#এক_ফালি_সুখ🌼 |২|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
একনজরে মৌরিনকে সম্পূর্ন পরখ করে নিলো লোকটা। তারপর সামান্য হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_”মৌরিন রাইট?”
স্মিত হেসে মাথা নাড়ল মৌরিন। রাতুল আশেপাশে তাকিয়ে একটা চেয়ার মৌরিন এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
_”রিমি তোমার কথা বলেছে আমাকে। বসো, কি খাবে বলো।”
মৌরিন রাতুলের বাড়িয়ে দেওয়া চেয়ারে বসে বলে,
_”ধন্যবাদ ভাইয়া, কিন্তু আমি কিছু খাবোনা।”
_”তা বললে কি চলে? আচ্ছা চা খাও অন্তত, মামা একটা চা..”
মৌরিনকে রাতুলকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
_”আমি চা খাইনা ভাইয়া। আপনি ব্যস্ত হবেন না, আসলে যেই কারণে আসা।”
_”রিমি আমায় বলেছে সবটা,শুনে সত্যিই খারাপ লাগলো।”
_”কি আর করা যাবে বলুন,যা আমার ভাগ্যে ছিলো তাই হয়েছে। আর আমি একটা কথায় ভীষণভাবে বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করে। হয়তো আমার সঙ্গে এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারতো।”
রাতুল চায়ের দোকানের পাশে থাকা বেঞ্চিতে বসে বলে,
_”বাহ,বেশ পজিটিভ চিন্তাভাবনা তোমার। ভালো লাগলো শুনে।”
_”ভাইয়া নিশ্চই জানেন আমরা মানে আমি আর আমার মা এই শহরে নতুন,তেমন একটা পরিচিত লোকজন নেই। আর এই মুহূর্তে আমার একটা কাজের খুব দরকার ছিলো।”
_”হ্যা তো কি ধরণের কাজ করতে চাইছো তুমি?”
_”এমনিতে আমি কোনো কাজকেই ছোট করে দেখিনা, তবে দু তিনটে টিউশন জোগাড় করতে পারলে ভালো হতো। এর আগেও স্টুডেন্ট পড়িয়েছি অনেক, খুব একটা খারাপ পড়াই না। ”
রাতুল দু আঙুল কপালে স্লাইড করে বলে,
_”আসলে ব্যাপার টা কি বলোতো, আমিও কাজের সূত্রেই এখানে থাকি। খুব একটা আত্মীয় স্বজন আমার ও নেই। তবে আমি আমার বন্ধুদের বলে রাখবো।”
সৌজন্যমূলক হাসে মৌরিন। নিজের ব্যাগটা একপাশে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”ঠিক আছে ভাইয়া, আমি তাহলে আসি।”
_”ওয়েট, তুমি কিছু মনে না করলে আমি আরেকটা অফার দিতে পারি।”
_”হ্যা হ্যা ভাইয়া,কোনো সমস্যা নেই আপনি বলুন।”
_”তুমি জানো হয়তো আমার কাজটা মিডিয়া সেক্টরে। মানে ক্যামেরার পিছনেই থাকা পরে আমার, কো ডিরেক্টর হিসেবে বা অন্যকিছু। তুমি চাইলে আমি সেখানে তোমায় একটা কাজ ম্যানেজ করে দিতে পারি।”
_”কিন্তু আমার তো অভিনয়ের বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই, আর তেমন কিছু কখনো করতেও চাইনি।”
_”অ্যাকটিং নয়, তবে শুটিং স্পট এ আরও অনেক যাবতীয় কাজ থাকে। যদি টিউশন পেয়েও যাও,তবুও পাশাপাশি তুমি এই কাজটা করতে পারো। বাট চয়েজ ইজ ইওরস।”
মৌরিন কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলে,
_”আমি একটু ভেবে দেখি ভাইয়া? আপনাকে আমি কল করে জানাবো,ফোন নম্বর তো আছেই।”
_”হ্যা অবশ্যই। আর আমিতো তোমার ভাইয়ের মতোই, তোমার কোনো হেল্প করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।”
_”জি ভাইয়া, দোয়া করবেন আমার জন্য।”
মৌরিন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বিদায় নেয়। আরও অনেক কাজ, ভার্সিটি থেকে ট্রান্সফার নেওয়ার জন্যও বেগ পোহাতে হয়েছে অনেক।
মানুষ ঠিকই বলে,মাথার উপর বাবা নামক ছাঁদ থাকাকালীন সময় মানুষ বাস্তবতা বুঝতে পারে না। যখন তারা চলে যায়,ঠিক তখনি যেন দুনিয়াটা নতুন করে চেনা যায়। শুধু সমাজ নয় আত্মীয় স্বজন দের আসল রূপটাও তখন দেখা যায়।
এত বড় রাজধানী তে একটা কাজের জন্য মানুষের এত কাঠখড় পোড়াতে হয়! যদিও মৌরিন কখনই অলস ছিলো না,সে যথেষ্ট পরিশ্রমী মেয়ে। তবে হুট করে বাস্তব সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের এই একুশ বছরের জীবনে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে তার,অনেক প্রকার মানুষ দেখেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে এতদিন সবকিছু দেখেছে অন্যের চোখে,এখন দেখছে নিজ চোখে।
___
রেস্টুরেন্টে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করছে তূর্য। চোখে তার হাই কোয়ালিটির সানগ্লাস, আর পরনে কালো রঙের শার্ট। ফর্সা মানুষকে কালো রঙে এমনিতেই মানায়,তবে তূর্যকে যেন একটু বেশিই মানায়।
তূর্য একা বসে নেই,তার পাশে আছে দিয়া,নির্ঝর এবং তন্নি। তন্নি তূর্যর আগেই ইন্ডাস্ট্রি তে এসেছে। নির্ঝর এসেছে তূর্যর পরে। আর দিয়া সবে কিছুদিন হলো এসেছে, তবে সে অনেক আগে থেকেই মডেলিং এর সঙ্গে জড়িত।
তূর্যর এবং তন্নির পর দিয়াই খুব অল্প সময়ে পপুলারিটি পেয়েছে,বলতে গেলে তার রূপের জন্য। আগে থেকেই তার অনেক ফলোয়ারস ছিলো,এখন তা আরো বেড়েছে।
অনেকদিন একসাথে বসা হয়না বলে আজ প্ল্যান করেই চারজন একসঙ্গে কফি খেতে এসেছে। রেস্টুরেন্ট টা একটু গ্রাম্য সাইডে নদীর পাড়ে হওয়ায় একটু শান্তিতে আছে তারা। সবসময় ক্যামেরার সামনে থেকে তারা নিজেরাও বিরক্ত, তাই একটু এসবের বাইরে গিয়ে সময় কাটানো প্রয়োজন।
তবে আজকের এই গেটটুগেদার এর পিছনে আরেকটা কারণ আছে যেটা তূর্য ব্যাতীত বাকি তিনজনই জানে।
দিয়া যে মডেলিং থেকে নাটকে এসেছে,এর একটি বড় কারণ হলো তূর্য। আগে থেকেই সে তূর্যকে পছব্দ করতো, তাই এই সেক্টরে এসেছে। ভেবেছিল একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে ধীরেধীরে তূর্যের মনেও যায়গা করে নিতে পারবে। ছয় মাস হলো নাটকে কাজ করছে দিয়া,তারমধ্যে একটা ছিল তূর্যর সঙ্গে। তূর্যর সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারলেও প্রেমের সম্পর্কটা এখনো তৈরি হয়নি। আর আজ সেটাই করতে চাইছে দিয়া।
নির্ঝর আর তন্নি আগে থেকেই জানে দিয়া আজ তূর্যকে প্রপোজ করবে,সবাই ভেবেই নিয়েছে তূর্য তা এক্সেপ্ট করে নেবে। কারণ তূর্যর ঠিক যেমন মেয়ে পছন্দ তার সবটাই দিয়ার মধ্যে আছে। রূপে-গুণে সবদিক থেকেই সে তূর্যর উপযুক্ত।
অত:পর দিয়া তার পরিকল্পিত কাজটিই করলো। টেবিলে রাখা গোলাপ টা তুলে নিয়ে তূর্যর সামনে এসে দাড়ালো। তূর্য এবার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো দিয়ার দিকে। তার মুখে যেন হাসি লেগেই আছে, সঙ্গে লজ্জাও। কালো রঙের লং গাউন পরেছে সে। তূর্য ভ্রু নাচিয়ে ‘কি’ সূচক প্রশ্ন করতেই দিয়া হাটু গেড়ে তার সামনে বসে পরে।তন্নি পাশ থেকে তালি দিচ্ছে, আর নির্ঝর শীষ বাজাচ্ছে।
দিয়া তূর্যর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে ওঠে,
_আই লাভ ইউ তূর্য। উইল ইউ বি মাই বয়ফ্রেন্ড?
____
স্বল্প পরিচিত আরো দুজনের সঙ্গে দেখা করে দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে মৌরিন। বাহিরে থেকে রঙ করা নেই বাড়িটা, দেখেই বোঝা যায় অনেক বছরের পুরনো বাড়ি। তাই জন্যেই ভাড়া তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। তবুও খুব একটা কমও নয়।
মৌরিনরা ভাড়া নিয়েছে তিনতলার একটা ফ্লাট। দোতলায় পৌঁছাতেই মৌরিন এর নজর যায় বাড়িওয়ালার বাসার গেইট এর দিকে। বাড়িওয়ালার বাসা চেনা যায় তার দড়জা দেখেই, এত পুরনো বিল্ডিং এও তাদের বাসার দড়জা রাজকীয়। পুরো দোতলা টাই সুন্দর, দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্রের ওয়ালমেট।
এগিয়ে এসে কলিং বেল এ চাপ দেয় মৌরিন, যদিও এইসময় বাড়িওয়ালা বাসায় আছেন কিনা জানা নেই। খানিক বাদে দড়জা খুললো বছর পঁচিশের একটি ছেলে, বোধ হয় বাড়িওয়ালার ছেলে। যদিও এনাকে আগে দেখেনি মৌরিন।
_”কাকে চাই?”
মৌরিন সালাম দিয়ে বলে,
_”আঙ্কেল আছে?”
ছেলেটা একবার মৌরিনকে ভালোকরে দেখে বলে,
_”আব্বু নামাযে গেছে। কি দরকার আমায় বলো..”
মৌরিন কিছুক্ষন ভেবে বললো,
_”না থাক, আমি বরং পরে এসে আঙ্কেল এর সাথে কথা বলে যাবো।”
মৌরিন চলে যেতে নিলেই ছেলেটা তাকে আবারো ডেকে বলে,
_”আব্বু কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে, চাইলে ভিতরে এসে বসতে পারো।”
_”বললাম তো পরে এসে কথা বলে যাবো, বিকেলের দিকে তো আঙ্কেল বাড়িতেই থাকেন বোধ হয়। তখন আসবো..”
_”বাই এনি চান্স,তোমরা কি তিনতলার বাম পাশের ফ্লাট এ উঠেছো?”
_”জি, আসছি আমি।”
আর কথা বাড়াতে চাইলো না মৌরিন। অপরিচিত লোকের সাথে খুব বেশি কথা বলা তার পছন্দ নয়,তাছাড়াও এই লোকটাকে তেমন সুবিধার মনে হচ্ছেনা। তাই দ্রুত পা ফেলে বাসায় চলে এলো মৌরিন।
#চলবে?