#যতনে_রাখিবো
৭
“তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে আমার স্বামীর সাথেই চক্কর চালিয়ে যাচ্ছিস! ভেবেছিলি আমি কিছুই জানতে পারব না। কিন্তু এখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। তুই শুধু বান্ধবী না, নারী নামেরও কলঙ্ক।”
কথা ক’টা বলেই সজোরে নাতাশার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পড়টা এতই জোরে লেগেছে যে নাতাশা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। ক্যামেরার পেছনের সকলে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। অভিনয় হলেও থাপ্পড়টা যে লোপা সত্যি সত্যিই মেরেছে এটা বুঝতে কারো বাকি নেই। এত জোরে থাপ্পড় খেয়েও নাতাশা শটের মাঝে কিছু বলতে পারলো না। বেচারীর ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে পড়েছে। নাতাশাকে থাপ্পড়টা মারতে পেরে লোপা মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেলো। গত সপ্তাহেই অভয়ের সাথে নাতাশার একটা নিউজ বেরিয়েছে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল নাতাশা কেমন ইচ্ছে করে অভয়ের গায়ে পড়ছিল। নির্লজ্জ মেয়েছেলে কোথাকার। অভয়ের কাছাকাছি আসতে চাইলে ভবিষ্যতে এমন চড় আরও একশোটা খেতে হবে। ডিরেক্টর কাট বলে দিয়েছেন। নাতাশা কোন সিন ক্রিয়েট করার আগেই লোপা ওর কাছে ছুটে গেল। গলায় একরাশ সমবেদনা নিয়ে বলল,
“ও নাতাশা ডার্লিং! তোমার কি খুব বেশি লেগেছে? তুমি তো জানো আমি শট দেওয়ার সময় ক্যারেক্টারের ভেতর ঢুকে যাই। আ’ম সো সো সো স্যরি বেইব।”
নাতাশা লোপাকে কাঁচা খেয়ে ফেলার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেও তাকে মিথ্যা হাসি দিয়ে বলতে হলো।
“ইট’স ওকে ডিয়ার! আমি জানি তুমি আমাকে ইচ্ছে করে মারোনি।”
লোপা মুখে হাসি টেনে রেখেই মনে মনে বলল,
“তোকে এরকম আরও কয়েকটা চড় মারতে পারলে মনে শান্তি লাগত। শেওড়া গাছের পেত্নী কোথাকার।”
লোপা নাতাশার কাছ থেকে চলে আসার সাথে সাথেই তার ম্যানেজার আনোয়ার এসে কাচুমাচু মুখ করে কিছু একটা বলতে লাগলো। লোপা হাত উঁচিয়ে ম্যানেজারকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এই মুহূর্তে আমার মেজাজ ভীষণ ভালো আছে। তোমার ওই অপয়া মুখ খুলে আমার মেজাজের বারোটা বাজিয়ো না।”
“কিন্তু ম্যাম…
“চুপ।”
লোপা গিয়ে নিজের ভ্যানে উঠে পড়ল। আজকেই মুভির লাস্ট শট দিতে হবে। এই শট দিয়ে বিশ মিনিটের বিরতি নিয়ে পরের শটে ফিরতে হবে। স্পট বয়ের জায়গায় আনোয়ার নিজে লোপার জন্য ডাবের পানি নিয়ে এসেছে। লোপা বিরক্ত হয়ে বলল,
“এত রোদে কেউ শুট করে! আমার স্ক্রিন পুরো ঝলসে গেছে। ছাগল ডিরেক্টর।”
সকাল থেকে দম ফেলারও সময় ছিল না। সেটে আসার সময় জেনেছে অভয় আজকের সব মিটিং ক্যান্সেল করেছে। প্রতি বছর এই দিনটায় অভয়ের যে কী হয় লোপা আজও জানতে পারল না। জানবে কীভাবে? অভয় বরাবরই তার এই প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। লোপার জীবনে একটাই দূর্বলতা। সেটা হলো অভয়। কিন্তু এই অভয়ই তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না।
“অভয়ের হাসপাতালের প্রোগ্রামটা শেষ হয়েছে আনোয়ার? ও কি ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে?”
আনোয়ার কী বলবে বুঝতে পারছে না। এদিকে ঘটনা যা ঘটেছে সে ব্যাপারে ম্যাম কিছুই জানে না। জানলে নিশ্চয় আজকে আর শুট হবে না। আনোয়ার জবাব দিচ্ছে না দেখে লোপা বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল। লোপা আনোয়ারের মুখ দেখেই বুঝতে পারলো কিছু একটা ঘটেছে।
“কী হয়েছে আনোয়ার? এভাবে মাথার উপর দাঁড়িয়ে না থেকে কিছু বলার থাকলে বলো।”
___
অভয় ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। নোমানও তার পেছন পেছন আসছে। আজকের দিনটা কোনরকমে শেষ হলেই বাঁচে। ফোনের রিংটোনে কান তব্দা হয়ে গেছে। একবার ভাবে এই চাকরি তার জন্য না। পরক্ষণে ভাবে তাকে ছাড়া স্যারের কী হবে? অভয় নিজের রুমে চলে এসেছে। পেছন থেকে নোমানও চলে এলে অভয় ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“আমার বেডরুমেও তুমি আমার সাথে থাকবে?”
নোমান ফোন হাতে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে এলো। গলায় চাপা আওয়াজ নিয়ে বলল,
“স্যার লোপা ম্যাম কল করছে! কী করবো?”
“তুমি নিজের ইচ্ছার মালিক নোমান। যা খুশি করো।”
নোমান কল না তোলাই ভালো মনে করলো। লোপা ম্যামের গালি বিশ্ব বিখ্যাত। এখন পর্যন্ত কম গালি খায়নি সে! স্যার উনার কল না তুললেই তাকে গালি খেতে হয়। স্যারকে তো কিছু বলার সাহস নেই। তাই সবাই তার উপরই রাগ মিটায়। অভয়ের ফোন বন্ধ পেয়ে লোপা পাগলের মতো নোমানের ফোনে কল করে যাচ্ছে। নোমান বেচারা পড়েছে মুশকিলে। সে নিজেও চায় না এই মহিলা তার স্যারের জীবনে আসুক। স্যার জীবনে ভীষণ ভদ্র মিশুক হাসিখুশি চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে ডিজার্ভ করে। লোপার মতো রাক্ষুসি স্যারের রক্ত চুষে খাবে এটা নোমান কখনোই চায় না।
___
রাতে ক্ষিধে পেটে তাথৈয়ের কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে। কিন্তু ঘুম বাবার আসার খবর নেই। ভেবেছিল আপু রাগ করে থাকলেও দুলাভাই এসে তাকে খেতে ডাকবে। কিন্তু দুপুর তো দূর রাতেও কেউ খেতে ডাকল না। কী পাষাণ মানুষ গুলোর সাথে বসবাস করছে সে! পেটে দানাপানি কিছু না পড়লে আজ রাতে যে ঘুম আসবে না এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।
“দূর! আমি আপু দুলাভাইয়ের ডাকার আশায় বসে আছি কেন? নিজের বাড়ি। গিয়ে নিয়ে খেয়ে উঠব। কে আমাকে কী বলবে?”
যেমন ভাবা তেমন কাজ করা। তাথৈ শব্দ না করে সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। রাতের খাবার সব ফ্রিজেই রাখা থাকে। বের করে একটু গরম করে নিলেই হবে। তাথৈ গুনগুন করতে করতে খাবার গরম করে টেবিলে এসে বসল। সব তার পছন্দের খাবার দেখে খিদেটা যেন আরও বেড়ে গেল। তাথৈ তৃপ্তি করে খাচ্ছে আড়াল দাঁড়িয়ে তানিয়া বোনকে দেখে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
“কেন নিজেকে সবসময় ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলিস? তোকে দেখে রাখার জন্য তোর সাথে কি আমি সারাজীবন থাকতে পারব?”
তাথৈ খুব ছোট থাকতে মা মারা গেছে। তার বয়সটাও তখন খুব বেশি না হলেও তারপর থেকে তানিয়াই ছোট বোনকে আগলে রেখেছে। ঘরে সৎমা এলে দুই বোনের জীবন একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখনই আল্লাহ তাদের জীবনে ফেরেশতা বানিয়ে একজন মানুষকে পাঠিয়েছে। বিয়ের পর বোনকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চাইলে হারুনের কোন আপত্তিই ছিল না। বরং তাথৈকে সে নিজের বোনের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেলে তানিয়া ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বউকে ভয় পেতে দেখে হারুন হেসে বলল,
“যাক আমার বউও তাহলে ভয় পেতে জানে!”
“মজা কোরো না তো। রাতদুপুরে ভূতের মতো পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে ভয় দেখাচ্ছ। তুমি উঠে এসেছ কেন?”
হারুন তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“তুমি যেকারণে এসেছ।”
“আমি তো পানি খেতে উঠেছিলাম।”
“আমিও।”
স্বামীর মুখে হাসি দেখে তানিয়া লজ্জা লুকাতে বলল,
“ঢঙ করো না তো। ঘুমোতে যাও। কাল অফিস নেই?”
___
তাথৈর বাড়ি থেকে বের হওয়া তো বন্ধ হয়েছেই সাথে আপু তার পকেট মানি দেওয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। তার বোনটা এত পাষাণ! মনটা একটু নরম করলে কী হয়? রনি হারামজাদার ফাঁদে পা দিয়ে কপালে শনি টেনে এনেছে। জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেছে। বাবাই আজ স্কুলে যায়নি। তানিয়াই যেতে দেয়নি। বলা তো যায় না হলুদ সাংবাদিক গুলো যদি বাবাইয়ের স্কুলে পৌঁছে যায়। বাবাই বাড়িতে থেকে প্রশ্ন করতে করতে তাথৈয়ের মাথা খারাপ করে ফেলছে।
“খালামনি।”
“হুম।”
“তুমি কি নায়িকা হয়ে গেছো?”
তাথৈ স্কেচ বুক রেখে দিয়ে বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে দম ফেলে বলল,
“না রে বাবা না। তোর খালামনি নায়িকা হবার মতো এতও সুন্দরী না।”
“তাহলে তোমাকে টিভিতে কেন দেখিয়েছে?”
“টিভি ওয়ালাদের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই তাই আমাকে টিভিতে দেখিয়েছে।”
“হুম। এবার বুঝেছি।”
বাবাই এমনভাবে হুম বুঝেছি বলল যে তাথৈ হেসে দিল।
“পাকনা বুড়া একটা। সব বুঝিস না!”
___
অভয়ের জন্য পরিস্থিতি সহজ হতে এখনও অনেক সময় লাগবে। তার শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে শত্রুর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সে তো কারো সাথে শত্রুতা করেনি। আসলে মানুষের জীবনে সাফল্য একা আসে না। সাথে কিছু শত্রু নিয়ে আসে। যারা তার সাফল্য দেখতে পারে না।
“তোমাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম নোমান। সেই কাজটা তুমি এখনও করতে পারোনি।”
“মেয়েটা বাড়ি থেকে বের না হলে আমি কীভাবে উনাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো বলুন।”
অভয় বাসা থেকে বের হতে পারছে না। তার বোনেরাও আসতে পারছে না। এটা কোন জীবন হলো!
“আজ তিনদিন পরেও বাড়ির সামনে সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে।”
“বিদায় করো এদের।”
“বোম মারা ছাড়া এদেরকে এখান থেকে সরানো যাবে না স্যার।”
“তাহলে বোমই মারো। যেভাবেই হোক আজকে আমাকে বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করো।”
চলবে
Jerin Akter Nipa
#যতনে_রাখিবো
৮
নোমান গত তিনটা দিন ধরে স্যারের কথামতো মেয়েটার উপর নজর রাখছে। এই মেয়ে কখন কোথায় যায়, কী করে, কার কার সাথে মিশে সব চোখ বন্ধ করে মুখস্থ পড়ার মতো বলে ফেলতে পারবে। মেয়েটার মধ্যে সন্দেহজনক কিছুই পায়নি। এত সাধারণ একটা মেয়ে কেন তার স্যারকে ফাঁসাতে যাবে? স্যারের সাথে এই মেয়ের কী শত্রুতা থাকতে পারে?
নোমান গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতের দিকে হাঁটছে। তার স্যার গাড়িতে বসে আছে। মেয়েটার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু নোমান ভেবে পাচ্ছে না এই মেয়ে ফুটপাতে মুচির দোকানে বসে কি করছে। এই মেয়ের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তার অজানা না। এর বংশের কেউ মুচির কাজ করেছে বলে তো জানা যায়নি। মেয়েটা কি নিজে মুচিগিরি করে? পার্ট টাইম জব যাকে বলে! না না, এত সুন্দর শিক্ষিত একটা মেয়ে ইচ্ছে করলেই অন্য যেকোনো কাজ নিতে পারবে। রাস্তায় বসে জুতা সেলাবে কেন? কোন কাজই ছোট না। তারপরও একটা মেয়েকে সে কোনোদিনও রাস্তার ধারে বসে জুতা সেলাতে দেখেনি। নোমান দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাথৈও খেয়াল করেছে লোকটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কেমন ভূত দেখার মতো তাকে দেখছে। মনে হয় তার মত সুন্দরী একটা মেয়েকে এখানে বসা দৃশ্যটা হজম করতে পারছে না। এই লোক যদি তাকে মুচি ভাবে তাহলে এর ভুল সে ভাঙবে না। তাথৈয়ের মনের মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করতে লাগল। সে ইচ্ছে করে পাশ থেকে একজোড়া ছেড়া জুতা নিল। বুট হাতে নিয়ে এমন একটা ভাব করল যেন সে সত্যি সত্যিই জুতা সেলাই করতে পারে। তাথৈ আড়চোখে দেখল লোকটা তার কাছাকাছি চলে এসেছে। সে গুনগুনিয়ে গান ধরল,
“খোকা বাবু যায় লাল জুতা পায় বড় বড় দিদিরা সব উঁকি মেরে চায়.. লে খোকা।”
নোমান তাথৈয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। স্যার গাড়িতে বসে তাকেই দেখছে। নোমান বারবার ঘাড় ফিরিয়ে গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা তাকে খেয়াল করছে না। নোমান গলা পরিষ্কার করে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইল। তখনও তাথৈ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে ডাকল,
“এক্সকিউজ মি ম্যাম, শুনছেন?”
তাথৈ হাতের কাজ থামিয়ে দিল। যেন ভীষণ বিরক্ত হয়েছে এমন ভাবে কপালে ভাজ ফেলে মুখ তুলে লোকটার দিকে চাইল। নাক উঁচিয়ে বলল,
“জুতা সিলাইবেন স্যার? স্যান্ডেল জুতা তিরিশ টেকা। চামড়ার জুতা পঞ্চাশ টেকা। এক দাম। কোন কমানি বাড়ানি চলব না। আপনারা হইলেন গিয়া ধনী মানুষ গাড়িতে চলেন বড় বাড়িতে থাকেন। আপনাগো টেকাপয়সা কুত্তায় খায়। হের পরেও আমাগো মতো খাইট্টা খাওয়া মানুষের লগেই আপনাগো যত কাইস্টামি। দামাদামি করলে জুতা সিলামু না।”
নোমান এই মেয়ের সম্পর্কে যতটুকু জানে তাতে এমেয়ে ইংলিশে অনার্স করছে। তাই তাথৈয়ের মুখ থেকে এসব কথা শুনে নোমান হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না। এই মেয়েটাই সেই মেয়ে তো? নাকি তার কোথাও ভুল হচ্ছে? তার স্যার অভিনেতা হলে এই মেয়েটাও অভিনেত্রী। স্যারের থেকেও বড় অভিনেত্রী। তাথৈ লোকটার মুখ দেখে মনে মনে হেসে ফেটে পড়ছে। লোকটাকে পুরোপুরি ভড়কে দিতে পেরেছে সে। তার এই একটা গুণের প্রশংসা আপুও করে। তাথৈ ভাবল, এর সাথে আরও একটু মজা নেওয়া যাক। তাথৈ কপালের বিরক্তির ভাঁজ গুলো আরও গাঢ় করল। বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছে বলল,
“কি সাহেব, জুতা সেলাইবেন না? হুদাই কেন আমার সময় খাইতাছেন? আপনার লগে কথা কইয়া আমার লস হইছে। এর লাইগা আপনার জরিমানা দিতে হইব। দেন সাহেব, একশো টেকা বাইর করেন। খাড়াইয়া থাইকেন না। আমার চেহারায় কি রুপ বাইয়া পড়তাছে? হাঁ কইরা তাকাইয়া কী দেখেন? বেডা মানুষ হইছেন, নজরটারেও একটু হেফাজত কইরা চইলেন। ঘরে মা বোন বউ নাই?”
নোমানের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেচারার কাশি উঠে গেছে। নোমান জোরে জোরে কাশতে লাগল। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসুক। স্যারকে বলুক, এ মেয়ে পাগল। এর সাথে আপনার কথা বলতে হবে না স্যার।
তাথৈ ভাবল, একটু বেশিই করে ফেলেছে সে। বেটার চেহারা সুরত দেখে হাবাগোবা মনে হলেও যদি বেটার ভেতরে ভেতরে শয়তানি থাকে! তখন উল্টো তাকে লেনেকা দেনে পারেগা। তাথৈ আশেপাশে দেখল। কোন মানুষ নেই। কাকাও এখনও খেয়ে ফিরছে না। থাক ভাই, আর মজা করার দরকার নেই।
নোমান ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলাতে তার বেশি সময় লাগল না। তার নার্ভ যথেষ্ট শক্ত। নইলে স্যারের ম্যানেজার হয়ে এতগুলো দিন থাকতে পারত! দিনে তাকে এমন এমন খবরও শুনতে হয় যা শুনে মরা মানুষও বলে উঠবে, কিরে মরবি না তুই! মনে আল্লাহর ভয় নেই! এত বড় মিথ্যা কথা কেমনে বলিস?
“আপনি কি তাসনিয়া জামান তাথৈ!”
তাথৈ ভ্রু কুঁচকে লোকটাকে দেখল। এই লোক তার পুরো নাম জানে কীভাবে! আশ্চর্য! সে এই লোককে জীবনে দেখেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
“না। তাথৈ কেডা সাহেব? আপনার পরিচিত কেউ?”
তাথৈ মুখের উপর অস্বীকার করলেও নোমান বিনীত কন্ঠে বলল,
“ম্যাম, আমি জানি আপনিই তাথৈ। আমার স্যার আপনার সাথে কথা বলতে চান ম্যাম। উনি এখন গাড়িতে বসে আছেন। আপনি প্লিজ আমার সাথে আসুন। স্যার বেশি সময় নিবেন না। জাস্ট পাঁচ মিনিট।”
এই লোকের স্যার কে হতে পারে? আকাশ পাতাল ভেবেও তাথৈ হদিস পেল না। ঠোঁট কামড়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দূরে দাঁড়ানো কালো গাড়িটা দেখল তাথৈ। ওরে বাপ! গাড়ি দেখে বেটার স্যারকে হেব্বি মালদার পার্টি মনে হচ্ছে। এরা আসলে নারী পাচার/কারী নয় তো! হতেও পারে। তাথৈ ঠিক করে নিল মরে গেলেও সে এই লোকের কথা শুনে ওই গাড়ির কাছে যাবে না। নাকে মুখে কিছু একটা চেপে ধরে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলে কোথায় নিয়ে চলে যাবে কেউ খোঁজই পাবে না। চোখ খুলবে তার অন্য দেশের বন্ধ ঘরে। তাথৈ অন্যমনস্ক হয়ে এসব কথাই ভাবছিল। নোমান অনুসন্ধানী চোখে তাথৈকে দেখছে। তাথৈয়ের উত্তরের অপেক্ষা করছে।
“ম্যাম আপনি কি আসবেন?”
তাথৈ মনে মনে ভয় পেলেও গলায় জোর এনে বলল,
“না গেলে কী করবেন? জোর করে তুলে নিয়ে যাবেন? আমাকে আপনি চেনেন না। জুতা সেলানোর এই বুটটা দেখছেন? একদম পেটে ঢুকিয়ে দেব। একবার শুধু কাছে এসে দেখুন।”
নোমানও বুঝতে পারল মেয়েটা তাকে খারাপ লোক ভাবছে। তার কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে এটাই ভাবছে হয়তো। নোমান হাসল। বিশ্বস্ত গলায় বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন ম্যাম। আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমার স্যারকে দেখলে আপনার আর এই ভয় থাকবে না।”
তাথৈ এত সহজে কারো কথায় পড়ার মেয়ে না। মনের ভয় কেউ দেখবে না৷ গলার তেজ থাকলে এই লোক কেন, কোন লোকই সুবিধা করতে পারবে না।
“কে আপনার স্যার? কোন সাধুপুরুষ সে?”
“সেটা আপনি নিজের চোখে দেখলেই ভালো নয় কি?”
“আপনার স্যার নিজে না এসে আমাকে নিতে আপনাকে পাঠিয়েছে কেন?”
“স্যার আসতে পারবে না। আর এলেও ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে। তখন আপনাকে নিয়েও টানা-হেঁচড়া হবে। স্যার আপনাকে কোন ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছেন না। তাই ব্যাপারটা গোপনে মিটিয়ে নিতে চাচ্ছেন। প্লিজ ম্যাম, আমার স্যারের পাঁচ মিনিট সময়ের মূল্যও অনেক। আপনি প্লিজ আমার সাথে আসুন।”
তাথৈ বুঝে উঠতে পারছে না তার সাথে এই মুহূর্তে কী হতে যাচ্ছে। সে কি কিডন্যাপড হতে যাচ্ছে? নাকি মার্ডার? মরার আগে অন্তত আপু দুলাভাই বাবাইয়ের মুখ দেখে যেতে চায়।
“ম্যাম প্লিজ চলুন।”
কাকা এখনও আসছে না কেন? কাকার দোকান পাহারা দিতে বসেছিল। কিন্তু তাকে পাহারা দেওয়ার যে কেউ নেই। অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও তাথৈ উঠে দাঁড়াল। কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল। আল্লাহ ভরসা। যা আছে কপালে।
দুই মিনিটের কথা বলে নোমান গাধাটা কোথায় হারিয়ে গেল। অভয়ের এখন মনে হচ্ছে আপুই ঠিক বলে। এই গাধাকে দিয়ে তার কোন কাজ হবে না। ছোট্ট একটা কাজ করতে এত সময় লাগাচ্ছে! তার সময়ের মূল্য কি নোমান জানে না?
অভয় বিরক্ত হয়ে নোমানকে ফিরে আসার জন্য কল করতে যাবে তখনই গাড়ির দরজা খুলে গেল। নোমানকে দেখে অভয় রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত সময় লাগিয়েছ কেন গাধা? কাজ না হলে ফিরে আসতে…
অভয় কথা শেষও করতে পারল না। নোমান সামনে থেকে সরে গেলে তাথৈয়ের দিকে চোখ পড়তে অভয় নিজে থেকেই থেমে গেছে। অভয়কে দেখে তাথৈয়ের চোখ হাঁসের ডিমের আকার ধারণ করলো। এই নায়ক বেডা তার সাথে দেখা করতে এসেছে! জীবন তো মাত্রই সহজ ধারায় ফিরে এসেছিল।বাড়ির সামনে থেকে মিডিয়ার ভীড় কমে এসেছে। এর মাঝে এই লোক কেন দর্শন দিতে গেল!
” মিস তাথৈ, আপনার মূল্যবান সময়ের কয়েক মিনিট দেওয়া যাবে?”
অভয়ের গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে তাথৈয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই লোকের ভয়েস এত ভারী! মুভিতে কি তাহলে অন্যের কষ্ট ভাড়া করে চালায়! তাথৈয়ের আজ পূর্বের সমস্ত অঘটনের কথা মনে পড়ছে, সে অঘটন গুলো সে ঘটিয়েছে। তার জন্য এই লোকের চরিত্র নিয়ে মিডিয়া কম জাল ঘোলা করেনি। আজ তার রক্ষে নেই। তাথৈকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভয় প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। তাথৈ দূর্বল কন্ঠে শুধু ‘হুম’ বলতে পারল। তার কথার উত্তরেই অভয় বলল,
“অলরাইট। দ্যান কারে উঠে বসুন।”
চলবে
Jerin Akter Nipa