা আলোচনার বৈঠক বসেছে। কাজের মহিলা চা দিচ্ছে একে একে সবাইকে। মীরাও হালকা পাতলা হাত লাগাচ্ছে কাজে। কাজ তো একদমই ফেলে দেওয়া যায়না।
মীরা একহাত দিয়ে খোলা চুলগুলো খোপা করে কাজ করছে। কিন্তু খোপা চুল বেশিক্ষণ টিকলো না তার পূর্বেই খোপা খুলে উন্মুক্ত হয়ে গেলো তার বিশাল চুল! অনেকবার চুল কাটাতে চেয়েও মীরা পারেনি, টাকার অভাবে। ভেবেছিলো বিয়ের পর ইয়ামিনকে নিয়ে চুল কাটাতে যাবে পার্লারে কিন্তু ইয়ামিনের মার তা পছন্দ ছিলো না বিধায় কোনোদিনো মীরা চুল কাটেনি। তবে মাঝে মাঝে ঘরে বসেই চুলের আগাছা কাটতো সে। মীরা পুনরায় চুল ঠিক করবে তার আগেই নিজের চুলে কারো স্পর্শ পেলো। মীরা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। ঘাড়কাত করে আদ্রিককে দেখতে পেয়ে চমকালো। তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াতে নিলে আদ্রিক এক হাত দিয়ে মীরার বাহু চেপে বলল,’ আমি চুল ঠিক করে দেই, দাঁড়াও। ‘
মীরা ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, নড়লো না কিঞ্চিৎ পরিমাণও। আদ্রিক তা দেখে মুচকি হেসে মীরার চুলে হাত দিয়ে আলতো করে বুলালো। খোপা করে সুন্দর বেলীর ফুলের মালা লাগিয়ে দিলো তাতে। মীরা চমকে বলল,’ এইসব লাগাচ্ছেন কেন? ‘
‘ বাজারে গিয়েছিলাম। আসার সময় একটা বাবুকে দেখলাম বেঁচতে তাই ভাবলাম নিয়ে আসি। ‘
‘ অরিন বা আদ্রিকার জন্য আনতেন! শুধু শুধু আমার জন্য আনলেন? ‘
মীরার কথায় আদ্রিককে এক টানে মীরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,’ সত্যিই কি তুমি বুঝো না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করো? ‘
‘ হয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করি! একটা মানুষ যখন ব্যথা পেতে পেতে শক্ত হয়ে যায় তখন সবকিছুই তার কাছে নাটক লাগে! ‘
‘ এই শক্ত খোলসে আবৃত এক কোমল মনের অধিকারিণী যে আছে তা আমি জানি! আমি চাই না তোমার কোমল স্বত্ত্বার ভালোবাসার কেউ হই! আমি চাই তোমার শক্ত খোলসের ভালোবাসার মানুষ! বানাবে কি আমায়? ‘
মীরা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিকের চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে! আদ্রিকের চোখ বলে দিচ্ছে সব! মীরা নিশ্বাস ফেললো! বলল,’ আমি অনেক ভীতু! আমার ভয় হয় কাউকে ভালোবাসতে। ‘
‘ সে ভয় নিয়েই আমাকে ভালোবেসে দেখো! আমি এই ভয় দূর করে দেবো, আগলে রাখবো বক্ষে। ‘
‘ সম্ভব না, দয়া করে বাচ্চামো, পাগলামো ছেড়ে দিন। অরিন আপু জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবেন। আমি মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের দুঃখের, বিরহের কারণ হতে চাই না। আমাকে অভিশপ্ত করবেন না। ‘
মীরা হনহন করে চলে গেলো। আদ্রিক ঠায় মেরে দাঁড়িয়ে রইলো মুচকি হেসে বলল,’ মীরা আমাকেও ভালোবাসবে! ‘
সাঁঝ বেলা নেমে এসেছে ধরণীর বক্ষে। সারা বাড়ি বেশ জমজমে। বাচ্চারা এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। মীরা হলুদ সালোয়ার কামিজ বের করে রেখেছে। পড়বে বলে, সবাই শাড়ি পড়েছে তার কাছে শাড়ি নেই বলেই এই প্রচেষ্টা। তাকে সবার মাঝে বেমানান লাগবে তবুও সে পড়বে, আদ্রিকার অনুরোধে। মেয়েটা খুব করে বলেছে যাতে সে আজকে অনুষ্ঠানে সর্বক্ষণ তার পাশে থাকে। আদ্রিকার অনুনয় ফেলতে পারে নি মীরা। রাজী হয়ে গেলো আদ্রিকার কথায়।
মীরা সালোয়ার কামিজ উলটে দেখছিলো তখন দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো এক মেয়ে। মেয়েটা বয়সে মীরার চেয়ে খুব বেশিই ছোট। ১০ বছরের হয়তো! মেয়েটা মীরার কাছে এসে লিপস্টিক ছড়ানো ঠোঁট এলিয়ে বলে,’ আপা, আপনার জন্যে একখান শাড়ি এনেছি। ‘
মীরা ভ্রুদ্বয় একত্রিত করে বলল,’ কে দিয়েছে শাড়ি? ‘
মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,’ মেঝ মায় দিছে। এই শাড়ি পইড়া দুরুত আহেন অনুষ্ঠানে। আদ্রিকা আপা কতক্ষণ ধইরা আপনাকে খুঁজতেছে। ‘
মীরা একগাল হেসে বলে,’ আচ্ছা তুমি যাও, আমি রেডি হয়ে এখনি আসছি। ‘
মেয়েটা হেসে চলে গেলো। মেয়েটার যেতেই মীরা শাড়িটার দিকে তাকালো। খুব সুন্দর কাজ করা হলুদ শাড়ি। মীরার পছন্দ হলো। মীরা শাড়ি পড়লো, কমদামি একটা লিপস্টিক ঠোঁটে হালকা ছোঁয়ালো। চুলগুলো খোপা করলো। শ্যামবর্ণের শরীরে সাজটা আহামরি সুন্দর না লাগলেও তাকে দেখত্র সুন্দর লাগছে। মীরা আয়নায় নিজেকে দেখলো। কতদিন পরে তার মুখে উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে।
চলবে?