#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব- ৮
পল্লবীর শ্বাশুড়ি জবাবে বলল
– এত অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয়নি। পড়ে গিয়ে মাথায় একটু আঘাত পেয়েছে।
– মা আপনি এটা কীভাবে বলছেন যে, অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয়নি? আমার মেয়েটা পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে আর আপনি বলতেছেন কিছুই হয়নি। কীভাবে পড়ল আনায়না? আপনারা কী একটু মেয়েটাকে দেখেও রাখতে পারেন না?
– দেখো মেয়ে আমার নাতি আমরা ভালো বুঝি। ঘুমিয়ে ছিল আমি গোসল করতে গেছিলাম, খাট থেকে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে। এতে কী এমন হয়েছে? মরে তো যায়নি।
– কেমন ভালো বুঝেন সেটা তো বুঝতেছিই। আমি আমার মেয়েকে কখনও কোনোদিন এভাবে ফেলে রেখে যায়নি। কত সাবধানে রেখেছি। আর আপনারা নিয়েছেন দুই দিন ও হলো না এর মধ্যে ব্যথা দিয়ে বসলেন। আমি আজকে এসেই মেয়েটাকে নিয়ে যাব।
– খবরদার বাসায় আসার সাহস দেখাবে না। আমাদের নাতি বাঁচুক মরুক আমরা বুঝব। বাসায় আসলেও ঘরে ঢুকতে পারবে না। মানুষ এনে পিটিয়ে বের করব। যে কারণে কল দিয়েছি সেটা শোনো আগে।
– আমি তো আমার মেয়েকে আগে হোক পরে হোক আমার কাছে আনবই। যাইহোক কল দিয়েছেন কেন বলেন?
– কল দিয়েছি এজন্য যে তুমি যে গহনা গুলো নিয়ে গেছ সেগুলো ফেরত দিয়ে যাও। নিয়ে গেছিলে তো আনায়নার জন্য। আনায়না যেহেতু আমাদের কাছে এখন, সেহেতু গহনা গুলো দিয়ে যাও। সাহিল ও বিয়ে করবে কিছুদিন পর সুতরাং এ গহনাতে আর তোমার অধিকার নেই।
– কে বলেছে আমার অধিকার নেই। এ গহনাতে একমাত্র আমার অধিকার আছে। আর আমার তো মনে হয় আনায়নাকে আপনারা গহনার লোভে নিয়ে গেছেন। সামান্য গহনার জন্য একজন মা হয়ে আরেকটা মায়ের বুক খালি করতে আপনার বুক কাঁপেনি? এত বড় অন্যায় করতে পারলেন কী করে? ভাবতে ঘৃনা হয় আপনি কারও মা। আপনি পুরো মা জাতির কলঙ্ক।
বলেই পল্লবী কলটা কেটে কাঁদতে লাগল।আনায়নার কান্নার আওয়াজটা পল্লবীর মাথায় বাজতে লাগল আর কষ্টে বুকটা ফেটে যেতে লাগল। কবে যে সে সুখের মুখ দেখবে সে আশায় বুকে বাঁধতে লাগল। নিজেকে আজ বড় অসহায় লাগে পল্লবীর। কারণ কোনোকিছু পেয়ে হারানোর মতো কষ্ট হয়তো দুনিয়াতে অন্য কিছু নেই। পল্লবীর কান্না দেখে নুরজাহান বেগম কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
– কী হয়েছে রে মা? এমন করে কাঁদছিস কেন?
– মা গো আমার আনায়নাকে ওরা ব্যথা দিয়েছে। মেয়েটা আমার ব্যথায় চিল্লাচ্ছে। আমার বুকের মানিককে আমি কবে পাব আমার জীবনে? মা গো আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
নুরজহান বেগম পল্লবীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
– আনায়নার জন্য হলেও ধৈর্য ধর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই নুরজাহান বেগম ও কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল অন্য রুমে। আর এদিকে পল্লবী কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেল। সকালে উঠেই রওনা দিল চাকুরির দরখাস্তের জন্য। চাকুরিতে দরখাস্ত করে বাসায় এসে উপরের দিকে তাকিয়ে পল্লবী শুধু ভাবছে কী করা যায়। ভাবতে লাগল নিজেকে একটু প্রস্তুত করা দরকার চাকুরির জন্য। পরশু একটা ইন্টারভিউ আছে সেটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। যে ভাবনা সে কাজ। সব চিন্তা দূর করে ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। পড়ালেখার সংস্পর্শে নেই অনেকদিন যাবত। তাই প্রস্তুতি নিতে বেশ হিমিশিম খাচ্ছে পল্লবী তবুও মনটাকে স্থির করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। টানা দুদিন বেশ ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছে পল্লবী। আজকে ইন্টারভিউ দিতে যাবে। বেশ পরিপাটি হয়ে ইন্টারভিউ দিতে রওনা হলো পল্লবী। ঘন্টাখানেক পর ব্যস্ত শহরের যানজট পার হয়ে অফিসে পৌঁছাল।
অফিসের বাইরে বসে আছে সে। বাইরে বসে পল্লবী বেশ ভালোই টের পাচ্ছে দেশে বেকারত্বের হার কত বেশি। একটা সাধারণ পোস্টের জন্য কত মানুষ ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। যদিও লোক নেবে মাত্র দশ জন। কিন্তু ইন্টারভিউ দিতে এসেছে শত শত মানুষ। চুপ করে বসে ভাবতে লাগল এত মানুষের ভিড়ে তার চাকুরিটা হবে তো? ভাবতে ভাবতেই পল্লবীর ডাক পড়ল। পল্লবী ভয়ে ভয়ে ইন্টারভিউ কক্ষে প্রবেশ করল। একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। বয়স আনুমানিক ৪০-৪৫ হবে। উনিই মূলত ইন্টারভিউ টা নেবেন। পল্লবী ঠিক উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পল্লবীকে লোকটা ইশারা করে বলল চেয়ার টেনে বসতে। পল্লবীও বাধ্য মেয়ের মতো চেয়ার টেনে বসলো। সকল সার্টিফিকেট সাবমিট করল। লোকটা এবার পল্লবীর সিভি দেখে পল্লবীর দিকে ভালো করে তাকাল তারপর বলল
– ডিভোর্স হয়েছে কেন?
– পরকিয়ার জন্য।
– কার? আপনার নাকি স্বামীর?
– স্বামীর।
লোকটা একটা হাসি দিয়ে বলল
– স্বামীর সাথে অশান্তি করতেন মনে হয়।
লোকটার কথা শোনে পল্লবীর শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। ইন্টারভিউ দিতে এসে যে এসব কথা শোনতে হবে সেটা পল্লবীর জানা ছিল না। তবুও সে নিজেকে সামলে নিল। কারণ চাকুরিটা তার প্রয়োজন তাই কথাগুলো হজম করে নিল। প্রতিউত্তরে পল্লবী কোনো জবাব দিল না। এমন সময় লোকটা পল্লবীকে জিজ্ঞেস করল
– চাকুরিটা কী খুব জরুরি?
পল্লবী হালকা গলায় জবাব দিল
– আমার একটা ছোট মেয়ে আছে। আমার মেয়ের ভরণ পোষণের জন্য চাকুরিটা অনেক জরুরি। চাকুরিটা দিলে খুব খুশি হব।
লোকটা চেয়ারে হেলান দিয়ে দুলতে দুলতে বলল
– চাকুরিটা দিতে পারি তবে একটা শর্তে।
পল্লবী কথাটা শোনে অস্থির গলায় বলল
– কী শর্ত বলুন। আমি সব মেনে নেব।
লোকটা সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নিয়ে এসে বলল
– সত্যিই কী সব মেনে নেবে?
– হ্যা স্যার মেনে নেব।
– বাহ তুমি তো গুড গার্ল। শোনো আমি তোমাকে চাকুরি দেবো তোমারও তো আমাকে কিছু দিতে হবে।
– দেখুন স্যার আমার কাছে এ মুহুর্তে কোনো টাকা নেই যে আপনাকে দেবো।
– আরে বোকা মেয়ে আমাকে দেখে কী তোমার মনে হয় টাকার দরকার আমার?
– ঠিক তা না স্যার।
– শোনো মেয়ে চাকুরিটা তোমাকে দেবো তবে এক রাত তোমার সাথে থাকতে দিলে। একরাত এক সাথে থাকব। তোমারও তো হাসবেন্ড নেই একা থাকতে কষ্ট হয়। আমারও একা থাকতে বেশ কষ্ট হয়। তাই দুজনের কষ্ট দূর করব। বিনিময়ে তুমি চাকুরিও পাবে আর টাকাও। আমি জানি তুমি না করতে পারবে না। কারণ তোমার টাকার খুব দরকার। আর আমার দরকার একজন সঙ্গীর।
কথাটা শোনে পল্লবীর শরীরটা রাগে জ্বলে গেল। টেবিল থেকে সকল কাগজ হাতে নিয়ে বলল
– স্যার আপনি বিয়ে করেন নি?
– হ্যা করেছি।
– ছেলে মেয়ে কয়জন?
– দুইটা মেয়ে আছে।
– বড় মেয়ের বয়স কত?
– এই তো ২৭ এ পড়ল। কিন্তু এতকিছু জিজ্ঞেস করছো কেন? চিন্তা করো না তারা কিছুই জানতে পারবে না। বিষয়টা তোমার আর আমার মাঝেই থাকবে।
পল্লবী এবার চেয়ারটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– বাবার বয়সী হয়ে লজ্জা লাগে না আপনার, আমাকে এসব বলতে। এতটা নীচ কী করে হয়েছেন? আমি ডিভোর্সি হতে পারি। টাকার দরকার হতে পারে। তার মানে এই না নিজের সম্মান বিক্রি করে দেবো। ইচ্ছা করছে আপনার গালে কষিয়ে দুইটা চড় দেই। তবে সে সুযোগটা পাচ্ছি না। আপনার চাকুরির আমার দরকার নেই। ঘরে আপনার বড় মেয়েটার যে বয়স আমার বয়স ও তার সমান। এত চুলকানী যেহেতু মেয়ের কাছে যান কমিয়ে দেবে।
লোকটা রেগে গিয়ে তুমি থেকে সম্বোধন আবার আপনিতে নিয়ে বলল
– মিসেস পল্লবী আপনি কিন্তু মাত্রা অতিক্রম করছেন।
– ওহ তাই নাকি। নির্লজ্জ কোথাকার। লাথি মারি আপনার চাকুরির। তবে আমার আফসোস দুইটা চড় কষিয়ে আপনাকে দিতে পারলাম না।
বলেই পল্লবী হনহন করে অফিস রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ল। অফিস রুম থেকে বের হয়ে নিজের অজান্তেই পল্লবী কাঁদতে লাগল। এতটা অপমান তাকে সহ্য করতে হবে কল্পনাও করেনি। সেদিন বাসায় গিয়ে অনাগত সন্তান আর আনায়নার জন্য কাঁদতে লাগল পল্লবী। নুরজহান বেগম মেয়ের এ অবস্থা দেখেও নির্বাক কারণ সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা পাচ্ছে না। এমন সময় এডভোকেট জান্নাত জেসির কল আসলো পল্লবীর ফোনে। পল্লবী কলটা ধরতেই এডভোকেট জান্নাত জেসি বলল
– আজকে বিকেলে আপনি আনায়নার সাথে দেখা করতে পারবেন। তাড়াতাড়ি আমার এখানে চলে আসবেন। দুই পক্ষের উকিলে থাকবে। কিছুক্ষণ সময় মেয়ের সাথে কাটাতে পারবেন।
এডভোকেট জান্নাত জেসির কথা শোনে পল্লবীর মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। আনায়নাকে দেখার আনন্দে সকল কষ্ট যেন দূর হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে তৈরী হয়ে আনায়নাকে দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিল পল্লবী। প্রায় এক ঘন্টা পর সেখানে পৌঁছে যখন আনায়নাকে দেখল তখন আনায়নার অবস্থা দেখে পল্লবীর বুকটা ফেটে গেল।
কারণ-