আহনাফ চৌধুরী পর্ব-১০

0
85

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা সুন্দর কথা বলেছেন জানেন?”

আহনাফের প্রশ্ন শুনে দৃষ্টি ফেরাল অর্ষা। ওকে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,

“আমিও আসলে কথাটা শুনেছি। যদিও অনেক আগের তবে লাইনটা আমার বেশ পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘জোর করে কাউকে ধরে রাখার প্রয়োজন নেই। যে থাকার সে থাকবেই। আর যে চলে যাওয়ার সে চলে যাবেই।’ শুনেছেন?”

“আমি তো কাউকে জোর করে ধরে রাখিনি। আটকাইওনি।”

“মনের দিক থেকে তো ঠিকই আটকে রেখেছেন। সারাদিন রাত তাকে নিয়েই ভাবেন। তাহলে আপনি তাকে চলে যেতে দিলেন কোথায়? সে আপনার জীবন থেকে যেরকম চলে গেছে। তাকে এবার মন থেকেও বিদায় দিয়ে দিন।”

“এত সোজা?”

“জানি কঠিন। তবে অসম্ভব তো নয়। বেইমান, প্রতারকদের মনের ভেতর রাখলে এক সময় মনে অসুখ হয়ে যাবে। তখন তিলে তিলে ম’র’তে হবে।”

“বেঁচে আর রইলাম কই? মানুষটা তো আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়ে গেছে!”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“আপনার সিচুয়েশন আমি বুঝতে পারছি। একটা জিনিস কি আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনি মরীচিকাকে আঁকড়ে ধরে আছেন?”

“আমি কাউকেই আঁকড়ে ধরে নেই। আমি শুধু এখান থেকে বের হতে পারছি না এতটুকুই।”

আহনাফ নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে। অর্ষা কেঁদে ফেলল হঠাৎ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি মানতেই পারছি না জানেন! আমাকে এত বাজেভাবে ঠকানো হবে আমি ভাবতেও পারিনি। ও যদি আমাকে বলত যে, আমাকে আর ভালো লাগে না, আমাকে ভালোবাসে না, আমার সাথে থাকতে চায় না তাহলে বিশ্বাস করুন কষ্ট হলেও আমি ওর পথ থেকে সরে আসতাম। ওকে কোনো দোষারোপ করতাম না। এটলিস্ট যেখানে ভালোবাসাই নেই সেখানে তো আমি জোর করে থাকতাম না। কিন্তু এখন!”

“এতকিছুর পরও কি আপনার তার প্রতি ঘৃণা কাজ করছে না?”

অর্ষা নিশ্চুপে কাঁদছে। আহনাফ বলল,

“ভালোবাসাকে এবার জেদে পরিণত করুন প্লিজ! এভাবে নিজেকে ভাঙতে দেবেন না। একজন প্রতারক, স্বার্থপরের জন্য আপনি নিজেকে তো কষ্ট দিচ্ছেনই; এমনকি কষ্ট দিচ্ছেন নিজের পরিবারকেও। জানেন আপনার মা আপনাকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তা করে? কান্নাকাটি করে? আপনার মা আপনাকে ভালোবাসে। আর ঐ মানুষটা আপনাকে ঠকিয়েছে। কাকে ভালোবাসা উচিত আর কাকে কষ্ট দেওয়া উচিত বুঝতে পারছেন না এখনো?”

অর্ষা ফুঁপিয়ে বলে উঠল,

“আমি পারছি না! কী করব?”

“চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করলেই পারবেন। শুধুমাত্র ভুলে যান যে ঐ মানুষটাকে আপনি ভালোবাসতেন। সে ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না। আর এইভাবে একা একা থাকা যাবে না। মানুষের সাথে মিশতে হবে। কথা বলতে হবে।”

অর্ষা কিছু বলল না। অর্থি তখন দৌঁড়ে আর্ট পেইপারটা নিয়ে এলো। অর্ষার হাতে দিয়ে বলল,

“দেখো তো আপু কেমন হয়েছে? এখন শুধু রঙ করাটা বাকি।”

অর্ষা চোখের পানি মুছে ছবিটা দেখল। অর্থি অর্ষার ছবি এঁকেছে। এতক্ষণ যেমন অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল অর্ষা, ঠিক সেই ছবিটাই এঁকেছে। শুধু অর্ষা নয়; পাশে আহনাফও রয়েছে। সে কেমন যেন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!

অর্থি হেসে বলল,

“আমি আপুর ছবিই আঁকছিলাম। পরে আপনি এলেন। মনে হলো আপনাকেও এঁকে ফেলি। কেমন হয়েছে?” কথাগুলো আহনাফের উদ্দেশে বলল।

আহনাফ বিস্মিত হয়ে বলল,

“চমৎকার! তুমি যে এত সুন্দর ছবি আঁকো আমি তো সেটা জানতাম না!”

অর্থি তার চুলগুলো ঠেলে পেছনের দিকে দিয়ে বলল,

“এখন তো জানলেন।”

আহনাফের সাথে অর্ষাও মৃদু হাসল। আহনাফ বলল,

“ছবিটা কি আমি নিতে পারি?”

অর্থি বলল,

“উম! ওকে। কিন্তু এখন না। ফিনিশিং হলে।”

“ঠিক আছে।”

অর্থি আবার ছবিটা নিয়ে নিজের জায়গায় চলে গেল। আহনাফ অর্ষাকে বলল,

“যান রেডি হয়ে নিন।”

“কেন?”

“পার্লারে যাবেন।”

“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন? আপনার মনে হয় আমি পার্লারে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছি?”

“তাও যেতে হবে। যেই কাজ করেছেন!”

“মানে?”

“এত সুন্দর চুলগুলো আপনি কাটলেন কীভাবে? একবারও কি হাত কাঁপল না? এখন বেসাইজ চুলগুলো তো সাইজ করতে হবে। ঐশি আপু আর তামিম পার্লারেই আসবে। আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে নেওয়ার জন্য।”

“আপনারা সবাই কি কাজ-টাজ ছেড়ে দিয়ে আমায় নিয়ে পড়ে আছেন?”

আহনাফ হাসার চেষ্টা করে বলল,

“না! সেই সুযোগ তো আপনি দেবেন না। তামিম বিয়ের জন্য ছুটি নিয়েছিল অফিস থেকে। সেই ছুটিই তো এখনো কাটাচ্ছে। আর ঐশি আপু তো জব ছেড়ে দিয়েছে শুনেছি।”

“আর আপনি? আপনার তো বিয়ে না। আপনাকে নিশ্চয়ই এতদিন ছুটি দেয়নি?”

আহনাফ হেসে বলল,

“না, দেয়নি। তবে আমি এই জবটা ছেড়ে দিয়েছি। অন্য জায়গায় এপ্লাই করা আছে। ইন্টার্ভিউয়ের জন্য ডাকেনি এখনো। ডাকলে যাব। আর আমার ইচ্ছে ছিল তামিমের বিয়েটা হয়ে গেলেই একদম জবে জয়েন করব।”

“চাকরি কেন ছেড়েছেন?”

“আমি যাদের ঘৃণা করি তাদের মুখোমুখি হতে চাই না আর তাই।”

“মানে?”

“মানে তেমন কিছুই না। সুপ্তিকে দেখতে ইচ্ছে করে না। বারবার নানান বাহানায় আমার কাছে আসাটাও আমার পছন্দ হচ্ছে না তাই।”

“ওহ!”

“হু। আমরা ছেলেরা আবার এত ইমোশোনাল নই। নিজেদের আবেগকে কন্ট্রোলে রাখতে পারি।”

“আপনারা ছেলেরা কি ভালোবাসতেও জানেন না?” বিষাদিত স্বরে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“জানি। আমরা সব ছেলেরা তো এক নই। সবাই প্রতারক নই।”

অর্ষা প্রত্যুত্তর করল না। প্রসঙ্গ বদলে বলল,

“আপনাকে একটা অনুরোধ করব।”

“কী?”

“আপু আর তামিম ভাইয়ার বিয়েটা যেই ডেইটে হওয়ার কথা ছিল ঐ ডেইটেই যেন হয়। এটা আপনি বাড়ির সবাইকে বোঝাবেন।”

“এটা কী করে সম্ভব? আপনার এই অবস্থায়!”

“আমার জন্য শুধু শুধু বিয়ে পেছানোর দরকার নেই। কত মানুষকে জানানো হয়ে গেছে! আমি নিজেকে সামলে নেব।”

“পারবেন?”

অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“ইন-শা-আল্লাহ্ পারব। পারতেই হবে। আর না পারলে আপনি আছেন না? সাহায্য করার জন্য ফ্রেন্ড!”

আহনাফ কাঁধ উচিয়ে বলল,

“গ্রেইট! আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।”
.
.
পার্লারে গিয়ে চুল কাটার পর কাঁধেরও একটু ওপরে উঠে গেল সাইজ করতে গিয়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে অর্ষার ভীষণ কান্না পেল। ঝোঁকের বশে কী করে ফেলেছে সে! তাও একটা প্রতারকের জন্য! নিজের চুলের জন্য তার মায়াও হতে লাগল। আহনাফ সেটা খেয়াল করে বলল,

“আবার নিজের যত্ন নিবেন। চুলের যত্ন নিবেন। দেখবেন নিজের সাথে সাথে চুলও আগের মতো ঝলমলে হয়ে গেছে।”

অর্ষা স্মিত হাসল। ঐশি বলল,

“ছোটো চুলেও তোকে সুন্দর লাগছে।”

“সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

“না। সত্যিটাই বললাম।”

পাশ থেকে তখন তামিম বলল,

“আমিও কিন্তু ঐশির সাথে সহমত।”

“বউয়ের সাপোর্ট তো নেবেনই।”

“শালিকার সাপোর্টেও আছি। চিন্তা করো না। চলো সবাই মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”

অর্থিও এসেছিল আহনাফ এবং অর্ষার সাথে। ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল,

“চলো, চলো।”

সবাই মিলে গেল সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে। গাছ-গাছালি দিয়ে ডেকোরেট করা। বেশ সাজানো-গোছানো। ছবি তোলার জন্যও অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। মানুষজনের সংখ্যা এখন নিতান্তই কম। অর্থি একা একা ঘুরছিল বলে ওর সাথে অর্ষাও গেল। তামিম তখন আহনাফকে বলল,

“তুই বসে আছিস কেন? ওদের সাথে যা।”

“টাইম চাস বললেই তো হয়।” পিঞ্চ মেরে বলে আহনাফ উঠে গেল।

কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দেখল অর্থি অর্ষার ফোন দিয়ে একা একা সেলফি তুলছে। কাছে গিয়ে আহনাফ জিজ্ঞেস করল,

“তোমার আপু কোথায়?”

“আপুকে তো ঐদিকে যেতে দেখলাম।” হাতের ইশারায় দেখাল অর্থি।

“আচ্ছা। তুমি ছবি তোলো। আমি আসছি।”

অর্ষাকে খুঁজতে খুঁজতে আহনাফ পেয়েও গেল। একটা পুলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পারল অর্ষা কাঁদছে। আহনাফের খারাপ লাগা, রাগ-জেদ সব কাজ করছিল একসাথে। মানুষ ভালোবাসতে না পারলে এমন বাজেভাবে ঠকায় কেন? একটা মানুষকে এভাবে নিঃশেষ করে দিয়ে কি এরা আদৌ ভালো থাকে?

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পেছন থেকে ডাকল,

“অর্ষা?”

অর্ষা দ্রুত চোখের পানি মুছে ঘুরে দাঁড়াল। আহনাফ তাকিয়ে আছে ওর ভেজা নেত্রদ্বয়ে। সে প্যান্টের দু’পকেট থেকে হাত বের করে অর্ষার মাথায় এক হাত রাখল। অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

“জানিনা আমার কথা কীভাবে নেবেন। এটা নিয়ে আমি ভাবতেও চাইছি না। আপনার যা ইচ্ছে, আমাকে যা ইচ্ছে ভাবতে পারেন। আমি শুধু বলতে চাই, আপনাকে ভালো রাখার দায়িত্ব দেবেন আমাকে?”

চলবে…