#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৫ )
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” বাবা, আমি আমার স্বামীর খুনিকে বিয়ে করতে পারবোনা।”
বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল শুভ্রতা।
বাজ পড়া পাখির মতো উপস্থিত সবাই পাথরচোখে শুভ্রতার মুখপানে তাকালো।যেনো এইমাত্র পৃথিবীতে কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেলো। যার কেন্দ্রবিন্দু হলো শুভ্রতা নামের মেয়েটি।
আয়মান অবিশ্বাস্য চোখে শুভ্রতার দিকে চোখ বড় করে চাইলো। তার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। শুভ্রতা তার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর!এতটা অমানবিক হবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো। ভুল করে ভুল বুঝে ভুল ধারণার উপর একজন মানুষ কিভাবে আরেকজন মানুষকে এতটা নিশ্চিত সন্দেহ করতে পারে? এতটা নারকীয় যন্ত্রণা দিতে পারে? ভেবেই আয়মান স্তম্ভিত! হতবিহ্বল!
” কি বলছ বৌমা? থামো বলছি। তোমার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিলো নাকি স্বামী শোকে? শোক মাত্র তোমার একার ? আমাদের শোক নেই? কই আমরাতো এমন কিছুই কাউকে নিয়ে ভাবিনি। সেখানে তুমি আমার ভালো ছেলেটার নামে এত বড় দুর্নাম তুললে? একথা দশকান হলে আমার ছেলেকে লোকে কি ভাববে আর কি বলবে? ভাবো একবার। ”
তেজী চোখে ঝাঁঝালো কন্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলল আমিনা বেগম। শুভ্রতার পরিবারের সবাইর উঁচু মাথা নিচু হয়ে গেলো। কেউই উপরে মুখ তুলে চাইছেনা। কি বলল শুভ্রতা এসব?
লতিফ খান স্ত্রীর দিকে চেয়ে রাশভারী কন্ঠে বললেন,
এটার ফয়সালা এখনই হবে। হয় এসপার নয় ওসপার। বৌমা কথাটা এমনি এমনিই বলেনি হয়তো। আমি শুধু কারণ জানতে চাই।
” বৌমা রাখঢাক না করে খোলাখুলিভাবে বলোতো। তোমার কেনো মনে হলো আমার ছোটছেলের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক?”
” হ্যাঁ শুভ্রতা বল। এতবড় সত্যি জানার অধিকার এখানের সবারই আছে।”
অধিকার নিয়ে বলল শুভ্রতার বড় বোন শিউলি।
” হ্যাঁ বলো শুভ্রতা! তোমার স্বামীর মৃত্যু অস্বাভাবিক। তার পিছনে আমার হাত আছে। তোমার বেবি নষ্ট হওয়ার পিছনেও আমার হাত আছে। কারণ সেদিন আকাশ থেকে বৃষ্টি আমি ঝরিয়েছি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে। পুকুর ঘাটকে কৃত্রিম শ্যাওলা দিয়ে আমি পিচ্ছিল করে রেখেছি। পুকুরে আমি অনেক মাছ ছেড়েছি, যেনো বেশী শৈবাল হয়ে ঘাটের নিচের সিঁড়িগুলোও পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এবং তুমি পড়ে যাও নামা মাত্রই। আর কি কি আছে আজ সব বল বলছি? ”
শুভ্রতাকে হুংকার দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বজ্রকন্ঠে আদেশ দিয়ে বলল আয়মান।
দালানের ঘর হওয়ার জন্য তাদের কথাগুলো দেয়াল ভেদ করে বাইরে তৃতীয় কান অবধি গেলোনা। সবাই চুপ হয়ে রইলো নিরব শ্রোতা হয়ে।
শুভ্রতা কেঁপে উঠল আয়মানের গর্জন শুনে। মিনমিনিয়ে উত্তর দিলো।
“বেবির পিছনে আপনার কোনো হাত নেই। কিন্তু আমার মনে হলো,যেদিন উনি মারা গেলো। তখন রাত বারোটা। সাধারণত উনি নয়টায় ফিরে দোকান বন্ধ করে। উনি সেদিন নেশা করেছে মনে হয়। যেটা প্রায় করতো আগেও। তো নেশা করে আসার সময় আপনিই হয়তো উনাকে পথের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। উনি হয়তো অতিরিক্ত এলকোহল খেয়েছে সেদিন। তাই ঘোরে ছিলো। উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ট্রাক এসে মেরে দিলো। আর তখন আপনিও বাড়ির বাইরে ছিলেন। ”
” মনে হয়? হয়তো? হোয়াট এ লেইম লজিক। ” বলল আয়মান।
” আরহাম মদ খেতো? কি বলছ বৌমা?”
কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো আমিনা।
” ভাইয়া ড্রিংকস করতো?”
চমকানো চোখে জানতে চাইলো উপমা।
” বৌমা তোমার কথা মানলাম সত্যি। কিন্তু তাই বলে আয়মান কেনো ছোট ভাইকে মেরে ফেলবে?”
উদ্বেলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো লতিফ খান। শুভ্রতা নেত্রপল্লব উল্টিয়ে আয়মানের দিকে চাইলো। আয়মান ইশারায় বলতে বলল শুভ্রতাকে সত্যিটা।
” কারণ আপনার বড় ছেলে আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। উনি একদিন বলছে আমাকে পাওয়ার জন্য খু’ ন ও করতে পারবে।”
সবাই ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আয়মানের দিকে।
” ছিহঃ! তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলেকে পেটে ধরলাম বলে নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। ”
বিষাদগ্রস্ত মুখে বললেন আমিনা বেগম।
” ভাইয়া কি শুনলাম এটা? তোমার চরিত্র কবে থেকে হলো অপবিত্র?”
বলেই উপমা কেঁদে ফেলল।
” তোর এত অধঃপতন কি করে হলো জা’ নো ‘ য়া র? ”
রোষপূর্ণ কন্ঠে বলল লতিফ খান।
শুভ্রতার পরিবারের সবাই এখনো চুপ হয়ে আছে জগদ্দল পাথরের ন্যায়। তারা কিছু বলা এখানে অনধিকার চর্চা হয়।
আয়মান শুভ্রতার দিকে দাঁতমুখ খিঁচে কটমট চোখে চেয়ে আছে। তার মন চাচ্ছে শুভ্রতাকে পিষে ফেলতে মাটির সাথে। সে চেয়ারে বসা থেকেই বলল শুভ্রতার দিকে দৃষ্টি তাক করে,
” শুভ্রতা। আমি এখন যা বলব, তার সাথে সাথে সত্যিটা যদি না বলো, আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা বলছি। একটা নয় কয়েকটা খু’ন হবে আজ।”
সবাই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বিস্ময় ভরা চোখে আয়মান ও শুভ্রতাকে দেখছে। কি হচ্ছে এসব। কি শুনছে তারা আজ। আসল রহস্যটা কি?
শুভ্রতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান বলতে লাগলো,
বাবা,মা,উপমা,আপা,জুনায়েদ ভাই, আন্টি, আঙ্কেল দয়া করে মন দিয়ে শুনুন,
” আপনারা যা ভেবেছেন। তা মোটেও সত্যি নয়। সত্যি হলো এই,
আমি ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে চোখ দিইনি। আমি শুভ্রতাকে যখন থেকে চিনি। তখন আমার পরিবারের মানুষও তাকে চিনতনা। শুভ্রতা যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আমি শুভ্রতাকে তার ক্যাম্পাসে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখি। সেদিন তাদের কোনো অনুষ্ঠান ছিলো সম্ভবত। এরপর তাকে ভালোলাগে। বিভিন্নভাবে তার সাথে আমার দেখা হয়ে যেতো। তাকে ভালোবেসে ফেলি। প্রপোজ করি। সে রিফিউজড করে। সে যত রিফিউজড করছে আমি ততই তার প্রতি আকর্ষণবোধ করছি। নানাভাবে তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করি। অনেক পাগলামো করতাম। এক পর্যায়ে আমার পাগলামো দেখে সে কিছুটা পজেটিভ হয়। বন্ধুর মতো চলতে থাকে। সব মিলিয়ে আমার মন্দের ভালো দিন যাচ্ছে। একদিন প্রসঙ্গক্রমে তাকে বিয়ের কথা বলি আমি। সে জানায়,
সে আমাকে বন্ধুই জানে। তার পরিবার যেখানে বিয়ে দেয় ও সেখানেই বিয়ে করবে। এবং এটাই তার ফাইনাল কথা। তখন আমি ঠিক করি আর কাউকেই বিয়ে করবনা ওকে না পেলে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবো। ও অন্য কারো হলে আমি সেটা মেনে নিতে পারবোনা। এরপর আমি দেশের বাইরে চলে যাই। ওর সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। ও এই রাখেতো এই রাখেনা। আমি দেশে নেই মা অসুস্থ। আরহামের বিয়ের বয়স হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলি,
তাকে বিয়ে করাও। আমার কোন সমস্যা নেই। আপত্তি নেই।
ওদের বিয়ে হয়ে গেলে আমি জানতে পারি শুভ্রতাই আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। আমি তখন কি অবস্থার মাঝে দিয়ে বেঁচে ছিলাম। তা কেবল আমি আর আল্লাহ জানে। এরপর আমি আর শুভ্রতার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। কারণ ও এখন আমার ভাইয়ের আমানত। তিনমাস আগে দেশে আসি। তাও জরুরী প্রয়োজনেই। শুভ্রতার দিকে ফিরেও চাইনি। আমার ভাই মারা গেলে বাবা,মা তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় আমাকে। তাও কারণবশত। তখন আমি রাজী হই বিয়ে করতে শুভ্রতাকে। আমার কবর দেওয়া অনূভুতিগুলো জ্বলে উঠে দাবানলের মতো। ”
” বৌমা আয়মানের সব বলা সত্যি?”
” জ্বি বাবা। সত্যি।”
আমিনা বেগম বললেন, এখানেতো আমার ছেলের কোন দোষ বা ভুল দেখিনা। বরং ত্যাগ করলো। আপনারা কি বলেন?
” আমরাও কোনো দোষ দেখিনা আপনার বড় ছেলের।”
একসাথে সবাই বলে উঠলো।
এখন মূল বিষয় হলো শুভ্রতার দাবী তার স্বামীর পিছনে আয়মানের হাত রয়েছে। এটা ক্লিয়ার হওয়া। বলল লতিফ খান।
” বাবা,মা, আমার কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আছে আমার ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে। আমি সেটাও বলছি। ”
আয়মান চেয়ার থেকে উঠে শুভ্রতার খুব কাছে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
” আচ্ছা শুভ্রতা। আমার ভাইটা যে নেশায় জড়িয়ে গিয়েছে। সেটাতো আমরা কেউই জানিনা। কিন্তু তুমিতো জানতে। তার আগেরদিন রাতে তোমাদের মাঝে কি এমন হয়েছে? যার জন্য আমার ভাইটা অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো? পারবে সৎ সাহস নিয়ে আমার মতো সবার সামনে বলতে? ”
শুভ্রতা ভীরুচোখে আয়মানের দিকে ও সবার দিকে তাকালো অপরাধীর মতো।
চলবে…৫