#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-১০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
শ্রাবণের মধ্যবেলা। গম্ভীর বদনে বসা সৈকত। চোখের শিরায় রক্তিম আভা, কপালের রগ ফোলা, চোয়ালে বিষন্নতা। সবসময় পরিপাটি চুল আজ বড্ডো অগোছালো। শুধু চুল নয়, অগোছালো সৈকত নিজেও। রুবাবের প্রতিক্রিয়া দেখার পর গেলো দু’দিন দুদণ্ড শান্তি পায়নি, ঘুমটি নামেনি চোখে। করণীয় নিয়ে শঙ্কিত। বন্ধুর কথা ভাবলে মনে হচ্ছে, বন্ধুর জন্য ওমন এক আধটু আবেগ ভোলাই যায়। কিন্তু মুনের কথা ভাবতে গেলে ভাবনারা এলোমেলো হয়ে যায়। মেয়েটা যেন ওর মন মস্তিষ্কে মিশে গেছে। সর্বক্ষণ খেয়াল আসে, ওকে ভুলে যাবে! পারবে? পারার চেষ্টা মাথায় আনতেই শ্বাস ভারি হচ্ছে যেন। কিভাবে ভুলবে সে! কী পরিণতি হবে তার?
ভাবনারা দিশেহারা। উদাস মন কত কী ভেবে যাচ্ছে! ঘরের দরজা লাগানো। কড়া নাড়ছে কেউ। রুক্ষ কন্ঠে বলছে,
“সৈকত! মাইয়্যা মাইনসের মতো দিন দুপুরে দরজা লাগাইয়্যা রাখছোস ক্যান! দরজা খুল!”
স্বরটা অন্তরের। সেই সকাল থেকে ডাকছে ওরা। বন্ধুর বিরহে অস্থির ওরা। কিন্তু কিছু করতে পারছে না। সেদিন নাহিদ রুবাবের সাথে কথা বলতে গেছিল। রুবাব উলটো রাগ ঝেড়েছে নাহিদের উপর। কারো সাথে কথা বলছে না। ফোন দিলেও তুলছে না। রুবাবের গম্ভীরতা, সৈকতের অস্থিরতার মাঝে নাহিদ অন্তরকে কষ্ট দিচ্ছে। সবসময় হাসিখুশিতে ভরপুর সার্কেলটায় হঠাৎ যেন মন খারাপের সুর তুলেছে, ভাঙনের আঁচ লাগছে। বিধ্বস্ত সৈকত হঠাৎ দোর দিয়ে বসায় ভীত ওরা। হতাশায় কিছু করে টরে বসলে! নাহিদ ভীত স্বরে ডাকল,
“সৈকত?”
জবাব এলো না। নাহিদ এবার ফোন দিল বেজে কেটে গেল। ভয় বাড়ল। বাড়ল কড়া নাড়ার শব্দ। অন্তর বলল,
” তুই ভাবিস না যে আমরা দয়ার মতো দরজা ভাঙব। অত শক্তি নেই। দরজা খুল, নয়তো মিস্ত্রি এনে দরজা ভাঙব। তখন মিস্ত্রির টাকা কিন্তু তুই দিবি!”
অন্তরের হেয়ালিপনায় কাজ হলো না। এবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল অন্তরের। চোয়াল শক্ত হলো। ধীরে বলল, “প্লিজ দোস্ত, বেরিয়ে আয়। আমি রুবাবের সাথে কথা বলব। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
দরজা খুলল না এবারও। ভয়ে হৃদপিণ্ড গলায় এসে ঠেকেছে যেন। নাহিদ কাঁপা স্বরে বলল,
“সৈকত, ঠিক আছস তুই? ”
এবার জবাব এলো গম্ভীরমুখে, “মরিনি এখনো। কুলখানি খাওয়া হচ্ছে না তোদের।”
হুট করেই প্রসন্ন হলো দুই বন্ধু। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বার কয়েকের অনুরোধে দরজা খুলল সৈকত। হুর হুর করে ঘরে ডুকল ওরা। অন্তর বলল,
“ম রা র চিন্তা মাথায় এলে আমাকে বলবি। কুলখানির মেন্যু করতে হবে।”
অন্তরের বুক কাঁপা বন্ধ হয়নি তখনো, অথচ দিব্যি হেয়ালি করে যাচ্ছে। নাহিদ এসে সৈকতের পাশে বসল, “শা লা ভয় পাইয়ে দিয়েছিস। চল উঠ, লাঞ্চ করব একসাথে। ”
সৈকত, নড়ল না। চড়ল না। ওঠল ও না। উদাস চোখে চেয়ে রইল জানালা গলিয়ে বাইরের দিকে। ওর দৃষ্টির মাঝে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। সকাল থেকে রোদ ছিল, এখন হঠাৎ বৃষ্টি। সৈকত স্থির চোখে বৃষ্টি দেখছিল। আকস্মিক ওর মস্তিষ্কে অন্য এক খেয়াল এলো। তড়িৎ উঠে গেল। আলমারির উপর রাখা গুটানো ছাতা নিয়ে একপ্রকার দৌড় দিল। চোখের পলকে উধাও। খানিক বাদে দরজা বন্ধ করার শব্দ এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় নাহিদ অন্তর থ বনে গেছে। সৈকতের এহেন কাণ্ডের কারণ বোধগম্য হচ্ছে না কারোরই। অন্তর দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,
“এটা কী হলো!”
নাহিদ সুক্ষ্মচোখে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর ঘটনার আঁচ করে হেয়ালি করে বলল,
“রোমিও ছুটিছে জুলিয়েটের মাথায় ছাতা ধরতে। ”
অন্তর ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে চাইল। বৃষ্টি দেখে ভ্রু নাড়াল। মুনের ভার্সিটি ওদের বাসার কাছে। সেদিকেই ছুটেছে সৈকত। খানিক বাদে ভীত স্বরে বলল, “যদি রুবাব ও যায়!”
নাহিদ আতঙ্কিত হলো, “সর্বনাশ! রুবাব যা ক্ষেপে আছে, সৈকতকে মুনের আশপাশে দেখলে আজ রক্ষা নেই। ”
অন্তর বিরক্ত নিয়ে বলল, ” শা লা জিন্দেগানি দারোয়ানের মতো হইয়্যা যাইতাছে। খালি পাহারা দিতাছি। চল।”
দুই বন্ধু গেল বাকি দুই বন্ধুর দ্বন্দ্ব নিরসন।
___________________
কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে মুন। সবে ক্লাস শেষ হয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ছাতা নেই সাথে। কিভাবে বাসায় ফিরবে সেই চিন্তাটি ঘুরছে মাথায়। এক পর্যায়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পা বাড়াল। পথিমধ্যে
ওর চিন্তিত বদনের চিন্তা নিরসন করতে হাজির হলো এক সুদর্শন মুখ। মাথার উপর ছাতা ধরে বলল,
“ছাতাটা নিয়ে যাও।”
বলে ছাতার হাতল বাড়িয়ে দিল। আকস্মিক আগন্তুককে দেখে বেশ চমকাল মুন। হতভম্ব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বিস্মিত হয়ে বলল,
“সৈকত ভাইয়া!”
সৈকত সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফিরতি বলল, “ছাতা নাও।”
মুন ধাতস্থ হয়ে বলল, “লাগবে না, আমি চলে যেতে পারব। ”
সৈকত গম্ভীরমুখে বলল, “ভিজতে হবে না, অসুখ হবে।”
মুন কি ভয় পেল? কে জানে! দ্বিরুক্তি করবার সাহস পেল না ছাতার হাতল ধরল। মুনের মনে প্রশ্ন জাগল, ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডকে সাথে দেখা যায় না কেন? মুন সন্দিহান চোখে তাকাল। সেই দৃষ্টির মাঝেই সৈকত ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। গভীর চোখে। কেমন করে তাকাল, মুনের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। চোখ ফেরাল। সৈকত ফেরাল না। চেয়ে রইল। পরখ করল, মুনের চোয়ালে বিষাদের রেখা আছে কি না। যাচাই হলো, রুবাব ওকে বকেছে কি না। সৈকত বলল,
“ভালো আছো?”
মুন মাথা নাড়াল। সৈকত আবার বলল, “সব ঠিকঠাক? কোন সমস্যা নেই তো!”
মুন এবারও মাথা নাড়াল। সৈকত স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। মুন এক পলক চাইল সৈকতের পানে তারপর বলল, ” আপনি কি অসুস্থ!”
সৈকত সামনে থেকে চোখ সরিয়ে চাইল আবার। একটুখানি হাসল, “অসুস্থ তো বটেই।”
“কী হয়েছে আপনার?”
“হৃদরোগ হয়েছে আমার।” বলতে ইচ্ছে করল সৈকতের কিন্তু বলল না। নিশ্চুপ রইল। মুন বলল, “মেডিসিন নিয়েছেন?”
সৈকত মুনের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন স্বরে বলল, ” মেডিসিন নেয়া যাচ্ছে না।”
“কেন! খুব এক্সপেন্সিভ! ”
সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উত্তর দিল না। ওর জীবনটা বড্ডো টানাপোড়েনের আছে। একদিকে বন্ধু, অন্যদিকে ভালোবাসা। কাকে বাদ দিবে!
ওরা গেইটের কাছে এসে পড়েছে। সৈকত ছাতা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়ি ঠিক করে দিয়ে বলল, ” ভালো থেকো সবসময়। ”
মুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চলে গেল সৈকত। মুন অবাক হয়ে চেয়ে রইল তাকে বৃষ্টির আড়ালে করে স্বয়ং বৃষ্টিতে মেখে চলা মানুষটার পানে। হুট করে আসল কেন! গার্লফ্রেন্ডকে না দিয়ে তাকে দিল কেন! কত প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়!
__________
বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় আনমনা হাঁটছে সৈকত। উদাস, বিষন্ন হয়ে। চারদিকের খেয়াল নেই। দূর থেকে খেয়াল করল অন্তর নাহিদ। দৌড়ে গেল। অন্তত বলল,
“কই যাস!”
সৈকত অবাক হলো, “তোরা এখানে!”
নাহিদ হাসল, “তুই যেখানে আমরাও সেখানে। বাইক নিয়ে আসছি, চল বৃষ্টিতে ভিজে লং ড্রাইভে যাব। ”
সৈকত বেশ বুঝল, বন্ধুরা ওকে একা থাকতে দিবে না। এটা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বহির্ভূত।
______________________
সমীকরণ মেলাতে প্রক্রিয়ায় বাসায় পৌঁছল মুন। বসার ঘরে দেখা হলো রুবাবের সাথে। ছাতা নিয়ে বেরুচ্ছে কোথাও। মুনকে দেখে বলল,
“এসে গেছিস! আমি তোকে আনতেই যাচ্ছিলাম। আসতে সমস্যা হয়নি তো?”
মুন হেসে বলল, ” না।”
এতক্ষণে রুবাবের খেয়াল হলো মুনের হাতের ছাতার দিকে। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে রইল। এমন একটা ছাতা সৈকতের আছে। এটা কি সৈকতের ছাতা! সৈকত দিয়েছে? তবে কি মুনের সাথে সৈকতের…. কপালের রগ ফুটে উঠল রুবাবের। স্বর গম্ভীর হলো,
” তোর হাতে ছাতাটা কার? আমাদের বাসার মতো তো লাগছে না।”
রুবাব বোনকে যাচাই করছে। মুনের সত্য মিথ্যা কথার ভিত্তিতে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। মুন প্রসন্ন মনে বলল,
“এটা সৈকত ভাইয়ার। ”
রুবাবের গোয়েন্দা ভাবনা গাঢ় হলো, “সৈকতকে পেলি কোথায়?”
“ভার্সিটিতেই। আমি বৃষ্টিতে ভিজে চলে আসছিলাম। পথের মধ্যে কোথা থেকে সৈকত ভাইয়া এসে ছাতা দিয়ে গেল। গাড়ি ও ঠিক করিয়ে দিয়েছে।” সরল মনে বলল মুন। সৈকত স্বর গম্ভীর থেকে গম্ভীর হলো,
“একসাথে এসেছিস তোরা?”
“নাহ, সৈকত ভাইয়া তো আমাকে ছাতা দিয়ে ভিজে ভিজে চলে গেছে। ”
থেমে দ্বিধান্বিত মনে বলল, “বুঝলাম না ভাইয়া, ছাতাটা উনি উনার গার্লফ্রেন্ডকে না দিয়ে আমাকে দিল কেন!”
রুবাব বিস্মিত হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনের চোখে মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। সৈকতের প্রতি কোন ভাব ও নেই। ভয় ডর অনুভূতি কিছুই নেই। সৈকতের সাথে কোন সম্পর্ক থাকলে ভাইয়ের কাছে এত সাচ্ছন্দ্যে বলতে পারতো না। এর মানে কি সত্যি মুন জানে না! অনুভূতি এক তরফা! রুবাব খুব ভালো করে বুঝেছে সৈকত মুনকে ছাতা দিতেই গিয়েছে। তবে মুন গার্লফ্রেন্ড এর কথা বলছে কেন! কোন গার্লফ্রেন্ড! সৈকত তো মুনকে ভালোবাসে। তবে মুন কার কথা বলছে! রুবাব ভ্রু কুঁচকাল,
“সৈকতের গার্লফ্রেন্ড পেলি কোথায়?”
মুন অবাক হলো, “তোমার বন্ধু তুমি জানো না! আশ্চর্য! সৈকত ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে। ”
“কে বলেছে তোকে!”
“সৈকত ভাইয়া বলেছে। উনি তো প্রায় ভার্সিটি যায় গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। তুমি জানো না! ”
রুবাবের চোয়াল শক্ত হলো। বলল, “এত কিছু জানিস, নাম জানিস না?”
“জানি তো। খুব সুন্দর একটা নাম। কী যেন নামটা….!
মুন মনে করার চেষ্টা করল। খানিক বাদে বিজয়ী হেসে বলল, ” মনে পড়েছে। ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের নাম চন্দ্রকথা।”
‘চন্দ্রকথা’ নামটা বার দুয়েক আওড়াল রুবাব। এর মাঝেই ওর কুঁচকে থাকা ভ্রু সোজা হলো। মুন বুঝতে না পারলেও সে বুঝে ফেলল নামের মর্মার্থ। পরপরই বোনের দিকে রেগে তাকাল। এডিয়েট!
মুন নিজ মনে বলে গেল, “অবাক করা বিষয় কী জানো? মেয়েটা আমার মতো দেখতে, আমার ভার্সিটিতে পড়ে। তাই ভাইয়া আমাকে দেখলে মাঝেমধ্যে ‘চন্দ্রকথা ‘ ডেকে ফেলেন। আমি ভাইয়াকে বলেছিলাম, ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় হতে। আমার মতো দেখতে মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছে করছে। তুমি দেখোনি!”
রুবাব নিশ্চিত হলো মুন সৈকতের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত নয়। অবাক হলো, সৈকত এত কিছু করে ফেলেছে মুন টের পায়নি! মেয়েরা না কি আশপাশের ছেলেদের চাহনি দেখেই তার মনোভাব বুঝতে পারে। মুন পারেনি! চন্দ্রকথা নামটা নিয়ে একটা ভাবলেই তো ধরতে পারে, চন্দ্র মানে চাঁদ। চাঁদ মানেই মুন। সৈকত ওকেই মিন করছে। তা না বুঝে এই মেয়ে সৈকতকে গিয়েই বলছে, গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করাতে। রুবাব ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ধমকে উঠল,
” বেকুব।”
হনহন করে রুমে চলে গেল রুবাব। মুন ভ্রু কুঁচকে চেঁচাল, “এ্যাই ভাইয়া! তুমি আমাকে বেকুব বললে কেন! কী করেছি আমি!”
_______________________
পাই পাই করে নিষেধ করবার পরও সৈকতের মুনের কাছে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ফিরতি দ্বন্ধ বেঁধেছে সৈকত, রুবাবের মাঝে। মূলত, দ্বন্ধটা এক তরফা। রুবাবের পক্ষ থেকে। সে ফোন দিয়ে দফারফা করেছে বন্ধুর। তাদের মাঝে কী কথা হয়েছে জানে না নাহিদ অন্তর। শুধু সকাল সকাল সৈকতকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। পিছন ফেলে গেছে বন্ধু, ভালোবাসা। নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
চলবে……
#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-১১)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
বলা হয়, কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। এই প্রবাদ যেন এই পর্যায়ে ক্ষুন্ন হলো। এক বন্ধুর জন্য থেমে আছে বাকি তিনবন্ধুর জীবন। নাহিদ পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না, অন্তরের মুখে হেয়ালি আসছে না। স্মৃতিবহুল বাসাটায় মন টিকছে না, টংয়ের দোকানে চায়ের কাপে আড্ডা বসছে না। জোর করে নিজেদের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেও কাপের চা শেষ হচ্ছে না। দু’চুমুকের পর সৈকতের শূন্যতা এসে মুখ আঁধার করিয়ে উঠিয়ে নিচ্ছে মহল থেকে। কিছুই হচ্ছে না নাহিদ অন্তরের জীবনে, নিত্যরুটিন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। কাজ বলতে খানিক বাদে বাদে নিরুদ্দেশ বন্ধুর ফোনে কল দেয়া, বন্ধ পেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলা। কিংবা সৈকতের ছোটোভাইকে কল দিয়ে জানা, সৈকত সেথায় গেছে কি না! ব্যার্থ উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলাই যেন এখন মূখ্যকাজ।
সৈকত? সে তো নিরুদ্দেশ। কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না।
আর ওদের বন্ধুত্বে ভাঙন ধরানো ছেলেটা কি নির্বিকার? সে কি পারছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে? উত্তরটা নেতিবাচক। রুবাব গম্ভীর তবে নির্বিকার নয়। মনের অস্থিরতা তারও আছে। কিন্তু রাগ সব দাবিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই তার, এ মুখো ও হচ্ছে না। জানা নেই সৈকতের নিরুদ্দেশ হবার সংবাদ। তাকে আজকাল হরহামেশাই বাড়িতে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বোনের উপর নজর রাখছে। বোনকে ভার্সিটি ছেড়ে আসছে, আবার নিয়ে আসছে।
_______
আজ অনেকদিন বাদে বাসা থেকে বেরিয়েছে সেঁজুতি। সাদাফ তদন্তের খাতিরে ঢাকার বাইরে গিয়েছে আজ ভোরেই। ফিরবে দু’দিন বাদে। সেঁজুতি যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। বেলা গড়াতেই মুখ ঢেকে বেরিয়েছে। তৎপর প্রেমিককে আসতে বলে অপেক্ষায় বসেছে রেস্টুরেন্টে।
বহুদিন বাদে প্রেয়সীর সান্নিধ্যে আসার তাড়ানায় এক ছুটে হাজির হয়েছে রুবাব। রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক পার্ক করে এক প্রকার দৌড়ে এসে ঢুকেছে রেস্টুরেন্টে। অস্থির চোখে এদিক ওদিক খুঁজে কাঙ্ক্ষিত মুখখানা দেখেই হাঁটার গতি বাড়াল। এসে থামল সেঁজুতির সামনে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ। অস্থির শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। প্রেমিকের ওমন অস্থিরতা দেখে এক গাল হাসল সেঁজুতি। চোখ মুগ্ধতা ঢের তারও। হেসে বলল,
“বসে দম নাও।”
রুবাব বসল। প্রেয়সীর পানে চাইল, চেয়ে রইল। তারপর আকস্মিক ঝুঁকে সেঁজুতির হাত টেনে নিল মুঠোয়। ভালোমন্দ জিজ্ঞাসার বালাই না করে আবেগীয় স্বরে বলল,
“চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি! একবার বিয়েটা হয়ে গেলে, আমি তোমাকে এক মুহুর্ত ও কাছছাড়া করব না।”
প্রেমিক হিসেবে রুবাব বরাবরই অস্থির। মুখে লাগাম নেই, নেই ভয়ঢর। সবকিছুর উর্ধ্বে তার আবেগ,প্রেয়সী। তা ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করে সেঁজুতি। এই অনুভূতি হৃদয়ে সুখের দোলা দেয়। সেঁজুতি ভালো জানে, এখন যদি সে হ্যাঁ বলে রুবাব সত্যি সত্যি আজ বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলবে। সেঁজুতি প্রসন্ন হাসল। কৌতুক করে বলল,
” বিয়ে করতে তো আমার আপত্তি নেই, কিন্তু বেকার যুবকের কাছে যে আমার ভাই আমার হাত তুলে দিবে না।”
‘ভাই’ শব্দটা কানে আসতেই নাক ফুলাল রুবাব। ফোঁসফোঁস করে বিতৃষ্ণার সুরে বলল, ” তোমার ধুরন্দর ভাই এমনি যে আমার কাছে তোমাকে দিবে তারও নিশ্চিয়তা নেই। ছ্যাকা খেয়ে প্রেমের চিরশত্রু হয়ে গেছে তোমার ভাই। তার আশা বাদ দিয়ে চলো তুমি আমি বিয়ে করে ফেলি।”
সেঁজুতি চোখ রাঙাল, “ভাইয়াকে নিয়ে বাজে কথা বলবে না।”
দমল না রুবাব। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, “যে কু ত্তার দৌড়ানি দিছে, তারপর কোন ভালো কথা আসছে না, দুঃখিত।”
সেঁজুতি সতর্ক করল, ” ওই ভাই ছাড়া গতি নেই তোমার। আমাকে বিয়ে করতে হলে আমার ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বিয়ে করতে হবে। আমার ভাই ছাড়া বিয়ে আমি করছি না।”
রুবাব হতাশ শ্বাস ফেলল, “এ তো ঘর শত্রু বিভীষণ! ”
থেমে সতর্ক করল, “তোমার ভাই যদি না মানে তুলে নিয়ে যাব তোমাকে। তবুও ছাড়ব না। মনে রেখো।”
পাগল প্রেমিকের পাগলামোতে গা ভাসিয়ে হাসল সেঁজুতি। কোমল স্বরে আশ্বাস দিল, ” তুমি একটা চাকরি যোগাড় করো। তারপর ভাইয়ার সামনে আমি তোমাকে নিয়ে দাঁড়াব। দেখবে ভাইয়া শুধু মেনে নিবে না তোমাকে বরং নিজে দাঁড়িয়ে আমাদের বিয়ে দিবে।”
রুবাব নরম হলো। চাপা স্বরে বলল, “তোমার ভাইয়ের এই গোয়েন্দাগিরি, এই লুকোচুরির দেখা, হুটহাট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া এগুলো ভালো লাগছে না আমার। আমার খুব ভয় লাগে, যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি!”
সেঁজুতির মুখ থেকে হাসি সরছে না। এই দিলখোলা প্রেমিকের প্রেম দেখে আবেগে আপ্লূত সে । রুবাবের হাত দু’খানা আকঁড়ে বলল, ” কথা দিচ্ছি, হারাব না। এই পাগল ছেলেটারই বউ হবো। চাকরিটা পাওয়ার দের।”
রুবাবের মুখ প্রসন্ন হলো। প্রেমের আলাপ এগুলো। এক পর্যায়ে কিছু মনে পড়ার ভানে সেঁজুতি ব্যাগ থাকে একটা ফোন বের করে রুবাবের হাতে দিল,
” ভাইয়া আমার ফোন ফেরত দিয়েছে। এখন আর এটার দরকার হবে না। ”
রুবাব ফোনটা হাতে নিল। ভ্রু কুঁচকাল। প্রথমে চিনল না, পরে চিনল। এটা সৈকতের ফোন, যা সে রুবাবের পক্ষ থেকে সেঁজুতিকে দিয়েছিল। রুবাব ফোনটা উল্টেপাল্টে দেখল। সেই উলোটপালোটে যেন সৈকতের অবদানও স্মরণে এসে গেল। ওর প্রেমের পিওন হয়ে কত সাহায্য করেছে ছেলেটা… রুবাব আকস্মিক বিমর্ষ হলো। কপালে রাগ, ক্ষোভ, চিন্তা, অস্থিরতা দেখা গেল।
ফিরতি পথে ফোন ফেরত দেয়ার মনস্থির করল। তবে সৈকতকে কল দিল না। বাসায় ও গেল না। সুক্ষ্ম রাগ তখনো ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নাহিদকে কল দিয়ে গলির মোড়ে আসতে বলল। নাহিদ এলে কোন ভণিতা ছাড়া ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” এটা দিয়ে দিস।”
সৈকতের সাথে হওয়া দ্বন্দ্বের রেশ দুই বন্ধুর উপর ও পড়েছে। রুবাব নাহিদ অন্তরের সাথে ও কথা বলছে না। ওদের দোষ, ওরা জেনেও কেন সৈকতকে লাই দিল। এমন বৈরি আচরণের জন্য রুবাবের উপর ক্ষুব্ধ নাহিদ অন্তরও। নাহিদ ফোন না নিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, “স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেছে তাহলে।”
বন্ধুর এহেন বাঁকা কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হলো না রুবাবের। তবুও অজানার ভান করল, “কিসের স্বার্থ!”
নাহিদ জমে থাকা রাগ উগড়াল, ” তোর আর সেঁজুতির প্রেমে যখন বিচ্ছেদ আসন্ন তখন সৈকত রিস্ক নিয়ে দেখা করিয়েছে তোদের। এই ফোনটা না হলে তোদের যোগাযোগ হতো? হতো না। এই ফোন, ফোনের আলাপ করতে কোন আপত্তি নেই তোর। ঠিকই তখন সায় দিয়েছিস। সৈকতের উপকারে গা ভাসিয়েছিস, কিন্তু যখন ফোনের কাজ শেষ হলো তখন সব ভুলে গেলি!”
রুবাব চোখ লাল করল, “ওর হয়ে সাফাই গাইবিনা।”
নাহিদ ও দমল না। দৃঢ় স্বরে বলে গেল, “একশো’বার বলব। আমাদের সবার জন্য কী না করেছে সৈকত? সব বিপদে পাশে থেকেছে। আমাদের কথা বাদ, কী না করেছে ও তোর জন্য? সব ভুলে গেলি! তুই সবসময় চেয়ে এসেছিস, তোর শালা যাতে তোর প্রতি দয়াবান হয়, সেই তুইই সৈকতের প্রতি রুড হয়েছিস। তাও তোর বোন, তাকে কার কাছে বিয়ে দিবি সে নিয়ে বলা অধিকার আছে তোর। বোন বিয়ে দিলে দিবি, না দিলে সরাসরি বলে দিবি। এমন রুড হলি কেন?”
রুবাব গমগমে স্বরে বলল, “বন্ধু হয়ে ও আমার বোনের দিকে নজর দিলে কিভাবে?”
নাহিদ বিরক্তির সাথে বলল, ” দ্যাখ, কার প্রতি কার কখন ফিলিংস এসে যায় বলা দায়। সৈকত তো তোর বোনের সাথে প্রেম করেনি। জাস্ট ফিলিংস তৈরি হয়েছে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে এ সেটা দমিয়ে ও রাখতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। এ শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে গেছে। নিজেকে হাজার শাসন করেছে। ব্যর্থ হয়েছে।
শুধুমাত্র তোর কথা ভেবেই নিজের ফিলিংস মুনকে জানানোর আগে তোকে জানিয়েছে, ও প্রেম নয় বিয়ের পর্বে যেতে চেয়েছে। একটাবার বুঝার চেষ্টা করেছিস ওকে! নিজের বেলায় তো ঠিকই ওর হেল্প নিলি, যখন ওকে হেল্প করার সময় এলো তখন গা ছাড়া দিলি। বাহ্! ”
রুবাব অন্যদিকে ফিরে চাপা শ্বাস ফেলল, “ওর সাথে মুনকে মানতে পারতেছিনা। ”
নাহিদ বুঝানোর চেষ্টা করল, “ছেলে হিসেবে সৈকত কি খারাপ? এতবছর ধরে চিনিস তুই ওকে, একটা খারাপ গুণ বের করতে পেরেছিস? আমাদের সার্কেলে সবচেয়ে ব্যক্তিত্ব, সুন্দরমনের ছেলে সৈকত। পিওর জেন্টেলম্যান। ওর ব্রাইট ফিউচার। আমাদের তিনজনের বিসিএস নিয়ে শঙ্কা থাকলেও সৈকতকে নিয়ে নেই। ওর তুখোড় মেধা আর চেষ্টায় আমি হলফ করে বলতে পারি, ঠিকমতো ফোকাস করলে ও প্রথমবারেই টিকে যাবে। জানা শোনার মধ্যে। আমার তো মনে হয়, মুনের জন্য ওর চেয়ে ভালো পাত্র তুই পাবিই না। তুই চাইলেই ওকে মেনে নিয়ে পারিস। ”
রুবাব গম্ভীরমুখে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না। খানিকবাদে তাড়া দেখিয়ে বলল, “ফোনটা রাখ,আমার তাড়া আছে। ”
নাহিদ নিল না, “ফোন নিয়ে কী করব? যার ফোন তারই খোঁজ নেই।”
রুবাব ভ্রু কুঁচকাল, “মানে? ”
“পাঁচদিন হলো সৈকত নিরুদ্দেশ। ”
রুবাব বিরক্ত নিয়ে বলল, “গেছে কই শা লা?”
“কোন খোঁজ নেই। বাড়ি ও যায়নি। কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে?” নাহিদের স্বর মলিন হলো।
রুবাবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল কি? ঠাহর করতে পারল না নাহিদ। সে হতাশ স্বরে বলল, ” কদিন বাদে পরীক্ষা। সবচেয়ে বেশি উৎসুক সৈকত থাকার কথা। অথচ ও নেই। তুই মানবি নাকি মানবি না এই চক্করে বিগত মাসখানেকে পড়ায় মনোযোগ দিতেই পারেনি। এভাবে হলে বিসিএসে বসতেই পারবে না। কত বছরের পরিশ্রম, স্বপ্ন ওর, সব শেষ হয়ে যাবে। না মুনকে পাবে আর না বিসিএস। ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের সার্কেলের মেধাবী ছেলেটার ভবিষ্যৎ অকালেই ঝরে যাবে। ”
বন্ধুর চিন্তায় উদ্ধিগ্ন হলো নাহিদের মুখ, মন, স্বর। রুবাব উদাস চোখে অন্যদিকে তাকানো তখনো। সে শুনছে না কি শুনছে না আদৌ জানা নেই।
____________
পরদিন সকাল সকাল রুবাবের ঘুম ছুটল ফোনের রিংটোনে। অন্তরের কল। ঘুমজড়ানো চোখে ফোন হাতড়ে নিয়ে কানে দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“সৈকতের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমরা যাচ্ছি। মনে যদি বিন্দুমাত্র মায়া দয়া অবশিষ্ট থাকে, তবে দেখতে আসিস।”
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোন কেটে গেল। রুবাব কিছুক্ষণ বুঝেই উঠতে পারল না, সে স্বপ্নে না কি বাস্তবে বিচরণ করছে।
খানিক বাদেই প্রচন্ড মন খারাপের ভাব নিয়ে রুমে এলো মুন। বিমর্ষ স্বরে বলল, ” সৈকত ভাইয়া না কি এক্সিডেন্ট করেছে? কেমন আছে এখন? তুমি যাচ্ছো না দেখতে?”
রুবাব চট করে চোখ মেলল। চাইল বোনের মুখ পানে। মুনের চোখে মুখে রাজ্যের মলিনতা। থমথমে, রক্তশূণ্য ভাব। ওর অসুখ হলে মুনের মুখটা যেমন থাকে তেমন। রুবাব দ্বিধার সাগরে ডুবল, তবে কি মুনের কাছে সৈকত ও এতটাই প্রিয়! অনুভূতি কি তবে দ্বিপাক্ষিক!
চলবে…..
#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-১২)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সৈকত। রুগ্ন, বিধ্বস্ত চোয়াল। গায়ের শুভ্রাব শার্ট রক্তে মাখা। কপালকোণে শুভ্র কাপড়ের প্রলেপ। বাঁ হাত ব্যাণ্ডেজে ঢাকা, ডান হাতে চলছে স্যালাইন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর বেডে দিয়েছে ।
শিওরে চিন্তিত বদনে বসা তিন যুবক। সবার চোখে আঁধার নেমেছে। তার মধ্যে দুইজন বন্ধু, আর একজন ছোটোভাই। ফোন পেয়েই ছুটে এসেছে। সৈকত বোধহয় বাড়ির পথ ধরেছিল। ওদের গ্রাম থেকে একটু দূরেই দুর্ঘটনাটা হলো। ট্রাক সিএনজিকে চাপা দিয়েছিল এক প্রকার। সংঘর্ষ হতে দেখে দরজার কাছে থাকা সৈকত লাফ দিয়েছে। গিয়ে পড়েছে রাস্তার সাইড। গড়ানো খেয়ে বাড়ি লেগেছে গাছের সাথে। মাথাকে বাঁচাতে বাঁ হাত এগিয়ে দিয়েছে। ফলে বাঁ হাত চোট লেগেছে অনেকটা। গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে আবার গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। রাস্তার কাজ করা কয়েকটা কংক্রিট পড়েছিল। ওগুলো কপালে লেগে কেটে গেছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে ওর ক্ষতিকে কমই ধরা যায়। কারণ সিএনজিতে যারা ছিল, তারা সবাই স্পটডেথ। সবার শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে একাকার। জানে বেঁচে ফিরেছে কেবল সৈকতই।
দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে ছিল সিফাত। দুর্ঘটনার কথা শুনে অবস্থা দেখতে গিয়েছিল । সেখানে হতাহতদের মাঝে নিজের ভাইকে দেখে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল যেন। দিশেহারা হয়ে বিশ্বাসই করতে পারেনি কিছুক্ষণ। ধাতস্থ হতেই ভাইকে নিয়ে ছুটেছে হাসপাতালে। বাবা মাকে বলেনি, মা হার্টের রোগী। শুনে সহ্য করতে পারবে না। ভাইয়ের অতিব আপন বন্ধু নাহিদকেই খবরটা দিয়েছিল।
আসামাত্র বন্ধুর অবস্থা দেখে নির্বাক ওরা। নাহিদের মুখে কালো মেঘের ছায়া। অন্তরের হাস্যঘন চোয়ালে আজ ব্যাথার আভা। বুক কাঁপছে এখনো। এ কদিনে সৈকত বেশ শুকিয়ে গেছে, চোয়াল ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালি দেখা যাচ্ছে। শান্তির ঘুমটি হয়নি বোধহয়। রুগ্নতা ছাপিয়ে বিষন্নতা উঁকি দিচ্ছে যেন। অন্তর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরেকবার চাইলে ঘুমন্ত সৈকতের পানে। তারপর সিফাতের উদ্দেশ্যে বলল,
” সৈকত এ কদিন কোথায় ছিল?”
সিফাত জানাল, ” কাল কথা হয়েছিল, বলল ঢাকাতে আছে। আপনাদের সাথে ছিল না? ”
নাহিদ অন্তর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। উত্তর দিল না কেউই। সিফাত ওদের চাহনিতে কিছুর আন্দাজ পেল বোধহয়। প্রশ্ন করল, ” হুট করে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি আসছিল কেন ভাইয়া? কোন সমস্যা হয়েছে? ”
নাহিদ কৌশলে সত্য গোপন করল, ” আন্টিকে মনে পড়ছিল না কি! তাই হুট করেই এলো।”
সিফাতের মুখ দেখে মনে হলো না সে কথাটা বিশ্বাস করেছে। সন্দিহান তাকাল। তবে কথা বাড়াল না। অন্তর পরিবেশ ঠিক করতে বলল,
” হাতে আঘাত ভালোই লেগেছে। ইমিডিয়েটলি এক্স-রে করিয়ে নেয়া দরকার। ফ্র্যাকচার হয়েছে না কি আবার।”
সিফাত হতাশ স্বরে বলল, “গ্রাম্য হাসপাতালে ওসব মেশিনাদি নেই। মেইন টাউনে নিতে হবে। ”
নাহিদ বলল, “তাহলে আমরা এখন ওকে নিয়ে ঢাকা ফিরে যাই। টেস্ট করে সেখানেই ভালো ট্রিটমেন্ট নেয়া যাবে।”
আলাপনের মাঝে অন্তরের চোখ গেল বাইরের দিকে। এক যুবক উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে হাসপাতালে ঢুকছে। বিধ্বস্ত চোখমুখ। ভীষণ উদ্ধিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজছে। হন্তদন্ত হয়ে এ রুম ও রুমে উঁকি দিচ্ছে। যুবকের ওমন উদ্ভ্রান্ততা দেখে বিস্মিত হলো অন্তর। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। পাশে থাকা নাহিদ তা দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
“হাসছিস কেন?”
সামনের দিকে ইশারা করে অন্তর অতিব ধীরে বলল,
” অবশেষে বন্ধুত্বের জয় হয়েই গেল।”
অন্তরের চাহনি অনুসরণ করে যুবকের চোয়াল দৃষ্টিগোচর হতেই থমকাল নাহিদ। পরপরই হেসে উঠল। বিড়বিড় করল,
” কদিন আগে না মা র তে আসছিল, বলেছিল সব শেষ! আজ যখন ম র তে বসেছে তখন আর সইতে পারল না। ”
থেমে অন্তরকে বলল, ” বেচারার যা অবস্থা আর কিছুক্ষণ হলে টেনশনে অ্যাটাক ফ্যাটাক করে বসবে। ধরে নিয়ে আয়।”
খোলা দরজা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। অন্তর বেরিয়ে ডাকল, “রুবাব?”
অন্তরকে খেয়াল হতেই রুবাব দ্রুত পায়ে এলো। তীব্র উদ্ধিগ্নতা নিয়ে বলল,
“সৈকত কেমন আছে? কোথাও আছে? নিউজে দেখলাম এই রুটের এক্সিডেন্টে কেউ বেঁচে নেই। সৈকত কি বেঁচে….
রুবাবের স্বর অবরুদ্ধ হলো। অন্তর বিস্ময় নিয়ে দেখল পরখ করল রুবাবকে।
বোধহয় ঘুমাচ্ছিল। বাসার পরিধেয় টি-শার্ট আর থ্রি- কোয়ার্টার। চোখ ফোলা, এলোমেলো চুল। এক্সিডেন্টের খবর শুনে চেঞ্জ না করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ঘন্টা তিনেকের পথ বাইকে পাড়ি দিয়েছে দেড় ঘন্টায়। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে, ওর ভয় আর হৃদপিণ্ডের মাত্রা জানান দিচ্ছিল দূর থেকেই। লাগাতার প্রশ্ন, ভাব ভঙিমা আর উদ্ধিগ্নতা দেখে যে কেউ বলবে এই যুবক রোগীর খুব আপন কেউ। কাছের কেউ ছাড়া পর কেউ এমন উদ্ধিগ্ন হয়!
বন্ধুত্বের মানুষের হাজার ভুলবুঝাবুঝি আসবে, দুরত্ব আসবে, যোগাযোগ বন্ধ হবে। কিন্তু বিপদ এসে হানা দিলে সব ভুলে ছুটে আসবে, এটাই সত্যিকার বন্ধুত্বের ধর্ম। সেই ধর্মের বাস্তবিক প্রতিচ্ছবি দেখছে যেন অন্তর। সন্তুষ্টচিত্তে বলল,
” শান্ত হ। সৈকত ঠিক আছে। এই এক্সিডেন্টে একমাত্র যাত্রী সৈকত, যে বেঁচে ফিরেছে।”
অনেকক্ষণ একটা শ্বাস আটকে রাখবার পর যেমন মুক্তির পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তেমন একটা নিঃশ্বাস ফেলল রুবাব। বিড়বিড় করে কী যেন পড়ল। ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ পড়ল বোধহয়। পরপরই প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল,
” কেমন আছে সৈকত? কোথায় লাগছে? ডাক্তার দেখিয়েছিস? কী বলল? সব ঠিকঠাক আছে তো?”
অন্তর স্মিত হাসল, “নিজে গিয়ে দেখ।”
রুম দেখিয়ে দিল অন্তর। রুবাব দরজা অবধি গিয়ে ভেতরে চাইল। সৈকতের বাঁ হাতের উপরিভাগে লম্বালম্বি কেটেছে। পুরোটা ব্যাণ্ডেজে ঢাকা। প্রথমবার দেখে রুবাবের মনে হলো বড়ো সড়ো আঘাত লেগেছে। বন্ধুর অবস্থা দেখে আবার উদ্ধিগ্নতা ফিরে এলো রুবাবের। আঁতকে ওঠে বলল,
“হাতে, কপালে লেগে বাজে অবস্থা! এই ভাঙাচোরা হাসপাতালে কিসের ট্রিটমেন্ট নিয়েছিস? কোথায় কিসের সাথে না কিসের সাথে লেগেছে। ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট না নিলে পরে ইনফেকশন হবে। ”
অন্তর আকস্মিক জিজ্ঞেস করল, ” তুই না সৈকতের সাথে বন্ধুত্ব শেষ করে ফেলেছিস, তবে এখন পাগলের মতো ছুটে এলি ক্যান?”
রুবাব সে কথার উত্তর দিল না। কথা এড়িয়ে বলল, “সৈকত জেগে আছে?”
অন্তর নেতিবাচক উত্তর দিল। রুবাব ভেতরে গেল। বন্ধুকে দেখে ধীরে বলল, “আর লাগছে কোথাও?”
সিফাত বলল, “এক্স-রে করলে বুঝা যাবে। ”
রুবাব বলল, “আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখি।”
রুবাব গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। এর মাঝে ঘুম ভাঙল সৈকতের। নাহিদ অন্তর ওর সেবায় মত্ত। রুবাব ফিরে এলো এক ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। শোনা গেল রুবাবের চিন্তিত জিজ্ঞাসা। “মাসখানেকের মাঝে ঠিক হয়ে যাবে তো ডক্টর? একচ্যুয়েলি মাসখানেক বাদে বিসিএস রিটেন। সৈকতের এক্সাম এটেন্ড করাটা বেশ জ….
বলতে বলতে ভেতরে ঢুকছিল। সৈকতের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। থেমে গেল রুবাব। ও ভেবেছে রুবাব ঘুমাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই পূর্বাকার দ্বন্দ্বের কথা মনে পড়ল, বাদ গেল না বন্ধুকে করা হেনস্তা ও। বিব্রতবোধ করল রুবাব। প্রথমবারের মতো বন্ধুর সামনে জড়তা হলো ওর।
অপরদিকে সৈকতের চোখে বিস্ময়। এতকিছুর পর রুবাবের উপস্থিতি ওর কল্পনাতীত। রুবাব এসেছে বিশ্বাস হলো না ওর। কিছুটা সময় লাগল। ধাতস্থ হতেই চোয়াল গম্ভীর হলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ডাক্তার চেকাপ করে চলে গেল। রুবাব ও যাবার জন্য দরজা মুখো হলো। নাহিদের উদ্দেশ্যে বলল,
” ভালো ট্রিটমেন্টের জন্য এখনই ঢাকা রওনা হবো আমরা। নাহিদ ওকে নিয়ে নিচে আয়।”
নাহিদ সৈকতকে সে কথা বলতেই সৈকত গম্ভীরমুখে স্পষ্ট বলল, ” আমি ঢাকা ফিরছি না আর।”
পরপরই সিফাতের উদ্দেশ্যে বলল, “সিফাত আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।”
সৈকতের ঢাকা না ফিরতে চাওয়ার কারণ ধরতে সময় লাগল না বন্ধুদের। রুবাব দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
” অন্তর ওকে মনে করিয়ে দে, শেখ বাড়ি ঢাকাতেই। তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরা কোন ছেলের কাছে আমি আমার বোনের বিয়ে দিব না।”
রুবাবের গম্ভীর কথাটা শোনার পরই তিনটা চোয়ালে বিস্ময় দেখা গেল। অন্তর হৈ হৈ করে বলল,
“এ্যাই, তুই সৈকতের শালানামা কবুল করে ফেলেছিস!”
রুবাব না সম্মতি দিল, আর না দ্বিরুক্তি করল। কিছুই করল না। কেবল ধীরে বলল,
” এম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে বসছি। তোরা ওকে নিয়ে আয়।”
রুবাব চলে গেল। সৈকত বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল দরজার দিকে। ওর হজম হচ্ছে না ব্যাপারটা। রুবাব পরোক্ষভাবে বলে গেল, ঢাকা ফিরলে মুনের সাথে ওর বিয়ে দিবে। অনুমতি দিল না কি সম্মতি! অবিশ্বাস্য লাগছে সৈকতের। দ্বিধা নিয়ে চাইল নাহিদের পানে। নাহিদ হেসে বলল,
” রুবাব সত্যি তোর শা লা হয়ে যাচ্ছে। ফাইনালি!”
অন্তর এসে ওকে ধরে ওঠিয়ে বসাল। কাধ চাপড়ে বলল,
“তোর বাপ্পারাজের কাহিনি শেষ, এবার রোমিও জুলিয়েটের কাহিনি পড়বি। ”
খুশিতে হোক কিংবা বন্ধুর কথায় আকস্মিক হেসে ফেলল সৈকত। মন খারাপের মেঘ এক আকাশ পেরিয়ে পূর্ণতায় রূপ নিল তবে! কত দিন অপেক্ষা করেছে এই ক্ষণের। কত প্রতিক্ষার পর এলো সেই ক্ষণ! অবশেষে এলো। তাও এই হাসপাতালে! সৈকতের চোখে মুনের হাস্যজ্বল চোয়াল ভাসল। সৈকতের মন বলে উঠল,
” তোমাকে পাবার অনুমতি পেয়েছি এত কিছুর পর
তবুও স্বস্তি, তবুও শান্তি।
চন্দ্রকথা যে হতে যাচ্ছে আমার রমনী।
তোমার ওই মুখখানা আর মনখানাতেই আমার হাজার আঘাত মাটি।
তোমাক পেতে শত আঘাত সইতে রাজি। ”
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে এঁকে মনে ভালোবাসার উপকথা লিখে গেল সৈকত।
“চন্দ্রকথা, আমি তোমার প্রণয়ে বাঁধা পড়েছি অনেক আগেই, এবার আমার প্রণয়ে বাঁধার পালা তোমার। তৈরি থেকো। আসছি আমি। ”
সৈকতকে ভীষণ খুশি দেখাল। চোখমুখ দেখে বোধগম্য হয় এই মুহুর্তে সবচেয়ে সুখী মানুষটা ওই। অত্যন্ত খুশিমনে বন্ধুর খুশি দেখছিল দুই বন্ধু। প্রাপ্তির হাসি শুধু সৈকতের ঠোঁটেই নয়, ওদের দুইজনের ঠোঁটে। নাহিদ ওকে দাঁড় করিয়ে বলল,
“যা বেটা জিলে আপনি জিন্দেগী। ”
সৈকত প্রসন্ন মুখে কিছু বলতে নিচ্ছিল তখন চোখ পড়ল ছোটোভাইয়ের দিকে। সিফাত বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে ওর পানে। ভাইয়ের সামনে নিজের অনুভূতির উন্মোচনে বিব্রতবোধ করল সৈকত। কেশে উঠল। ধীর পায়ে হাঁটা ধরল। নাহিদ গিয়ে ধরল ওকে। অন্তর রয়ে গেল সিফাতের সাথে। ওরা একসাথে পা চালালো। সিফাতকে ভীষণ দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। খানিক আগে বোধ হওয়া বিষয় নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি না দ্বিধায় আছে। ওর দ্বিধা বুঝে অন্তর বলল,
” আন্টিকে বলবে, সৈকতের বিয়ের পাত্রী দেখার ঝামেলা কাধে না নিতে। পাত্রী বাছাইয়ের পর্ব সৈকত ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলেছে। শুধু সানাই বাজানো বাকি। ”
সিফাত কৌতুহলী প্রশ্ন, “ভাবি কি রুবাব ভাইয়ার বোন?”
অন্তর হাসল। স্পষ্ট সম্মতি। সিফাত বেশি খুশি হলো। এবার তার সিরিয়ালও আসছে তবে। ভাইয়ার বিয়ের পরদিনই প্রেমিকাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে, মনে মনে সিদ্ধান্ত কষে ফেলেছে।
____________
সাধারণত এম্বুল্যান্সের বেডের স্থানটা পেশেন্টের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু এখনকার দৃশ্য ভিন্ন। রোগী সিটে বসা। রোগীর বন্ধু বেডে শুয়ে আরামছে ঘুমাচ্ছে। এম্বুল্যান্স এ উঠতেই সৈকত বেডে বসেছিল। অমনি অন্তর এসে শুয়ে পড়ল। বলল,
” তোর জন্য সকালে ঘুমাইতে পারি নাই। এখন আমি ঘুমাব।”
সৈকত বলল, ” তুই ভুলে যাচ্ছিস শা লা, রোগী আমি।”
অন্তর চোখ বন্ধ করেছিল। আবার খুলে ফেলল।ওঠে বসল। রুবাব বসেছে সামনে। । রুবাবকে ডাকল, ” রুবাব?”
রুবাব ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। অন্তর রুবাবকে দেখিয়ে সৈকতকে বলল,
” এ হলো রুবাব। সম্পর্কে তোর শা লা। আজ থেকে ওকে শা লা ডাকবি। জলজ্যান্ত শালা থাকতে আর কাউকে শা লা ডাকবি না। তোর নজর খারাপ। শা লা ডেকে ডেকে সত্যি শালা বানিয়ে দিস। এখন শা লা দুলাভাই আলাপ কর, আমাকে ঘুমাতে দে।”
অন্তর আবার শুয়ে চোখ বুজল। রুবাব সৈকতের চোখাচোখি হলো। কিসের যেন জড়তা হানা দিল। চোখ ফেরাল দুজনেই। পুরনো সম্পর্কে ফাটল আর নতুন সম্পর্কের সংমিশ্রণে জড়তার মাত্রা বেশ। আগের মতো ঠিক হচ্ছে না ভাবখানা।
রুবাবের আচরণের সৈকত কষ্ট পেয়েছে বটে। তবে প্রাপ্তির ছোঁয়া সেই কষ্ট দূর হয়ে গেছে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। আগের কথা ধরে বসে থাকলে সৈকতের ক্ষতি। মুনকে পাওয়া হবেনা । মুন সৈকতের জীবনে উপহার নয়, অর্জন। এমন অর্জনের জন্য এক আধটু কষ্ট ভুলাই যায়। সৈকত আবার মজল মুন ভাবমায়।
“হ্যাঁ, মুন বল?” ফোন কানে দিয়ে বলা রুবাবের কথায় ঘোর কাটল সৈকতের। উদগ্রীব হয়ে চাইল ফোনের দিকে। সৈকত কথা বলে যাচ্ছে,
“আমরা ঢাকা ফিরছি।”
অপাশ থেকে কিছু বলল। রুবাব কিছু বলার আগে সময় নিল। তারপর বলল, ” ঠিক আছে। বেশি লাগেনি। ”
কথার ভাবে সৈকত বুঝতে পারল মুন ওর কথাই জিজ্ঞেস করছে। কী ভীষণ খুশি হলো সৈকত! রুবাব এক পলক চাইল ওর দিকে। তারপর ফোনে বলল,
” চিন্তা করিস না। ”
ফোন রাখার পর বলল,
” এক্সিডেন্টের কথা কে বলেছে মুনকে?
নাহিদ বলল,
“তোকে ফোনে না পেয়ে মুনকে কল দিয়েছি, ও ফোন রাখার পরের ট্রাইয়ে তোকে পাওয়া গেছে।”
পরপরই বলল, “মুন চিন্তা করতেছে?”
রুবাব আনমনে বলল, “তাই তো দেখছি। এটা ফোনের এগারোতম কল। ”
মুনের চিন্তার পসরা আর এগারোটা কলের কথায় সৈকত পারলে ডানা ভাড়া করে আকাশে উড়াল দেয়। মুনকে দেখার জন্য মন উদগ্রীব। সেই আকাঙ্খা পূরণ হলো সেদিনই। অপ্রকাশিত সাক্ষাৎ পেয়ে গেল সৈকত তার চন্দ্রকথার।
চলবে…….