পরিণয় পর্ব-০৭

0
1369

#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

পরদিন সকালে নিজের হাতে নিজের বাচ্চা খুন করতে রওনা দিয়েছে পল্লবী। সারাটা রাস্তা পল্লবী ভাবতে লাগল বাচ্চাটাকে কী নষ্ট করা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের সামনে আসলো। মন সায় দিচ্ছে না বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে অপরদিকে পরাস্থিতিও সব কিছুর বিরুদ্ধে। ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে হাসপাতালের করিডোরে বসে এসব ভাবতে লাগল পল্লবী। এমন সময় এক দম্পত্তি এসে পাশে বসল। কেন জানি না পল্লবীর মন চাচ্ছে মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে একটু কথা বললে তার একাকীত্বের গ্লানিটা দূর হবে। তাই হালকা গলায় মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল

– আপনার কী হয়েছে? মেডামের কাছে এসেছেন কেন?

মেয়েটা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুখটাকে আঁধার করে বলল

– বিয়ে হয়েছে ৮ বছর চলে। আমাদের কোল আলো করে এখনও কোনো বাচ্চা আসেনি। সংসারে সব পেয়েছি। স্বামীর ভালোবাসা, শ্বশুড় শ্বাশুড়ির আদর, টাকা পয়সা সব। তবে একটা জিনিসের ঘাটতি আর সেটা হলো একটা বাচ্চা। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। যে যখন যা করতে বলেছে করেছি। টাকাও অনেক খরচ করেছি। কবিরাজও দেখিয়েছি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সব কিছু থেকেও যেন কিছু নেই। আল্লাহর কাছে কত চেয়েছি একটা বাচ্চা। আল্লাহও হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই অভাগী মায়ের কথা শোনে না। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে যখন দেখি গোলুমুলু বাচ্চাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে মরে থাকে তখন খুব আফসোস লাগে। জানি না সেসব মায়েরা কীভাবে পারে একটা বাচ্চাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে। তাদের আত্মা কী কাঁপে না? কত মায়ের আর্তনাদ থাকে একটা বাচ্চা আর তারা সে বাচ্চাকেই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। অনেকে দেখি দুই মিনিটের আবেগের বশে প্র্যাগন্যান্ট হয়ে গর্ভপাত করায় তাদের জন্যও আফসোস হয়। একটা বাচ্চা নষ্ট করা তো একটা প্রাণ খুন করার সমান। তারা বুঝে না একটা বাচ্চার মর্ম কত। আমাদের মতো যারা একটা বাচ্চার জন্য দিনরাত চোখের জল ফেলে তারায় বুঝে একটা বাচ্চা আল্লাহর কত বড় নেয়ামত।

বলেই মেয়েটা কাঁদতে লাগল। পাশ থেকে মেয়েটার কান্না দেখে মেয়েটার স্বামী মেয়েটাকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বলতে লাগল

– তুমি কান্না করো না। এবার আমাদের দিকে আল্লাহ তাকাবে দেখো। তুমি নিজেকে সামলাও সায়মা। দেখবে আমাদের কোল আলো করে এবার একটা সন্তান আসবে ইনশাআল্লাহ।

মেয়েটার স্বামীর মুখে সায়মা নামটা শোনে পল্লবী বুঝতে পারল মেয়েটার নাম সায়মা। একদিকে সায়মা কাঁদছে আরেক দিকে ছায়ার মতো সায়মার পাশে দাঁড়িয়ে সায়মার স্বামী সাত্ত্বণা দিচ্ছে। ভালোবাসার কী অটুট বন্ধন দুজনের মধ্যে। সব ছেলেরা যদি সাহিলের মতো হত তাহলে সায়মার স্বামী সায়মাকে নিয়ে আট বছর সংসার করতে পারত না। তাদের ভালোবাসার বন্ধন এত বছর পর নড়বড়ে হয়ে যেত। কিন্তু কিছু ছেলে আছে যারা শত বাঁধা পেরিয়ে স্ত্রীকে সম্মান দিতে জানে ভালোবাসতে জানে। সায়মা আর সায়মার স্বামীর ভালোবাসার মাত্রা কতটা গভীর সেটা তাদের কথোপকোথনেই বুঝা যাচ্ছে। এর মধ্যেই চেম্বার থেকে ডাক আসলো সায়মা কে?

সায়মা আর সায়মার স্বামী ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দুজন দুজনের হাতটা ধরে চেম্বারের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। এখান থেকে চেম্বারের পথটা মিনেট একের। তার মধ্যেও কেউ কারও হাত ছাড়েনি। পরম যত্নে একে অপরকে ধরে চেম্বারে প্রবেশ করল। পল্লবী শুধু দু চোখ দিয়ে তাদের দেখতে লাগল। পরক্ষণেই তার মনে প্রশ্ন জাগল আল্লাহর এত বড় নেয়ামত কী শেষ করে দেওয়া তার উচিত হবে? ভাবতে লাগল নিজের হাতে একটা বাচ্চা খুন করতে হবে তাকে। অথচ এ বাচ্চার জন্য কেউ মোনাজাতে চোখ ভিজিয়েও পায় না। কথাগুলো ভেবে মুহুর্তের মধ্যেই পল্লবীর মন পরিবর্তন হয়ে গেল। সে চিন্তা করলো তার এ বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে। সাহিলের অপরাধরের জন্য তো সে এ নিষ্পাপ বাচ্চার খুন করতে পারে না। এসব ভেবেই সে করিডোরের সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার না দেখিয়েই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেল। চিন্তা করলো তার সংগ্রামের পথটা আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। তবে তাকে এ সংগ্রামে জয়ী হতে হবে৷ দুটো প্রাণের জন্য হলেও তাকে লড়তে হবে।

আনায়নার কথা মনে হয়ে গেল পল্লবীর। আনায়নাকে দেখার জন্য তার বুকটা ছটফট করতে লাগল। একবার কী আনায়নাকে দেখে আসবে কী না সেটা ভাবতে লাগল। কী করবে পল্লবী বুঝতে পারছিল না। চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। ভাবতে লাগল এখন আনায়নাকে দেখতে গেলে সেটা কৃতকার্য হবে না। কারণ কেউ আনায়নাকে দেখতে দেবে না। তাই অনেক ভেবে পল্লবী এডভোকেট জান্নাত জেসিকে কল দিল। এডভোকেট জান্নাত জেসি ওপাশ থেকে কল ধরতেই পল্লবী বলে উঠল

– আমার আনায়নার সাথে কী দেখা করার ব্যবস্থা করা যায় না? আনায়নাকে দেখার জন্য বুকটা ছটফট করছে অনেক।

জান্নাত জেসি হালকা হেসে বলল

– আপনি বলার আগেই আমি এ ব্যবস্থা করতেছি।আনায়নার দায়িত্ব পাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি আনায়নার সাথে সপ্তাহে দুদিন যেন দেখা করতে পারেন সে ব্যবস্থা আমি করতেছি। আপনি চিন্তা করবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই আনায়নার সাথে দেখা করতে পারবেন। আমি একজন মা আমি একটা মায়ের কষ্ট বুঝি। আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। আপনি বলার আগেই আমি সব কাজ করে রাখব। তবে আইনি জটিলতার জন্য হয়তো বিষয়টা সময় সাপেক্ষ তবুও আপনার বাচ্চা আমি আপনার কোলে ফিরিয়ে দেবো।

পল্লবী জান্নাত জেসির কথা শোনে খুঁশিতে কেঁদে দিল।চোখের জলটা মুছতে মুছতে বলল

– আপনার এ ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না।

– মিসেস পল্লবী এভাবে বলবেন না এটা আমার দায়িত্ব। আমি চাইলেও এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারব না।

– আমি জানি এটা আপনার দায়িত্ব তবে আমার মতো মায়ের হাহাকার টা যে আপনি বুঝতে পেরেছেন এটার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ।আল্লাহ আপনার অনেক ভালো করুক। ভালো থাকবেন।

বলেই পল্লবী কলটা কাটল। একটা রিকশা ভাড়া করে বাসায় আসতে নিল। রিকশায় এক পা উঠিয়ে আরেক পা উঠাতে যাবে এমন সময় পল্লবীর চোখ গেল সামনের শপিং কমপ্লেক্সে। পল্লবী লক্ষ্য করল সাহিল আর তার পাশে রুশি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাসি মাখা মুখটা দেখে পল্লবী বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে তারা বেশ সুখে আছে। পল্লবীর চোখের কোণে জল চিক চিক করতে লাগল। কোনোরকমে চোখটা মুছে রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে বলল তাড়াতাড়ি যেতে।

বাসায় পৌঁছাল আধা ঘন্টা পর।বাসায় এসে ঘরে ঢুকতেই পল্লবীর মা জিজ্ঞেস করল

– কী রে সব ব্যবস্থা করে এসেছিস কী?

– কিসের ব্যবস্থা মা?

– বাচ্চাটা নষ্ট করার।

– নাহ । কোনো ব্যবস্থা করে আসে নি।

– কেন?

– কারণ আমি আমার বাচ্চাটাকে নষ্ট করব না। নিজের হাতে নিজের সন্তান খুন করার মতো অপরাধ আমি করতে পারব না।

নুরজাহান বেগম হালকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল

– তোর যা ভালো মনে হয় কর।

বলেই হনহন করে অন্য রুমে চলে গেল। পল্লবী মেঝেতে বসে দেয়ালে মাথাটা এলিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একের পর এক চাকুরির নোটিশ দেখতে লাগল। কোথায় কোথায় এপ্লাই করা যায় সব খাতায় লিখে রাখল। কালকে বের হয়ে সব জায়গায় এপ্লাই করে আসবে। এর মধ্যে পল্লবীর ফোনে পল্লবীর শ্বাশুড়ির কল আসলো। পল্লবী তার শ্বাশুড়ির কলটা পেয়ে তাড়াহুড়ো করে কলটা ধরল। কলটা ধরতেই আনায়নার কান্না পল্লবীর কানে আসলো।পল্লবী আনায়নার কান্না শোনে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল

– আনায়না এভাবে কাঁদছে কেন? আনায়নার কী হয়েছে? আমার মেয়েটা এত জোরে কাঁদছে কেন?

পল্লবীর শ্বাশুড়ি জবাবে বলল