#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৮|
-“প্লিজ.. একটা চুমু খাব.. একটা! রিলেশনের চার বছরে প্রথম আবদার..”
প্রিয় আর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই শ্রেয়ান দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলল। দীর্ঘসময়ের আশ্লেষের চুম্বনে প্রিয় যখন শ্বাস নেওয়ার তাগিদে সরে আসার চাহিদা দেখাল, শ্রেয়ানের অধর দংশন তখন গাঢ় হলো। অনুভূতিরা লাগামহীন। প্রিয়র হাত এতক্ষণ শ্রেয়ানের চুলে ছিল, শক্ত করে ধরা। হাতের গ্রিপ আরও শক্ত করে শ্রেয়ানের মাথা সরাতে চেষ্টা করল। বিরক্ত হয়ে শ্রেয়ান চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল। একটা বাচ্চাকে তার প্রিয় কাজটি করা থেকে কেউ আটকালে, বাচ্চাটা যেমন চোখ কুঁচকে তাকায় না? ওমন করে।
ছাড়া পেয়ে প্রিয় হাঁপাতে লাগল। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। শ্রেয়ান নিজেও ঘোর থেকে বেরোল। সামনে থেকে বোতল নিয়ে নিজে পানি গিলে প্রিয়র দিকে বাড়িয়ে দিলো। প্রিয় মানা করল না, নিজেও খেলো। শ্রেয়ান শান্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট করেছে।
বেশ অনেকক্ষণ ঘুরল। এর মধ্যে প্রিয়ও নিজেকে স্বাভাবিক করেছে। তার জন্য শ্রেয়ান নিজের ফোনটা প্রিয়র হাতে দিয়ে রেখেছে। প্রিয় বরাবরই শ্রেয়ানের ফোন হাতে পেলে ওর নোটপ্যাড, গ্যালারি খুব মনোযোগ সহকারে ঘাঁটে। বেশ মজাও পায় এতে। আজও তাই করছিল। তবে হুট করেই কী মনে করে যেন মেসেঞ্জারে গেল।
ম্যাসেজ রিকুয়েস্টে অসংখ্য মেয়ে থাকলেও, চ্যাটলিস্টে কেবল ছেলেরা। প্রিয়র আইডি পিন করা এতে। মুচকি হাসি প্রিয়র ওষ্ঠাগত। সে নিজেদেরই কনভারসেশন পড়তে লাগল। আঁড়চোখে একবার প্রিয়কে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে শ্রেয়ান স্বস্তি পেল। সে আনমনে ড্রাইভ করতে করতে শহর থেকে কিছুটা দূরের রাস্তা ধরল। সারারাত শহরের বাইরের হাওয়া খেয়ে ভোরের দিকে প্রিয়কে বাড়ি পৌঁছে দেবে। যেতে ঘন্টা লাগবে, আসতে ঘন্টা আর থাকবে কিছুক্ষণ।
প্রিয় কী মনে করে নিজের ইনবক্সে খুব ঘুরল। কনভারসেশন সার্চে গিয়ে লিখল, ‘আই লাভ ইউ।’
তারপর অনেক অনেক ম্যাসেজ শো করল। প্রিয় গুনতে লাগল। একটা একটা করে গুনতে গুনতে দেখল কয়েক হাজার পেরিয়েছে। তার মধ্যে শুরুর দিকে শ্রেয়ান বেশি বেশি বলত, আর শেষের দিকে প্রিয় মাত্রাতিরিক্তবার বলত। এমনও হয়েছে, এক ম্যাসেজেই ৮০০টি শব্দে কেবল ভালোবাসি লেখা। মেসেঞ্জারে এর বেশি আবার একত্রে সেন্ডও হয় না।
প্রিয় অনেক ধরনের শব্দ সার্চ দিয়ে দেখতে লাগল। এরপর কী যেন মনে করে ইনবক্স থেকে বের হয়ে মেসেঞ্জারের সার্চবারে গেল। সেখানে লিখে সার্চ দিলো, “লাভ।”
অনেক ধরনের একাউন্ট, ম্যাসেজ শো করল। প্রিয় ম্যাসেজ অপশনে গেল। শুরুতে তার আইডি। এরপর ফ্রেন্ডসগ্রুপের আলাপ, প্রফিট বিষয়ক লাভ, বিভিন্ন মেয়ের প্রপোজাল। প্রিয়র রাগ লাগল। কে বলেছে শ্রেয়ানকে এত সুদর্শন হতে? আঁড়াআঁড়িভাবে শ্রেয়ানকে লক্ষ করে পুনরায় ফোনের স্ক্রিনে মন দিলো।
ঘাটতে ঘাটতে বেশ নিচে আসায় কিছু পরিচিত-অপরিচিত-অর্ধপরিচিত মেয়েদের ইনবক্স শো করল। উপর থেকে শো করল শ্রেয়ানের ম্যাসেজ হিসেবে লাভ ইউ লেখা। প্রিয় ঝটকা খেল। ভেতরে গিয়ে দেখল ভীষণ প্রেমময়ী কনভারসেশন।
প্রিয়র হাত-পা কাঁপতে লাগল। সে বের হলো ওখান থেকে। নিচে যেতে যেতে অসংখ্য মেয়েদের ইনবক্স দেখতে পেল, যেখানে স্পষ্ট একটি মিউচুয়াল রিলেশন।
প্রিয় পাশে শ্রেয়ানের উপস্থিতি খেয়াল রেখেছে। ব্যাকে গিয়ে আবার সার্চবারে লিখল, “কিস”
শুরুতে তার ইনবক্স শো করলেও নিচের দিকে খানিকক্ষণ আগে দেখা মেয়েদের লিস্টগুলো এলো। সবার আগে যেই প্রোফাইলটা নজর কাড়ল, সেটা শ্রেয়ানের বান্ধবী নিঝুমের। কনভারসেশন চার বছর পুরোনো। সেখানে নিঝুম লিখেছিল, “এসব টাইমে তুই এত জংলী হয়ে যাস কেন? ঠোঁটের এই দাগগুলো এখন কী করব?”
শ্রেয়ান পালটা জবাবে লিখেছিল, “আই লাইক ইউর লিপ টেস্ট। দ্যাট কিস.. ভুলব না।”
প্রিয় ব্যাক করল ওখান থেকে। আস্তে আস্তে আরও এরকম অনেকের সাথে কনভারসেশন দেখল। কেউ কেউ তো ম্যাসেজেই কিস করেছে। শোকে মানুষ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে উলটা-পালটা কাজ করে আর অতিশোকে মানুষ পাথর বনে যায়। প্রিয়র ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঘটনাটা দারুণভাবে ফলেছে।
প্রিয় ওসব দেখতে দেখতে হঠাৎ এক অভাবনীয় কাজ করে বসল। সার্চবারে “সেক্স” লিখে সার্চ দিলো। এবারের ফলাফলে প্রিয়র ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। পুরো গা কাঁপতে লাগল। রাগ লাগছে। অসম্ভব রকমের রাগ লাগছে। চোখের বাধ ভেঙে অশ্রু গড়াচ্ছে। শ্রেয়ান ততক্ষণে গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে। গাড়ি পার্ক করে প্রিয়র দিকে তাকাল। মুহূর্তেই অজানা ভয়ে গা হিসহিসিয়ে উঠল। তার প্রিয় কাঁদছে কেন?
কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে ডাকল,
-“কী হয়েছে? এই? কাঁদছ কেন? এই না ঠিক ছিলে? শরীর খারাপ? কিছু হয়েছে? বলো!”
প্রিয় কিছু বলছে না। সে প্রিয়র কোলের মধ্যে তার ফোনটা পড়ে থাকতে দেখল। ডিস্প্লে লাইট জ্বলছে। ফোনটার দিকে হাত বাড়াতেই প্রিয় তা শক্ত করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। শ্রেয়ান চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
-“দাও।”
প্রিয় বুঝতে পারছে না কী করবে। তার এসব দেখা উচিত হয়নি। মোটেও উচিত হয়নি। কিন্তু দেখে ফেলেছে। তার মনে আছে, রিলেশনের যখনের দিকে প্রিয় শ্রেয়ানে গভীরভাবে মজেছিল, তখন শ্রেয়ান বেশ কিছু মেয়ের নাম নিয়ে বলেছিল,
-“আমি প্লেবয়। বিশ্বাস না হলে এই মেয়েদের জিজ্ঞেস করো।”
প্রিয় সে কথাগুলো বারংবার হেসে উড়িয়ে দিত। ঘুণাক্ষণেও টের পায়নি, শ্রেয়ান আলগোছে সত্য বলেছিল। আজ একই সত্য চোখের সামনে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না কেন?
শ্রেয়ান প্রিয়র হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজের অপকর্মগুলো দেখতে পেল। নিভে গেল সে। কপালের রগ ও হাতের পেশি ফুলে উঠল। মাথাটা দপদপ করে জ্বলছে। স্টেয়ারিংয়ের ওপর হাতের কনুই ঠেকিয়ে, সে হাতের দু’আঙুল কপালে বুলিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সামনে থেকে পানির বোতলটা নিয়ে পুনরায় প্রিয়র দিকে এগিয়ে দিলো। প্রিয় অশ্রুসজল নেত্রে বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে সেকেন্ড পাঁচেক তাকিয়ে রইল। পরপর বোতলটা নিয়ে পানি খেল, জানালার গ্লাস নামিয়ে মুখেও পানি ঢালল। গায়ের ওড়না দিয়ে মুখ কোনোরকমে মুছে সিটে গা এলিয়ে দিলো।
আস্তে আস্তে প্রিয় শান্ত হতে লাগল। তার কাছে উপায় নেই শ্রেয়ানকে ছাড়া থাকার। সে শ্রেয়ানে এতটাই আসক্ত! এখন এসব কারণ সামনে তুললে যদি শ্রেয়ান আবার দূরত্ব বাড়ায়? প্রিয়র কলিজা কেঁপে উঠল। কিন্তু সে মেনে নিতেও পারছে না। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোটা অশ্রুকণা।
এমতাবস্থায় শ্রেয়ান নিস্তব্ধতা ভেঙে হুট করেই বলে উঠল,
-“স্যরি।”
প্রিয়র তৎক্ষণাৎ জবাব,
-“ডোন্ট বি।”
-“ট্রাস্ট মি, আই নেভার ফেল্ট দেম লাইক ইউ। ইউ আর এক্সেপশনাল। ওসব মিউচুয়াল রিলেশন ছিল, বাট ইউ আর মাই লাভ..”
-“জানি।”
-“বলতে দাও। আই ওয়ান্ট টু এক্সপ্লেইন।”
-“প্রয়োজন নেই।”
প্রিয় থেমে থেমে পুনরায় বলল,
-“পাস্টে সবারই কিছু না কিছু থাকে। কারো অল্প কিছু, কারো ভয়াবহ কিছু। আমি কনভারসেশনের মধ্যে বিগত চার বছরের কিছু পাইনি। আর ওসব প্রেম থেকে থাকলেও, আমার কিছু করার ছিল না। তুমি ভালো করেই জানো, চার বছরের মধ্যে তুমি একাধিক সম্পর্কে জড়ালে, আমি তোমার পায়ে পড়ে হলেও তোমার সাথে সম্পর্কটা কন্টিনিউ করে যেতাম..যাব।”
শ্রেয়ান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল,
-“এত স্ট্রং দেখাচ্ছ কেন?”
প্রিয়র ভেতরটা জানে, সে কখনই এত শক্ত নয়। সে বাইরে থেকে দেখাচ্ছে কেবল মাত্র শ্রেয়ানের রাগ যাতে কোনোক্রমে না আসে, এজন্য। রাগ এলেই দূরত্ব বাড়বে, আর দূরত্ব বাড়লেই প্রিয় একাকী হয়ে যাবে। নিঃসন্দেহে একাকিত্ব অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। সে তো মরেই যাবে শ্রেয়ানকে ছাড়া।
প্রিয় চুপ থেকে শ্রেয়ানের দিকে তাকাল। এই চোখ! শ্রেয়ানের এই চোখ তাকে ছাড়াও আরও অনেক নারীকে দেখেছে, নারী শরীরের ভেতরটা দেখেছে। এই ঠোঁট, এই হাত.. ছুঁয়েছে! ওর চেয়েও গভীরভাবে ছুঁয়েছে! প্রিয় মানতে পারছে না। একটুও না।
হঠাৎই সে হু হু শব্দ করে কেঁদে উঠল। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগল। শ্রেয়ান নিজের সিটবেল্ট খুলে প্রিয়তমার দিকে এগিয়ে গেল। মুখ থেকে প্রিয়র হাত দুটো সরিয়ে নিজের হাত দিয়ে আঁজলা করে ধরল। বৃদ্ধাঙ্গুল দুটো দিয়ে চোখের পানি মুছল। আহ্লাদ পেয়ে প্রিয় আবার ফুঁপিয়ে উঠল।
শ্রেয়ান তাকে থামাতে বলল,
-“হুশশশ… কাঁদে না! এই চোখের জল কি আমার জন্য নাকি ওদের জন্য?”
প্রিয় কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“তোমার শরীরে ওদের স্পর্শ.. আমি মেনে নিতে পারছি না।”
শ্রেয়ান মলিন দৃষ্টিতে তাকায়,
-“মেনে নিয়ো না। চার বছরে কোনো স্পর্শ থাকে না! বি নরমাল।”
-“আমি পারছি না স্বাভাবিক হতে।”
-“কেন?”
-“ওই স্পর্শ..”
-“তবে আসো, নিজের স্পর্শ দিয়ে সেসব মিটিয়ে দাও।”
প্রিয় সত্যি সত্যিই শ্রেয়ানের বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগল। এক সময় শ্রেয়ানের বুকে কামড়াতে লাগল। ছোটো ছোটো কামড় ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল।
শ্রেয়ানের এক হাত প্রিয়র পিঠে, অন্য হাতে চুলগুলো মুঠো করে ধরা। ব্যথা সে সয়ে নিচ্ছে, তবে প্রিয়র কান্না ওর সহ্য হচ্ছে না। বেশ খানিকটা সময় গেলে শ্রেয়ান বলে উঠল,
-“আশফিক রহমান শ্রেয়ান বিলংস টু ইউ, প্রিয়শ্রী। রাগ, ঝাঁজ সব মেটাও।”
______
প্রিয় সব মেনে নিল। শ্রেয়ান ছাড়া তার আর গতি নেই। শ্রেয়ানের মতো কেউ তাকে ভালোবাসবে না। সে পেছনে যাই করুক, এখন তো কেবল তার। তাই আর ওসব মনে রেখে বসে রইল না। সময় এগোল। আস্তে-ধীরে শ্রেয়ান যেন অসহনীয় হয়ে উঠল। প্রতি ওয়াক্তে এখন প্রিয় কান্না করে। শান্তিতে দুদণ্ড থাকতে পারে না। শ্রেয়ান কিছু না কিছু খোঁচা মেরে বলবে, যার জন্য প্রিয় কাঁদবেই।
এভাবে আর কত চলা যায়? প্রিয়র ভালো লাগছে না। আজ তাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল, প্রিয় নাছোড়বান্দা। সে বিয়ে করবে না। একটা মেয়েকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে, খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সে বিয়ে করতে নারাজ। এ নিয়ে বাড়ি থেকে কম কথা শুনছে না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার বাবা-মা তো তার সাথে আগে এরকম ছিল না? হঠাৎ করে কীভাবে এমন হলো?
হঠাৎ করে কিছুই হয়নি। সবকিছু ধীরে-সুস্থে হয়েছে। প্রিয় তা টের পায়নি। প্রহর অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে এখন। বেশ শক্ত মনোভাবের হয়েছে। আগের থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। প্রিয়র থেকে বেড়ে যাওয়া দূরত্বটা প্রহরও মেনে নিতে পারেনি।
আজ একমাস হলো, শ্রেয়ান প্রিয়র খোঁজ নেয় না। এটা এই অবধি সবচেয়ে বেশি সময় প্রিয়র থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার। প্রিয় কম চেষ্টা করেনি শ্রেয়ানের সাথে কানেক্টেড হতে। কিন্তু ব্যর্থ। কে জানত, এই ব্যর্থতাই প্রিয়কে সামনে বাড়তে সহায়তা করবে?
চলবে..