বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ৪
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
ঘরটা বেশ বড়। একপাশে সোফা সেট রাখা। তার অপরপাশে ড্রেসিং টেবিল। আর তার ঠিক মধ্যখানে খাট। রাজকীয় না হলেও ভাবটা তেমনই। এই ঘরটায় যে দম বন্ধ হবে এটা শতভাগ নিশ্চিত মাহা। মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে মাহাকে নিয়ে আসা হয়েছে এই বাড়িতে। কাল অবধি যাকে সে ঘেন্না করত আর আজ তার বউ। সা’দ যে এত বড় খেলা খেলবে ভাবেনি মাহা।
সেন্স আসার পর নিজেকে বিছানায় পায় মাহা। চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ঘরটা তারই। তার মানে এখনও নিজের বাড়িতেই আছে সে। হঠাৎই ফোনে মেসেজ আসে। মাহা ফোন আনলক করতেই দেখে একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। যাতে লেখা ছিল – ভণিতা করে অজ্ঞান হয়েছ নাকি আমাকে এইখানে এইভাবে দেখে সত্যিই অজ্ঞান হয়েছ আমি বুঝতে পারছি না। বাই দ্যা ওয়ে আমি বুঝতেও চাই না। তুমি সেদিন ঠিকই বলেছ, আজ আমার জন্য একটা বিশেষ দিন এবং এই দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর তুমি, এইদিনটার জন্য সারাজীবন আফসোস করবে। এই বিয়েতে তুমি না করতেই পারো, তবে তাতে তোমার বাবার মান সম্মান নষ্ট হবে। শুনেছি তোমার বাবার হার্টের সমস্যা। এবার ডিসিশন তোমার। দেখ কী করবে — মাহা মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
মা বাবার মান সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে সকলের সামনেই চুপচাপ বিয়েটা করে নেয় মাহা। না করারও অপশন ছিল না। কারণ, প্রথম থেকে সে নিজেই এই বিয়ের জন্য রাজি ছিল। ভেবেছিল বিয়েটা হয়ে যাক, এরপর সে সুস্থ একটা জীবনযাপন শুরু করবে। কিন্তু তার আরেকটু ভাবা উচিত ছিল। সা’দকে এতটা লাইটলি নেওয়া উচিত হয়নি তার। বাকি জীবনটা যে কীভাবে কাটবে তার একমাত্র আল্লাহ পাক-ই জানেন। এমতাবস্থায় ঘরে দু’জন মেয়ের পা পড়ে। তারা উভয়েই নিজেদের সা’দের কাজিনের পরিচয় দেয় এবং জানায় তাদের এ ঘরে পাঠানো হয়েছে নতুন বউকে ফ্রেশ করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে দিতে। কিছুক্ষণ পর খাবার দেওয়া হবে। মাহা কুশল বিনিময়ের পর ওয়াসরুমে যায়। ওয়াশরুমের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ উভয়ই দিকেই বাড়ন্ত। মাহা ফ্রেশ হয়ে শরীরে ব্লাউজ আর পেটিকোট জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। মেয়ে দু’জন মাহাকে শাড়ি পরতে সাহায্য করে। কিন্তু তারা উভয়ই দেখল মাহা তাদের সাহায্য ছাড়াই মোটামুটি পুরো শাড়ি পরে ফেলেছে। তারা কুচি ঠিক করে দিয়েছে। মাহা স্থির হয়ে বসতেই জাফর ইসলামের সহধর্মিণী অর্থাৎ সা’দের মা খাবার নিয়ে হাজির। তিনি মিষ্টি হেসে মাহার গালে হাত রেখে বললেন, ‘আজ তো তোমার প্রথমদিন এই বাড়িতে। সব মিলিয়ে তুমি ক্লান্তও বটে। তাই আর তোমাকে নিচে যেতে বলি নাই। খাবারটা খেয়ে নাও মা।’
মাহা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে এই মহিলার পেটে ওমন সন্তান, হয় কী করে!
★★
জীবনটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে মাহার। কিছুক্ষণ আগে অশান্ত মনটাকে শান্ত করার জন্য রুমের সাথে এটাচড থাকা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় মাহা। আজ আকাশে অসংখ্য তারা। পুরো আকাশ জুড়ে যেন খুশি বিরাজ করছিল। কিন্তু মাহা বুঝতে পারছিল না যে আকাশের এত খুশির কারণ কী? তার মনে তো কোনো খুশি নেই। তার জীবনটা তো এক প্রকার নষ্টই হয়ে গেল। যা সে চায়নি, প্রকৃতি তা-ই তাকে দিল। এর থেকে কষ্টের কিছু হতে পারে না। এইসব ভাবতে ভাবতে মাহা নিচে তাকায়। চারদিকটা আলোকিত। লাইটের সূক্ষ্ম আভায় নিচের বাগানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে হরেক রকম ফুল গাছ। সাদা জবা ফুলগুলো মাথা উঁচিয়ে বলছে, দেখ হে মানবকূল, দেখ আমি তোমাদের মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছি। মাহার ঠোঁটের কোণে তখন মুচকি হাসি। বাগানের আরেক পাশে চোখ পড়তেই সা’দকে দেখতে পায় সে। আপন মনে সিগারেট টানছে। আর পাশে কিছু ছেলেপেলে কথা বলছে। এই ছেলেগুলোকে মাহা বেশ ভালো করেই চিনে। ভার্সিটিতে সা’দের পিছে পিছে ঘোরে। ভার্সিটিতে প্রায়ই এরা মাহাকে ভাবী, ভাবী করে ক্ষেপাতো। সেদিনের সেই অহেতুক কারণে ডাকা ভাবী শব্দটা আজ সত্যি হয়ে গেল। এখন তারা সত্যিকার অর্থেই ভাবী ডাকবে। সা’দকে দেখে মাথাটা টনটনিয়ে উঠল মাহার। ঘরে এসে সমস্ত লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সে।
শুয়ে শুয়ে নিজের জীবনকে অভিশাপ দিচ্ছে। এই বাড়ির কয়েকজনের মুখে শুনতে পেয়েছে দুই একদিনের মধ্যে অনেক বড় করে একটা রিসিপশন পার্টি রাখবেন সা’দের বাবা। ওই পার্টিতে নিজেকে সা’দের বউ হিসেবে সঙ সাজাতে। যা অসহ্যকর মনে হচ্ছে মাহার কাছে।
কিছুক্ষণ পর সা’দের প্রবেশ ঘটে সেই ঘরে। সে এসেই ঘরের সমস্ত লাইট জ্বালিয়ে পুরো ঘর আলো করে দেয়। মাহার বিরক্ত লাগলেও সে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। সা’দ সোফায় বসে। তার নজর বিছানায়। শাড়িতে আবৃত মাহার শরীরের দিকে। ভেতর থেকে তাচ্ছিল্যের সুর আসে সা’দের। সে ফোন টিপতে টিপতে বলল, ‘তুমি যে ঘুমাওনি তা আমি জানি। ঘুমের অভিনয় করতে যেও না। তোমাকে এমন সস্তা অভিনয়ে মানায় না।’
মাহার রাগ উঠে যায়। সে চট করেই বিছানা থেকে নেমে সা’দের সামনে এসে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল, ‘তোমার মতো মানুষের সঙ্গে এক সাথে এক ঘরে থাকার চাইতে আমি মৃত্যুকে আপন করতে বেশি আনন্দবোধ করব সা’দ। মিথ্যা পরিকল্পনা করে ঠকিয়ে আমাকে তুমি বিয়ে করেছ। কী ভাবছ তুমি, বিয়ে করলেই আমি তোমাকে মেনে নিব? কখনো না, কখনোই না। আমি তোমাকে আরও বেশি ঘেন্না করি। এই বিয়েটাও আমি মানি না। হুমকি দিয়ে আমাকে তুমি বিয়ে করেছ। ছিঃ’
সা’দ ফোনটা পাশে রেখে শান্ত নজরে মাহার দিকে তাকায়। এরপর উঠে দাঁড়ায়। মাহার চারপাশে গোল গোল ঘুরপাক খায়। এরপর বলে, ‘মরতে ইচ্ছা করলে মরতেই পারো। কিন্তু তোমার মৃত্যুতে তো কারো কিছু আসবে যাবে না। আমার হয়তো কিছুটা আসবে যাবে। এছাড়া বাকিরা কয়েকমাস কান্নাকাটি করবে। আর তারপর ভুলে যাবে। এবার ভাবো তুমি মরবা নাকি কি করবা? তোমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করি নাই আমি। মিথ্যা পরিকল্পনাও করি নাই। হুমকিও দিই নাই। আমার বাবা মাকে দিয়ে তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েই তোমাকে আমি বিয়ে করেছি। হ্যাঁ, আমার পুরো নামটা তুমি জানতে না। ভার্সিটিতে সবাই যা জানে, তুমিও তাই জানো। এখানে তোমার ভুল। জানা উচিত ছিল তোমার। খোঁজ করা উচিত ছিল। সেন্সলেস হওয়ার পর যখন সেন্স ফিরল তখম শুধু বলেছিলাম এতে তোমার বাবার মান সম্মান জড়িত। তুমি বিয়েতে না করতে পারতা তো। করো নাই, এটা তোমার ব্যাপার। এখন আমাকে এসব বলে তো লাভ নাই। তুমি কি করে ভাবলা, আমি যাকে বিয়ে করব মুখিয়ে ছিলাম, সে অন্য কারো হয়ে যাবে, আর আমি বসে বসে দেখব! এতটা বোকা আমি, এতটা নির্বোধ! সেদিনের সেই থাপ্পড়ের শোধ এইভাবে তুলব।’
মাহা খানিকটা সময় সা’দের দিকে তাকিয়ে থাকে। সা’দের প্রত্যেকটা কথা তার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। খুন করতে ইচ্ছা করছিল সা’দকে। মাহা আরেকবার হাত উঠালে এবার সা’দ খপ করে হাতটা ধরে ফেলে। অপর হাতে মাহার চুলগুলো চেপে ধরে মাহাকে খুব কাছে নিয়ে আসে। আর তারপর গালে আলতো চু*মু বসিয়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়। বলে, ‘আমাকে সেইসব পুরুষ ভাবলে ভুল করবে তুমি, যারা নিজের পুরুষত্ব ফলানোর জন্য নারীর ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে। আবার ওইসব পুরুষ ভাবলেও ভুল করবে, যারা একেবারে সততা নিয়ে চলে। আমাকে রাগাবা না। আমাকে রাগালে নিজেই বিপদে পড়ে যাবা। আজকের তারিখে এই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।’
পুরো ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়ে সা’দ। মাহা ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের গাল ঘষছে আর কাঁদছে। মনে মনে বলছে, ‘ঘেন্না করি তোমাকে আমি। স্বামীর অধিকার কোনোদিনও পাবা না তুমি। তোমার পরিণতি খারাপ বানানোর জন্য আমি মাহা একাই যথেষ্ট। বিয়ে করে নিয়ে আসছ না এখানে আমাকে। এবার দেখ আমি কী কী করি তোমার সাথে।’
এমন সময় ওয়াশরুমের দরজায় টোকা পড়ে। মাহা পাশ ফিরে তাকায়। বাইরে থেকে সা’দ বলছিল, ‘আরে ভাই ওয়াশরুমে এতক্ষণ করো কী? বের হও। ওয়াশরুমটা আমারও। নাকি ওইখানেই ঘুমাবা ঠিক করছ।’
বিরক্তিভরা চাহনি নিয়ে মাহা ওয়াশরুম থেকে বের হয়। আর সা’দ ভেতরে ঢোকে। মাহা কী যেন ভাবে আর তারপরেই ওয়াশরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দেয়। চোখেমুখে প্রশান্তির হাসি হেসে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
চলমান……………….