পরিণয় পর্ব-১২

0
1369

#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১২

কারণ ঐ গার্মেন্টসের উচ্চ পদে লোক নেওয়ার জন্য নোটিশ দিয়েছে। সে পদে দরখাস্ত করার মতো পল্লবীর যোগ্যতা আছে তবে সে দরখাস্ত করবে কী না সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল। যদি ইন্টারভিউ দিতে গেলে তাকে আবারও ডিভোর্স নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। আর ঐখানে যদি কোনো ঝামেলা হয় তাহলে তো তার বর্তমান চাকুরিটাও চলে যাবে। বেশ চিন্তা করতে লাগল পল্লবী। এ গার্মেন্টসের মালিক সাদেক সাহেবকেই চিনে শুধু পল্লবী। এমনিতে যতবার উনি এসেছেন শ্রমিকদের সাথে খুব ভালোভাবে কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যাক্তিগত ভাবে উনি কেমন সেটা পল্লবীর জানা নেই। তাই দরখাস্ত করতে বেশ ভয় পাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। এমন সময় কেউ একজন পল্লবীকে ডাক দিয়ে বলল

– কাজ রেখে নোটিশ বোর্ডে কী দেখছেন?

পল্লবী ভাবনার ঘোর থেকে বের হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই লক্ষ্য করল সাদেক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। পল্লবী উনাকে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। মুখটা একদম চুপসে গেল। ঢুক গিলতে গিলতে বলল

– না স্যার তেমন কিছু না। নেটিশ বোর্ডের নোটিশটায় চোখ পড়ল তো তাই। দেখলাম উচ্চ পদে লোক নিচ্ছে ।

– হ্যাঁ ইমারজেন্সি লোক দরকার। আপনি এগুলো দেখে কী করবেন? যান গিয়ে কাজ করুন।

পল্লবী ভয়ে আরও চুপসে গেল। মুখটা একদম মলিন হয়ে গেল। যদিও লোকটা হাসির রেখা টেনেই কথাগুলো বলছে তবুও পল্লবীর ভীষণ ভয় লাগছে। একবার মনে হচ্ছে এখনই কী জিজ্ঞেস করবে এ বিষয়টা নাকি করবে না। মনের ভেতর একটা সংকোচ কাজ করছে। আবারও চিন্তায় ডুবে গেল। পল্লবীকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদেক সাহেব ও হতভম্ব হয়ে গেল। পল্লবীকে কেন জানি না তার রহস্যময় লাগতে লাগল। কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলল

– কী হলো আপনি এভাবে হা করে তাকিয়ে কী ভাবছেন? আর মুখটা এত মলিন কেন? কোনো কথা বলার থাকলে আমাকে বলেন? নাহয় গিয়ে কাজ করুন। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করে তো লাভ নেই। এ নোটিশ বোর্ডের নোটিশ তো আপনার কোনো কাজে দেবে না।

সাদেক সাহেবের কথায় পল্লবী ভাবনার ঘোর থেকে বের হয়ে আসলো। তারপর হালকা গলায় বলল

– কিছু না স্যার। আমি এখনই কাজে যাচ্ছি।

সাদেক সাহেব লক্ষ্য করল পল্লবীর মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে। সাদেক সাহেব হালকা হেসে বলল

– আপনি কী আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

পল্লবী আমতা আমতা করে বলল

– না স্যার ভয় পাচ্ছি না।

– এখানে কাজ করছেন নতুন মনে হয়?

– হ্যা স্যার দুই মাসের মতো হবে।

– এজন্য আমার সম্পর্কে ধারণা নেই।বাকিদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেবেন আমি কেমন। আমাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি।মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। যান গিয়ে মন দিয়ে কাজ করুন।

পল্লবী মাথা নেড়ে চলে গেল।সারাদিন কাজের মধ্যেও পল্লবীর শুধু নোটিশ বোর্ডের নোটিশের চিন্তাটায় মাথায় আসতেছিল। যতই সে চিন্তাটা থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে ততই যেন চিন্তাটা তাকে ঘিরে ধরছে। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার সময় পার করে বাসায় ফিরল। হালকা খেয়ে আনায়নাকে কোলে নিয়ে আবারও ভাবতে লাগল।ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিল সে দরখাস্ত করবে এতে যা হওয়ার হবে। যদি বর্তমান চাকুরিটায় কোনো ঝামেলা হয়ে চলে যায় আরেকটা খুঁজে নেবে। তবে জীবনে একটু ভালো কিছু করতে চাইলে একটু ঝুঁকি নিতেই হয়।

পরদিন সকালে বের হয়েই পল্লবী প্রথমে দরখাস্তটা করে ফেলল। তারপর আবার কাজে গিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। সারাদিন কাজ শেষে বের হয়ে হাঁটতে লাগল।পল্লবীর বাসাটা গার্মেন্টস থেকে কাছেই। তাই হেঁটে যাওয়া যায়।বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পল্লবী হাঁটতে লাগল। হাঁটার এক পর্যায়ে পল্লবী সুপার সপের সামনে এসে থেমে গেল। অনেকদিন যাবত পল্লবীর পিজ্জা বানিয়ে খেতে মন চাচ্ছে। তাই সুপার সপে ঢুকল প্রয়োজনীয় সব কেনার জন্য। সুপার সপে ঢুকতেই পল্লবীর চোখ পড়ল সাদেক সাহেবের দিকে। তিনিও তখন কী যেন কিনছিলেন।পল্লবী এবারও দোটানায় পড়ে গেল সুপার শপে গিয়ে কিছু কিনবে নাকি বের হয়ে যাবে। দোটানায় থাকতে থাকতে সাদেক সাহেবের নজর পড়ল পল্লবীর দিকে। পল্লবীকে চিনতে সাদেক সাহেবের ভুল হলো না। কারণ গতদিন পল্লবীর সাথে তার কথা হয়েছে। সাদেক সাহেব পল্লবীকে দেখেই জিজ্ঞেস করল

– আরে আপনি এখানে?

পল্লবী কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিল

– আমি তো একটু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম।

– ওহ আচ্ছা তাই বলুন। আপনার নাম টা কী?

– পল্লবী।

– বাসা কোথায়?

– ঐ তো সামনের গলিতে ব্লক সি বাসা নং ২৪। হামিদ সাহেবের বাসা বললেই সবাই চিনবে। আমি উনার ছোট মেয়ে।

– সেটা কী আপনাদের নিজেদের বাসা?

– জ্বি স্যার।

সাদেক সাহেব পল্লবীর কথা শোনে কিছুটা বিস্মিত হলো। কারণ ঢাকায় একটা বাসা থাকা মানে যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবারের। স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে হয়েও পল্লবী কেন গার্মেন্টসে চাকুরি করছে সে প্রশ্নটা সাদেক সাহেবের মনে আসলো প্রথমে। তবে পল্লবীকে তা জিজ্ঞেস করাটা অনেকটা বেমানান দেখায় তাই কিছুই জিজ্ঞেস না করে বলল

– আচ্ছা ঠিক আছে যা কেনার কিনুন আমি গেলাম।

বলেই সাদেক সাহেব বের হয়ে গেল। বের হয়ে গাড়িতে উঠে কেন জানি না তার ইচ্ছা জাগল পল্লবীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী বাসাটা দেখে যাওয়ার। সাদেক সাহেব গাড়িতে উঠে পল্লবীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গলিতে ঢুকতেই ২৪ নম্বর বাসাটা চোখে পড়ল। তিনতলাবিশিষ্ট বাসাটা। বাসাটার সামনে বিরাট একটা আম গাছ আছে। সাদেক সাহেবের বিস্ময়ের পরিমাণ বাসাটা দেখে আরও বেড়ে গেল। কারণ তিনতলা বাসা তার উপর বাসার আশে পাশে ভালোই জায়গা রয়েছে। এরকম বাসার একটা মেয়ে গার্মেন্টসে শ্রমিক পদে ১২ হাজার টাকার বেতনের কেন চাকুরি করছে সে প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগল সাদেক সাহেবের মনে। কিছুটা ভাবতে ভবতেই গাড়িটা নিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগুলো।

অপরদিকে পল্লবীও সব কেনা শেষ করে বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরে চাকুরিটার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। ইন্টারভিউ আর সাত দিন পর। তাই যত কষ্টই হোক তাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পল্লবী তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখল না। প্রতিদিনের ডিউটি শেষে যে সময় পেত সেটা আনায়না আর চাকুরির প্রস্তুতির পেছনে দিত। অবশেষে সেই ইন্টারভিউ এর দিন আসলো। বেশ পরিপাটি হয়ে গেল ইন্টারভিউ দিতে। সেখানে গিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ বসতেই পল্লবীর ডাক পড়ল। পল্লবী রুমে যেতেই থমকে গেল। সাদেক সাহেব বসে আছে। অপরদিকে সাদেক সাহেব পল্লবীকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো। পল্লবী ভয়ে ভয়ে সাদেক সাহেবের সামনে দাঁড়াল। সাদেক সাহেব ইশারা করল পল্লবীকে বসতে। পল্লবী চেয়ারটা টেনে বসল। সাদেক সাহেব পল্লবীর সিভিটা দেখে লক্ষ্য করল যে পল্লবী ডিভোর্সি। কেন জানি না বিষয়টা সাদেক সাহেবের মনে নাড়া দিল। পল্লবীকে এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করল

– ঢাকার মতো জায়গায় তিনতলা একটা বাসা আছে। আপনার রেজাল্ট ও যথেষ্ট ভালো।তাহলে ঐ পদে চাকুরি কেন করছিলেন?

পল্লবী একটা নিঃশ্বাস টেনে পরক্ষণেই নিঃশ্বাস ফেলে বলল

– আমি একজন ডিভোর্সি । আমার একটা মেয়ে আছে বয়স এক পার হলো। আমি আরেকটা সন্তানের হবু মা। প্রথম দিকে আমি কারও সাপোর্ট পায়নি। ভাই বলেন, আত্নীয় স্বজন বলেন সবাই এ ডিভোর্সের জন্য আমাকে দায়ী করেছিল। যদিও ডিভোর্সটা হয়েছিল আমার স্বামীর পরকিয়ার জন্য। তখন বাচ্চাটার দেখাশোনার জন্য একটা চাকুরির খুব দরকার ছিল। এখানে ওখানে সব জায়গায় ছুটেছি। সব জায়গায় হয় আমাকে কু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে নাহয় ডিভোর্সের জন্য হাজারটা প্রশ্ন করে আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে এখানে চাকুরি নিই। নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা জরুরি ছিল।

সাদেক সাহেব পল্লবীর কথা শোনে একটু ভেবে বলল

– হবু মা বলতে আপনি এখন প্র্যাগনেন্ট তাই তো?

– হ্যাঁ আমি প্র্যাগনেন্ট।আমার চার মাস রানিং।

– চাকুরিটা পাওয়ার যোগ্যতা আপনার আছে। ধরুন আমি আপনাকে চাকুরিটা দিলাম তবে কিছুদিন পর তো আপনার ডেলিভারির সময়টায় আমাকে সমস্যার সম্মুখী হতে হবে।কারণ মাতৃকালীন ছুটি তো আপনাকে তিন মাস অথবা ছয় মাস দিতে হবে।

পল্লবী হালকা গলায় বলল

– আমাকে সব মিলিয়ে একমাস ছুটি দিলেই হবে। আমার বড় মেয়েটার সময় আমি একমাসেই বেশ স্বাভাবিক আর সুস্থ ছিলাম। এখন ও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না আশা করি।চাকুরিটা আমার দরকার। দেওয়া না দেওয়া পুরোপুরি আপনার ব্যপার।

সাদেক সাহেব হাতে থাকা কলমটা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল

– আপনি এখন আসুন। আপনাকে আমি কল দিয়ে জানিয়ে দেবো চাকুরিটা হয়েছে কী না।

পল্লবী তার কাগজগুলো নিয়ে বের হয়ে গেল। বাসায় এসে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবতে লাগল হয়তো এ চাকুরিটাও তার যাবে।সারাদিন কতশত ভাবনা যে তার মনে আসলো হিসাব নেই। এভাবেই পার করল সারাদিন। রাত ঠিক দশটায় পল্লবীর ফোনে কল আসলো। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল

– আমি সাদেক বলছিলাম। আপনি নিশ্চয় পল্লবী বলছেন।

পল্লবীর ভয়ে হাত পা হিম হয়ে যেতে লাগল।ভয়ে ভয়ে বলল

– হ্যা স্যার বলুন।

– আমি চিন্তা করেছি আপনাকে আমি চাকুরিটা দেবো তবে এক শর্তে।

পল্লবী শর্তের কথা শোনে ঢুক গিলতে লাগল। পল্লবীর আর বুঝতে বাকি রইল না শর্তটা কী হতে পারে। তবুও হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল

– কী শর্ত বলুন?

ওপাশ থেকে মুচকি হেসে সাদেক সাহেব বলল