জোনাকি প্রদীপ পর্ব-৬+৭

0
318

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা

নীরার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো। সে খেয়াল করে দেখেছে, যখনই ওর কোনো প্রয়োজন থাকে তখনই এই সমস্যাটা হয়। যেমন এমনিতেই ভালোই থাকে সব, কিন্তু পরীক্ষার সময় এগিয়ে এলেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। একবার রাতে ফুরফুরে মেজাজে শুয়েছে, সকালে বাড়ির সবাই মিলে একজায়গায় ঘুরতে যাবে, শুরু হলো মাথা ব্যথা। যেন ওর প্রয়োজনের সাথে সাথে ওই বিশ্রী ব্যথারও নীরার মাথাটাকে দরকার হয় আয়েস করে বসবার জন্য৷ একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করে বসেছিল, তখনই একজন বলল,

“আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?”

“কেন? আশেপাশে তো অনেক জায়গা আছে সেদিকে যান।”

নীরার এমন কাঠখোট্টা জবাবে ছেলেটি প্রথমে যদিও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল, তবে ক্ষণেক পরেই সেটা কাটিয়ে উঠে বলল, “আপনি তো নীরা, তাই না?”

“তাতে কী হয়েছে? আপনি আমার পাশে বসার অনুমতি পেয়ে গেছেন?”

“আপনি আমাকে চিনতে পারেননি হয়তো।”

নীরা এবার ভালো তীক্ষ্ণ নজরে ছেলেটাকে দেখল। মনে হলো কোথাও আগে দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না। তবে যারা যেচেপড়ে আলাপ করতে আসে, এমন ধরনের লোকজনকে সে পাত্তা দেয় না। এদের সাথে সামান্য ভদ্রতা দেখিয়ে কথা বললে এরা পেয়ে বসে। ভাবে মেয়েটা পটে যাব যাব করছে। গাধাগুলো সৌজন্যতাই বোঝে না৷ মেজাজের পারদ চড়েছে ওর। তাই সে স্বভাবসুলভ রসকষহীন গলায় বলল,

“কেন? আপনি কি দেশের বিশাল বড় সেলিব্রিটি গোছের মানুষ যে জনে জনে আপনাকে চিনবে?”

এপর্যন্ত বললে অন্যরা দমে যায়, কিন্তু এই বেচারা দমল না। বরং ধৈর্য সহকারে গলায় সমস্ত বিনয় ঢেলে বলল, “না, আমি তেমন কেউ নই। তাই জনে জনে চেনার কথা না। তবে আপনি যেহেতু বকুল চাচির ভাইঝি…”

এইবার নীরা চিনতে পারল। বকুল ফুপু শ্বশুর বাড়ি অন্তঃপ্রাণ। ওখানকার সবাই ওদের বাড়িতে আসত। এই ছেলেকে বোধহয় সামনা-সামনি দেখেনি সে, কিন্তু ফুপুর বদৌলতে তার সাথে আনা এ্যালবামে এই গুণধর ব্যাক্তিকে দেখেছে। তবে সামনা-সামনি কিছুটা অন্যরকম দেখতে। ছবিতে দেখে মনে হতো লাজুক, গোবেচারা ধরনের মানুষ। কিন্তু এখন উল্টোই মনে হচ্ছে। কথার পিঠে কথা বলায় অত্যন্ত পারঙ্গম বলেই মনে হচ্ছে।

“এখন বসতে পারি?”

“বসুন।”

“আমার নাম সায়মন।”

“এটা বলার জন্য এত ঝক্কি ঝামেলা সহ্য করে বসলেন?”

সায়মন হেসে ফেলে বলল, “শুরু থেকেই আমাকে ভড়কে দেবার একটা প্রবণতা আপনার মধ্যে দেখছি। হয়তো ভাবছেন আমার উদ্দেশ্য আপনাকে বিরক্ত করা। কিন্তু আমি তেমন অল্প বয়সী কেউ নই যে কারো অনিচ্ছা সত্বেও তার বিরক্তির কারণ হব। আর আমাকে ভড়কে দেয়া এত সহজও নয়।”

নীরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, আমি কিন্তু বিরক্তই হচ্ছি।”

সায়মন হাসিটা চওড়া করে বলল, “সেটা হয়তো আমার ব্যর্থতা। আমি কিন্তু আপনার বিরক্তি এক তুড়িতে কাটিয়ে দিতে পারি।”

“কেন? আপনি কি লাফিং গ্যাস স্টোর করে এনেছেন? তুড়ি মেরে সেটা আমার নাকের সামনে ছেড়ে দেবেন? নাকি হাইলি স্কিলড ম্যাজিশিয়ান? কোনটা?”

“কোনোটাই নই। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। ম্যাজিক ট্যাজিক জানি না।”

“দেখুন ভাই, আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি কিশোরী মেয়েদের মতো আপনার কথায় পটে যাব কিংবা আপনার চেহারা দেখে ফিট খেয়ে পড়ে থেকে তিন বেলা আপনার নাম যপ করব তাহলে ভুল ভাবছেন।”

“যাক, অন্তত কিশোরী মেয়েদের মাথা খারাপ করবার মতো কোয়ালিটি তাহলে আমার মধ্যে আছে, এটা স্বীকার করলেন। এটা আমার বিশাল বড় প্রাপ্তি। তবে আমি আজ অব্দি এমন কিছুতে সফল হইনি।”

নীরা চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে হাতের তালুতে নিজের মাথায় চেপে ধরে বসল। ওদিকে বাংলাদেশ বেতারের মতো সায়মনের কথা বেজেই চলেছে। বাংলাদেশ বেতারে তবুও খানিকটা বিরতি আছে। এই লোকের তা-ও নেই দেখা যাচ্ছে। নীরার খুব কঠিন গলায় বলতে ইচ্ছে করল,

“আরে গ আকার ধ আকার, তুই মেয়ে পটাতে পেরেছিস কী পারিসনি সেই কেচ্ছা শুনে আমার কাজ কী?” কিন্তু বকুল ফুপুর কথা চিন্তা করে বিরত থাকল। তার আদরের সায়মনকে কিছু বললে তার কলিজাতেও তীর বিঁধবে।

“আমার জীবনের সবচাইতে লজ্জাজনক এবং একমাত্র প্রত্যাখ্যানের গল্পটা বলি তাহলে। তখন আমি সবে টেনে পড়ি। উঠতি বয়স, তাই প্রেম নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ফ্যান্টাসি তৈরি হচ্ছিল মনে। ভালোবাসা যে কী সেটাই বুঝতে শিখিনি তখনো আসলে। তখন আমাদের ক্লাসেরই একটা মেয়েকে নিয়ে বন্ধুরা ক্ষেপাতে শুরু করল। কারণ আমার প্রিয় সাবজেক্ট ছিল কেমিস্ট্রি আর মেয়েটার নাম ছিল অনু। যে আবার ছিল কেমিস্ট্রি স্যারেরই আদরের মেয়ে৷ তো বন্ধুদের ওই অতিমাত্রায় ফাজলামোর জন্যই কিনা জানি না, হঠাৎ মনে হয়েছিল অনুর প্রতি বুঝি আমি কোনো কিছু ফিল করছি। প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পরে একদিন অত্যন্ত সাহস করে গেলাম নিজের অনুভূতির কথা ওকে জানাতে। বন্ধুরাও আড়ালে লুকিয়ে ছিল দেখার জন্য। আমিই ওদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম যাতে একা একা ভীত না লাগে। আমি যেই ভালোবাসার কথা বললাম, ওমা মেয়েটা রাস্তার মধ্যেই এমন কান্নাকাটি শুরু করল যে আমি তখন মান সম্মান নিয়ে পড়িমরি করে কেটে পড়ি। বন্ধুদের মধ্যে মুখ দেখানোর উপায় নেই। পরেরদিন স্যার ডেকে দিলেন উত্তম-মধ্যম। কী লজ্জার কথা। সেই থেকে আজ অব্দি আর সাহস করে কোনো মেয়েকে পটানোর সাহস করিনি।”

নীরা সশব্দে হেসে ফেলল। সে উপলব্ধি করল ওর বিরক্তি সত্যিই নেই সাথে মাথা ব্যথাটাও কমে গেছে। ছেলেটার মধ্যে সহজাত একটা ভঙ্গি রয়েছে। নীরার চারপাশের দুর্ভেদ্য প্রাচীর সামান্য চিড়ে কেউ ওকে নির্মল হাসাতে পারল, এই প্রথমবার।

“আপনার হাসিটা ভীষণ সুন্দর নীরা।”

নীরা হাসতে হাসতেই বলল, “আমি জানি। আর একটা খুবই সৎ পরামর্শ দেই ফ্রি অফ কস্ট। আপনি কোনো মতলবে যদি এসেও থাকেন, অন্য রাস্তা দেখুন প্লিজ। হেসেছি বলে ফেঁসে যাইনি, তেমন সম্ভাবণাও নেই।”

“বন্ধু ভাবা যায় না?”

“এত তাড়াতাড়ি কাউকে বন্ধু ভাবার মতো অতি বিশ্বাস আমার নেই। আসছি।”

নীরা যেতে যেতে একবার নিলয়দের দিকে তাকালো। সেখানে হৈ হল্লা, হাসাহাসির মধ্যে বসে থেকেও একজন যেন ঠিক নির্জন দ্বিপের মতোই একা। এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবার মতো বিষাদ আফনানের চোখেমুখে। সেই বিষণ্ণ চোখ দুটোর সাথে ওর চোখের স্পর্শ বিনিময় হলো যেন দৃষ্টির মাধ্যমে। নীরা চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত। নিজেকে আড়াল করতেই বাড়ির ভেতরে কণের কাছে চলে গেল।

***
ইরা দেখল শাফিন ক্যামেরা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল,

“এভাবে অলস ঘোরাঘুরি না করে আমার কিছু ছবি তুলে দিলেই তো পারেন।”

“সেদিন ছবি তুলেছিলাম বলে ঝগড়া করেছেন। আজ কেন তুলব?”

“সেদিন অনুমতি ছাড়া কাজটা করেছিলেন যেটা অন্যায়। আজ আমি নিজেই বললাম। ওই যে ওখানে স্টেজের পাশে যে দেয়ালে সুন্দর করে ডেকোরেট করা, ওইখানে চলুন। কী হলো, আসুন! আপনার পেমেন্ট নিয়ে টেনশন করবেন না। আমি কৃপণ নই।”

স্বল্প পরিচিত কারোর মধ্যে এমন অধিকারবোধ সচরাচর দেখতে অভ্যস্ত নয় শাফিন। সে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “আপনি হঠাৎ আমাকে বিশ্বাস করে ছবি তুলে দিতে বলছেন কেন? প্রথমদিন তো..”

“নীরা আপুর জন্য। আপু যেহেতু আপনাকে বিশ্বাস করে, তাই আমিও করি। নীরা আপু কোনো আজাইরা হেঁজিপেঁজি মানুষকে তার আশেপাশে এ্যালাউ করে না।”

নানানরকম পোজের ফটোসেশান চলল প্রায় মিনিট বিশেক। আরও অনেকেই এদিকে আসছে বলে ওরা সরে গেল। হঠাৎ পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে শাফিন বলল,

“আমার নাম্বারে একটা কল দিন না, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না।”

ইরা হেসে নিলয়ের বন্ধু রোমেলকে এদিকে ডেকে বলল, “ভাইয়া, উনার ফোন খুঁজে পাচ্ছেন না৷ তুমি একটু তার নম্বরে কল দাও তো।”

শাফিন প্রমাদ গুনে বলল, “ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমার ব্যাকপ্যাকে রেখেছিলাম৷ লাগবে না ভাইয়া।”

ইরা হেসে রোমেলকে বলল, “আচ্ছা রোমেল ভাইয়া যাও, ভাইয়ার কাছে যাও।”

রোমেল যাবার আগে বলল, “কোনো সমস্যা হলে ডাকিস।”

শাফিনের অভিব্যক্তি এখন ঠিক ছিঁচকে চোররা ধরা পড়লে যেমন হয় তেমন। ইরা মিষ্টি করে হেসে বিষ ঢালল যেন শাফিনের লজ্জাবনত মুখে।

“সরাসরি আমার কাছেই নম্বরটা চাইলে দিয়ে দিতাম। ত্যাড়াব্যাকা রাস্তা ধরেই সমস্যাটা করেছেন। এমন সস্তা ট্রিক এ-যুগে কেউ করে! আমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের সাথে এমন বোকা বোকা কাজটা করে আমার বুদ্ধিকেই ছোট করলেন আপনি! কী যে দুঃখ পেল আমার শার্প ব্রেইন।”

শাফিনের বলতে ইচ্ছে করল, “ধরণী দ্বিধা হও।”

এখন শাফিন মুখ দেখাবে কী করে এই মেয়ের কাছে! একটা বোকা বোকা ভুল, সারাজীবনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। নীরা জানলে কী ভাববে ওকে। কোন মতিভ্রম যে ওর হয়েছিল কে জানে!
………
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

নীরাদের বাড়ি নতুন অতিথির আগমনে আজ মুখরিত হয়ে উঠেছে। একেবারে বয়োবৃদ্ধ এবং শিশুরা বাদে সকলেই রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত মেতে রইল নতুন বউ নিয়ে। এরপর আরও রাত বাড়তেই ধীরে ধীরে সব স্তিমিত হয়ে এলো। আনিকার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। এত ভারী সাজপোশাক, গহনা তো সচরাচর পরা হয় না। তাছাড়া সেই কোন সকালে এসব গায়ে তুলেছিল। নিলয় ওকে আগেই বলেছিল বউ সাজে কাছ থেকে ওকে দেখবে। সেজন্য এখনো সবটাই সেভাবে রয়েছে। তবে সারাদিনের ধকলে এখন আর পরিপাটি নেই।

নিলয় তবুও একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলল, “তোমাকে অন্যরকম লাগছে, বউ বউ লাগছে।”

আনিকা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। বলল, “বউ সেজেছি, আজ বিয়েও করলাম। বউ বউ না লাগলে হয়!”

“আমাকে কেমন লাগছে দেখতে?”

“মেয়েরা ছেলেদের রূপের প্রশংসা করে না, জানো না?”

“কোন সংবিধানে লেখা আছে এটা?”

“মেয়েদের নিজস্ব সংবিধানে।”

“আজ ব্যতিক্রম হোক।”

“একদম না। এখন বিয়ে করে ফেলেছ। তাই আর এসব ঢং মানায় না তোমাকে, বুঝলে? সুন্দর লাগুক, অসুন্দর লাগুক তা তো একজনেরই। তাই ওসব না বলাই ভালো। বুঝলে?”

“তুমি কিন্তু খুবই টিপিক্যাল বউদের মতো কথা বলছো।” হেসে বলল নিলয়।

“কিছু জিনিস টিপিক্যাল হলেও সুন্দর। যেমন আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। এখন হাজব্যান্ড ওয়াইফ। বিষয়টা সুন্দর না?”

“ভালো ভালো।”

কথায় কথায় খুঁনসুটি একসময় থেমে যায়, আজ ওদের চির আরাধ্য প্রাপ্তির রাত। এই যে পাওয়া, তা যেন ওদের জীবনে অক্ষয় হয়, এই কামনা করল দু’জন সর্বান্তকরণে।

***
এই ক’দিন আফনান ঘুমিয়েছে নিলয়ের সাথে। আজ ওর জায়গা হয়েছে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। আত্মীয়স্বজনের আগমন উপলক্ষে এই ঘরকে বসবাস উপযোগী করা হয়েছে। ওর সাথে সায়মনেরও এখানেই জায়গা মিলেছে।

সায়মকে দেখে আফনানের প্রথমেই নীরার হাসিমুখের ছবিটা ভেসে উঠল। কতদিন পরে নীরাকে এভাবে হাসতে দেখল! আফনান কেবলই চোখের জল উপহার দিয়েছিল।

“আফনান, কী এত ভাবছেন বলুন তো?”

আফনান চমকে সায়মনের দিকে তাকায়। ঘরে একটা বড় খাট, ছোট্ট একটা টেবিল আর একটা কাঠের চেয়ার আছে। সায়মন সেই খাটে বসে প্রশ্নটা করেছে।

“না, এমনি কিছু না।”

“ঘুমাবেন না? অনেক রাত হয়ে গেল।”

“হ্যাঁ, ঘুমাব। আপনি ঘুমান। আজ আর মনে হয় আমার ঘুম আসবে না। আমার একটা বদ অভ্যাস হলো, ঘুমের সময় পেরিয়ে গেলে পরে আর হয় না।”

সায়মন হেসে বলল, “আমার আবার এমন কিছু নেই। যেখানেই রাত, সেখানেই কাৎ৷ আর শুলেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম।”

আফনান হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি তো ভীষণ সুখী মানুষ তাহলে।”

“তেমন দুঃখ পাবার মতো কিছু ঘটেনি আমার লাইফে। আসলে আমি জায়গা দেইনি।”

আফনানের মনে হলো ওর সামনে বসা সদালাপী ছেলেটা আসলেও যেন অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কেবলই ওরই যেন সব অপ্রাপ্তি।

“আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”

“মা আর বোন। বোনের অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর আমাদের সাথে থাকে না।”

“স্যরি, আপনার বাবা…”

“স্যরি বলার মতো কিছু নেই। উনি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন৷ তবে আমাদের সাথে তার কোনো লেনাদেনা নেই। তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি কিংবা সহানুভূতি যাই বলি, সেসব কিছু নেই।”

আফনানের এই বিষয়ে কথা বলতে ভীষণ অনীহা। তবুও এটাই ওর জন্য বহুল চর্চিত বিষয়। লোকটা ওর সাত বছর বয়সের সময় গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। ওর মা জানতে পেরে সাথে সাথে বেরিয়ে এসেছিলেন ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে। বাস্তবতার রুক্ষ মাটিতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে দেখেছে সে তার মা’কে। সেই শৈশব থেকে তাই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল জীবনের প্রতিকূলতার সাথে। তবে কিছু ভালো বন্ধু সে নিজের চারপাশে পেয়েছে। যারমধ্যে নিলয় সবচাইতে কাছের। ওদের সাথে থাকলে সে অন্য আরেক জীবনকে খুঁজে পায়। তাদের সান্নিধ্যে হৈ রৈ’তে মেতে থাকে। ক্লেদটুকু এখন আর ওর জীবনে নেই। কিন্তু ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র বাসিন্দা কথাটা নানাসময় নানা লোকে মনে করিয়ে দিয়েছে একসময়। মা ওর জীবনে কত বড় আশীর্বাদ সেটা কেবল সে-ই উপলব্ধি করতে পারে।

আফনান মন্দ সময়ে যাদের একান্ত সান্নিধ্যে সব ভুলতে পেরেছিল, তাদেরকে আঁকড়ে ধরতে চায়। বন্ধুতা হারাতে চায় না। নীরা যখন ওর কাছে নিজের কিশোরী বেলার সমস্ত আবেগ জড়িয়ে প্রথম ভালোবাসাটুকু ওকে সঁপে দিতে চেয়েছিল, সে তা গ্রহণ করতে পারেনি। ভয় পেয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল নীরাকে সে কখনো নিলয়ের বোন ছাড়া অন্য দৃষ্টিতে দেখেনি। তাই সে চরম অবহেলা ভরে ফিরিয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল মেয়েটা ভুল করছে। তাই ওমন ভুল যেন ভবিষ্যতে না করে। ওকে নিয়ে যেন অন্য কিছু না ভাবে আর। তাই সেই প্রগাঢ় আবেগ জড়ানো ভালোবাসা শেকড় সমেত সমূলে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। আফনান চেয়েছিল মেয়েটা ভালো থাকুক।

কিন্তু ওর অবচেতন মন ওকে নিজের কৃতকর্মের কথা ভুলতে দেয়নি। মনের কোথাও সূক্ষ্ম কাঁটা হয়ে আলতো করে খুঁচিয়ে দিয়ে যেত। এখানে সে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রাণমনে চেষ্টা করেছে অবচেতন মনের প্রলোভন উপেক্ষা করতে। এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছে, নীরা ভালো আছে। এত বছরে নিশ্চয়ই সব ভুলে জীবনে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিলয়ের বিয়ে উপলক্ষে এত বছর পরে যখন প্রথম মেয়েটাকে দেখল, তখন বুঝল ওর ধারণা ভুল। নীরাকে বুঝতে ওর ভুল হয়েছিল। যতই লুকিয়ে রাখুক, আফনান জানে, নীরা আজও ওর মনে তাকে পুষে রেখেছে, হয়তো ভালোবাসায় নয়, হয়তো প্রগাঢ় অভিমানে। যেটাই হোক, তবুও ওই অতল চোখের মেয়েটার হৃদয়ে এখনো অন্যকেউ আসেনি। তবে এটাও উপলব্ধি করতে পারছে, এই মুহূর্তে ওর সামনে বসা প্রায় ওরই বয়সের ছেলেটা, সায়মন, সে-ই হয়তো…

“আপনি নিলয় ভাইয়ের খুব ভালো বন্ধু, এই বাড়িতে আপনার যাতায়াত কেমন?”

“স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় প্রচুর আসতাম। এবার অনেকদিন পরে এসেছি।”

“ও আচ্ছা।”

আফনান খেয়াল করেছে সায়মনের চোখে নীরার জন্য অন্যকিছু একটা ছিল যেন৷ ওর বোঝার ভুলও হতে পারে। তবে একজন পুরুষ হবার সুবাদে অন্য পুরুষের মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিগুলো কেমন হয় সে ভালোই জানে। সায়মনের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছিল, ঠিক প্রেমে পড়ার আগ মুহূর্তে যে-ই মুগ্ধতা থাকে, ঠিক তেমন। সরাসরি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এতটা অভব্যতা করার মতো অশিষ্ট সে হতে পারে না। তবে এভাবে থাকতেও পারে না। একটা অসহ্য অস্থিরতা ওকে অসহায় করে তুলে।

সায়মন তখন শুয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও আফনান বলেই ফেলল শেষ পর্যন্ত, “নীরা, ইরাদের সাথে আপনার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে নিশ্চয়ই।”

“আছে, তবে সেভাবে আগে ছিল না। আসলে নীরার সাথে আমার বিয়ের একটা প্রাথমিক প্রস্তাবনার প্রক্রিয়া চলছে। বকুল চাচির কাছে শুনে শুনে ছবি দেখে একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল মেয়েটা অন্যরকম। আজ সামনা-সামনি অনেকক্ষণ কথা বলে সেই কৌতূহল বদলে গেল। আচ্ছা, আফনান, আপনার সাথে ওদের ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই! নীরা মেয়েটা ভীষণ চমৎকার, তাই না?”

আফনানের ভেতরের ছোট্ট আ গু নে র ফুলকিটা আচমকা দা বা ন লে রূপ নিল। হৃদপিণ্ড যেন দাউ দাউ করে জ্ব ল ছে। ভস্মীভূত হচ্ছে, ছাই হয়ে সেটা উড়ে যাবে সুদূরে। বাকি জীবনটা ওকে বেঁচে থাকতে হবে হৃৎপিণ্ড ছাড়াই। সে-ই বাঁচা কী বেঁচে থাকা! আর কিছুই ভাবতে পারে না। তবুও সে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গলায় জোর এনে বলল,

“হ্যাঁ, চমৎকার। নীরা ভীষণ চমৎকার একটা মেয়ে। আপনি ভীষণ সৌভাগ্যবান সায়মন। আপনার সুখী জীবন আরও সুখে ভরে উঠবে।”

বলল বটে, কিন্তু শুভাশিষটুকু মন থেকে আর এলো কই। সায়মনের মতো জীবনে সব পাওয়া মানুষদেরই ভাগ্য সবকিছুতে অনুকূলে থাকে। আর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাপ্তি হীন একটা জীবন কাটিয়ে দিতে হয় আফনানদের। সব অপ্রাপ্তি কেবল ওর ঝুলিতে জমুক। এই জীবনে ওর একমাত্র প্রাপ্তি বোধহয় একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অপ্রাপ্তির ঝুলি!

একসময় মনে হলো সে যেভাবে বলেছে, সেভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। সায়মনের মতো বুদ্ধিমান ছেলে নিশ্চয়ই ওকে পড়ে ফেলবে। সে দ্রুত হাতে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে বের করল। এরপর গলার স্বর প্রাণপণে স্বতঃস্ফূর্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “সিগারেট চলবে সায়মন?”

সায়মনের কপালে ভাঁজ সরল এতক্ষণে, উত্তরে সে বলল, “না। এই জিনিসে ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি।”

“তাহলে আপনাকে আর বিরক্ত না করি। আমি ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি। কেমন?”

ছাদে আসতেই একটা শীতল বাতাস আফনানের গায়ে এসে লাগল। তবে ওর হৃদয় বাড়ির জ্ব ল ন্ত ভিসুভিয়াস এই বাতাস নেভাতে পারল না। বরং আরও যেন উস্কে দিয়ে গেল।

সে সিদ্ধান্ত নিল ঘুম থেকে উঠেই সে চলে যাবে। এমনিতেও পরশ সে চলেই যেত। কিন্তু নীরাকে সে চোখের সামনে অন্যের পাশে দেখে সহ্য করতে পারবে না। এতটা মনের জোর ওকে সৃষ্টিকর্তা দেননি। তাই চলে যাওয়ায় ঢের ভালো। সে একলা পুড়ুক, কেউ তা না দেখুক।
………
(ক্রমশ)