এক ফালি সুখ পর্ব-৩২

0
377

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৩২| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
“সবশেষে এ বছরের সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার গ্রহণের জন্য ‘এক ফালি সুখ’ এর সম্পূর্ন টিমকে মঞ্চে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি।”

সম্পূর্ন জায়গা জুড়ে করতালির শব্দ ছড়িয়ে পরলো মুহূর্তের মাঝেই। একে একে স্টেজ এ উঠে এলো রাতুল,তন্নি,তূর্য,মৌরিনসহ আরো অনেকে। সকলের মুখে প্রাপ্তির হাসি। অবশ্য খুব একটা অবাক করা বিষয় নয়, এবারে অ্যাওয়ার্ড শো এর সব পুরস্কার ই তাদের দখলে বলা চলে। বেস্ট ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে রাতুল, বেস্ট স্ক্রিপ্ট রাইটার অ্যাওয়ার্ড পেলো মৌরিন, বেস্ট মেল অ্যাকটর হলো তূর্য। বেস্ট ফিমেল অ্যাকটর ই কেবল অন্য একটি চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী পেয়েছে। বাকি অধিকাংশ পুরস্কার এবার এক ফালি সুখ চলচ্চিত্রের টিম এর দখলে। অত:পর সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার টাও পেলো তারাই।

চার বছর, কেটে গেছে পুরো চার চারটে বছর। এতদিনে বদলে গেছে অনেককিছু, সকলেই নিজেদের জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। মৌরিন মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে নিজের কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে, সকলের কাছে একজন আদর্শ শিক্ষিকা সে। তবে চলচ্চিত্র জগতে তার আসা কেবলই রাতুলের কথায়। তবুও মৌরিন নিজেকে ফুল টাইম টিচার আর পার্ট টাইম স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে দাবি করে।

রাতুল আর তন্নিরও সংসার চলছে ভালোই,দুবছরের একটি মেয়েও আছে তাদের, নাম তরি। তারা নির্দিধায় নিজেদের হ্যাপি কাপল হিসেবে দাবি করতেই পারে, তাদের মাঝে না কখনো আহামরি প্রেম ছিলো আর না আছে ঝগড়া। এদিক থেকেই তারা স্পেশাল, সাধারনের মাঝেই তাদের সম্পর্কটা অসাধারন।

এবার আসে ইলহাম আবসার তূর্যের কথা, সবার আগেই তার ব্যক্তিত্বের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আগের সেই অহংকারের একভাগও তার মাঝে বর্তমানে নেই বললেই চলে। সেই ভাব নিয়ে কথা বলা, নিজেকে সেরা দাবি করা তূর্য এখন বেশ সাধারণ। আর এই সাধারণ হয়ে যাওয়াই তাকে এনে দিয়েছে আরো অধিক জনপ্রিয়তা। ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় এসেছে সে আরো দু বছর আগে। এটা ছিলো তার চতূর্থ চলচ্চিত্র। এছাড়াও এই নিয়ে পরপর দুবছর ই সেরা অভিনেতার পুরস্কার টাও নিজের নামে করে নিয়েছে সে।
স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে মৌরিনের এটা দ্বিতীয় কাজ ছিলো, অন্যদিকে ডিরেক্টর হিসেবেও রাতুলের দ্বিতীয় কাজ। বলা চলে একদম নতুনদের সমাহার। তবুও যে এই সিনেমা মানুষ এতটা পছন্দ করবে সেটা হয়তো কল্পনারও বাহিরে ছিলো সকলের।

স্টেজ এর সম্মুখে অতিথিদের আসনে বসে ছিলো আরো এক জুটি,তারা আর কেউ নয়, নির্ঝর এবং জ্যোতি। জ্যোতি হাসিমুখে নির্ঝর এর দিকে তাকাতেই দেখে সে খুশি তবে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে। জ্যোতিকে এভাবে তাকাতে দেখেই সে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে সামান্য হতাশ সুরে বলে,
_”এবারেও সেরা হতে পারলাম না রে।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে জ্যোতি,এরপর নির্ঝর এর হাতের উপর হাত রেখে বলে,
_”তাতে কি? জামাই হিসেবে তো সেরা হয়েছোই। আর এবার..”

ধীরেধীরে নির্ঝর এর হাতটা নিজের পেটের উপর রাখে জ্যোতি। নির্ঝরের কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_”বেস্ট বাবা হওয়ার প্রস্তুতি নাও।”

সকল হতাশা কেটে গিয়ে মুখে খুশির আভা ফুটে ওঠে নির্ঝর এর। জ্যোতির দিকে তাকাতেই সে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, “এটা সত্যি”। ব্যাস,আর কি লাগে তার জীবনে? সকল ক্যামেরা,লাইটিং এর কথা ভুলে গিয়ে জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে নির্ঝর। অত্যাধিক খুশি হয়ে বলে,
_”ইউ আর দা বেস্ট..”

জ্যোতিও মুচকি হেসে বলে,
_”আই নো দ্যাট..”

স্টেজ থেকে সকলে নেমেছে প্রায় পাঁচমিনিট হলো। তন্নি আর রাতুল মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়েছে এক জায়গায়। মুহূর্তেই তাদের সামনে ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক চলে আসে। তন্নির সামনে মাইক নিয়ে বলে,
_”অভিনেত্রী তন্নির দিনকাল তো ভালোই যাচ্ছে, তাহলে মা তন্নির দিন কেমন যাচ্ছে শুনি।”

হাসে তন্নি,মেয়েকে আদর করে বলে,
_”মা তন্নি হিসেবে একদমই রিল্যাক্স দিন কাটাচ্ছি। মেয়ে যেন আমার নয়, সবসময় বাবার কাছেই থাকতে চায়। ভালোই হয়েছে আমার, বাড়িতে থাকলে আরামেই থাকতে পারি।”

তরি একটু কান্না করতেই রাতুল কোলে নেয় তাকে। তন্নি ভুল কিছু বলেনি, মেয়েকে দেখতেও হয়েছে একদম বাবার মতো। সাংবাদিক আবারো হেসে তন্নিকে বলে,
_”আপনাকে কিন্তু অনেক মেয়েরা হিংসে করবে তন্নি। এমন হাজবেন্ড কিন্তু সব মেয়েরাই আশা করে, রাতুল ভাইয়ার কিন্তু নজর লেগে যাবে।”

তন্নি রাতুলের কাধে হাত রেখে বলে,
_”আর এমন বলোনা ভাই। জামাই আমার একটা বউ নিয়েই হিমসিম খাচ্ছে। সে বরং বউ বাচ্চাই সামলাক,তার উপর নজর দিওনা কেমন?”

হাসলো উপস্থিত সকলে। সেই মুহূর্তে তূর্য তন্নির মাথায় গাট্টা মেরে দু কদম এগোতেই সাংবাদিকরা সব ওর দিকে ছুটে যায়। তূর্য সুযোগ বুঝে ঠিক মৌরিন এর একটু পাশে গিয়েই দাঁড়ায়। মৌরিনকে এই দ্বিতীয়বার শাড়ি পরতে দেখলো তূর্য, গেটআপ এও কিছুটা পরিবর্তন রয়েছে। চুলে বরাবরের মতোন বিনুনির বদলে নিচু খোপা করা। সাজগোজ এর মধ্যে চোখে কাজল,হালকা লিপ্সটিক এবং কপালের সেই কালো রঙের টিপ। মেহরুন কালার শাড়ির সঙ্গে সাজটা মানিয়েছে ভালো।

_”তূর্য,আজ কোনো কথা শুনবো না। বলতেই হবে, বিয়ে করছো কবে?”

মুচকি হাসে তূর্য। পাশে মৌরিন এর সামনেও সাংবাদিক দাঁড়িয়ে ছিলো কয়েকজন। তূর্য সেদিকে একনজর তাকিয়ে মাথা চুলকে বলে,
_”ম্যাডাম রাজি থাকলে আজ কালের মধ্যেই।”

_”কিহ! দিস ইজ নট ফেয়ার তূর্য, দাওয়ার পাচ্ছিনা আমরা?”

_”আরে আরে দাওয়াত তো অবশ্যই পাবে। কিন্তু তার আগে তো পাত্রীকে রাজি হতে হবে নাকি? অবশ্য রাজি না হলে এবার আমি তুলে নিয়ে বিয়ে করবো।”

শেষের কথাটা কিছুটা জোরেই বলে তূর্য। মৌরিন এর মাঝে ভাবান্তর নেই খুব একটা,তাকাচ্ছেও না তূর্যের দিকে। সাংবাদিক আবারো প্রশ্ন করে,
_”তূর্য কি তাহলে এবার মেয়েদের মন ভেঙে দিয়ে বিয়েটা করেই ফেলবে?”

তূর্য উত্তর দেওয়ার আগেই আবরাজ এসে তার কাধে হাত রেখে বলে,
_”নো টেনশন মেয়েরা। আমি তোমাদের জন্য অল টাইম সিঙ্গেল আছি, তোমাদের জন্যই তো বিয়েটাও করলাম না এখনো। তূর্যকে বরং ছেড়েই দাও, বেচারা এবার মিঙ্গেল হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। নো প্রব্লেম, আমরা পেট ভরে কাচ্চি খেয়ে আসবো।”

উপস্থিত সকলে হাসে একসঙ্গে। আবরাজ বেশ মজার মানুষ, তবে কথা সত্যি, সে এখনো বিয়েটাই করতে পারলো না। তূর্য কোনো কথা বলার আগেই খেয়াল করে পাশে মৌরিন নেই। পুরস্কার টা হাতে নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছে সে। সঙ্গে সঙ্গেই তূর্য সাংবাদিক দের থেকে বিদায় নিয়ে ছুটে যায় মৌরিন এর পিছনে।

মৌরিন বেরিয়ে যেতেই তূর্যও তার পাশে এসে বলে,
_”কি ব্যাপার? না বলে কোথায় চলে যাচ্ছো শুনি?”

মৌরিন না তাকিয়েই উত্তর দেয়,
_”কোথায় আবার? বাসায় যাচ্ছি।”

_”কোনো বাসায় টাসায় যেতে পারবেনা। এখন তুমি আমার সঙ্গে যাবে।”

মৌরিন থামে। পাশ ফিরে বুকে হাত গুজে বলে,
_”আপনার কথায়?”

তূর্য কিছুটা এগিয়ে শক্ত গলায় উত্তর দেয়,
_”হুম,আমার কথায়।”

_”যদি না যাই?”

_”ইউ নো হোয়াট, তোমার হাতের আরো কয়েকটা থা’প্প’র খাওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।”

কথাটা বলেই মৌরিনের হাত ধরে টেনে নিজের গাড়ির সামনে নিয়ে আসে তূর্য। হাতটা ছেড়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে,
_”দু তিনটে থা’প্প’র দেওয়ার হলে দিয়ে নাও, তবে গাড়িতে উঠতেই হবে।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো মৌরিন। এরপর কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে বসলো। তূর্যও মুচকি হেসে ড্রাইভিং সিট এ গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতেই সামনে থেকে একটা কাগজ নিচে পরে গেলো। মৌরিন ঝুকে সেটা হাতে তুলতেই তূর্য একহাতে কেড়ে নেয় সেটা। ড্রাইভ করতে করতেই বলে,
_”খবরদার,একদম হাত দেবেনা এটায়। এই চিঠি একজন স্পেশাল ব্যাক্তির দেওয়া, একদমই সিক্রেট।”

চিঠিটা মুখের সামনে নিয়ে বেশ শব্দ করে চুমু খায় তূর্য। মৌরিন ঠোঁট চেপে হেসে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, বেশি কথা বলার অভ্যাস বোধ হয় তার কোনোকালেই হয়ে উঠবেনা।

#চলবে?