#আসমানী
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“আপনি কি সত্যিই ডিভোর্স চাইছেন আপু?”
রোজিনা উদাস হয়ে বলে, “যেখানে আমার কোনো মূল্যই থাকবে না,সেখানে থেকে আমি কি করবো?তাই তাদেরকে মুক্তি দিয়ে চলে আসছি।”
“উনি এতো সহজে মেনে নিলো?”
রোজিনা আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলে,”উনি মানে কে আসমানী? আমার স্বামীর কথা বলছো?”
আসমানী মাথা নাড়ায়।রোজিনা বলে,”মেনে নিতে চায় নি।কিন্তু আমার কাছে থেকে দূরে চলে যাওয়াই ওনার উচিত। আমি কি সেটা দিতে পারবো,যেটা উনি চায়?”
“আপনার জায়গায় উনার সমস্যা থাকলে কি করতেন আপু?”
“আমিও উনার মতোই কাজ করতাম।কেন বলো তো আসমানী?”
“কেন?”
“কারণ আমি যে আমার বাবার মেয়ে।আমার শরীরে তো আমার বাবার রক্তই বইছে।আমার বাবার মেয়ে থাকা সত্ত্বেও একটা ছেলের আশায় আমার মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।আর আমি যদি সন্তানের মা না হতে পারতাম, তাহলে কত বছর আগেই চলে আসতাম।” রোজিনার চোখে পানি চলে আসে।আসমানী বুঝতে পারে সে অভিমান থেকে এই কথা গুলো বলছে।
“আপনি কি তাকে অভিশাপ দিচ্ছেন আপু?”
রোজিনা হঠাৎ কঠোর হয়ে বলে,”তুমি কি জানো তুমি কার ব্যাপারে কথা বলছো?তুমি যাকে নিয়ে কথা বলছো,সে এখনও পর্যন্ত আমার স্বামী।আমি তার সঙ্গে ৭ বছর যাবত সংসার করছি।আজ পর্যন্ত সে আমার সাথে একটু উচ্চস্বরেও কথা বলেনি।আমি মা হতে পারবোনা জেনেও ৫ বছর আমার সাথে সংসার করে যাচ্ছে।তার মা,খালা,ফুপু তাকে বিয়ে করার জন্য হাজারও বুঝিয়েছে।তাদের বাড়িতে তার সামনে কত মেয়েকে এনে দেখানোর চেষ্টা করেছে সে ঘুরেও তাদের দেখেনি।তোমার কোনো ধারণা নেই এই ৫ বছরে সে আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য।তার পরিবারের রোষানল থেকে আমাকে কিভাবে বাঁচিয়েছে।কিন্তু এখন সে অপারগ।তার মা মৃত্যুশয্যায়।শেষ ইচ্ছে হিসেবে সে তার কাছে সেটাই চেয়েছে যেটা এতোদিন এতো চেষ্টা করেও তারা করতে পারেনি।বুঝলে আমাদের কাহিনী?”
আসমানী মাথা নিচু করে থাকে।খুব ধীরে ধীরে বলে,”আপনি তাকে ভালোবাসেন না?কষ্ট হচ্ছে না আপনার?”
রোজিনা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,”,এটা কোনো নতুন ব্যাপার না আসমানী।আমি ৭ বছর আগেও আরো একবার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছিলাম।তখন ভেবেছিলাম স্বামী নামক মানুষকে ভালোই বাসতে পারবো না।কিন্তু বিয়ের মতো একটা হালাল সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস আমার ছিল না।নিজের অজান্তেই আমি কিভাবে যে তাকে ভালোবেসেছি,আমি তা জানিনা।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাকে ভালো না বাসলেই বুঝি আমার ভালো হতো।”
আসমানীর বুঝতে সময় লাগলো না রোজিনা কি বলতে চাইছে।সে বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তাকে ছেড়ে বিয়ে করেছিলেন কেন আপু?”
“ঐ যে,আমার বাবা।সে আমার সুখ চেয়েছিল।তাই তো অত বড় বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিল।তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।”
“ভালো কোথায় হলো?”
“ঐ যে,আমার ভালোবাসার মানুষটা।তার কেউ নেই জানো তো?ছোট বেলাতেই তার মা-বাবা মারা গেছে।আমাকে বিয়ে করলে সে তো একটা সন্তানও পেতো না।তার জীবনটাও অপূর্ণ থাকতো।” বলেই রোজিনা একটু মুচকি হাসে।
আসমানীর ভীষণ ইচ্ছে করে সেই মানুষটা কোথায় আছে সেটা জানতে।কিন্তু সাহসে কুলোয় না সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার।
রোজিনা বলে,”শোনো আসমানী,জীবনে সুখী থাকতে গেলে বেশি কিছু লাগে না।তুমি আমার ভাইয়ের কাছে বেশি কিছু চেয়ো না।তাহলে একটা সময় পর তোমারও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে যাবে আর সেও হারাম পথ ধরবে উপার্জনের জন্য।কেন বলো তো এই কথা বললাম?”
“কেন?”
“আমার বাবা কে দেখো না?নাহিদের শরীরেও তো আমাদের বংশের রক্ত বইছে।কোনোভাবে যদি চাচার ব্যবহার পেয়ে বসে?”রোজিনা কথাগুলো বলে এমনভাবে হাসতে থাকে যেন সে খুব মজার কথা বলেছে।
আসমানী বুঝে উঠতে পারে না সে কি বলবে।রাত পোহালেই যে মেয়েটার ডিভোর্স হবে,সেই মেয়ের মুখে কি এমন হাসি মানায়?
” আসমানী,তোমার শ্বশুর আসছে মা।চলো আমাদের যেতে হবে।”
“যাচ্ছি আম্মা।”
শাহেদা বেগমের এই বাসায় আসতে মোটেও ভালো লাগে না।সারাজীবন টিনের ঘরে থাকা মানুষটা এই বাসায় এসে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।তার জা মানুষটা খারাপ না।কিন্ত ভাসুর মানুষটা বড্ড বেশি লোক দেখানো স্বভাবের।তার কি আছে সেটা মানুষকে দেখানোই তার স্বভাব। বিয়ের প্রথমদিকে তার ভাসুরের কথাগুলো শুনে তার নিজের সংসারে বেশ অশান্তি হতো।সে তার স্বামীকে এটা সেটা বলে বিরক্ত করতো।এটা নেই,সেটা নেই, এটা লাগবে, ওটা লাগবে বলে ঝগড়া করতো।এরপর রোজিনা আর নাহিদ হলো।রোজিনার কত খেলনা,কত দামী দামী পোশাক,প্রতি বেলায় দুধ।আর নাহিদের জন্য তেমন কিছুই না।বুক ফেটে কান্না আসতো তার।স্বামীর ব্যর্থতার জন্য যেমন খারাপ লাগতো,তেমনি নিজেদের মন্দ ভাগ্যের জন্যও কষ্ট পেতো।আর তার স্বামীর সাথে শতবার ঝগড়া করলেও তার স্বামীর মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হতো না।সেটা দেখে তার আরো বেশি রাগ হতো।কিন্তু একদিন যখন রোজিনার মায়ের থেকে একটু দুধ নেওয়ার জন্য ওদের ঘরের কাছে যাচ্ছিল,ভেতর থেকে ভাসুরের চিৎকার আর রোজিনার মায়ের নিরব আর্তনাদ।রোজিনার বাবা শ্রাব্য,অশ্রাব্য অনেক ভাষাতেই গালাগালি করছিল আর মাঝে মাঝে প্রহারও করছিল।ভেতর থেকে ভেসে আসছিল রোজিনার কান্না।তখন একদিকে যেমন রোজিনার মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিল,তেমনি নিজের সুখের জন্য ভালোও লাগছিল।তার স্বামীকে সে কত কথাই শুনাতো অথচ সে উলটো কোনো প্রতিবাদই করতো না।শুধু মুখ বুজে শুনতো সবকিছু।সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত নিজের কি নেই আর অন্যের কি আছে সেটা নিয়ে কখনোই স্বামীর সাথে কোনো ঝগড়া করেনি।এমনকি কোনো খোঁটাও দেয়নি।বরং সেদিনের পর থেকে সে ভেজা বেড়ালের মতো স্বামীর অনুগত ভালোবাসার স্ত্রী হয়েই আছে।
★★★
আসমানী রোজিনাদের বাসা থেকে বের হয়ে বললো,”রোজিনা আপুর ভাগ্য কত খারাপ,তাই না আম্মা?”
“শুধু ভাগ্যই খারাপ না মা।বাবা-মায়ের কর্মফলও।”
“কি বলেন আম্মা?”
“হ্যাঁ। ঠিকই বলছি আসমানী।”
“কেন আম্মা?”
“তুমি জানো না ওর বাবা কেমন মানুষ।আমি ওদের বাড়িতে ওর বাবা থাকলে যাই না।উনি বাড়িতে থাকলেই তোমার শ্বশুরকে ছোট করে কথা বলে।ওদের এই আছে,সেই আছে বলে বলে আমার মাথা খারাপ করে দেয়।আমার ভীষণ লজ্জাও লাগে।রোজিনার জন্মের পর একটা ছেলের জন্য ওর মায়ের উপর কত জুলুম যে করেছে তার হিসাব নাই।সাথে ছিল তোমার দাদী শাশুড়ী। মরা মানুষরে নিয়া খারাপ কিছু বলা ঠিক না।কিন্তু সেও অনেক জ্বালাইছে।আমারেও জ্বালাইছে।কিন্তু শেষ বয়সে এসে রোজিনার মা কিন্তু তাকে দেখে নাই।আমিই দেখছি।রোজিনার মায়ের উনার উপর থেকে সব মায়া মমতা উইঠা গেছিল।সেই কারণ তুমি জানোনা।কেউ জানেনা আমি আর রোজিনার মা ছাড়া। রোজিনার বাবা আমারে আর তোমার শ্বশুররে কথা শুনাইতে আর অপমান করতে কোনো সু্যোগই হাতছাড়া করে নাই।কিন্তু আজকে দেখো,মেয়ের কালকে ডিভোর্স তাই মুখ কালো করে ঘরে শুয়ে আছে।আমাদের সামনেও আসলো না।এইজন্যই বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।”
“থাক আম্মা,এইসব বইলেন না।আল্লাহ উনার শাস্তি উনার মেয়েরে কেন দিচ্ছেন আল্লাহই ভালো জানেন।”
“আমার তো খারাপ লাগে মা।কত কথা মনে পড়ে।আমার নাতাশা তখন কেবল হইছে।আমার নাহিদ রোজিনাদের বাড়ির টিভিতে কোনো এক বড়লোকের মেয়ের নাম শুনেছিল নাতাশা।নাম টা এতোটাই ভালো লেগেছিল ওর যে নাতাশা জন্মের আগে থেকেই বলতো ওর বোন হবে।বোনের নাম হবে নাতাশা।জন্মের পর ওর নাম নাতাশা রাখলে তোমার চাচা শ্বশুর আমাদের কত কি বলেছে নাম রাখার কাহিনী শুনে সেটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না।আমি আতুর ঘরে বসে শুধু আল্লাহকে বলেছি আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে বড় ঘরে বিয়ে দেয়।যেন টিভির ঐ মেয়ের বাবার চাইতেও আমার নাতাশা অনেক বড় ঘরের বউ হতে পারে।আমাদের তো অত সামর্থ্য নেই যে সে বড় ঘরের মেয়ে হবে।” কথাগুলো বলে হুট করেই কাঁদতে থাকে শাহেদা বেগম।
আসমানী তাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,”পুরোনো কথা মনে রাখবেন না আম্মা।চলেন আম্মা,সামনের দোকান থেকে পান কিনে নিয়ে যাই আপনার জন্য।পান তো শেষ হয়ে গেছে।”
কথাগুলো বলে আসমানী জবাবের অপেক্ষা না করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।শাহেদা বেগমও বাধ্য মেয়ের মতো ছেলের বউয়ের পিছু পিছু যেতে থাকে।
আসমানী আর তার শাশুড়ী যখন বাড়ির সামনে আসছিলো,তখন আসমানী খেয়াল করে একটা লম্বা মতো শুকনো লিকলিকে চেহারার এক লোক এদিক সেদিক তাকাতাকি করছে।তার পোশাকও যেন কেমন।যেন কারো থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য আলখাল্লা টাইপ কিছু একটা পড়েছে।আসমানী বুঝে উঠতে পারেনা লোকটা কে।আগে কোথাও দেখেছে বলে তো মনে পড়ে না।তাদের সদস্যও না।না হলে তাকে সিগন্যাল দিতো।তাহলে কে এই লোকটা?
★★★
“এতোক্ষণে আসার সময় হলো মহারানী?”
“কি করবো বলুন?রোজিনা আপুর সাথে কথা বলছিলাম।ওনার জন্য খারাপ লাগছে।”
“আমার লাগছে না।”
আসমানী চমকে উঠে বলে,”মানে?আপনার বোনের বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে আর আপনার খারাপ লাগছে না?”
“নাহ।কারণ,ঐ সম্পর্কে ও ভালো ছিল না।ওর স্বামী ভালো মানুষ হলেও শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ভালো না।আমার বোন কষ্ট পাক,সেটা আমি চাইনা।আমি চাই ও যেখানেই থাকুক,ভালো থাকুক।”
“কিন্তু ওনার কি হবে?”
“ওর জন্য সামনে অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।দেখে নিও তুমি।”
“কিন্তু উনি এখন অনেক বেশি কষ্টে আছেন।”
“আর এই ঘরের মানুষটাও যে তার বউয়ের বিরহে এতোক্ষণ কষ্ট পেয়েছে,সেটা কি তার বউ জানে?”
চলবে…..