#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_4
ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পূর্ণ করে মহলে ফিরেছেন সুলতান ও আজমাইন মাহতাব। পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শুরু হবে হয়তো এখান থেকেই। পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সুলতান ‘উমার’ তার সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। তাই বেশ খোশ মেজাজেই মহলে ফিরেছেন তারা। সুলতান শাহজাইন মহলে প্রবেশ করতেই একজন সেবক এসে বার্তা দিয়ে গেল। আম্মাজান এখনি নিজের কামরায় ডেকেছেন তাকে। অবাক হলেন সুলতান। হঠাৎ এমন জরুরি তলব! তার অনুপস্থিতিতে কিছু ঘটেছে নাকি মহলে? মাহতাবকে তার কামরায় অপেক্ষা করতে বলে সে দ্রুত এগিয়ে গেল আম্মার কামরার দিকে। ওয়াসিফা সুলতানের কামরার সম্মুখে আসতেই পাহাড়ারত সেবকগন মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো। তাদের মধ্যে একজন উচ্চস্বরে জানান দিলো সুলতানের আগমন বার্তা। দ্বার খুলে দিলো ওয়াসিফা সুলতানের খাস দাসী ‘রেবেকা’। অতঃপর দাঁড়িয়ে রইল কক্ষের এক কোনে। ওয়াসিফা সুলতান আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন নিজের পালঙ্কে। আম্মার গম্ভীর মুখভঙ্গিতে ভ্রু কুচকাল শাহজাইন। সে আন্দাজ করতে পারলো মহলে কিছু ঘটেছে। উঠে দাড়ালেন ওয়াসিফা সুলতান। শান্ত স্বরে বললেন, “এসেছো? বসো এখানে।”
“বসবার প্রয়োজন নেই আম্মাজান। মাহতাবের সাথে জরুরি আলোচনায় বসতে হবে রক্ষীর খুনের ব্যপারে। তাছাড়া সৈনিকদের বেতনটাও বাড়াতে হবে। সে ব্যপারেও একটু আলোচনা করতে হবে। আপনি এতো জরুরি তলব করলেন যে? কিছু ঘটেছে কি?”
বিরক্ত হলেন ওয়াসিফা সুলতান। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, “সৈনিকদের বেতন বাড়ানোর কী দরকার? তাদের তো যথেষ্ট সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।”
“সে আপনি বুঝবেন না আম্মা। তারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে সাম্রাজ্য রক্ষার ভার নিয়েছে। সে তুলনায় বেতনটা নেহাতই কম হয়ে যায়। আপনি চিন্তা করবেন না। যতটুকু বাড়ানো উচিত ঠিক ততটুকুই বাড়ানো হবে। সৈনিকদের বেতন বাড়ালে সুলতানের অর্থে টান পড়ে যাবে না।”
“সে তুমি বাড়াতেই পারো। এই সাম্রাজ্যের সুলতান তুমি। তোমাকে তো আর বাঁধা প্রদান করা যায় না।”
আম্মার অভিমানী মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন সুলতান। এমন সময় ওয়াসিফা সুলতান বলে উঠলেন, “তোমার এখন বিবাহ করে নেওয়া উঠিত শাহজাইন। এলিজার মৃত্যুর দু’বছর হয়ে গেছে। এতোটা সময়ই কি যথেষ্ট নয় নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য?”
চমকাল শাহজাইন। গায়েব হলো তার মুখের হাসি। সে হতবাক হয়ে শুধাল, “এগুলো কী বলছেন আম্মা? আর কতোবার বললে আপনি বুঝবেন? এলিজার স্থান অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এসব বলে কেন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করতে চান আপনি?”
বিচলিত হলো না ওয়াসিফা সুলতান। সে জানতো এমন উত্তরই আসবে তার নিকট থেকে। শাহজাইনের হতাশা আরো বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বল উঠলেন, “সুলতানদের এভাবে এক নারীর জন্য জীবন বিলিয়ে দিলে চলে না। তোমার উপর পুরো একটা সাম্রাজ্য নির্ভর করে আছে। তোমার দায়িত্বের মাঝে কি পড়ে না এই সাম্রাজ্যকে তাদের পরবর্তী সুলতান উপহার দেওয়া? তারা কি তাদের সুলতানের কাছে চাইতে পারে না একজন সম্রাজ্ঞী?”
“তাদের জন্য আমি এতোকিছু করতে পারলে তারা কেন পারবে না এতোটুকু আত্মত্যাগ করতে? সম্রাজ্ঞী তো তাদের এনে দিয়েছিলাম আমি। তাকে রক্ষা করতে পারেনি তারা। রইল পরবর্তী সুলতান? তোহফা তো আছে আম্মা। বংশ রক্ষার জন্য আমার হৃদয় ভাঙবেন না আম্মা।” কাতর স্বরে বলল শাহজাইন।
হার মানলো না ওয়াসিফা সুলতান। পুত্রের করুন মুখশ্রীতে গললে চলবে না আজ। তাকে কঠোর হতে হবে। সে কঠিন গলায় বলে উঠলো, “এসব যুক্তি দিয়ে তুমি আমায় বোঝাতে এসো না। তোহফার জবান নেই। সে কী করে সাম্রাজ্যের ভার নেবে? তোহফারও আম্মার ভালোবাসা প্রয়োজন। বিবাহ তোমাকে করতেই হবে নতুবা এই মহল ত্যাগ করতে বাধ্য হবো আমি।”
হতবুদ্ধির ন্যায় চাইল শাহজাইন। অতঃপর কঠিন স্বরে বলে উঠলো, “অন্যায্য আবদার করবেন না। আপনি চাইলে যেতেই পারেন সে অধিকার আছে আপনার। বাঁধা দেবো না আমি। তবে বিবাহ আমি কিছুতেই করবো না। আর তোহফার জন্য তার পিতার ভালোবাসাই যথেষ্ট। উপরওয়ালা হয়তো তার ভাগ্য আম্মার ভালোবাসা রাখেনি কিন্তু পিতার অজস্র ভালোবাসা রেখেছে।”
রাগান্বিত হলো ওয়াসিফা সুলতান। গর্জে উঠে বললেন, “দুটো বছর ধরে তোমার এসব তালবাহানা সহ্য করছি আমি আর নয়। আজ আমার চলে যাওয়াতেও তোমার কিছু যায় আসে না! আমার আবদার অন্যায্য মনে হচ্ছে তোমার নিকট? তুমি কি জানো এলিজা ছাড়া তোমার দুনিয়া শূন্য, অর্থহীন হয়ে উঠেছে? আমি ভুল করেছিলাম তাকে পুত্রবধূ করে এনে। রূপে, গুনে পারদর্শী এবং বংশমর্যাদা দেখে এনেছিলাম অথচ সে আমার পুত্রের উপর নিজের জাদু চালিয়ে দিলো, বস করে নিলো। তোমাকে বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম কিন্তু আসলে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছো। তোমার শশুর, এলিজার পিতাও কিন্তু দুই বিবাহ করেছেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর এলিজার কথা ভেবে সে কি দ্বিতীয় বিবাহ করেনি? মাইরার আম্মা মারজিয়া সুলতান তো কখনো এলিজাকে কম ভালোবাসেনি।”
রাগান্বিত হলেও মায়ের উপর কথা বলতে চাইল না শাহজাইন। কথায় কথা বাড়বে ছাড়া কমবে না। নীরব থাকাটাই সঠিক মনে হলো তার নিকট। তবে বেশিক্ষণ সেই নীরবতা স্থায়ী হলো না। ওয়াসিফা সুলতান অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন, “আমি একজন কবিরাজকে চিনি যে বোবাদের চিকিৎসা করেন। তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বহু মানুষ নিজের জবান ফিরে পেয়েছে। বহুবার সে তার বিদ্যার প্রমান দিয়েছে। এমনকি সারাজীবন যেই মানুষ কথা বলতে পারতো না তাকেও কথা বলিয়েছে সে।”
কথাট শ্রবণগোচর হতেই আগ্রহী হলো শাহজাইন। ব্যস্ত স্বরে শুধাল, “তার ঠিকানা কোথায়? নাম কী? আপনি এতোদিন বলেননি কেন?”
“উত্তেজিত হইয়ো না শাহজাইন। এতোদিন স্মরণে ছিলো না আমার। আজ মনে পড়ছে। ঠিকানাও বলবো তোমায় তবে তার জন্য আমার কথা রাখতে হবে তোমাকে। তুমি বিবাহ করলেই আমি তার নাম-ঠিকানা সব বলে দেবো।”
এবার যেন আশ্চর্যের চরম শেখরে পৌঁছালো শাহজাইন। কন্ঠের দৃঢ়তা হারিয়ে গেল নিমেষেই। সে কাতর গলায় বলল, “তোহফা আপনার নাতনি! সেটা কি ভুলে গেছেন আপনি? এমন নিষ্ঠুর বাক্য আপনার থেকে আশা করিনি আমি।”
“তুমিও তো ভুলে গেছো আমি তোমার আম্মাজান। নিশ্চয়ই তোমার খারাপ চাইব না? একজন সুলতানা হিসেবে সাম্রাজ্যের জন্য আমি এটুকু নিষ্ঠুর হতেই পারি। তুমি মৃত স্ত্রীর প্রেমে উন্মাদ হতে পারো, আমি নই। আমার কথা শুনলে তুমি ঠিকানা পাবে নাহলে নয়।”
মায়ের কথায় হতবাক হওয়ারও সুযোগ পেল না শাহজাইন। সে স্পষ্ট অনুভব করছে বুকের ব্যথাটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হৃদযন্ত্রটা জানান দিচ্ছে এই স্থান শুধুই তার বেগমের, তার এলিজার। আম্মা যতই ছলচাতুরি করুক না কেন সে কিছুতেই বিবাহ করবে না। সে তো তার এলিজাকে কথা দিয়েছিল জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তার হয়ে থাকবে। সে আজ নেই বলেই কি তাকে করা অঙ্গীকার অস্বীকার করবে সে! ভঙ্গ করবে নিজের ওয়াদা! কখনোই নয়। সে হনহন করে বেরিয়ে গেল মায়ের কামরা থেকে। হতাশার শ্বাস ফেলে পুনরায় পালঙ্কে বসলেন ওয়াসিফা সুলতান।
নিজের কামরায় ফিরে শক্ত করে দ্বার এঁটে দিলেন সুলতান। পাগরীটা খুলে ছুড়ে ফেলে পালঙ্কে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন। আগে থেকেই সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মাহতাব। তাকে এভাবে ফিরতে দেখে খানিক অবাক হলো সে। সামান্য কারনে তো সুলতান এমন আচরন করেন না! সে এগিয়ে এসে শুধাল, “আপনার রাগের কারন টা কি জানতে পারি মহামান্য?”
কাতর মুখখানা তুল ধরলেন শাহজাইন। চোখদুটোতে যেন তার হাজারো অভিযোগ। অথচ তা ব্যক্ত করবার মানুষটাই নেই। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তুমি কি সত্যিই অনুভব করতে পারছো না মাহতাব আমার এই মলিনতার কারন?”
চিন্তিত হলো মাহতাব। কৌতূহলী হয়ে শুধাল, “আবার আপনার বিবাহের কথা বলছেন তিনি?”
নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শাহজাইন। কোনো উত্তর দিলো না সে। এই প্রসঙ্গটাই যেন তাকে যন্ত্রণা দেয়! কষ্টের গভীর প্রলেপ লেপে যায়! তার অনুভূতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো মাহতাব। পুনরায় শুধাল, “শুধু কি এ কারনেই আপনার এই মলিনতা?”
“না মাহতাব, আম্মা আমার ভরসা ডুবিয়েছে। সে নিষ্ঠুর হয়েছে। তোহফার চিকিৎসা করতে পারবে এমন কবিরাজের খবর জানেন তিনি। অথচ আমি বিবাহ না করলে সে তার নাম-ঠিকানা কিছুই বলবেন না। এ কেমন নির্মমতা বলো তো? তোহফা তো তার একমাত্র নাতনি। তবে কেন এই কঠিন শর্ত? একজন সুলতান কি কাউকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে পারে না মাহতাব?”
কপাল কুচকাল মাহতাব। সে দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে পারছে সম্মুখের ব্যাক্তিটির অসহায়তা। সে জানে বড় সুলতানার জিদ কতটা প্রখর। এতো সহজে সে হার মানবার পাত্রী নয়। তবে সুলতানের এমন অসহায়ত্বও সে সহ্য করতে পারছে না। একদিকে তার হৃদয়ে রানি অন্য দিকে তার একমাত্র কন্যা। এ কেমন শর্ত জুড়েছেন বড় সুলতানা! বড়ই বিচক্ষণতার সাথে অথৈ জলে ঠেলে ফেলেছেন নিজের পুত্রকে! অস্থির চিত্তে সে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো ঘরময়। হুট করে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঠোঁটদুটো প্রসারিত করলো। অতঃপর ছুটে আলো সুলতানের দিকে। উত্তেজিত স্বরে বলল, “আমি একটা পরিকল্পনা ব্যক্ত করতে চাই। যদি আপনি অনুমতি দিতেন আর কী?”
আগ্রহী নয়নে চাইল সুলতান। সে উপলব্ধি করতে পারছে মাহতাবের মাথায় কোনো ধুরন্ধর পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই খুশি হলো মাহতাব। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল নিজের পরিকল্পনা। নীরব হয়ে শুনলেন সুলতান। অতঃপর কাতর মুখখানাতে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তুমি পারোও বটে মাহতাব। তবে বুদ্ধিখানা মন্দ নয়। চলো, আম্মাকে সুখবরটা দিয়ে আসি।”
____________________________
সুলতান শাহজাইন গম্ভীর মুখে বসে আছেন কাঠের কারুকার্যমণ্ডিত একটি চেয়ারে। তার সম্মুখের চেয়ারটাতে বসে আছে শেহজাদি মাইরা। দৃষ্টি জুরে তার অসীম চঞ্চলতা। সুন্দর মুখখানায় স্থান পেয়েছে গোলাপী আভা। সে কি লজ্জা পাচ্ছে? না চাইতেও খানিক রাগান্বিত হয়ে পড়লো শাহজাইন। বড় বোনের স্বামীর সঙ্গে বিবাহ! অথচ মেয়েটার খুশি যেন উপচে পড়ছে। সহ্য হলো না তার এই লাজুক চেহারা। এলিজার বোন হওয়ার দরুন খানিক মিল রয়েছে তাদের রূপের মাঝে। এলিজার রাগান্বিত দৃষ্টিও নেশা ধরাতো তার। অথচ মাইরার এই লজ্জামিশ্রিত চাহনি একদমই হজম হচ্ছে না তার। দৃষ্টির অগোচরে সে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো চেয়ারের হাতলখানা। পারলে এখনি পিষে ফেলতো এই হাতল। কিছুক্ষণ পূর্বেই সে আম্মাজানকে জানিয়েছে সে বিবাহ করতে প্রস্তুত। তবে তখনও সে অবগত ছিলো না পাত্রী আগেই জুটিয়ে রেখেছে তার আম্মা এবং সম্মতি পেয়েই তাকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন তার গলায়। আবার সেই পাত্রী কি-না এলিজার ছোট বোন! এতোটাও আশা করেনি সে। মাহতাবের বুদ্ধি শুনে বিবাহে সম্মতি জানিয়েই বোধহয় ভুল করলো সে! এখন তাকে আবার মাইরার সাথে বিবাহ সম্পর্কিত আলাপচারিতা করতে হবে! এ কেমন নিয়ম! কোথায়, এলিজার সঙ্গে তো বিবাহের পূর্বে তার এমন আলাপচারিতা হয়নি! সে কটমট করে তাকালো মাহতাবের দিকে। যার অর্থ: আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি কিছু করো নতুবা গর্দান যাবে তোমার।
কামরার সামনে তলোয়ার হাতে সটান দাঁড়িয়ে থাকা আজমাইন মাহতাব চেয়ে আছে তাদের দিকেই। মাইরার লাজুক চাহনি লক্ষ্য করেছে সে। সুঠামদেহি একজন সুপুরুষ হওয়ার দরুন অগনিত রমনীর এমন চাহনি উপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। তাই এই চাহনির ব্যাখ্যা উপলব্ধি করতে সময় লাগলো না তার। শেহজাদি মাইরা তবে নিজেও বিবাহের জন্য প্রস্তুত? হঠাৎ সুলতানের এমন চাহনি দেখে ঢোক গিলল সে। এখানে তার দোষটা কোথায়? সে কি জানতো যে পাত্রীর খোঁজ ইতিমধ্যে করা শেষ? জানলেও কিছু তো করার ছিলো না। তাছাড়া বিবাহে সম্মতি দিলেই তো আর বিবাহ হয়ে যাচ্ছে না। সেও কিছুটা সময় পাবে। এই সময়ের মাঝে বড় সুলতানার সঙ্গে সঙ্গ জমিয়ে নিতে পারলেই ঠিকানা পেয়ে যাবে সে। কিন্তু এখন কি করবে সে? শেহজাদি মাইরাকে তো আর যা-তা বলে তাড়ানো যায় না।
তাদেরকে এই গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত করতেই হয়তো দ্বারে কড়া নাড়লো কেউ। ব্যস্ত পায়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলো মাহতাব। একজন সেবক এসেছে। হাতে তার শরবতভর্তি পাত্র। ভ্রু কুচকাল মাহতাব। সুলতান বাইরে থেকে ফিরলে সবসময় শরবত পান করেন। এ সম্পর্কে সে অবগত। এটাই সুযোগ। কিছু একটা ভেবে সে ফিরিয়ে দিলো সেবককে। অতঃপর হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো কামরায়। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “ক্ষমা করবেন মহামান্য। তবে আপনাকে এখনি একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে। বার্তাবাহক বার্তা এনেছে। রক্ষীর খুনের কোনো সূত্র পাওয়া গেছে।”
হুট করে এমন কথাতে ভ্রু কুচকে চাইল শাহজাইন। মাহতাবের মুখের ভঙ্গিমা দেখেই সে উপলব্ধি করতে পারলো মিথ্যা বলছে সে। তবুও হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, চলো।”
ব্যস্ত পায়ে কামরা ত্যাগ করলো তারা। হতবুদ্ধির ন্যায় সেদিকে চেয়ে থাকলো শেহজাদি মাইরা। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটলো যে সে কোনো কথাই বলার সুযোগ পেল না। তারা চলে গেছে উপলব্ধি করতে পেরে তরতর করে রাগ উঠে গেল তার। তাকে উপেক্ষা করে এভাবে চলে গেল! অন্তত একটাবার বলে যেতে পারতো। এমন ব্যবহার সে আশা করেনি সুলতানের থেকে। এলিজার বিবাহের তিন বছরেও সে আসেনি এই সাম্রাজ্যে। তবে এলিজার মৃত্যুর পূর্বেই সে একবার এসেছিল এই মহলে। সেবার এখানে সে অবস্থান করেছিল মাসখানেক। তবে সুলতানের সঙ্গে তেমন কোনো আলাপচারিতা হয়নি তার। সে সময় সুলতান অধিক ব্যস্ত সময় পার করছিলেন পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে। এলিজার মৃত্যুর খবর পেয়েও এই মহলে এসেছিল সে সপরিবারে। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি ছিল আরোও মর্মান্তিক। এলিজার শোকে সুলতানের তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। এই শক্ত পুরুষের হৃদয় ভাঙা কান্না নিজ চোখে দেখেছে সে। সেই আহাজারি আজও ভুলতে পারে না সে।
দিন পেরিয়ে রাত নেমেছে। নিজ কামরায় ফেরেনি শাহজাইন। মহলের পেছনের সুবিশাল বাগানটাই দাঁড়িয়ে আছে সে। সম্মুখেই স্থির তার দৃষ্টি। বাগানের একপাশে বৃহৎ জায়গা জুরে শুধুই রজনীগন্ধার আবাদ। সাদায় সাদায় ছেয়ে আছে চারপাশ। জোৎস্নার আলোয় জ্বলে উঠছে তার সফেদ বর্ণ। থেকে থেকে রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ সুবাস এসে নাকে ঠেকছে। বেগমের পছন্দের ফুল ছিল রজনীগন্ধা। তার জন্যই এই বাগানে ঠাঁই পেয়েছিলো রজনীগন্ধারা। বাগানের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজমাইন মাহতাব। সতর্ক তার দৃষ্টি। সুলতান তাকে কামরায় ফিরতে বললেও সে নিজ স্থান থেকে এক পা নড়েনি। অজানা শত্রুর বিচরণ চলছে সাম্রাজ্য জুরে। জানা নেই তার মনোবাসনা। তবে সুযোগ পেলে সে তো আক্রমণ করতেই পারে সুলতানের উপর। কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে রাজি নয় মাহতাব।
এমন সময় তাকে ডেকে উঠলেন সুলতান। দ্রুত এগিয়ে গেল আজমাইন মাহতাব। তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন সুলতান। পূর্বের ন্যায় প্রাণোচ্ছল নয় সেই হাসি। সে নিজের পাগরীটা খুলে হাতে নিতে নিতে বলল, “তোমার বিবাহের বয়স হয়েছে মাহতাব। এবার সময় হয়েছে তোমার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার।”
হুট করে এমন কথাতে চমকাল মাহতাব। খানিক লজ্জাও পেল বটে। নিজেকে সংবরণ করে বলে উঠলো, “আমি এখনো প্রস্তুত নই মহামান্য।”
“জীবনের আঁটাশটা বসন্ত তো পেরিয়ে গেল আর কত সময় নেবে প্রস্তুত হতে? পছন্দের কেউ থেকে থাকলে আমাকে বলতে পারো। আমি নিজে প্রস্তাব পাঠাব তার নিকট। আছে নাকি কেউ?”
মুহুর্তেই একরাশ মলিনতা ভর করলো মাহতাবের চোখে-মুখে। সে শুকনো গলায় বলল, “ছিলো কেউ একজন তবে এখন আর নেই। তাকে নিজের করে রাখতে পারিনি আমি। হারিয়ে ফেলেছি তাকে বহু বর্ষ পূর্বেই। কতগুলো বসন্ত পার করেছি তাকে খুঁজে খুঁজে তার হিসেব নেই। এখন নিশ্চয়ই সে অনেক বড় হয়ে গেছে। বয়সটাও বেড়ে হয়তো চব্বিশ/পঁচিশে ঠেকেছে। হয়তোবা এতোদিনে সেও অন্যের অর্ধাঙ্গীনি হয়ে গেছে। সে আর কখনোই আমার হবে না।”
তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বলল না সুলতান। নীরবতাই শ্রেয় মনে হলো তার নিকট। মাহতাবের থেকে দৃষ্টি হটিয়ে অদূরে ঝোলানো দোলনাটায় গিয়ে বসলো। মৃদু বাতাসে দুলছে রজনীগন্ধা গাছগুলো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কেটে যাওয়ার পর সে আকাশের পানে চেয়ে হুট করে বলে উঠলেন, “চাঁদ দেখবে মাহতাব? এলিজা খুব পছন্দ করতো রজনীগন্ধার সুবাস মেখে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। গত চারটা বছর ধরে প্রত্যেক রোজার চাঁদ আমরা একসাথে এখানে বসেই দেখতাম। আজ আমার এলিজা নেই। তুমি কি সঙ্গ দেবে আমাকে?”
হঠাৎ এমন আহ্বানে তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো আজমাইন মাহতাব। নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক, বংশ মর্যাদা ভুলে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল সে। সুলতানের পাশে বসে তলোয়ারটা সরিয়ে রাখলো। দৃষ্টি রাখলো চাঁদের দিকে। সে হলফ করে বলতে পারে বেগম খুবই ভাগ্যবতী ছিলেন।
চলবে……….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_5
“আপনি আমার হয়ে থাকবেন তো সুলতান?”
এলিজার ভার মুখখানা মোটেই সহ্য হলো না শাহজাইনের। ভালোবাসার অনলে ঝলসে যাচ্ছে তার হৃদয়। মেয়েটার কান্না ভেজা চোখ আর ভার মুখশ্রী কোনো কালেই পছন্দ নয় তার। অথচ মেয়েটা কি-না তার সামনে এভাবে মুখ ভার করে আছে! সে দ্রুততার সাথে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো তার মুখখানা। চোখে চোখ রেখে শুধাল, “সে কথা কি তুমি বুঝে নিতে পারো না বেগম? কেন তোমায় সব কথা বলে দিতে হবে?”
টলমল চোখে তাকালো এলিজা। দু’হাতে ধাক্কা মেরে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো তাকে। ধরা গলায় বলে উঠলো, “আপনি দূরে সরে যাচ্ছেন সুলতান। নিজের অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।”
চমকাল শাহজাইন। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। এলিজার মাথা গিয়ে ঠেকল তার বুকের সাথে। সে আদুরে গলায় বলল, “দূরত্ব কোথায়? কোথাও যাচ্ছি না আমি। একটা মশাও গলতে পারবে না তোমার-আমার মাঝে। আমার হৃদয়ের কতটা গহীনে তোমার বাস তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না বেগম। কতবার বলেছি তোমায়, আমার সামনে এভাবে অশ্রু ঝরাবে না। সহ্য করতে পারি না আমি।”
“অযথায় মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছেন আমায়। আপনি কি বুঝতে পারছেন না? ইতিমধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মাঝে, এক আকাশসম দূরত্ব।”
কথা সম্পূর্ণ করেই তাকে ঠেলে দিয়ে সরে গেল এলিজা। একপা, দু’পা করে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে সে। তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মাঝে। হাত বাড়িয়ে তাকে আটকাতে চাইল শাহজাইন। তবে তার পূর্বেই হারিয়ে গেল এলিজা। শূন্য হলো চারিপাশ। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল শাহজাইন। ডানে-বামে নজর বুলিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো, “বেগম।”
ধরফরিয়ে জেগে উঠলো সুলতান। আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলো বেগমকে। অথচ চারপাশে নিখুঁত অন্ধকার বিরাজমান। নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে অক্ষম হলো সে। স্থান, কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো, “সাড়া দাও বেগম। অন্ধকারে কিছুই যে দেখতে পাচ্ছি না আমি।”
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মাহতাব আচমকা চিৎকারে লাফিয়ে উঠলো। তন্দ্রা কেঁটে গিয়ে হকচকিয়ে উঠলো সে। অন্ধকারের মাঝে নিজের পাশ হাতরে আঁকড়ে ধরলো তলোয়ারখানা। দোলনাটা দুলে উঠছে তাদের নড়াচড়া পেয়ে। সুলতান এখনো অব্দি একই সুরে ডেকে চলেছে, “এলিজা, কেন অভিমান করছো তুমি? সামনে এসো।”
ইতিমধ্যে দোলনা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। অন্ধকারের মাঝে সামনে আগাতে নিতেই পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরলো মাহতাব। অবাক কন্ঠে বলল, “কোথায় যাচ্ছেন মহামান্য? বেগম নেই এখানে। সে কী করে আসতে পারে?”
মানতে নারাজ শাহজাইন। এক ঝটকায় মাহতাবকে ছাড়িয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললেন, “তুমি জানো না মাহতাব। এসেছিল এলিজা। কথা বলেছে আমার সাথে।”
পুরো উদ্যমে সামনে আগাতে চাইল সে। পুনরায় তার হাত টেনে ধরলো মাহতাব। সামান্য গলা উচিয়ে বলল, “সামনে শুধুই অন্ধকার মহামান্য। আপনি স্বপ্ন দেখেছেন। বেগম মারা গেছেন। সে আর কখনোই ফিরে আসবেন না। ঘোর ছেড়ে বেরিয়ে আসুন।”
চমকাল শাহজাইন। বেগম মারা গেছেন! বাক্যটা বড় কঠিন ঠেকল তার নিকট। মুহুর্তেই নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হলো সে। ধপ করে বসে পড়ল দোলনার উপর। শূন্য দৃষ্টিতে চাইল মাহতাবের দিকে। স্বপ্ন দেখছিল সে! আসেনি এলিজা! হতাশার শ্বাস ফেলে মাটির দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর সেদিকে চেয়েই বলে উঠলেন, “আমি একটু একা থাকতে চাই।”
“কিন্তু মহামান্য………..”
বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল মাহতাবের। সুলতান খানিক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “এটা আমার আদেশ।”
দ্বিতীয় কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না মাহতাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল মহলের দিকে। ফটকের সামনে গিয়ে পুনরায় ফিরে তাকালো সে। অন্ধকারে তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হলো না তার। মহলের চোখ ঝলসানো আলো ফটকের সামনে কিছুটা পড়লেও পৌঁছায় না বাগানের গভীরে। তাই দোলনাটা অন্ধকারেই রয়ে গেল।
অন্ধকারাচ্ছন্ন বাগানটায় একলা বসে রইল সুলতান। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে রজনীগন্ধার কড়া সুবাস টেনে নিচ্ছে নিজের গভীরে। তবে নিকষ কালো আঁধারের মাঝে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না রজনীগন্ধার চোখ ধাঁধানো সফেদ সৌন্দর্য। সকাল হতে আর কতটা প্রহর বাকি? এক প্রহর? দুই প্রহর? অথচ তার নিকট এই সময় এক যুগের চেয়েও অধিক। হৃদযন্ত্রটা কি নিজের কাজ খানিক কমিয়ে আনলো? নাকি সেও উপলব্ধি করতে পারছে বেগমের অনুপস্থিতি। সময়ের নাও বেয়ে চলছে নিজের মতো করে। একটা সময় ভেসে আসলো ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি। মুহুর্তেই যন্ত্রণাটা যেন উপশম হলো ক্ষণিকের জন্য। সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে পাগরীটা হাতে করে উঠে দাঁড়ালো সে। মূল ফটকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পাগরীটা ঠিকঠাক করে বসিয়ে নিলো চুলগুলো ঢেকে। দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলল এই সুমধুর আহ্বানে সাড়া দিতে।
সকালের প্রথম প্রহর। সূর্যের মৃদু আলোর ঝলকানিতে মাথা তুলে হাসছে গাছগাছালি। পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত পরিবেশ। ইটের তৈরি খুব ছোট্ট একটা দালান। শ্যাওলা পড়েছে তার শরীর জুড়ে। ভঙ্গুর ধরেছে কিছু কিছু স্থানে। প্রধান ফটকের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। প্রশস্ত তার দেহখানা। বারান্দায় পেতে রাখা ছোট্ট চকিটাতে বসে একমনে তসবি জপছেন আব্দুর রহমান। চোখদুটো বন্ধ করে অনুভব করছে সকালের স্নিগ্ধতা। বারান্দার মেঝেতে কাঠের তৈরি একটি মাঝারি আকারের বাক্স খুলে বসেছে জোভিয়া। বাক্সটা তার ব্যক্তিগত। এটাতে সে ছাড়া কেউ হাত পর্যন্ত লাগায় না। এটার মধ্যে তার জামা-কাপড়সহ যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে। তবে এই সাত সকালে এটা খুলে বসার কারন অবশ্য ভিন্ন। সে এক এক করে জামাকাপড়গুলো বের করে এলোমেলো করছে আবার ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে। ফাঁকে ফাঁকে কটমট করে তাকাচ্ছে সামনের উঠোনের দিকে।
উঠোনের আঙিনার ছোট ছোট গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে জারনাব। পানির পাত্রটা হাতে করে ঘুরে ঘুরে পানি দিচ্ছে সমস্ত গাছে। শাক-সবজির গাছ ছাড়াও উঠোনের এক পাশ জুড়ে কিছু রজনীগন্ধার গাছ লাগিয়েছে জারনাব। সকাল সকাল সেগুলোরই পরিচর্যা করছে সে। পানি দেওয়া শেষ করে আড়চোখে তাকালো জোভিয়ার দিকে। তার ফুলে থাকা মুখখানি দেখে মৃদু হাসলো সে। সে ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে তার উপরেই রেগে আছে মেয়েটা। তাইতো জামাকাপড়গুলোর উপর এমন নির্মম অত্যাচার চলছে। রাগের কারন আছে বটে! সকালে দোকানে যাবার কথা বললে সে কড়াকড়িভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। জিদান আবার চলে আসে নাকি সেই ভয়ে। কালকের ঝামেলার পর থেকেই ভীত হয়ে আছে সে। জিদান মোটেই ভালো লোক নয়। অন্যদিকে জোভিয়ারও রাগ অতিরিক্ত। সে ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ। জিদান তো মোটেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে নিশ্চয়ই তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। এমত অবস্থায় দোকানে না যাওয়াটাই উত্তম। শেষে দোকান তো যাবেই মানুষের প্রান নিয়েও টানাহ্যাঁচড়া বেঁধে যাবে। জোভিয়াকে নিয়ে অধিক চিন্তিত সে। মেয়েটার রাগ সম্পর্কে ধারনা আছে তার। জিদান আবার আসলে আরো বড় ঝামেলা বেঁধে যাবে তা সে নিশ্চিত।
সে পুনরায় তাকালো জোভিয়ার দিকে। এই নিয়ে একই কাপড় সপ্তমবারের মতো ভাঁজ করছে সে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। প্রিয়জনের উপর নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে না পেরে এভাবেই রাগ মেটাই সে। এতে নাকি রাগ কমে আসে তার। পানির পাত্রটা রেখে উঠে এলো জারনাব। বারান্দার মেঝেতে গিয়ে বসলো জোভিয়ার পাশে। এলোমেলো করে রাখা একটা কাপড় তুলে ভাঁজ করতে করতে বলল, “অতিরিক্ত রাগ শরীরের জন্য ভালো নয়।”
মাথা তুলে একবার তার দিকে তাকালো জোভিয়া। সাথে সাথেই আবার মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। হতাশ হলো না জারনাব। বরং উঠে গিয়ে ঘর থেকে এক পাত্র পানি নিয়ে এলো। জোভিয়ার দিকে পাত্রটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটুকু খেয়ে নাও।”
তাকালো না জোভিয়া। সে নিজের মতো করে কাজ করতে ব্যস্ত। মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো জারনাব, “কী হলো? শুনতে পাচ্ছ না? পানিটুকু খেয়ে নাও।”
বাক্সটা পাশে সরিয়ে রাখলো জোভিয়া। অতঃপর ছো মেরে পাত্রটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো সবটুকু পানি। পাত্রটা এগিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “পানি খাওয়াতে উঠে পড়ে লেগেছো অথচ পেটে যে পাথর বাঁধতে হবে কাল থেকে তার হিসেব আছে? ঘরে কোনো খাবার নেই, পয়সা নেই। দোকানেও যেতে দিচ্ছ না। খাবার কোথা থেকে আসবে?”
পাত্রটা যথাস্থানে রেখে হাসলো জারনাব। কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে বলল, “ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। আজকের দিনটা আঙিনায় জন্মানো শাক-সবজি দিয়েই চালিয়ে নেওয়া যাবে। কালকেরটা কাল ভাববো।”
“দু’য়েকদিন নাহয় না খেয়েই থাকলাম কিন্তু আব্বাজানের ওষুধ? সেটাও তো ফুরিয়ে যাচ্ছে। অন্যের ভয়ে আমরা কেন ঘরে বসে থাকব। ভয় তো ঐ বদমাইশটার পাওয়া উচিত। ওকে ধরে শাহ নদীতে দুইটা চোবানি দিলেই শিক্ষা হয়ে যাবে। বদের ঘরের বদ একটা।” দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল জোভিয়া।
তসবি রেখে এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন আব্দুর রহমান। সুন্দর করে বললেন, “এতো রাগ কেন ছোট আম্মা? রিযিকের মালিক আল্লাহ। তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন। কাল থেকেই তো বোধহয় রোজার শুরু। না খেলেও চলবে। সেহেরিতে এক পাত্র পানি আর সন্ধ্যায় দুটো খেজুর। ব্যাস! জমে যাবে রোজা। ওষুধপত্র দু’দিন না খেলে কিচ্ছু হবে না। রোজার মাসে আল্লাহর একটা রহমত আছে না?”
আব্বা আর বোনের এসব যুক্তিতে নিরাশ হলো জোভিয়া। দোকানটা তাদের রোজগারের একমাত্র মাধ্যম। সেটা এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখলে তারা খাবে কী? তার উপর রমজান মাস এসে পড়েছে। এখনি তো ভীর বেশি হয় দোকানে। তাদের নিয়মিত ক্রেতাগুলো বোধহয় এবার তারা হারিয়েই ফেলবে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে চেয়ে হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল সে। সেদিকে চেয়ে হাসলো আব্দুর রহমান। কন্যার রাগের কারন সে উপলব্ধি করতে পারছে। সে যে সবসময় পরিবারের কথাই চিন্তা করে তাও সে জানে। তবে নিজ কন্যার জীবনের চেয়ে দামী কিছুই নয় তার নিকট। জারনাব নিজেও এগিয়ে গেল জোভিয়ার পিছু পিছু। তাকে আবার রান্না বসাতে হবে। আঙিনায় কিছু শাক-সবজি হয়েছে। সেগুলোই আজকের খাবার তাদের। জারনাব চোখের আড়াল হয়ে যেতেই ভিজে ওঠে আব্দুর রহমানের চোখদুটো। চোখের আশেপাশের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে জানান দিচ্ছে তার বার্ধক্যের। অথচ তার বয়স এতটাও বেশি নয় যে তাকে এভাবে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হবে। মনে পড়ে তার। এইতো সেদিন তিন কবুল পড়ে তার বিবাহ হলো জারনাবের আম্মার সাথে। বিবাহের দু’বছর পেরোনোর পূর্বেই ঘর আলো করে আসলো জারনাব। কত সুখের ছিল তার সেই জীবন। অথচ চোখের পলকেই সব ধোঁয়াশায় পরিণত হলো। শব্দহীনভাবে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। এসবই তার পাপের ফল। মেয়েদুটো শান্তিতে দু’দন্ড বসতে পর্যন্ত পারে না। পয়সার চিন্তা, সংসারের চাপে মেয়েদুটোর একটু আরাম পর্যন্ত নেই। তার উপর আবার উটকো এই ঝামেলা।
এসব তার কারনেই হচ্ছে। উপরওয়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাকেও কম সুযোগ দেয়নি কিন্তু সে নিজ কর্মে এতটাই মত্ত ছিল যে সেই সুযোগ হেলায় উড়িয়েছে। আজ সে পঙ্গু, হাঁটতে পারে না। ওষুধ ছাড়া একটা বেলা চলতে পারে না। লাঠি ভর দেওয়া ছাড়া তার চলার উপায় নেই। সে পাপী। হ্যাঁ, পাপী সে। নিজ কৃতকর্মের দিনগুলো যেন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে সম্মুখে। সে ঘুমাতে পারে না সেই দিনগুলোর কথা ভেবে ভেবে। এটা তার মাতৃভূমি নয়। দক্ষিণী সাম্রাজ্যের বাসিন্দা সে। সেই সাম্রাজ্যের কুখ্যাত একজন অপরাধী। যে কি-না পয়সার বিনিময়ে মানুষ হ’ত্যা করতে পর্যন্ত পিছপা হতো না। কতোই না মানুষের প্রাণ নিয়েছে সে তার কোনো হিসেব নেই। বেশ কয়েক বর্ষ পূর্বে একজন সৈনিককে হ’ত্যা করে ধরা পড়ার ভয়ে স্ত্রী-কন্য সমেত পালিয়ে এসেছিল এই রামান সাম্রাজ্যে। এখানে এসে কয়েক বছর তাদের জীবন বেশ সুখেই কাটছিল। দোকান চালিয়ে পয়সা জমিয়ে এই ছোট্ট দালানটা তুলেছিল। অ’পরাধ জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে। খুশি হয়েছিল তার স্ত্রী তার অপরাধ জীবন শেষ হয়েছে ভেবে। অথচ হঠাৎ একজন কীভাবে যেন খোঁজ পেয়ে গেল তার সম্পর্কে। আজ থেকে ঠিক দু’বছর পূর্বে সে অজস্র অর্থ পেল এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীকে হ’ত্যা করার বিনিময় হিসেবে। এতো এতো অর্থের লোভ সেদিন সামলাতে পারেনি সে। স্ত্রীর হাজারটা নিষেধ অমান্য করে ছুটে গিয়েছিল অ’স্ত্র হাতে।
তাকে বলা হয়েছিল পাহাড়েই পাওয়া যাবে বেগমকে। হলোও ঠিক তাই। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতেই লক্ষ করল কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মহলের দামী পোশাক আর ঝকঝকে অলংকার শোভা পাচ্ছিল তার শরীর জুড়ে। মাথায় থাকা সম্রাজ্ঞীর তাজ দেখে আর চিনতে বাকি রইল না এই তার শিকার। সে হয়তো কারোর জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে। তাকে দেখে ঘুরে দাঁড়ালো সে। তার কোমরে গুঁজে রাখা অ’স্ত্রখানা বের করতেই চমকে গিয়েছিল সে। তবে ঘাবড়াল না তখনও। শক্ত কন্ঠে বলল, “কে আপনি? এভাবে অ’স্ত্র নিয়ে কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন এখানে?”
আর কোনো কথার সুযোগ দেয়নি আব্দুর রহমান। হুট করে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অ’স্ত্র গেঁথে দিয়েছিল তার পেট বরাবর। গলগলিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে ভরে উঠলো দামি বস্ত্র। আচমকা আ’ক্রমণে নিজের আত্মরক্ষা করতে পারেনি সে। শুধু চোখদুটো বড়বড় করে জানতে চেয়েছিল কোন অপরাধে তাকে হ’ত্যা করা হচ্ছে। উত্তর ছিল না তার নিকট। তাই পুনরায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল তাকে পাহাড়ের সবুজ বুকে। পেট চেপে ধরে আ’র্তনাদ করে উঠেছিল সে। অনুরোধ করেছিল তাকে যেন না মা’রা হয়। শোনেনি আব্দুর রহমান। পুনরায় তাকে প্রহার করতে এগিয়ে গেলে সে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে ঢুকে পড়ে পাহাড়ের উপর করা ছোট্ট ঘরটাতে। ঘর নয় সেটা ছিল বিশ্রামাগার। সুলতান বানিয়েছিল অন্য সাম্রাজ্য থেকে বানিজ্য করতে আসা ব্যবসায়ীদের বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। অথচ সেই ঘরটাই আগুনে ঝলসে গিলে নিয়েছিল তার প্রাণ প্রিয় বেগমকে। আব্দুর রহমান যখন হনহন করে সেখানে প্রবেশ করে তখনই আচমকা সে আক্র’মণ করে বসে তার উপর। বিশ্রামাগারের একটি মোটা লোহা খুলে নিয়ে গেঁথে দিয়েছিল তার পায়ের উপর। র’ক্তের স্রোতে ভেসেছিল তার শরীর।
পা চেপে বসে পড়েছিল আব্দুর রহমান। কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বিশ্রামাগার থেকে সরে এসেছিল সে। আক্রোশে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ঘরটাতে। মুহুর্তেই তা দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়েছিল ঘর জুড়ে। ততক্ষণে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছে বেগম। মাটিতে পড়ে থেকে করুন দৃষ্টিতে চেয়েছিল তার দিকে। সেদিনই বাড়ি ফিরেই সে তার স্ত্রীর মৃতু সংবাদ পায়। আজও তার কানে বাজে মৃ’ত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বেগমের বলা সেই বাক্যগুলো। সুন্দর চোখদুটো ভরে উঠেছিল তার নোনাজলে। আগুন যখন তার বহু দামী বস্ত্রখানা স্পর্শ করেছে তখনই সে তার নিকট মিনতি করে বলেছিল, “আপনি আমার পিতার সমতুল্য। দয়া করে মা’রবেন না আমায়। আমার মৃ’ত্যু সংবাদ সইতে পারবে না আমার সুলতান। আমার বাচ্চা, আমার একমাত্র কন্যা তোহফা। সে যে এখনো অনেক ছোট। কথাও বলতে শেখেনি এখনো। সে কী করে নিজের আম্মাজান ছাড়া থাকবে? তাদের জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে দিন। আমার হাতটা ধরুন। আমি এই আগুনে পু’ড়লে আমার সুলতাননন, আমার সুলতাননন………….।
চলবে…….