তীব্রস্রোত পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
297

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#তীব্রস্রোত
#পর্ব ১৩
#শেষপর্ব
.
.
সুপ্তি ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে তার অলংকার গুলো খুলছিল আর ভাবছিল, কিছু ক্ষণ আগেই যখন সুপ্রিয়ারা সবাই চলে যাচ্ছিল, তখন স্রোত দরজার সামনে গিয়ে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে ছিলো করুণ দৃষ্টিতে, সুপ্তি চোখ সরিয়ে নিলো স্রোতের থেকে, যা দেখে স্রোত চোখ সরিয়ে এগিয়ে চলে গেল। সুপ্তির মনে হচ্ছে এখন স্রোত কে যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভালো হবে, এতে সে নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে পারবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাকি সবাই ও চলে গেল সুপ্তিদের বাসা থেকে। তবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে রেখে গেল, তারা চায়না আর দেরি করতে, আহান যখন দেশে ফিরে আসছে তবে যতটা জলদি সম্ভব সুপ্তি কে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। তাই বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো মাত্র ১০ দিন পর।

সুপ্তি চেঞ্জ করে এসে বিছানার এক কোণে বসে পড়ল। সুপ্তির চোখ পড়ল আহানের পড়িয়ে দেওয়া আংটির উপর, যা দেখে সুপ্তির ঠোঁ*টে একটা মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠল। আংটি’টা যখন আহান কিনেছিল তখন সুপ্তিকে ছবি দিয়েছিল পছন্দ করার জন্য, বাট সুপ্তি আহানের উপরই ছেড়ে দিয়েছিল, তবে আংটির ডিজাইনটা খুব সুন্দর লাগছে সুপ্তির কাছে, ছবির থেকে বাস্তবে বেশি সুন্দর আংটি’টা।

রাতে যখন সুপ্তি আহানের সাথে ফোনে কথা বলছিল তখন বারবার তার ফোনটা কেপে উঠছিল, সাথে টুং টুং শব্দ তাদের ডিস্টার্ব করছিল তাই সুপ্তি ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখল স্রোত তাকে বারবার ফোন দিচ্ছে। সুপ্তির মনে হচ্ছে এখন ফোনটা রিসিভ করা উচিৎ হবে না। তাই সুপ্তি আহানের সাথে কথা বলায় ব্যস্তই হয়ে রইল।

এভাবেই দিন গুলো যেতে শুরু করে দিলো এক দিন দুই দিন করে বিয়ের দিনটা ঘনিয়ে আসলো। সব কিছু একদম ভালো ভাবেই গুছানো হয়ে গেল।

গায়ে হলুদের দিন গায়ে হলুদ দেওয়া শেষ হতেই সুপ্তিকে সুপ্রিয়া ছাদ থেকে রুমে নিয়ে গেল, ড্রইং রুমে যেতেই দেখল স্রোত দাঁড়িয়ে সুপ্তির আব্বুর সাথে কথা বলছে সুপ্তি কিছুটা ঘাবড়ে গেল, কী বলছে তার আব্বুর সাথে স্রোত এই ভেবে।

সুপ্তি সুপ্রিয়া দুজনেই সেখানে এগিয়ে গেল। স্রোত কে কিছু বলতে শুনলো না তারা বাট তার আব্বুর কথা শুনে তারা থমকে গেল।

তুমি বুঝতে পারছ তুমি কী বলছ?

জ্বি আঙ্কেল আমি বুঝে শুনেই বলছি।

তুমি এখন এসব কথা বলছ? তুমি কী জানো না সুপ্তির কালকে বিয়ে?

জ্বি জানি দেখেই বলছি।

সুপ্রিয়া তোর দেবর এগুলো কী বলছে?

কী বলেছে আব্বু?

তুই জানিস না কিছু?

নাতো আব্বু।

তোর দেবর নাকি সুপ্তি কে পছন্দ করে, খুব ভালোবাসে, সে সুপ্তিকে ছাড়া বাঁ*চ*বে না।

স্রোত আব্বু কী বলছে এগুলো? বাট তুমি তবে আগে কেনো বলো নি কাউকে?

ভাবী তোমার বোন সব কিছুই জানে। সেও আমাকে ভালোবাসে বাট আঙ্কেলের ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।

সুপ্তি স্রোতের এমন কথা শুনে প্রচুর ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে।

সুপ্তি, স্রোত কী সত্যি বলছে?

না আব্বু উনি মিথ্যা বলছেন।

সুপ্তি এখনো তুমি চুপ করে মিথ্যা কথা বলো না প্লিজ, আঙ্কেল ও আপনাকে সত্যিটা বলতে পারবে না আমি বলছি তো সুপ্তিও আমাকে অনেক ভালোবাসে।

না আব্বু উনি মিথ্যা বলছেন আমি ওনাকে ভালোবাসি না। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো।

আঙ্কেল সুপ্তি ভয় পাচ্ছে তাই ও এমন করছে।

সুপ্তি আমি তো তোকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলাম। তারপরও তুই ও সুপ্রিয়ার মতই করলি? তাও তো সুপ্রিয়া বিয়ের বেশ কিছুদিন আগেই চলে গিয়েছিল, কিন্তু তুই কিনা বিয়ের আগের দিন রাতেই, আমি তোকে দিয়ে এমন কিছু আশা করিনি। ঠিক আছে তুই তোর ভালোবাসার মানুষের সাথেই ভালো থাক, আমার জন্য বা আমাকে ভয় পেয়ে তোর এত বড় স্যাক্রিফাইস করতে হবে না। তুই যেতে পারিস স্রোতের সাথে।

এই বলে সুপ্তির আব্বু জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল, যা দেখে স্রোত এসে সুপ্তির হাত ধরে বলে উঠল।

সুপ্তি চলো তোমার ভয় তো আঙ্কেল কে নিয়েই ছিলো, আঙ্কেল তো বলে দিয়েছে এখন চলো প্লিজ।

এই কথা স্রোত বলতেই সুপ্তি ঠা*স করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো স্রোতের গালে।

আমি আপনাকে প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম আমি আপনাকে নয় আহান কে ভালোবাসি, তারপর ও আপনার সাহস হয় কী করে এমন মিথ্যা কথা বলার? আমি আপনাকে খুব ভালো মনের অধিকারী ভেবেছিলাম, যার জন্য বন্ধুর স্থান দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনার সেই যোগ্যতাই নেই। হাত ছাড়ুন আমার।

এই বলে সুপ্তি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা ঠেলে ধরলো। তার বাবা দরজা শুধু আঁটকাতে নিয়ে ছিলো আর একটু হলেই আঁটকে দিয়ে ছিলো, সুপ্তি দরজা ঠেলে ধরেই তার বাবার পায়ের কাছে বসে তার বাবার পা জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে উঠল।

আব্বু তুমি প্লিজ আমার কথা বিশ্বাস করো, আমি মিথ্যে বলছিনা, আমি স্রোত কে নয় আহান কেই পছন্দ করি, আব্বু আমাকে তুমি এভাবে ভুল বুঝো না। স্রোত আমাকে পাওয়ার জন্য মিথ্যা কথা বলছে, আব্বু তুমি প্লিজ ওনার কথা বিশ্বাস করো না।

তুমি মিথ্যে বলছ আমার মন রাখার জন্য নিশ্চয়ই।

না আব্বু আমি সত্যি বলছি। আমার কাছে তার প্রমাণ ও রয়েছে। তুমি দেখতে চাও আমি এখনই দেখাচ্ছি।

এই বলে সুপ্তি তার ফোন থেকে স্রোতের সাথে সেদিনের লেখা ম্যাসেজ গুলো বের করে তার বাবাকে দেখালো। যা দেখে তার বাবা সুপ্তিকে বুকে টেনে নিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু ফেলতে লাগলো। তার বাবা স্রোতের কথা এজন্য বিশ্বাস করে ছিলো কারণ সে বুঝেছিল তার মেয়ে হয়ত ভয়ে মিথ্যে বলছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে তার মেয়ে মিথ্যা নয় সত্যি বলছে, তাই সে নিজের বুকে টেনে নিলো মেয়েকে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সুপ্তির আব্বু সুপ্তি কে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, সে স্রোতের কাছে এগিয়ে গেল। স্রোতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্রোত কে ঠাশ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে সুপ্রিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।

সুপ্রিয়া তুমি এখনি তোমার দেবর কে এখান থেকে চলে যেতে বলো। তার জন্য আমি আমার মেয়েকে সন্দেহ করেছি, আমার মেয়ের কথা বিশ্বাস করিনি। আমি চাইনা সে আর এক মূহুর্ত ও আমার চোখের সামনে থাকুক।

এরপর সে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেল। আর সুপ্তি ও নিজের রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

সুপ্তি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল, সুপ্তি আজ প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে ভেবেছিল তার বাবা হয়ত আজ কিছু একটা করে ফেলবে, হয়ত আর এক সেকেন্ড দেরি হলে কিছু একটা করেই ফেলত, ঠিক সময় সুপ্তি দরজা ঠেলে ধরতে পেরেছিল দেখে আজ শেষ রক্ষা পেল।

সুপ্তি সুপ্তি কোথায় গিয়েছ তুমি?

সুপ্তি নিজের চোখ মুছে বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল তার দুলাভাই দাঁড়িয়ে আছে।

কী করছ ওখানে? সবাই তোমাকে খুঁজছে। দেখি এদিকে এসো।

জ্বি দুলাভাই।

সুপ্তি তার দুলাভাই এর সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সুপ্তি কে জিজ্ঞেস করে উঠল।

আচ্ছা বলো বিয়েতে তোমার কী গিফট চাই?

কিছু না দুলাভাই।

জানি তোমার মন খা*রাপ, কাল যেহেতু সবাইকে এখানে রেখে তুমি শশুড় বাড়ীতে চলে যাবে। কিন্তু আমার কাছে তুমি দুটো গিফট পাও, যেহেতু তুমি সেদিন আমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে ছিলে, আজ তো তোমার জন্যই আমি আর তোমার আপু এক সাথে আছি। তাই বলো তুমি কী গিফট চাও।

কিছু না দুলাভাই শুধু একটু শান্তি চাই। যাতে এই বিয়েটা একটু শান্তি মতো হয়ে যেতে পারে। আমি আর কোনো ঝামেলা চাই না।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কিছু কী হয়েছে সুপ্তি?

আপু থেকে জেনে নিয়েন দুলাভাই আমার ভালো লাগছে না। আর এসব বিষয়ে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তবে আপনি একটু খেয়াল রাখবেন যাতে কাল কোনো ঝামেলা না হয় এই বিয়েতে, আমি শালিকা নয় ছোট বোন হিসেবে অনুরোধ করছি আপনাকে, সাহায্য প্রার্থনা করছি আপনার কাছে।

দু হাত জোর করে কথা গুলো বলে উঠল সুপ্তি ফারাবী কে। যা শুনে ফারাবী আর কথা না বাড়িয়ে সুপ্তির রুম থেকে বের হয়ে গেল সুপ্রিয়ার কাছে।

এরপর আর সুপ্তি ওদের স্রোত কে দেখতে পেল না কোথাও। পরদিন খুব ভালো ভাবেই বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। সুপ্তি বিদায় বেলা খুব কান্না কাটি করল তার আব্বু আম্মু কে ধরে। সুপ্তি তার দুলাভাই কে আর বোন কে তার বাবার মায়ের খেয়াল রাখতে বলে আহানের হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে, সুপ্তি জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে রয়েছে, কান্না জেনো থামার নামই নিচ্ছিল না আজ সুপ্তির। সুপ্তি কে এভাবে কাঁদতে দেখে আহান সুপ্তির হাত ধরে সুপ্তি কে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

তুমি এভাবে কাঁদলে আমি ড্রাইভার কে বলে দিচ্ছি গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে।

কেনো?

এজন্য যাতে তোমার কান্না থেমে যায়।

কী ম্যাডাম বলব? এই যে ড্রাইভার ভাই গাড়ি পেছনে নিয়ে চলেন তো?

এই না না, তবে সবাই আমাকেই বকবে।

ঠিক আছে আমি বলব আমার কান্না পাচ্ছিল তাই চলে এসেছি।

না থাক তবে আরও বেশি কষ্ট হবে।

কিন্তু তোমার তো কষ্ট হচ্ছে?

আমি সামলে নেবো নিজেকে একটু সময় দাও প্লিজ আমাকে।

হুম ঠিক আছে।

গাড়ি সুপ্তিদের বাড়ির গলি থেকে বের হচ্ছিল, সুপ্তি আহানের সাথে কথা বলতে বলতে চোখ গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশেই, একটা গাছের উপরে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো স্রোত প্রচুর অপেক্ষা চোখে নিয়ে, সুপ্তি তার দিকে তাকিয়ে স্রোত ও সুপ্তি কে দেখছিল সুপ্তি আজ আর চোখ সরালো না। কারণ আজ স্রোতের জন্য সুপ্তির মনে অনুশোচনা নয় ঘৃণা বিরাজমান।

সুপ্তি তার শশুড় বাড়ীতে পা রাখলো সবাই খুব সুন্দর ভাবেই তাকে বরণ করে নিলো।

এভাবেই সুপ্তির জীবনটা চলতে লাগলো খুব সুন্দর ভাবেই, আহান সুপ্তি কে খুব ভালোবাসে, আর সুপ্তিও আহান কে অনেক ভালোবাসে। দুজন দুজনার সাথে খুব ভালো আছে। ওদের ছোট সংসারে ওরা খুব ভালো আছে।

এদিকে স্রোত সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাহিরে চলে গেছে পড়াশোনার জন্য, তার ইচ্ছে সে সেখানেই থাকবে এখন থেকে, কিন্তু বাসায় সবাইকে জানালে হয়ত কেউ যেতে দিবে না তাই সে পড়াশোনার কথা বলে পারি জমালো অচেনার পথে। যাবার আগে সুপ্তির সাথে একবার দেখা করে গিয়েছিল, তেমন কথা হয়নি তবে বলে ছিলো স্রোত।

চলে যাচ্ছি একেবারের জন্য হয়ত আর দেখা হবে না আপনার সাথে। যদি কখনো চলে আশি তবে দোয়া করবেন যাতে আপনাকে আর ডিস্টার্ব না করতে আশি। হয়ত ভুলে যাওয়া সহজ নয়, তাই ভুলতে পারবো না। তবে ভুলে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাবো অবিরাম, আশি তবে ভালো থাকবেন দোয়া করি আপনি যাতে আপনার প্রাপ্য ভালোবাসার ছোঁয়া পান, আপনি যাতে এই দুঃখটা অনুভব না করতে পারেন, যেটা আজ আমাকে গ্রাস করেছে। আসছি তবে আল্লাহ হাফিজ।

হুম আপনিও ভালো থাকবেন। দোয়া করি আপনি যাতে অন্য কাউকে নিজের জীবনে নিয়ে আসতে পারেন খুব জলদি, যাতে সে আমার শূন্য স্থানটি পূর্ণ করে দিতে পারে। খোদা হাফেজ, আল্লাহ তায়া’লা আপনাকে এই কষ্ট সহ্য করার তৌফিক দান করুক।

এরপর স্রোত পারি জমালো তার গন্তব্যে আর সুপ্তি তার সংসারে মন বসালো। সবাই খুব ভালো ভাবেই জীবন যাপন করছে। ভালো আছে সবাই।

আল্লাহ হাফিজ বন্ধুরা। আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো থাকবেন এই কামনা নিয়ে এই পথ চলা শেষ করছি। ক্ষমা করবেন এতটা অপেক্ষা করানোর জন্য। আমি খুবই দুঃখিত। এরপরের গল্পটা আসতে একটু সময় লাগবে। তাই আজ আর কথা নয় “”আসসালামু আলাইকুম”” সবাই আমাকে মনে রাখবেন, আবার ভুলে যাবেন না কেমন।

………………………….সমাপ্তি……………