ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০২

0
378

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ- ০২
#_আরজু_আরমানী

পরদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে মায়ের মুখোমুখি হলাম। তিনি আমায় দেখে নাক সিটকালেন। কথা বললেন না। কেমন আছি জিজ্ঞেসও করলেন না। চলে গেলেন। তখনি আচমকা তাসকিন এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। মাত্র ক্লাস থেকে ফিরেছে ও। ক্লাস টুয়ে পড়ে। কিছুক্ষন ওভাবেই রইলো। আমি ওকে সরালাম না। ও একটু পর আমার হাত ধরে বললো,

” আপু তুমি এখন সুস্থ আছো তো? জানো কাল রাতে তোমার জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। ”

ওর কথায় ভালোবাসা খুঁজে পেলাম। এতোটা কেউ ভালোাবসেনি। বলা হয়ে থাকে, “মেয়েদেরকে বাবার পর যদি কেউ ভালোবাসে সে হচ্ছে তার ভাই।” আজ এ কথার সত্যতা বুঝতে পারলাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

” যা ড্রেস চেঞ্জ করে নে।”

তাসকিন চলে গেলো। আমি আমার রুমে গেলাম। রুমটা এলোমেলো হয়ে আছে। আমার শখের ফুলদানিটা ভেঙে মেঝেতে পরে আছে। কষ্ট হলেও চাপা দিলাম। কতদিন টিফেনের টাকা বাঁচিয়ে এই ফুলদানীটা কিনেছি! আবার টাকা জমানো শুরু করতে হবে। অনেকক্ষন ধরে রুমটাকে গোছালাম। গোসল করলাম। এই দুপুরে তেমন কেউ বাসায় নেই। ফুপিরা তাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে। সন্ধ্যায় আসেন গল্প করতে। বাবা- কাকা নিজেদের কাজে গেছেন। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিলাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শহরের রাস্তায় ছুটছে গাড়ি। ধুলো উড়ছে। হেয়ার ড্রয়ার দ্বারা চুল শুকালাম। রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। লতিফা খালা দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাসন- কোসন মাজছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” খালা রান্না কি হয়ে গেছে?”

তিনি আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। বিরস মুখে বললেন,

” ম্যাডাম তার বান্ধবীর মেয়ের বিয়েতে যাবেন। তাই আজ বাসায় রান্না করতে না করছে। স্যারও যাবেন।”

আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আর কোনো কথা বাড়ালাম না। ফ্রিজটা খুললাম। কোনো খাবার পাওয় যায় কিনা তার জন্য। সেখানেও শূন্য হাতে ফিরলাম। আমার মা তো জানতো যে, আমি বাসায় থাকবো। তবুও সে রান্না করতে নিষেধ করলো। কি কপাল আমার? এরকম কপাল আর কার আছে? নিজের অস্বিস্তের উপহাস করলাম। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটে থাকে বড় ফুপি। ওনার বাসায় কলিংবেল টিপলাম। দরজা খুললো তাহমিদ ভাইয়া। আমাকে দেখে ভিতরে আসতে বললেন। আমি ভিতরে ঢুকে ফুপির কাছে গেলাম। ফুপি আমায় দেখে বললেন,

” কি ব্যাপার?
” মা খেতে দাও রাত্রিকে।” তাহমিদ ভাইয়া বললেন।

আমি অবাক হলাম তার কথা শুনে। আমি তো তাকে কিছু বলিনি। তবে তিনি কিভাবে জানলেন? ফুপি টেবিলে ভাত বাড়লেন। আমরা তিনজনেই খেতে বসলাম। কৌতুহলবশত তাহমিদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনি কিভাবে জানলেন আমি দুপুরে ভাত খাইনি।?”

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কোনো কথা বললেন না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছি। ফুপিও কোনো কথা বললেন না। তাহমিদ ভাইয়া খাওয়া শেষ করে চলে গেলেন। আমি আমার বাসায় চলে এলাম। ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন লতিফা খালা। ওনার নাক ডাকা দেখে আমার ভীষন হাসি পেলো।

————————

সকাল সাতটার এর্লামে ঘুম ভাঙলো আমার। ছাদে চলে এলাম। আমার ছোট্ট ছোট্ট ফুল চারায় পানি দিলাম। এক্সারসাইজ করলাম। তখন তিশা এলো ছাদে। ওকে বললাম,

” তিশা চল আজ স্কুলে যাই।”
” না। এখন আমরা ছুটিতে। ”
” তুই থাক। আমি স্কুলে যাবো।”

সেদিন ওকে ছাড়াই চলে গেলাম স্কুলে। কেমন যেনো একা একা লাগলো। দশবার কান ধরে উঠবস করলাম,” তিশাকে ছাড়া আর কখনে স্কুলে আসবোনা।” তবে সেদিন তিশা না আসায় আমার জীবনে সোনালি সূর্যের আগমন ঘটলো। সেদিন ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ে গেলাম। কোচিং শেষ হতে সন্ধ্যা হলো। এখন একা বাসায় ফিরবো কিভাবে? সবসময় আমি আর তিশা দুজনে থাকতাম ভয় হতো না। আজ কোনো এক অজানা কারনে ভীষন ভয় হচ্ছে। ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা মেয়ের দিকে যে কারোরই নজর পরতে পারে। অস্বাভাবিক কিছুই না। একটি রিক্সা নিয়ে বাসায় যাবো তারও কোনো উপায় নেই। আমার কাছে যা টাকা ছিলো তা টিফিনে শেষ করেছি। হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ একটা বখাটে ছেলে আমার স্কুল ব্যাগটা টেনে নিয়ে গেলো। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই ওর পিছু ছুটলাম। অনেকক্ষন দৌড়ালাম। ছেলেটা একটা অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে গেলো। আমি ওদিকে পা বাড়াতেই কেউ একজন আমাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। মেজাজটা বিগড়ে গেলো। রাগে গজ গজ করতে করতে তাকে বললাম,

” আপনার কোনো আক্কেল নেই নাকি? ওই লোকটা আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে। আমাকে ওটা আনতে হবে।”

” আপনি কি পাগল? ওই লোকটা যে গলিতে ঢুকেছে ওই এরিয়াটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখানে কেউ ঢুকলে আর বের হতে পারবেনা। জীবন শেষ হয়ে যাবে তবুও পারবে না। ওখানে পঁচে মরতে হবে।”

তখন লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট। তাকে দেখতেও কি স্নিগ্ধ? ঠোঁট নেড়ে কথা বলছে। সে আমাকে টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে এলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

” আপনার বাসা কোথায়? ”

তাকে বাসার ঠিকানা দিতেই সে আমাকে তার গাড়িতে টেনে উঠালো। কোনো কথা বলতে দিলো না। আমি তাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করছি,” সে কে? ” কিন্তু কোনো উত্তর সে দেয়নি। গাড়িতে বসে কোনো কথাও সে বললো না। গাড়ি থামলো আমার বাড়ির সামনে। আমি গাড়ি থেকে নামতেই সে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। একটুও অপেক্ষা করলো না। কোনোকিছু সেদিন তাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ভীষন ইচ্ছে ছিলো তার পরিচয় জানার। ভাগ্য আমার সহয় ছিলো না। আমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বাসার দিকে হাঁটলাম। বাসার গেট খুললো বাবা। তার সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে এলাম। আমি রুমে আসার কিছুক্ষন পরে বাবা আমার রুমে এলো। আমি তখন চুল আঁচড়াচ্ছি। বাবাকে দেখে চিরুনিটা রেখে দিলাম। বাবা চেয়ার বসলেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসতে বললেন। আমি ফ্লোরেই বসলাম। বাবা অনুরোধের স্বরে বললেন,

” রাত্রি তোর কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চাইবো। আমাকে কে দিবি মা? ”
” আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে দিবো।”

বাবা পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলেন। চোখের চশমাটা নামিয়ে একটু মুছে আবার চোখে দিলেন। ঘরে এসি চলছে। তবুও তাঁকে প্রচন্ড ঘাম দিচ্ছে। আমার একটু খটকা লাগছে। কি বলতে চাইছে বাবা? আমার সাথে কথা বলতে কেউ এতো ফর্মালিটি করে না। তবে বাবা কেন করছে? টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সবটুকু পানি একঢোকে শেষ করলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? আই মিন ভালোবাসিস। ”

বাবার এমন কথায় অবাক হলাম। তার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক নয়। এসব প্রশ্ন করার মতো স্কোপ নেই আমাদের মধ্যে। আমি যতদূর জানি, সে অনেকটা লাজুক প্রকৃতির। মেয়েদের চেয়েও তার বেশি লজ্জা। এই লাজুকতার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে এমন প্রশ্ন করার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। সহজ কন্ঠে তার উদ্দেশ্যে বললাম,

” যেখানে আমাকে আমার বাবা- মা ভালোবাসে না। সেখানে অন্য কারো ভালোবাসা প্রত্যাশা করা নিছকই বিলাসিতা। ”

চলবে…………..