সুবর্ণবন্ধন পর্ব-০১

0
156

সুবর্ণবন্ধন- ১

ভ্যাপসা গরম, মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে। কিন্তু নতুন টিনের চাল থেকে নেমে আসা গরম কমাতে পারছে না।
সারাদিন প্রচন্ড রোদে টিন যে আগুন গরম হয়েছে, এখন সেই গরম ভিতরে চালান দিচ্ছে।
সুবর্ণার মনে হলো, বৃষ্টিও তো হতে পারে একটু!
বাড়ির ভেতরের লোকজনের আধিক্য গরম বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। সুবর্ণা অনেকক্ষণ বসে আসে। ঘামে কাতান ব্লাউজ ভিজে গায়ের সাথে সেঁটে আছে। মাথায় জরী দেওয়া পাতলা ওরনা ভার ভার লাগছে।
এখন বাজছে প্রায় এগারোটা।আজ বিকেলে তার বিয়ে হয়েছে।সমস্ত শরীরে মনে হয় একশটা পিঁপড়ে একসাথে কামড় দিচ্ছে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কোন পাপের শাস্তি এটা! সে পা ছড়িয়ে বসতে পারছে না। বিছানার এক পাশে তার নতুন ট্রলি ব্যাগটা ওঠানো। এটা বিশাল সাইজ, এই অফসাইজ ব্যাগ কে কিনেছে কে জানে!
তার বর জাহিদ, উফ লোকটিকে “বর” বলতে হচ্ছে, তেমন কেউকেটা কেউ না। সরকারি কলেজের লেকচারার। বছর দুই আগে জয়েন করেছে। ফ্যামিলির অবস্থা বেশি ভালো না, এই নতুন ঘর ওই ভদ্রলোক করেছেন বোধহয়, বিয়ে করবেন তাই। এই ধরনের পরিবার গুলোতে একজন একটু জাতে উঠলে মানে চাকরি পেলে আর কি, বিয়ের আগে নতুন ঘর তোলে। বিয়ে করবি তো কর, পাত্রীর অভাব ছিল নাকি! সুবর্ণাকেই বিয়ে করতে হলো!
জাহিদ নামের ভদ্রলোক, রাধানগর সরকারি কলেজে জয়েন করেছেন কিছুদিন। সুবর্ণার মামা ওখানকার সিনিয়র প্রফেসর। বিয়েটা মামাই দিয়ে ফেললেন। সুবর্নার মত ছিল না। পরিবারের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়েছে।
রাজীবকে যখন ফোন করে জানাল , বিয়ের জন্য চাপাচাপি করছে এটা জানাতে, রাজীব বলল, ক্যাম্পাসে চলে আয়, আমি তোর বাড়ি গিয়ে কি করব! আমার সাথে কী তোর বিয়ে দিবে!
-আশ্চর্য কথা, প্রেম করেছিস চার বছর, সামনে অনার্স ফাইনাল দিবি, আর বিয়ে করতে পারবি না?
রাজীব এই কথার কোন উত্তর দিলো না।
এসব ভেবে রাগে আর জিদে সুবর্ণা বিয়ে করে ফেলল।
এখানে এসে সে পুরোপুরি হতাশ, একজনকেও মনে ধরলো না। কেউ শিক্ষিত বলেও মনে হলো না। তার চাইতে ক্যাম্পাসে পালিয়ে গেলেও ভালো হতো।
এই পরিবেশে এডজাস্ট করবে কীভাবে সুবর্ণা!
হায় রে আব্বা, খালি ছেলের চাকরিটাই দেখলা, না চেহারা দেখলা, না বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন! সুবর্ণা একা একা ভাবে।
সুবর্ণা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, জাহিদ রুমে ঢুকলেই সে বলবে, সে আসলে চাপে পড়ে বিয়েটা করেছে, সে রাজীবকে ভালোবাসে এবং সে রাজীবকে বিয়ে করবে কিছুদিন পরে। তাই দূরে থাকুন, কাছে আসবেন না।
খেলা শেষ!
বিকেলে মামার বাসায় বিয়ে পড়ানো হলো, সন্ধ্যার পরে এখানে নিয়ে চলে আসা হলো। কাল নাকি বৌভাত করা হবে। সুবর্ণার বাড়িতে প্রোগ্রাম হবে এখান থেকে দুদিন পরে ওরা যাবে, তখন। উল্টাপাল্টা নিয়ম হয়ে গেল সব।
সবই ওলট পালট। সুবর্ণার সাথে এ বাড়িতে বড়মামার ছেলে আর ওর ছোটভাই এসেছে, ওরা কই কে জানে, একটা মেয়ে আসার দরকার ছিল। আসেপাশে চেনা একজন মুখও নেই।
দুনিয়ার ক্ষ্যাত ফ্যামিলি, জরী দিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছে। বিছানার উপরও জরী। ধুর, এত গা চুলকাচ্ছে, সিওর বড় বড় লাল স্পট হয়ে আছে সারা শরীর৷ ওই লোক যদি জোর করে কিছু করতে চায়, তখন কি হবে!
নাহ জোর করার মতো মনে হয় নাই, ভদ্র চেহারা৷ যদিও গায়ের রঙটা কুচকুচে কালো!
ইশ, বডি শেমিং হয়ে যাচ্ছে, কালোটা তো সমস্যা না।
নাহ , কালোটাও সমস্যা, সুবর্না সবসময় চেয়েছে ওর বর দেখতে রাজপুত্রের মতো হবে!
আচ্ছা রাজপুত্রের মতো কেন বলে, রাজপুত্র তো বিত্তবান, রাজ্যের উত্তরসুরী, সুন্দর হবে এমন তো বলা নেই!
অবশ্য টাকা পয়সাওয়ালা ছেলেরা পোশাক আশাকে কেতাদুরস্ত সেজে থাকে, মেয়েরা আকৃষ্ট হয় সহজে, খুবই আশ্চর্য বিষয়। পুরুষ মানুষকে পছন্দ করার পেছনে তার টাকা পয়সা দায়ী থাকছে! রাজপুত্রও রাজপোশাকে থাকত বলে সুন্দর লাগতো দেখতে বোধহয়!
ধ্যাৎ, সুবর্ণা এসব কি ভাবছে, এগুলো কি এখন ভাবার সময়।
ক্যাৎ ক্যাৎ করে আওয়াজ হলো, বিশ্রী শব্দ। দরজা খুলছে। একদল মহিলা অশ্লীল জোকস বলতে বলতে জাহিদকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
জাহিদ ভেতর থেকে কপাট লাগিয়ে বিছানায় এসে বসলো।
জাহিদ প্রথম কথাটাই বলল, একি সুবর্ণা ঘেমে কি অবস্থা তোমার! গলার নিচে লাল লাল কি, এলার্জি নাকি!
রাজীবের প্রেমকাহিনী সুবর্ণা আর বলতে পারল না। তার বদলে বলল, আমি একটু গোসল করবো, অনেক গরম লাগছে!

সুবর্ণার কথা শুনে জাহিদের প্রথম যেটা মনে হলো, এই ভ্যাপসা গরমের সময় এত রাতে, ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে মেয়েটার ঠান্ডা লেগে যাবে। প্রথমে একটু গরম পানির ব্যবস্থা করতে হবে। এখন ঘরভর্তি মানুষ, গরম পানি করতে হলে বাইরে রান্নাঘরে যেতে হবে, আর গ্রাম এলাকায় বউয়ের এলার্জির সমস্যা কথাটা গল্পের মতো ছড়াবে।
জাহিদ আলমারি খুলে একটা ওয়াটার হিটার বের করল।
এটা শীতকালে এনেছিল, কিন্তু কাজে লাগানো হয়নি। আজ এভাবে কাজে লেগে যাবে, আশা করেনি। ঘর লাগোয়া পাকা ওয়াশরুম, সবকিছুই নতুন, মাস আটেক হয়েছে এই নতুন ঘর করা হয়েছে। টিনশেড আঁধপাকা বাড়ি, চারটা রুম, বাইরেটা তাও প্লাস্টার করা হয়নি এখনো। একার বেতন দিয়ে এত কিছু সম্ভব না।
বিয়েটা আরো বছর খানেক পরে করলে ভালো হতো, সুবর্ণার ছবি দেখে খুব ভালো লেগে গেল, ফ্যামিলিটাও ভালো, ওর যেমন কেউ নেই আত্মীয়স্বজন, সুবর্ণার মামা, খালু চাচা সবাই বড় বড় পজিশনে আছে। সুবর্ণার বাবারও বড় বড় দুইটা কাপড়ের দোকান জেলা সদরে।
জীবনে ভালো পজিশনের আত্মীয়স্বজন লাগে! সব চাইতে বড় কথা, মেয়েটাও মিষ্টি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
তাই বিয়েতে রাজী হয়ে গেল গোলাম রসুল স্যারের প্রস্তাবে।
এটা জাহিদের গ্রামের বাড়ি। ও থাকে এখান থেকে দুটো গ্রাম পরে, রাধানগর কলেজের টিচার্স কোয়ার্টারে।
বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা যায়। কিন্তু ওখানে আরো কলিগরা আছে, কলেজের লাইব্রেরিটা বেশ সমৃদ্ধ, কোয়ার্টারটাও ছিমছাম, মোটকথা দারুণ পরিবেশ।
এখানে হয়ত সুবর্ণার ভালো লাগবে না কিন্তু রাধানগরে ভালো লাগবে। ওখানে ওর মামার বাড়িও কাছে।
এসব ভাবতে ভাবতে জাহিদ পানি গরম করে ফেলল।
সুবর্ণা গয়না গাটি খুলে ফেলেছে। বড় ট্রলিটা নিচে নামানো হয়েছে। জাহিদ দেখেছে পুরো বিছানায় জরী চিকচিক করছে, মেয়েটার এলার্জি জরীর কারণেও হতে পারে।
গয়নাগুলো খুলে বক্সে রেখে সুবর্ণ কিছু খুঁজছে।
-সুবর্ণা, কিছু খুঁজছ?
সুবর্ণা একটাও পুরোনো জামা খুঁজে পেলো না। ওর সাথে সব জামা নতুন, বিয়ে উপলক্ষ্য করে, মা বানিয়ে এনেছিলেন, শ্বশুরবাড়িতে কী পুরনো জামা পরে ঘুরবে তার মেয়ে!
এখন কী হবে, না ধুয়ে এ জামা পড়লেও ওর গা চুলকাবে।
মা কিভাবে ভুলে গেল!
-কি হলো, কিছু খুঁজছ?
এই মুহুর্তে জাহিদ ছাড়া সাহায্য চাওয়ার মতো কেউ নেই। সুবর্ণা বলল, আমার ব্যাগে সব জামা, শাড়ি নতুন।
কিন্তু এগুলো ওয়াশ করা হয়নি, আমি পরলে আবার গা চুলকাবে, গোসল করে লাভ হবে না।
জাহিদ চিন্তায় পড়ে গেল, এখন কী করবে?আলমারির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার টিশার্ট আছে, লন্ড্রি করা, আর ট্রাউজার, আপাতত চালিয়ে নিতে পারবে না?
কী আর করা যাবে, এগুলো তাও ওয়াশ করা, সমস্যা হবে না। একটা ড্রেস ধুয়ে চেয়ারে মেলে দিলে সকালে সেটা পাল্টে নেওয়া যাবে। সুবর্ণা ঘাড় নাড়ল, টাওয়েল আর টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে ও ওয়াশরুমে চলে গেল।
জাহিদ গরম পানিটা বালতিতে দিয়ে এসে বলল, ডিপকলের পানিতে গোসল করলে ঠান্ডা লাগবে, তাই একটু মিক্স করে নাও।
জাহিদ এই ফাঁকে জরীর ঝালরগুলো খুলে বারান্দায় রেখে এলো। চকমকে নতুন বিছানার চাদর পাল্টে আলমারি থেকে একটা পুরনো বেডশিট বের করে বিছিয়ে দিলো।
এটা সফট আছে, আপতত আর কিছু চোখে পড়ছে না। ওর যেহেতু স্কীনে এলার্জির সমস্যা, ওষুধ সাথে থাকার কথা। ঠিক মতো খেতেও পারেনি মেয়েটা।
সারাটা দিন ওর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল।
কী আশ্চর্য, কয়েক ঘন্টায় মেয়েটাকে এত আপন মনে হচ্ছে, কিন্তু কেন!
জাহিদ নিজে বিয়ের পোশাক পাল্টে অপেক্ষা করতে লাগল। ধকল তারও কম হয়নি, সুবর্ণা বের হলে ও ফ্রেশ হবে। তারপর একটু ঘুমাবে।
সুবর্ণা প্রায় আধঘন্টা পরে বের হলো মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে, জাহিদ তাকিয়ে দেখল, কি সুন্দর লাগছে ওকে, এই বেসাইজ ঢোলা টিশার্ট আর কতখানি বেশি লম্বা ট্রাউজারে। যদিও সুবর্ণা ট্রাউজার গুটিয়ে নিয়েছে বেশ খানিকটা। ফর্সা ভেজা পা চকচক করছে। পায়ের আঙুলে কী নেইলপালিশ দিয়েছে?
সুবর্ণার একটু অস্বস্তি লাগছিল প্রথমে, পরে দেখল পোশাকগুলো পরিস্কার, তাই আর সমস্যা মনে না করে সহজেই পরে নিয়েছে। একটা সুতির জামা ধুয়ে নিয়ে এসেছে।
জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা এখানে মেলে দিই? বাতাসে শুকিয়ে যাবে।
জাহিদ বলল, আমাকে দাও। কাপড় থেকে পানি ঝরছে এখনো। জাহিদ বারান্দা থেকে নিংড়ে নিয়ে আলনা আর চেয়ারে ফ্যানের নিচে মেলে দিলো। সুবর্ণা বিছানায় বসে দেখলো জবড়জং জরী, চাদর উধাও। এটা পুরোনো চাদর হলেও নরম, পরিস্কার।
বাহ, অনেক গোছানো মানুষ তো ভদ্রলোক!
সুবর্ণা নিজে এতো গোছানো না। গোছানো হলে নিজের প্রয়োজনীয় একটা নরম ড্রেস ঠিকই নিয়ে আসত মনে করে। মনেই ছিল না।
-সুবর্ণা, তোমার কাছে কোন ওষুধ আছে, থাকলে খেয়ে শুয়ে পড়ো, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি, জাহিদ বলল।
-না, ওষুধ খেতে হবে না, এমনিতেই কমবে। জরী আর গরমে এই অবস্থা হয়েছে।
-আচ্ছা তুমি শুয়ে পড়ো তাহলে।
সুবর্ণা ঘাড় নেড়ে বলল, চুল ভেজা, এখনি শুয়ে পড়া যাবেনা।
জাহিদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো সুবর্ণা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে।
জাহিদ একটা এক্সট্রা টাওয়েল বের করল লাগেজ থেকে। বালিশে বিছিয়ে সুবর্ণাকে শুইয়ে দিলো চুল ছড়িয়ে।
সারাদিনের ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুবর্ণা কিছু টের পেলো না।

চলবে

শানজানা আলম