আহনাফ চৌধুরী পর্ব-১১

0
237

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
বাড়িতে আসার পর থেকে ঝিম মেরে বসে আছে অর্ষা। আহনাফের কথাটি মাথায় ঘুরছে। যদিও সে কোনো জবাব দেয়নি। জবাব নেইও তার কাছে। তৎক্ষণাৎ ঐশির কাছে চলে গেছিল। এরপর আর কথা হয়নি ওদের মধ্যে। নিজের রুমে শুয়ে সে যখন দোলাচলে ছিল তখনই আননোন নাম্বার থেকে কল এলো তার ফোনে। ‘রিহান’ কল করেছে ভেবে ভীষণ আনন্দিত হয়ে কল রিসিভ করল সে। কিন্তু ওপাশ থেকে ভেসে এলো অন্যজনের কণ্ঠ। হতাশ হলো সে।

“হ্যালো? শুনছেন?” প্রশ্ন করল আহনাফ।

অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“হু।”

“সরি রাতে কল করার জন্য।”

“ব্যাপার না।”

“রাগ আমার ওপর?”

“না।”

“তাহলে উত্তর দেননি কেন?”

“কী উত্তর দেবো?”

“আপনাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম।”

“কতদিনের জন্য?”

“মানে?”

“মানে ঠিক কতদিনের জন্য দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন? আজকাল তো সবাই শুরুতে নিজের দায়িত্ব দেখায়। এরপর পিছপা হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পরে এই মানুষটাই দিয়ে যায়।”

আহনাফের ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছিল, সবাই আপনার রিহানের মতো নয়। কিন্তু অর্ষার মানসিক অবস্থা ভালো নয় এবং এভাবে কথা বললে মেয়েটা কষ্ট পাবে ভেবে সে ইচ্ছেটুকু এড়িয়ে গেল। শান্তকণ্ঠে বলল,

“যদি বলি সারাজীবনের জন্য?”

অর্ষা হাসল। আহনাফ বলল,

“হাসছেন?”

“হ্যাঁ, হাসছি। কারণ কেউ সারাজীবন পাশে থাকে না।”

“আমি থেকে দেখিয়ে দিতে চাই। একজন আপনার বিশ্বাস ভেঙেছে বলে আপনি সবাইকে অবিশ্বাস করতে পারেন না।”

“আমি এখন ভয় পাই সত্যি! মানুষ ভয় পাই আমি।”

আহনাফ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

“স্বাভাবিক! কিন্তু আমায় একবার বিশ্বাস করা যায়?”

“আমায় নিয়ে এত চিন্তিত হতে হবে না। আপনার আমার প্রতি এত উদারতা দেখে ভালো লাগল। কিন্তু আমার দায়িত্ব আমি নিতে পারব।”

“কীভাবে নেবেন?”

“এখন যেভাবে নিচ্ছি।”

“ইয়াহ্, রাইট! রাতে কান্না করতে করতে ঘুমাবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কান্না করবেন। সারাদিন উদাসীন হয়ে থাকবেন। পুরনো স্মৃতি মনে করে ফের কান্না করবেন। ঠিক এভাবেই নিজেকে সামলাবেন বলে ঠিক করেছেন?”

অর্ষা চুপ করে গেল। কথা বলতে চেয়েও পারছে না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কান্না এসে দলা পাকাল কণ্ঠে। কিন্তু আহনাফকে সেটা বুঝতে দিতে চাইল না সে। আহনাফ নিজে থেকেই বলল,

“এভাবে কোনো লাইফ চলতে পারে না অর্ষা! বের হতে হবে এখান থেকে।”

অর্ষা নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে না পেরে কল কেটে দিল। ফোন বন্ধ করে আবারও সে কান্নাকে সঙ্গী করে নিল। এত যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না তার। আর কতগুলো খারাপ দিনের পর ভালো দিন আসবে? আদৌ কি আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত ভালো দিন?
.
.
সকালবেলা সম্পা এসে অর্ষাকে জোরপূর্বকই ভার্সিটিতে নিয়ে গেল। উদ্দেশ্য মন ভালো করা। কিন্তু সব সময় চাওয়া আমাদের ইচ্ছেমতো পূরণ হয় না। আমরা যা চাই তা পাই না। যা পাই অনেক সময় হয়তো চাই না। সৃষ্টিকর্তা যা চান, সেটা হবেই বলে হয়তো। কলেজে যাওয়ার আগেই অর্ষা দেখতে পেল রিহান সেই মেয়েটাকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। দুজনকেই বেশ হাসি-খুশি লাগছিল। অর্ষার বুকে যেমন মোচড় দিয়ে উঠল সেই সাথে নিজের ওপর তার ভীষণ ঘৃণাও হলো। এই মানুষটার জন্য সে দিনরাত কান্না করে যাচ্ছে? যে কিনা দিব্যি হাসি-খুশি আছে, ভালো আছে, তাও আবার অন্য কারও সাথে!

অর্ষার চোখ ছলছল করছে। সম্পা অর্ষার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

“খবরদার! এক ফোটা পানিও যেন তোর চোখ থেকে না পড়ে বলে দিচ্ছি অর্ষা! ঐ বেঈমানটাকে দেখ আর শেখ, কীভাবে ভালো থাকতে হয়! এরপরও কি তুই নিজের ভালোটা বুঝবি না?”

অর্ষা কোনো জবাব দিল না। সে দু’হাতে চোখের পানি মুছে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। সম্পা বিস্মিত হয়ে বলল,

“কী করছিস তুই? তাকে ফোন দিচ্ছিস? দিবি না। তোর কি আত্মসম্মান নাই একটুও? কেন ছোটো হবি ওর কাছে?”

অর্ষা এবারও কোনো জবাব দিল না। কল লিস্টে গিয়ে নাম্বারে ডায়াল করল। সম্পা রাগারাগি করে যাচ্ছে,

“অর্ষা! আমার কথা শোন প্লিজ! নিজেকে আর ছোটো করিস না।”

“হ্যালো আহনাফ চৌধুরী…”

সম্পার মুখ হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে আহনাফ বেশ অবাক হয়েই বলল,

“ইয়েস?”

অর্ষা ফুঁপিয়ে বলল,

“আপনি না বলেছিলেন আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নেবেন?”

“হ্যাঁ, বলেছিলাম। আপনি রিজেক্টও করেছিলেন।”

“এখন আমি সেই দায়িত্বটা আপনাকে দিতে চাই।”

“আপনি কাঁদছেন?”

অর্ষা চুপ হয়ে গেল। কান্নার সময় বা ভীষণ মন খারাপের সময় কেউ এরকম ধরণের প্রশ্ন করলেই কান্নার গতি বেড়ে যায়। আহনাফও কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে বলল,

“যখন চেয়েছিলাম তখন দায়িত্ব দেননি। এখন নিজে থেকেই বলছেন। এখন তো আমি এভাবে দায়িত্ব নেব না। সরি।”

বলে ফোন কেটে দিল আহনাফ। অর্ষা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পা জিজ্ঞেস করল,

“কী বলল?”

“বাড়ি যাব।”

কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অর্ষার চোখ বেয়ে। সম্পা আর কিছু জানতে চাইল না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“চল।”

মানুষ যেমন অধিক কষ্টে বা শোকে পাথর হয়ে যায়, অর্ষার নিজেকেও এখন তেমনই মনে হচ্ছিল। আহনাফ তো নিজে থেকে এসেছিল, ভালো রাখার দায়িত্ব নিবে বলেছিল। আর এখন যখন অর্ষা সেই দায়িত্বটা দিতে চাইল তখন মানুষটা এভাবে পিছু হটে গেল! অর্ষা হাসল বিদ্রুপ করে। নিজের বোকামির জন্য নিজের প্রতিই তার করুণা হতে লাগল। পুরো পথে সে শুধু সম্পাকে একটা কথাই বলল,

“কিছু মানুষ থাকে যাদের কপালে সুখ নেই। আমি হচ্ছি সেই মানুষ জানিস?”

সম্পাও কিছু বলতে পারল না। কী-ই বা বলবে সে! কেবল তার ভীষণ দুঃখ হতে লাগল ভাঙা মেয়েটির জন্য।

বাড়ির সামনে এসে দু’হাতে চোখ মুছে নিল অর্ষা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। সম্পাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর আমেনা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,

“ফোন দিয়েছি দেখিসনি?”

অর্ষা হাতের ফোনের দিকে তাকাল। সাইড বাটনে চাপ দিয়ে দেখল ফোন সাইলেন্ট করা। আমেনা বেগম আর ওকে কিছু বলতে না দিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে অর্ষা এবং সম্পা দুজনেই যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষজন। তামিম, ঐশি, তামিমের মা, ওসমান আলম, অর্থি, আহনাফের বাবা-মা, আহনাফ এবং তাদের পাশেই বসে আছে কাজী।

অর্ষাকে দেখতে পেয়ে আহনাফ বসা থেকে উঠে এলো। অর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

“হঠাৎ আপনার কী হয়েছে আমি জানিনা। কেন আমাকে সেই দায়িত্ব দিতে চেয়েছেন তাও জানিনা। কিন্তু একবার যখন সেই দায়িত্ব নিজে থেকেই দিতে চেয়েছেন, তখন সেটা সারাজীবনের জন্য দিতে হবে এবং পাকাপোক্তভাবেই দিতে হবে। এখন শুধু আপনাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নয়, হাত ধরতে চাই চিরকালের জন্য। যাতে ছেড়ে যেতে না পারেন এজন্য সেই ব্যবস্থা করেই আপনাকে পেতে চাই। মিথ্যে বলব না যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনাকে আমি এখন ভালোবাসি না। কিন্তু বিয়ে করে ভালোবাসতে চাই। উইল ইউ ম্যারি মি অর্ষা?”

অর্ষার কয়েক সেকেন্ড লাগল পুরো বিষয়টা বুঝতে। এরপর সে ঝাপসা দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাল। সবার মুখাবয়বেই বোঝা যাচ্ছে তাদের কারও কোনো আপত্তি নেই। বরং সবার চোখে-মুখে কেমন যেন একটা সুখের ছাপ। অর্ষা মায়ের দিকে তাকাল। তার মায়ের চোখেও পানি। কিন্তু ঠোঁটে হাসি। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। সম্পাও খুশিতে পাশ থেকে বলল,

“বল!”

অর্ষা আর কিছু ভাবল না। কেবল আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ইয়েস, আই উইল!”

চলবে…